![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ২৯
ভাত বাঙালির জীবনে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে তা ঐতিহাসিক উৎস বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন সম্ভব। এ সম্পর্কে লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া, গোবিন্দপুর, তর্পণদীঘি প্রভৃতি তাম্রশাসনের আরম্ভ শ্লোকে বলা হয়েছে:
ফনিপতি মণিদ্যুতি যাহাতে বিদ্যুৎ স্বরূপ,
বালেন্দু ইন্দ্র ধনুস্বরূপ, স্বর্গতরঙ্গিনী বরিস্বরূপ,
শ্বেত কপালমালা বলাকাস্বরূপ, যাহা ধ্যানাভ্যাসরূপ
সমীরণের দ্বারা প্রেরিত এবং যাহা ভবার্তিতা
ধ্বংসকার- সম্ভুর টারূপ সেই মেঘ তোমাদের
শ্রেয়ঃ শস্যের অঙ্কুরোদ্গমের হেতু হোক।৪৩
ভাত সম্পর্কে আমরা বিক্ষিপ্ত তথ্য অন্যত্রও পেয়ে থাকি। আনুলিয়া তাম্রশাসনে লক্ষ্মণসেন কর্তৃক ব্রাহ্মণদের বহু গ্রাম দানের কথা উল্লিখিত হয়েছে। বিভিন্ন শস্যে এই সমস্ত গ্রাম সমৃদ্ধ ছিল এবং উপবনসমূহ অপরূপ শোভায় অলঙ্কৃত ছিল। এসব গ্রামে প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপন্ন হতো।৪৪ কেশবসেনের ইদিলপুর তাম্রশাসনেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে: অনেক গ্রাম ব্রাহ্মণগণ রাজার কাছ থেকে পেয়েছিলেন; এ সমস্ত গ্রাম সুন্দর সুন্দর শস্যক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ছিল এবং তাতে প্রচুর ধান উৎপন্ন হতো।৪৫ বিদ্যাকর সংকলিত সুভাষিতরতড়বকোষ কাব্যে বিবৃত বিভিন্ন শ্লোকের বিভিন্ন স্থানে আবহমান বাংলার চিরায়ত শস্য ধান্য ফসল সম্পর্কে বলা হয়েছে: নতুন পানিতে প্লাবিত ধানক্ষেত গুলিতে ব্যাঙ কর্কশ স্বরে ডাকছে। কর্দমাক্ত শিশুরা লাঠি হাতে নিয়ে ধানক্ষেতের মাছ ধরতে ছুটছে।৪৫
আর্যাসপ্তশতী তে শালি ধানক্ষেতে হরিণের উপদ্রবের কথা জানা যায়: কোমল শালিধানের লোভে চঞ্চল হরিণ, নিজেকে ধরা দেওয়ার ছলনায়, তরুণ পথিককে এখানে কমলগোপীর নিকট আনয়ন করে। হরিণের এরকম কৌশলের উদ্দেশ্য, পথিক ও গোপী যখন প্রেম চর্চায় রত থাকবে, তখন সে নির্ভয়ে ইচ্ছামত শালি ধান ভক্ষণ করতে পারবো ৪৬
এ সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকারের ধান উৎপন্ন হতো। বল্লালসেন রচিত দানসাগর গ্রন্থে আঠার প্রকার ধানের কথা বলা হয়েছে। এ সমস্ত ধানের মধ্যে ব্রীহি (আশুধান্য), গোধুম, অণু (দাদখানি), পিয়ঙ্গু (কঘাটী), উদার (দে-ধান), স-চীনক (অর্থাৎ চিনাধান ও তৎসহজাত কলাই) প্রভৃতি উলেখযোগ্য। অবশ্য শালিধান ছিল সকল ধানের শ্রেষ্ঠ।৪৭ মৎস্যের মধ্যে সম্ভবত রুই, শোল, পুঁটি, ইলিশ, শুঁটকি প্রভৃতি মাছ বাঙালির প্রিয় খাদ্য ছিল। কারণ এই সকল মাছের উল্লেখ বিভিন্ন লিপিতে বারবার বলা হয়েছে। বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনের আরম্ভশ্লোকে ‘শৈবাল জালে বদ্ধ শফরী’ লম্ফের সৌন্দর্যের বর্ণনা এবং শোভমান রোহিত মৎস্যের ৪৮ উলেখ আছে। সম্ভবত ইলিশ মাছ তৎকালীন সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল।
আবুল ফজল মন্তব্য করেন, ‘তাদের (বাঙালিদের) প্রধান খাদ্য ভাত আর মাছ; গম, বার্লি ও এ ধরনের খাদ্য তারা সুস্বাদু বলে মনে করে না। ৪৯ বাঙালিদের খাদ্য হিসেবে গম ও বার্লি গ্রহণ না করা সম্বন্ধে এই মোঘল ঐতিহাসিকের ধারণা কিছুটা সংশোধনযোগ্য। এটা সত্য নয় যে, তারা এগুলোকে অরুচিকর বলে মনে করত। বরং, এ রকম প্রমাণ রয়েছে যে, যেসব অঞ্চলে এ সকল শস্য জন্মাত- সেইসব অঞ্চলে গম, বার্লি বাঙালিদের খাদ্য ছিল।
বৃষ্টি-বাদল প্রধানত নিয়ন্ত্রিত করেছে বাঙালিদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও গৃহনির্মাণ প্রণালী। বাংলার সাধারণ অধিবাসীরা যে ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে থাকে (লুঙ্গি, ধুতি) তা বছরে ছ’মাসকাল জলপ্লাবিত একটা দেশের পক্ষে খুবই উপযোগী। নদ-নদীর পরিবর্তনশীল প্রকৃতি, বৃষ্টি-বাদল ও বান-বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে খড়কুটা, কাঠ, কাদামাটি ও বাঁশ এবং অন্যান্য বহনযোগ্য ও হালকা উপকরণ ছিল গৃহাদি নির্মাণের একমাত্র উপযোগী অবলম্বন, বিশেষত গ্রাম বাংলার। এটা অনেকটা জাপানিদের মতো, যারা তাদের দেশের প্রাকৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, কাগজ ও কাঠ দিয়ে বাড়িঘর তৈরি করে থাকে। এমনকি অপেক্ষাকৃত হালকা ধরনের উপকরণাদির সাহায্যেও বাঙালিরা অত্যন্ত চমৎকার টেকসই ও মূল্যবান বাড়িঘর নির্মাণ করত। উচ্চবিত্তের লোকজন গ্রামে বা শহরে ইষ্টকনির্মিত নির্মাণ করত। পাথর এদেশে দুস্প্রাপ্য ছিল বিধায় পাথরের তৈরি বাড়িঘরের কথা শোনা যায়নি।
প্রাকৃতিক অবস্থা বাঙালি অধিবাসীদের যাতায়াতের অবলম্বনও নির্ধারণ করেছে। নাব, নাবী, নাবড়ি, ভেলা, বেণী প্রভৃতি এবং এগুলির সঙ্গে প্রয়োজনীয় কেড়–, আল, খুন্তি, কাচ্ছি, মাঙ্গ, পিট, দুখোল, চকা পতবাল, নাহী, গুণ ইত্যাদির উলেখ ছাড়াও নৌবন্দর, নৌযাত্রা, নৌবাহিক প্রভৃতির উলেখ পাওয়া যায়।৫০ সম্ভবত এই নদীমাতৃকার প্রভাব চর্যাপদে অত্যন্ত গভীরভাবে ছাপ পড়েছে। এর গীতগুলি সাগর-নদী-খাল-বিলের বর্ণনায় পরিপূর্ণ। তাই বোধহয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চর্যাকারদের বর্ণনায় প্রধান প্রধান দার্শনিক তত্ত্ব এবং গুহ্য সাধনতত্ত্বগুলি সাগরনদী খাল-বিলের রূপকেই উপস্থাপিত হয়েছে, তদ্রুপ চাটিল্লপাদের চর্যাতে:
ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দায়ান্তে চিখিল মাঝেঁন থাহী॥
ভবনদী গভীর, গম্ভীর তাহার বেগ; দুই তীরে কাদা মাঝে ঠাঁই নাই॥৫১
নদীর দুই কূলের অতিরিক্ত কর্দমাক্ততা বাংলাদেশের নদীসমূহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের খালবিলের উলেখ প্রসঙ্গে সরহপাদের চর্যাতে বলা হয়েছে:
বাম দাহিণ জো খাল বিখলা।
সরহ ভণই বপা উজুবাট ভাইলা॥
পথে যেতে বাঁকে বাঁকে ডানে-বাঁয়ে অনেক খাল-বিখাল রয়েছে, সরহ বলছেন, এই সব বাঁকা খাল-বিখালে প্রবেশ করো না, সোজা পথে অগ্রসর হও।৫২ বিশেষ করে বর্ষাকালে যাতায়াতের জন্য নৌকা ব্যবহৃত হয়। জল-কাদায় পরিপূর্ণ বন-জঙ্গল ও প্রচুর খালা-খন্দকের মধ্য দিয়ে স্থলপথে যাতায়াত কষ্টসাধ্য ছিল বিধায় জল-পথকেই প্রাচীনকালে অধিক ব্যবহারযোগ্য মনে করা হতো এবং মালসামান পরিবহনের জন্য অধিক সুবিধাজনক ছিল। চাকাযুক্ত যানবাহনের জন্য অধিক রাস্তা ছিল না বললেই হয়। তারা স্থলপথে ভ্রমণের জন্য ‘সুখাসন ব্যবহার করত। এটি একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি বিশিষ্ট শিবিকা। এটা রেশম বা পশম-নির্মিত উজ্জ্বল লাল বর্ণের বস্ত্র বা এ ধরনের কিছু দ্বারা আবৃত রাখা হতো। এর উভয় প্রান্তে বিভিন্ন ধাতব দ্রব্যের বাঁধন আছে এবং এটাকে বহন করার জন্য একটি থামের সঙ্গে লৌহ পেরেকাদির দ্বারা সংযুক্ত থাকে। ভ্রমণকালে এতে স্বচ্ছন্দে বসা, শোয়া ও ঘুমানো যেতে পারে। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার জন্য এর উপরে আবরণের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের কারো কারো হাতিতে চড়ার বিলাসিতা ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কম লোকই অশ্বারোহণে চলাফেরা করত।৫৩ ‘সুখাসন’ ছিল‘ডুলিরই উন্নত সংস্করণ। ডুলি সচরাচর সাধারণ লোকেরা ব্যবহার করতো। যানবাহনযোগ্য রাস্তার অভাবে এদেশে রথের ব্যবহার কোনোদিনই ছিল না। গরুর গাড়ির প্রচলনও ছিল উত্তর ও পশ্চিম বাংলায়।
৪৩ এন.জি. মজুমদার, ইন্সক্রিপশন্স অফ বেঙ্গল, খণ্ড-৩।
৪৪ এন.জি. মজুমদার, ইন্সক্রিপশন্স অফ বেঙ্গল, খণ্ড-৩।
৪৫ বিদ্যাকর ‘সুভাষিতরত্নকোষ ডানিয়েল এইচ.এইচ. এ্যাঙ্গেলস (অনূদিত), হার্ভাড ওরিয়েন্টাল সিরিজ।
৪৬ জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী, আর্যাসপ্তশতী ও গৌড়বঙ্গ।
৪৭ বলালসেন, দানসাগর, শ্যামাচরণ কবিরত্ন (সম্পাদিত)।
৪৮ সদ্যুক্তিকর্ণামৃত।
৪৯ আবুল ফজল: আইন-ই-আকবরী।
৫০ সুকুমার সেন: চর্যাগীতি।
৫১ নীলরতন সেন (সম্পা), চর্যাগীতিকোষ।
৫২ নীলরতন সেন (সম্পা), চর্যাগীতিকোষ।
৫৩ আবুল ফজল: আইন-ই-আকবরী।
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ২৮
©somewhere in net ltd.