নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখালেখি পেশা নয় নেশা। তাই শত প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও ছাড়তে পারি না। লিখেছি লিখছি লিখব। কিছুটা আবেগী হওয়ায় মনের রাগ ক্ষোভ দমিয়ে রাখতে পারিনা বিধায় কিছুটা প্রতিবাদী হয়ে যাই। লিখার ভালো মন্দ বিচার বিশ্লেষণ করা হয় না। তাই অনেকে খেপাটে ও বলতে দ্বিধাবোধ করে না।মনে মাঝে আঘাতটাকে শক্তিতেই রুপান্তরিত করি।চেষ্টা করি সমসাময়িক বিষয়ে লিখতে। হয়তো সফল হয়তো বিফল। কিন্তু সবার ভালবাসা ই আমার প্রেরণা।
সাম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র ‘গুন্ডে’ নিয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র চলছে আলোচনা-সমালোচনা। চলচ্চিত্রটিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করার কারণে বাংলাদেশের সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। চলচ্চিত্রটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ তথা অভ্যুদয় নিয়ে হিন্দিতে করা মন্তব্যের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় এরকম- ‘৭১-এ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় মাপের আত্মসমর্পণ আর হয়নি। তারপরই জন্ম হয় নতুন এক দেশের। যার নাম বাংলাদেশ।’ এছাড়াও চলচ্চিত্রটিতে বাংলাদেশ নিয়ে আরো বেশ কিছু নেতিবাচক মন্তব্য ও আপত্তিকর দৃশ্য সংযোজিত করা হয়েছে। উদ্ধৃত মন্তব্যটি সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যের রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক বড় এবং আমাদের জন্য চরম অবমাননাকর। এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাঙালিদের স্বাধীনতা লাভের মতো শ্রেষ্ঠ অর্জনকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য আমাদের সুদীর্ঘকালের সংগ্রামকে শুধু ৭১-এর ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে যে সময়টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস আমরা কমবেশি সবাই জানি। তারপরেও বক্ষমান নিবন্ধের পূর্ণতার জন্যই তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশবিরোধী ১৯০ বছরের আন্দোলনের কথা যদি বাদও দিই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও আমাদের ২৩ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই ২৩ বছরের মধ্যে নয় মাস ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম যা বিশ্বব্যাপী খরনবৎধঃরড়হ ধিৎ বা মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯০ বছর ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের আওতায় আমরা প্রথম স্বাধীনতা লাভ করি। আমাদের বাংলাদেশের ভূখ- পূর্বপাকিস্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু ওই স্বাধীনতা আমাদের আকাক্সক্ষার পূর্ণতা দিতে পারেনি। ব্রিটিশদের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হলেও আমরা নতুন করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকেই রাজা সেজে আমাদের ওপর প্রজার মতো আচরণ শুরু করে। প্রথমেই তারা আমাদের ভাষার ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মধ্যে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান সৃষ্টির বছর না ঘুরতেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে ছাত্র-জনতা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। দাবি তোলা হয় বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু বাঙালিদের সহনশীল ও সমঝোতামূলক এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি হয় না পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তারা সংখ্যালঘু মানুষের ভাষা উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। এ নিয়ে সারা পূর্ব পাকিস্তানে চলতে থাকা প্রতিবাদের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি। এদিন ঢাকার রাজপথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে মারা যান রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেকে। আহত হন অসংখ্য মানুষ। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে ভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী একমাত্র জাতি হিসেবে স্থান করে নেয় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের বাঙালিরা। ওই আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত ’৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে এতে বাঙালিদের কাক্সিক্ষত বিজয় হলেও ভাষাকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আচরণে বাঙালি হৃদয়ে যে ক্ষত ও সন্দেহের সৃষ্টি হয় তা আর দূর হয়নি। বরং এর সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এক সাথে থাকা যাবে না-এমন চিন্তাভাবনা বাঙালিদের মধ্যে জাগ্রত হতে থাকে। ’৬২-তে ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-তে ৬ দফার আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উত্তাল অংশগ্রহণ সেই মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বায়ত্তশাসনের আদলে ৬ দফা দেওয়া হলেও তা ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার প্রথম সোপান। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ’৬৯-এ অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের লৌহমানবখ্যাত সামরিক শাসক স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। জনতার প্রবল দাবির মুখে ’৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন তিনি। ওই নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে পূর্বপাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতেই বিজয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। এর ফলে বাঙালিদের পাকিস্তান শাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আসলে ’৭০-এর নির্বাচনের ওই রায় ছিল প্রকৃত অর্থে বাঙালিদের পশ্চিম পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে। সাধারণ নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিদের স্বাধীকার আন্দোলন দমাতে ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে বাঙালি নিধন অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন সার্চলাইট। এক রাতের অভিযানেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরে হাজারো মানুষের মৃত্যু ঘটে। অকস্মাৎ এ আক্রমণে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে জাতি। তবে ওই অবস্থা ছিল সাময়িক। ২৬ মার্চ তৎকালীন সেনা অফিসার মেজর জিয়াউর রহমানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ওই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হয়ে পাল্টা আঘাত হানে বীর বাঙালিরা। শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস ওই যুদ্ধ চলার পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। নয় মাসের ওই যুদ্ধে আত্মাহুতি দিতে হয় ৩০ লাখ বাঙালিকে। ইজ্জত হারাতে হয় ২ লাখ মা-বোনকে। সম্পদ ও অবকাঠামো ক্ষতির পরিমাণ ছিল সীমাহীন। এত অল্প সময়ে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের আত্মাহুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে কোনো জাতির স্বাধীনতা অর্জনের নজির বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। অথচ আলোচিত ‘গুন্ডে’ চলচ্চিত্রে আমাদের এই দীর্ঘ সংগ্রাম এবং বিশাল আত্মত্যাগকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। বিশ্ব দরবারে স্থান করে নেওয়া আমাদের বীরত্বগাথা মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যায়িত করা হয়েছে পাক-ভারত তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে। এখানে বলে রাখা ভালো-স্বাধীনতা লাভের পর ’৪৮ ও ’৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারত দু’দফায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। গুন্ডে চলচ্চিত্রের ভাষ্য অনুযায়ী ’৭১-এ কথিত পাক-ভারত তৃতীয় যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশীদের কোনো আত্মত্যাগ বা অবদানের কোনো কিছুই ওতে উল্লেখ করা হয়নি। যার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাংলাদেশীদের কোনো ভূমিকা নেই। লক্ষণীয় যে, চলচ্চিত্রটিতে পাক-ভারত তৃতীয় যুদ্ধ, ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে বলা হলেও ভারতের বিজয় কথাটি সরাসরি বলা হয়নি। হতে পারে এটা একটা কৌশল। বিতর্ক এড়ানোর জন্যই হয়তো এই কৌশল। এ থেকেই বুঝে নেওয়া যায় কাজটা করা হয়েছে অত্যন্ত সচেতনভাবে। আমাদের সামগ্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামে নয়-তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পরিক্রমার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে ভারতের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রায় ১ কোটি মানুষকে ভারতের মাটিতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়দান, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ, বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো-এসবই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় অবদানের উদাহরণ। এসব সহযোগিতার পাশাপাশি ৩ ডিসেম্বর ’৭১ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িত হয় ভারত। এখানে লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, ’৭১-এর ৩ ডিসেম্বর ভারত যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে তখন রাজধানী ঢাকা ও বড় কয়েকটি শহর ও সেনানিবাস ছাড়া পুরো বাংলাদেশই কার্যত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। পাক আর্মিরা পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কোনো কর্তৃত্ব তখন বাংলাদেশের ওপর ছিল না বললেই চলে। নয় মাসের যুদ্ধে সাড়ে আট মাসই মুক্তিযোদ্ধারা এককভাবে পাক আর্মিদের মোকাবিলা করেছে।ভারতীয় বাহিনী মাত্র শেষ ১৩ দিন যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং ওই ১৩ দিনের যুদ্ধেও মুক্তিবাহিনী ছিল অগ্রভাগে। এক কথায় বলা যায়, আমাদের বিজয় যখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখনই কেবল ভারতীয় বাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধে তারা যোগ দিয়েছিল মিত্র বাহিনী হিসেবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে-ভারতীয় বাহিনী সরাসরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করার বিষয়টি ভারত সরকারিভাবে কখনোই স্বীকার করেনি। বরং ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে পাকিস্তানের এমন অভিযোগ তারা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে এমন অভিযোগের দায়দায়িত্ব ভারত সরকারিভাবে নিতে চায়নি। ভারতের এই লুকোচুরি খেলা থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের বিজয়ের ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়ার পরই ভারতীয় বাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হলেও ৬ ডিসেম্বর ভারত আমাদের স্বীকৃতি দেয়। ’৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়, সে যুদ্ধ ছিল অবশ্যই দখলদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধ। ৩ ডিসেম্বর ওই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সহযোগী তথা মিত্রবাহিনী হিসেবে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ বলার সুযোগ ছিল না। বিশেষ করে ৬ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তো নয়ই। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর যে আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে সেখানে পাক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ তথা মিত্রবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ওই আত্মসমর্পণ কোনোভাবেই পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ ছিল না। কারণ আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। যদিও সব বিবেচনায় ওই আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ঘটা উচিত ছিল মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানির কাছে। কিন্তু পাকিস্তান এবং ভারত উভয় দেশই তখন কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিজয়কে দালিলিক প্রমাণের বাইরে রেখে দেয়। চক্রান্ত করে ওসমানিকে আত্মসমর্পণ স্থলে আসতেই দেওয়া হয়নি। পাকিস্তান কাজটি করেছিল কিছুটা হলেও তার মর্যাদা রক্ষার জন্য। সরাসরি বাংলদেশের কাছে পরাজয় মেনে নেওয়াটা তার জন্য ছিল চরম অবমাননাকর। আর ভারত কাজটি করেছিল সব কৃতিত্ব নিজের করে নেওয়ার জন্য। আসলে বাংলাদেশের বিজয় নিয়ে ষড়যন্ত্রটার শুরু তখন থেকেই। ভারত-পাকিস্তান দু’দেশই ওই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। গুন্ডে চলচ্চিত্র সেই ষড়যন্ত্রেরই নতুন সংস্করণ। তাই এটাকে যদি কেউ শুধু কোনো একটি চলচ্চিত্রের ভাষ্য হিসেবে মনে করেন তা হলে তারা ভুল করছেন। সত্যিকথা বলতে গেলে এটা হচ্ছে ভারতের রাষ্ট্রীয় অবস্থান বলেই মনে হয়। কারণ, ভারতীয়রা এটাই মনে করে যে, তারাই বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছেন। যদি তাই না হতো তা হলে ভারতের কোনো চলচ্চিত্রকারের এত বড় দুঃসাহস হতো না বন্ধুপ্রতীম একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনের মতো সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসকে এভাবে বিকৃত করে উপস্থাপন করার। যদি বিতর্কের খাতিরে ধরে নিই চলচ্চিত্রকার ভুল করেছেন। কিন্তু ভারতের সেন্সর বোর্ড কী করল? তারা তো সরকারি প্রতিষ্ঠান। যে কোনো দেশের সেন্সর বোর্ডের কাজই হচ্ছে নির্মিত কোনো চলচ্চিত্রে দেশের তো বটেই বন্ধুপ্রতীম কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো কিছু আছে কিনা তা সর্বাগ্রে যাচাই করে দেখা। আর সেন্সর বোর্ডে যারা থাকেন তারা ইতিহাস জানেন না-এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসলে ভারত সরকার যা মনে করে, সে দেশের সেন্সর বোর্ডও তাই বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের সমার্থক বক্তব্যই গুন্ডে চলচ্চিত্রে তুলে ধরায় চলচ্চিত্রটি আনকাট মুক্তি পেয়েছে। লক্ষণীয় যে, চলচ্চিত্রটি নিয়ে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার পর চলচ্চিত্রটির প্রযোজনা সংস্থা শুধু দুঃখ প্রকাশের মধ্য দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষে করেছে। তারা চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনী বন্ধ করা তো দূরের কথা বিতর্কিত বক্তব্যটি প্রত্যাহার কিংবা সংশোধন করতেও রাজি হয়নি। আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের সরকার একটি চিঠি দিয়ে ভারত সরকারের কাছে চলচ্চিত্রটির বক্তব্য বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত ভারত সরকার আমাদের সরকারের চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজনটুকুও অনুভব করেনি।আমরা লড়াই করেছি স্বাধীনতার জন্য। আর ভারত আমাদের লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য। এদিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পাশাপাশি ভারতেরও বিজয় হয়। তবে লড়াইয়ের উদ্দেশ্য ভিন্নতর হওয়ার কারণেই ভারত আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে অর্জিত বিজয়কে নিজেদের বিজয় বলে প্রচার করছে এবং অস্বীকার করছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগকে। ’৭১-এ পাকিস্তান ভেঙে একটি মেরুদ-হীন অনুগত রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন ভারত দেখেছিল গত ৪৩ বছরে এদেশের স্বাধীনচেতা মানুষের দৃঢ়তার কারণে সে স্বপ্ন সফল না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তারা কিছুটা হতাশ। এবার তাই এদেশের জনগণকে বাইপাস করে তাদের প্রতি অনুগত একটি সরকাকে ক্ষমতায় বসিয়ে সে স্বপ্ন কিছুটা হলেও সফল করতে পেরেছে। আর সেই স্বপ্ন সফলের প্রথম উপহারই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বানানো গুন্ডে চলচ্চিত্র। সম্প্রসারণবাদী শক্তি ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমরা কীভাবে আমাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের অবমাননা হজম করে নিচ্ছি? আমরা তো কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে দেশকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শিবিরেও বিভক্ত করে ফেলেছি। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দেশের সংখ্যাগুরু মানুষকেই বলা হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী। অথচ স্বাধীনতার সপক্ষ দাবি করে যারা ক্রমাগত রাজনীতির মাঠ গরম করে চলেছেন বিস্ময়করভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বানানো ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। কোথায় সেই গণজাগরণ মঞ্চ, সুশীল সমাজ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নকারীরা? প্রধানমন্ত্রী তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা-বিবৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত এমন কথাও তিনি হরহামেশাই বলেন। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে আমরা দেশকে বিভক্ত করে ফেলছি। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত আসার পরও তা নীরবে হজম করে যাচ্ছি। তবে আশার জায়গা একটাই-তা হলো, এদেশের সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম দেশপ্রেম। ’৭১ সালেও সাধারণ মানুষ জেগে ওঠার ফলেই একটি সুশিক্ষিত ও সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত সময়ে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে তৎকালীন মেজর জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আজ আবার সময় এসেছে সেই ’৭১-এর মতো জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসার। কেননা, সময় এসেছে আরও একটি মুক্তিযুদ্ধের। তবে এ যুদ্ধ অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, এ যুদ্ধ করতে হবে চেতনা দিয়ে। গণতন্ত্রকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের প্রকৃত মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
©somewhere in net ltd.