নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন মানুষকে পিতা- মাতা জন্ম দিলেও মানুষ হিসেবে জন্ম লাভ করে একজন শিক্ষকের মাধ্যমে। তাই পিতা মাতার পরে একজন মানুষের কাছে তার সবচেয়ে শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র তার শিক্ষক। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ আমাদের দেশে শিক্ষার সাথে সাথে শিক্ষকের মান সম্মান আর মর্যাদা যে কতটা নীচে নেমেছে তা আর বলার অপেক্ষা কি রাখে? শিক্ষকের অপমান লাঞ্ছনা প্রতিনিয়ত ই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হতে দেখছি। এমন সংবাদ পরে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি আমাদের সমাজের গন্তব্য কোথায় তা হলে কি মানুষ নামে জম্ম হয়ে মানুষ হতে কি ব্যর্থ হয়েছি। এই সব ঘটনা শুনে ভাবি আমরা কি তা হলে অতিমাত্রায় বর্বরতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি? পৃথিবী জন্মলগ্ন থেকেই শিক্ষক সম্মানিত হয়ে আসছে। যুগে যুগে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সৎ ও কল্যানের পথে আনার জন্য রাসুল ও নবীগনকে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন। আর নবী রাসুলগনের কাছে আল্লাহ ওহির মাধ্যমে মানব জাতির কল্যান ও সম্পুর্ন জীবন ব্যবস্হা প্রেরন করছেন নবী ও রাসুলাগন আল্লাহর সেই পাঠানো বানী মানুষের কাছে শিক্ষক হিসেবে পৌঁছে দিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষকে জ্ঞানী করে তুলতে শিক্ষক হলেন সবচেয়ে বড় মাধ্যম আল্লাহ ই হলপন একমাত্র জ্ঞানদাতা আর শিক্ষক হলে মানুষের মাঝে সেই জ্ঞানকে স্হাপনের মাধ্যম। কিন্তু শিক্ষকদের সেই সম্মানের কথা আজ আমরা সবাই ভুলতে বসেছি।
গত ৭ জুলাই রাতে নগরীর নিউমার্কেট সংলগ্ন রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর মালিকানাধীন থিম ওমর প্লাজার চেম্বারে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে সাত জন অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের সামনে প্রায় পনের মিনিট ধরে পিটানোর অভিযোগ উঠে। গোদাগাড়ীর মাটিকাটা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আব্দুল আউয়াল রাজু ফোন করে বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদের ৭ জুলাই রাত ৯টায় থিম ওমর প্লাজায় এমপির চেম্বারে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেন। ফোন পেয়ে রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাসহ আট অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ এমপি ফারুকের চেম্বারে হাজির হন। তাদের সামনেই একটি বিষয় নিয়ে অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে বেধড়ক মার মারেন এমপি। কিন্তু ভয়ে কেউ তাকে বাধা দেননি। যদিও পরে সংবাদ সম্মেলনে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর পাশে বসে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা এমপির বিরুদ্ধে আনিত এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে বলতে বাধ্য হন। আমি অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে ঐ বক্তব্য দিতে বলা হয়ছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যে সুর উঠেছে আমি ও তাদের সাথে এক মত। কেন তার বিস্তারিত অবশ্যই বলবো। তবে ওমর ফারুক চৌধুরী ই যে প্রথম শিক্ষক পেটালাম এমনটি নয় এর আগে
এর আগে গত মে মাসে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার দলবল নিয়ে কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজে ঢুকে তার প্রিয় এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার কাগজপত্রও গায়েব করতে না পেরে অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনকে মারধর করেন। যদি ও শিক্ষক নির্যাতনে এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের লোপ টি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে কেউ। এর আগেও পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় গৈয়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দিনকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হান্নান মিয়া। ২০১৫ সালে রাজশাহীর তানোরে শিক্ষার্থীদের বরণ, বিদায় ও বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক মণ্ডলকে প্রধান অতিথি না করায় ওই চেয়ারম্যান তার অনুগতদের নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে সভা পণ্ড করেন। গত কয়েক দিন আগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া শিক্ষক অধ্যাপক, গবেষক ও নাট্যকার ড. রতন সিদ্দিকীর বাসায় হামলা হয়েছে। তার পরিবার বলেছে, একটি চক্র বাসার গেটের সামনে নিয়মিত বাজার বসায়, গেটের সামনে সব্জির ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে। এসবের প্রতিবাদ করায় এই হামলা। তবে এই হামলার সাথে ধর্মের একটা মিশ্রন ঘটাতে অনেকেই চেষ্টা করেছিল। ঐ হামলাকারীদের অনেকেই ড. রতন সিদ্দিকীকে নাস্তিক হিসেবে ট্যাগ করে রতন সিদ্দিকী কে আরো নাস্তানাবুদ করা চেষ্টা করে ছিল।
এর আগে মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয় বিজ্ঞান ও গণিত পড়িয়ে আসছেন হৃদয় মণ্ডলকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের দ্বারা আন্দোলন নামে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে জেলে পাঠানো হয়। অনেকেরই অভিযোগ ছিল শ্রেনী কক্ষে বিজ্ঞান শিক্ষার নাম করে হৃদয় মন্ডল ধর্ম অবমাননা করে অনেকের হৃদয়েই নাকি আঘাত করেছেন। যদি হৃদয় মন্ডল ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন ধর্মকে অবমাননা করে থাকেন তবে নিসন্দেহে সেটা একটা অপরাধ সেটা অন্যায়। তবে হৃদয় মন্ডল ও তার পরিবারের দাবী ছিল বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্ম হৃদয় মন্ডলের নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাকে এই হেনস্তার মুখোমুখি করে শেষ পর্যন্ত কারাগারে বাসিন্দা হতে হয়। শিক্ষক হৃদয় মন্ডল দীর্ঘ বাইশ বছর সুনামের সাথে বিজ্ঞান ও গনিত শিক্ষা দিয়ে আসছেন এই বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে। হঠাৎ করে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করা এক জন শিক্ষককে অপদস্ত করতে উক্ত এলাকার মানুষের বিবেকে কি একটু ও বাঁধলো না ? এর পর একই ঘটনা ঘটলো নড়ালে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ) কে নিয়ে মন্তব্যের জন্য সমালোচিত ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে নড়াইল সদর উপজেলায় মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজে এক ছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে গত ১৮ই জুন উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দাড় করিয়ে রাখা হয়। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ঐ ঘটনার সময় নড়াইলের ডিসি এসপি সকলের ওখানে ছিলেন। যদিও তাদের ভাষ্য ছিল শিক্ষককে যেখানে জুতার মালা পরানো হয়েছে, সেখান থেকে তারা কিছুটা দূরত্বে ছিলেন। অবশ্য এই ঘটনার পর সারাদেশে যখন বির্তকের ঝড় ওঠে তখন পুলিশ মামলা করে কথিত কাউকে গ্রেফতার করে পরিস্হিতি সামাল দিতে চেষ্টা করে। শিক্ষক লাঞ্ছিত করা শিক্ষকে অপদস্ত করা একটা মামুলি বিষয় ক্ষমতাশালী দলের কথিত ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের হাতে ও প্রায়ই শিক্ষক লাঞ্ছিত হবার কথা শুনে আসছি ২০১৪ সালে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক গোলাম মঈনুদ্দীনকে মারধরের অভিযোগে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা মামুন খানকে বহিস্কার করা হয়ে ছিল। ২০১৯ সালে পাবনায় শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজের শিক্ষককে মারধরের ঘটনায় কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি শামসুদ্দিন জুন্নুনকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল। এই তো মাত্র উদাহরণ এমন ঘটনার তালিকা প্রত্যেকটি ক্ষমতায় থাকা রাজনেতিক দলের ছাত্রসংগঠনের অনেক দীর্ঘ।
শ্যামল কান্তি ভক্তের কথা তো আমরা ভুলেই গেছি। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করা হয়৷ তাঁকে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস করানো হয় স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানের নির্দেশে ৷ তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তখন মামলারও ‘অপচেষ্টা’ করা হয়৷ তবে সারাদেশে মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদের মুখে প্রভাবশালীরা সে যাত্রা ব্যর্থ হয়৷ শ্যামল কান্তিকে অপমান ও লাঞ্ছিত করার ঘটনার তদন্ত হয়৷ এই ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে গড়া বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি এমপি সেলিম ওসমানসহ দু'জনকে দায়ী করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে৷ এর পর ঢাকার সিএমএম আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও গঠন করা হয়৷ আর ওই দিনই আদালত সেলিম ওসমানের জামিন মঞ্জুর করেন৷ পরে অবশ্য শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ও প্রভাবশালীদের নানান ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়েছে। তবে শ্যামল কান্তি ভক্তকে যারা অপমান নির্যাতন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কি আইনি ব্যবস্হা নিতে পেরেছে আমাদের প্রশাসন? এবার আসি রাজশাহীতে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার অধ্যক্ষ সেলিম রেজার কথায়। অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর পাশে বসে সংবাদ সম্মেলনে তাকে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন। ইতোমধ্যে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী দ্বারা অধ্যক্ষ সেলিম রেজা যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। অবশ্য এই নিয়ে অনেকেই সেলিম রেজাকে নানান ভাবে বিদ্রুপ করছে। এটা সত্য যে একজন শিক্ষকের সংবাদ সম্মেলনে এসে এমন কথা বলা কখনোই কাম্য নয়। তবে সেলিম রেজা ছিলেন নিরুপায়। কারন তিনি জাননে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী তাকে যতই নির্মম ভাবে নির্যাতন করুক না কেন বর্তমান এই রাষ্ট্র ব্যবস্হায় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর কিছুই হবে না। বরং তাকে হয়তো শ্যামল কান্তি ভক্তের মত উল্টো নানান নির্যাতন জেল জুলুম পোহাতে হতে হবে। তাই বিচার চাইনা জীবন সামলাও নীতিতে এগিয়েছেন সেলিম রেজা। বাস্তবতার নিরিখে একটা সত্য।
আজ আমাদের রাষ্ট্র তথা সমাজ ব্যবস্হা এমন এক পর্যায়ে এাসে দাঁড়িয়েছে যেখানে আজ আর মানীর মান সম্মানের কথা কেউ ই খেয়াল করে না। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্হা আজ অর্থের কাছে ক্ষমতার কাছে জিম্মি। ছোটে বেলায় পড়া কবি কাজী কাদের নেওয়াজের " শিক্ষাগুরুর মর্যাদা " কবিতা আজ পুরোটাই অর্থহীন। সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত শিক্ষক সমাজকে ও চরম ভাবে লাঞ্ছিত করে কেউ কুণ্ঠা বোধ করছে না তখন আমরা ধরেই নিতে পারি আমাদের এই সমাজ আজ পঁচে গেছে সমাজের রঞ্জে রঞ্জে আজ ঘুন বাসা বেঁধেছে। তাই আমাদের এই নষ্ট ঘুনের সমাজকে সকলেই মিলেই সংস্কার করে আমাদের পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে আসতে পারলেই আমার সবাইকে যথাযথ সম্মান করতে পারবো।
©somewhere in net ltd.