নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি ও বলতে চাই !

ওয়াসিম ফারুক হ্যাভেন

ব্লগিং হউক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।

ওয়াসিম ফারুক হ্যাভেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১২


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ শব্দটি এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের প্রতীক। এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ, আশা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং একই সঙ্গে রয়েছে হতাশা, প্রতারণা ও রক্তাক্ত পরিণতির দীর্ঘ ইতিহাস। প্রতিবারই জনগণ ভেবেছে এবার বুঝি দুঃশাসনের অবসান ঘটবে, এবার বুঝি রাষ্ট্র জনগণের হাতে ফিরবে, এবার বুঝি স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু ইতিহাস নির্মমভাবে দেখিয়েছে প্রত্যেক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উল্লাস যতটা প্রবল ছিল, তার পরিণতি বহু ক্ষেত্রেই ততটাই ভয়াবহ ও বিপরীতমুখী। এই বাস্তবতা অনুধাবন না করলে বর্তমান রাজনৈতিক মুহূর্তের গভীরতা ও তাৎপর্য বোঝা অসম্ভব। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক স্বপ্নময় মুহূর্ত। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, কোটি মানুষের আত্মত্যাগ, ধ্বংসস্তূপের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা একটি রাষ্ট্র এই বাস্তবতায় শেখ মুজিবের ফিরে আসা ছিল আশার একমাত্র বাতিঘর। লাখো মানুষ সেদিন রাজপথে নেমেছিল, তাদের চোখে ছিল অশ্রু আর মুখে ছিল মুক্তির গান। তারা বিশ্বাস করেছিল, যিনি স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনিই দেশকে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার পথে পরিচালিত করবেন। কিন্তু ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। স্বাধীনতার মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন সদ্য স্বাধীনদেশের মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গের কারন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহন করেই শেখ মুজিবর রহমান হয়ে উঠেন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মালিক। বাংলাদেশ নামক সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পরিনত হয় এক গুম, খুন আর দুর্ভিক্ষের রাষ্ট্রে। বাংলাদেশের মানুষ হারায় তাদের সকল অধিকার। মাত্র তিন বছরের মাথায় শেখ মুজিবর রহমান হয়ে উঠেন একদলীয় শাসনের রূপকার। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা বিলুপ্ত করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে এক ভয়াবহ দমনযন্ত্রে পরিণত করা হয়। বিরোধী মতের কোনো স্থান থাকেনি, সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়। মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করে রাষ্ট্রের মানচিত্র এলেও প্রকৃত মুক্তি আসেনি। রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে না থেকে একটি পরিবার ও গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এই শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতার মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে প্রায় স্বপরিবারে নিহত হন। এটি নিঃসন্দেহে একটি নৃশংস ও বেদনাদায়ক ঘটনা, যা কোনোভাবেই মানবিক বা সভ্য সমাজের মানদণ্ডে সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু একই সঙ্গে ইতিহাসের এক নির্মম সত্যও অস্বীকার করা যায় না এই মৃত্যুর খবরে দেশের একটি বড় অংশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। অনেক জায়গায় মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল। এটি কোনো ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ছিল না বরং এটি ছিল দীর্ঘদিনের দমন, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক শ্বাসরোধের বিরুদ্ধে মানুষের অবদমিত প্রতিক্রিয়া।

ইতিহাস এখানেই থেমে থাকেনি। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর প্রবাসে থাকা তার কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে বিপুল জনসমর্থনের আবেগে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই প্রত্যাবর্তনও ছিল আবেগঘন। অনেকেই ভেবেছিল, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া হবে, একদলীয় শাসনের বিভীষিকা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আশাও ফিকে হয়ে যায়। দীর্ঘ রাজনৈতিক কৌশল, আপস ও সমঝোতার রাজনীতির মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আবার ২০০১ সালে ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটে। এরপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আসে এক গভীর অস্থিরতা। কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনার তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ কার্যত এক নতুন পরাধীনতার যুগে প্রবেশ করে যে পরাধীনতার কেন্দ্র ছিল দিল্লি। এই সময় থেকেই শেখ হাসিনা কেবল একজন প্রধানমন্ত্রী নন বরং ভারতের স্বার্থরক্ষাকারী এক বিশ্বস্ত এজেন্টে পরিণত হয়েছেন এমন ধারণা জনমনে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দাসত্বে আবদ্ধ করেন। সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশি হত্যা, পানিবণ্টনে বৈষম্য, বন্দর ও ট্রানজিট সুবিধা, একতরফা নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। ভারতের ছত্রছায়াতেই শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শাসকে পরিণত হন। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহৃত হয় নির্দ্বিধায়। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, সাজানো নির্বাচন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক ভয় ও আতঙ্কের রাষ্ট্রে রূপ নেয়। এই দুঃশাসনের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে। এই গণঅভ্যুত্থান কেবল শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছিল না এটি ছিল বাংলাদেশের উপর ভারতের দীর্ঘদিনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ। মানুষ বুঝে গিয়েছিল, দিল্লির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশীর্বাদ ছাড়া এই শাসন কখনোই এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত না। অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে তার পারিষদবর্গ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নিয়ে লজ্জাজনকভাবে ভারতে পালাতে হয়।


এই পটভূমিতেই আসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। দীর্ঘ সতেরো বছরের নির্বাসন জীবন শেষে ২০২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। লাখো মানুষের ভালোবাসা, আবেগ ও প্রত্যাশায় এই প্রত্যাবর্তন নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মানুষ আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের সতর্ক করে দেয় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উল্লাসই শেষ কথা নয়। প্রকৃত চ্যালেঞ্জ শুরু হয় এর পরেই। তারেক রহমানের ওপর মানুষের আশা ও ভরসা যেমন প্রবল, তেমনি তার কাঁধে দায়িত্বও ভয়াবহ রকমের ভারী। তাকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা। সেটি ছিল একদিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, অন্যদিকে স্পষ্টভাবে ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী। এই কারণেই তারেক রহমানকে সর্বাগ্রে সতর্ক থাকতে হবে বিদেশি আধিপত্য, বিশেষত ভারতের ব্যাপারে। তাকে মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার পতনের অন্যতম কারণ ছিল তোষামোদকারী ও সুবিধাভোগী চক্রের ওপর তার অন্ধ নির্ভরতা। এই চক্রই শাসককে বাস্তবতা জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত পতনের দিকে ঠেলে দেয়। আজ বিএনপির ভেতরেও রয়েছে আওয়ামী মতাদর্শের হাইব্রিড অংশ, সুবিধাবাদী ও আদর্শহীন কিছু নেতা-কর্মী, যারা প্রয়োজনে যে কোনো শিবিরে ভিড়তে দ্বিধা করে না। এদের ব্যাপারে তারেক রহমানকে হতে হবে কঠোর ও আপসহীন। এছাড়াও রাজনীতির বাহিরে আাছে বিভিন্ন পেশাজীবি ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবি চাটুকার যারা সবসময়ই নিজেরদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য সব কিছুই করতে প্রস্তুত। ইতিহাস প্রমাণ করেছে এই হাইব্রিডর সুবিধাভোগীরাই ভবিষ্যতের বড় বিপর্যয়ের বীজ বপন করে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও আপোষহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান হিসেবে তারেক রহমানের সামনে আজ এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের যে উত্তরাধিকার তিনি বহন করছেন, সেটিকে কেবল আবেগে নয়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নৈতিক দৃঢ়তা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত বিচক্ষণতায় ধারণ করতে হবে। দেশের ভেতরে ও বাইরে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে ভুল করলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। ফ্যাসিবাদী শক্তি নতুন মুখোশ পরে আবার ফিরে আসতে পারে। তাই সতর্কতা, স্বচ্ছতা ও আদর্শিক দৃঢ়তাই হতে পারে তারেক রহমানের সবচেয়ে বড় শক্তি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ইতিহাসে বারবার এসেছে। কিন্তু ইতিহাস বদলেছে কেবল তখনই, যখন প্রত্যাবর্তনের পর নেতৃত্ব জনগণের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আজ আবারও সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ । সামনে জাতীয় নির্বাচন দেশ একটি নতুন সরকার পাবে। তাই বাংলাদেশ নতুন করে নতুন পরিকল্পনায় নতুন দৃষ্টিতে পথ চলবে এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
:

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.