নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আদনান সাদেক

আদনান সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

জার্মানির ডায়রি ১: অপমান

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:০০

অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও ক্লাসে একদম মন দিতে পারছি না। প্রফেসর ফিঙ্গার যে খুব জটিল কিছু পড়াচ্ছেন তা নয়। ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকা গ্রাফ আর সমীকরণ দেখে মোটামুটি ধারণা করছি আজকের বিষয়বস্তু। প্রোফেসর ফিঙ্গার থিওরেটিক ফিজিক্সের একটা সাধারণ থিউরি পড়াচ্ছেন, বিষয়টা কোন একসময় বুয়েটে থাকতে গলধগ্রহন করেছিলাম, অতটুকু বুঝতে পারছিলাম সেটার জন্যই।



সমস্যাটা যে শুধু আজকের ক্লাসটা নিয়েই তা নয়, সেমিস্টারের শুরু থেকেই একটা কিছু গোলমাল হয়েছে, কোন ক্লাসেই ইদানীং আর কিছু বুঝতে পারছি না- মন বসবে কি করে। চায়নিজ, ইন্দোনেশিয়ান, ব্রাজিল, মেক্সিকান, জর্ডান, ইন্ডিয়ান- অন্য সব দেশের ছেলেমেয়েরা দেখি ধুমধাম করে নোট টুকে যাচ্ছে। ফ্রাও মেইসিঙ্গেনের ইমেইলের কথা মনে পড়ে গেল। ভর্তির অনুমোদন পত্র পাঠানোর সময়ই সতর্ক করে লিখেছিলেন এই মাস্টার্স প্রোগ্রামে দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে সব কোর্স জার্মান ভাষায় পড়ানো হবে। আমি তখন গোয়েঠে ইন্সটিটিউট থেকে লেভেল ওয়ান শেষ করেছি, দ্বিতীয় সেমিস্টার শুরু হতে অনেক বাকি, এরমাঝে নিশ্চয়ই জার্মান ভাষা ভেজে খেয়ে ফেলব। গোগলে একটা অনুবাদ করে ফ্রাও মেইসিঙ্গেনকে জানিয়ে দিলাম আমি আসছি – তাও আবার জার্মান ভাষায়।



সেই এপ্রিল মাসে প্রথম জার্মানিতে পা রাখার পরপরই আমার লেভেল-১ এর কেরামতি ফাঁস হয়ে গেল। ড্রেসডেন শহরের দোকানপাটে কেউ একবিন্দু ইংরেজি বলতে পারে না। সুপারমার্কেটে গিয়ে প্রথম দিন ডিম কিনতে গিয়ে কোনভাবেই সেলস গার্লকে বোঝাতে পারছিলাম না। শেষপর্যন্ত লজ্জার মাথা খেয়ে মুরগির মত ডাক পাড়লাম, সেটাতে কাজ হল। দেশে গোয়েঠেতে স্যার জার্মান পড়ানোর সময় কি সুন্দর করে নতুন দেশের ভাষায় কথা বলতেন, তখন মনে হত বাহ অনেক কিছুইতো বুঝতে পারি, জার্মান ভাষা দেখি শিখেই ফেললাম। এখানে এসে মনে হল এরা সবাই যেন অন্য কোন অজানা ভাষায় কথা বলে, এই ভাষা তো স্যার আমাদের শেখান নি! পাখির মতন শিখে নাহয় দুই একটা কথা বলা যায়, কিন্তু উত্তরটাতো বুঝতে পারতে হবে। একদিন পথ খুঁজে না পেয়ে এক বুড়োকে জানতে চাইলাম বাসার ঠিকানা বলে। সে আমাকে খুব সুন্দর করে সব বুঝিয়ে দিল, একটা বিন্দুও বুঝতে পারলাম না। বুড়ো আমার মুখ দেখে সেটা অনুমান করল মনে হল, সে আবার প্রথম থেকে বোঝাতে শুরু করল- আমি শেষমেশ দেখি মহাবিপদ, আমাকে না বুঝিয়ে দেখি বুড়ো ছাড়বে না। তৃতীয়বার বোঝানোর সময় সব বোঝার একটা ভাব করলাম, তারপর কেটে পড়া। আমারই দোষ, এই সামান্য জিনিস না বুঝতে পারলে জানতে চাওয়া কেন।



গত ছয়মাসে যে কিছুই শিখিনি তা নয়। ইউনিভার্সিটি থেকে ফ্রি কোর্স ছিল, সেখানে গেলাম নিয়মিত, পড়াশোনা আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে জার্মান শেখার একটা আপ্রাণ চেষ্টাও চালালাম। লাভের মধ্যে খেয়াল করলাম ইদানীং ইংরেজি ভুলে যাচ্ছি, আর জার্মান যে কিছুই শেখা হয়নি সেটা অনুভব করি ক্লাস করতে গিয়ে। এই যেমন অনেকক্ষণ ধরে হাত পা নেড়ে লেকচার দিচ্ছেন প্রফেসর ফিঙ্গার, মনে হচ্ছে ফ্লাইং সসার থেকে নেমে এসে কোন এলিয়েন কথা বলছে। আমি বুঝতে না পেরে মাঝে মাঝে আমার পাশের জার্মান ছেলেটার কাছে বুঝতে চাইছিলাম। ব্যাপারটা ফিঙ্গার সাহেবের মন-পুত হয়নি। একটু আগে লিখা ইকুয়েশনের একটা অংশ মুছে দিয়ে হঠাৎ করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন ক্লাসের দিকে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই আমি অন্যদিকে তাকালাম, মনে মনে প্রার্থনা করলাম, “ধরণি দ্বিধা হও”।

পাশ থেকে একটা খোঁচা খেয়ে খেয়াল করলাম, প্রফেসর আমাকেই কিছু একটা প্রশ্ন করেছেন। টেকনিক্যাল ব্যাপারটা হয়ত ব্যাখ্যা করতে পারতাম, কিন্তু প্রশ্নই তো বুঝতে পারি নি। এখানে ক্লাসের ছাত্ররা সাধারণত বসেই শিক্ষেকের প্রশ্নের উত্তর দেয়। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে ইংরেজিতে বললাম, দুঃখিত, আমি প্রশ্নটা বুঝতে পারিনি। প্রফেসর ফিঙ্গার খুব কড়া ভাষায় একটা কিছু বললেন। আমি সেটাও বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সামনের সারিতে বসা কয়েকটা ইন্ডিয়ান ছেলে দেখি খুব সমজদারের মতন মাথা নাড়ছে, সেটা দেখে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। প্যাট্রিক নামের জার্মান সহপাঠী আমাকে পরে ব্যাখ্যা করল, “প্রফেসর বলছিলেন, জার্মান না জেনে এখানে কেন পড়তে আসা, ইংল্যান্ড আমেরিকা গেলেই তো হয়”।



জার্মানিতে আসার পর পৃথিবীর সব দেশের সাথে আমরাও পারি টাইপের অঘোষিত একটা যুদ্ধের ঘোষণা ছিল মনে মনে, বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মনে হল দেশটাকে খুব ছোট করলাম সবার সামনে। প্রফেসর ফিঙ্গারের ক্লাসে আর গেলাম না সারা সেমিস্টারে, শুধু তাইনা, অন্য ক্লাসে যাওয়াও কমিয়ে দিলাম। লেকচার না বুঝে শুধু হা করে তাকিয়ে থেকে কি লাভ। অন্যদেশের সাথে প্রতিযোগিতার ব্যপারটা মাথা থেকে বের হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম পাশ করতেই ঠ্যালা আছে জার্মান শিখতে না পারলে।

চলবে…



[জার্মানির ডায়রি-২: স্বপ্ন-ভেঙে বাস্তবে]





লেখকের কথাঃ



ঠিক এক যুগ আগের কথা। ২০০১ সাল, আমরা তখন অনেক সেশন জটে জট পাকিয়ে অবশেষে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, পাশ করে আর কিছুদিন পরে উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ যাব – এমন একটা স্বপ্ন চোখেমুখে । বুয়েটের স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম আর ঐতিহ্য (!) মেনে মনে মনে এক পা প্রায় আমেরিকার পথে। টোফেল দেয়া শেষ, জিআরই নিয়ে বসব বসব করছি। এমন সময় আল কায়েদার আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা (কিংবা কেউ কেউ বলেন আমেরিকার নিজের লোকদের করা প্ল্যানে ঘটানো কাজ, সে যাই হোক না কেন)। আমরা যখন পাস করি করি তখন ভিসা দেওয়া তো দূরের কথা, আমেরিকার নামও মুখে আনা নিষেধ। স্কলারশিপ টিপ দিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না এমন এক দুঃসময়! এমন একটা সময়ে একদম কোন কিছু না জেনে, প্রায় কোন জার্মান ভাষা না শিখেই ২০০২ সালের এপ্রিলের ৮ তারিখ পা দিলাম জার্মানির মাটিতে।



অনেক বছর শেষে পিছন ফিরে তাকিয়ে ইদানিং মনে হয় জীবন যদি আবার শুরু করতে পারতাম, আর ৯১১ যদি না ঘটতো আর যদি জানা থাকতো জার্মানিতে কি কি সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, তাহলে চোখ বুজে আমারিকা কানাডা বাদ দিয়ে আবার জার্মানিতেই আসতাম। সেই প্রথম বছরগুলির সীমাহীন প্রতিকূলতা আর সম্পূর্ণ নতুন একটা ভাষা এবং কালচার শিখে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা – এইসব অভিজ্ঞতার আলো আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যাওয়া উচিত – এমন একটা উপলব্ধি থেকে লিখতে বসা। কারো ভাল লাগলে এই সামান্য প্রচেষ্টা সার্থক মনে করব।



এই লেখাগুলি তাদের জন্য যারা অনেক বাঁধা আর প্রতিকুলতার মুখেও স্বপ্ন দেখতে ভুলে না, নিজের জন্য এবং নিজের দেশের জন্য। বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে যারা শেখালো, সেই শাহবাগের নির্ঘুম গনজনতার জন্য উৎসর্গিত থাকল এই লেখার প্রতিটি অক্ষর।

মন্তব্য ১৭ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:২১

মশিকুর বলেছেন:
পোস্টে ভালোলাগা। অনেকে উপকৃত হবে আশাকরি। সিরিজ চলুক...

২| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৩৮

১৯৭১স্বাধীনতা বলেছেন: +++

৩| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৭

একাকী সমুদ্রে বলেছেন: ভাইয়া আপনার ঘটনাটা ভাল লাগছে :)

৪| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:০৭

হিংস্র ঈগল বলেছেন: ভাইয়া আপনি সামুতেও আছেন!!!!! B-) B-) B-) আপনার এই লেখা আগেও পড়েছি। তবে সামুতে আপনাকে পেয়ে খুব ভালো লাগলো।

অন্য উন্নত দেশ, কানাডা, ফ্রান্স সম্পরকে জানাতে পারবেন কি? এই সব দেশের থাকা-খাওয়া, টিউশন ফি সম্পরকে জানতে চাই, কিন্তু ফেবুতে কোন গ্রুপ পাচ্ছি না। আপনার যদি জানা থাকে তাহলে লিঙ্কটা শেয়ার করবেন। উপকৃত হব।

পোস্টে +++++

৫| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:১০

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: অনেক ভালো লাগল লেখাটা। এই সিরিজের অন্য লেখাগুলো পড়ার ইচ্ছা পোষন করি। আপনার জন্য রইল অনেক শুভ কামনা।

৬| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:৪৩

ক্যপ্রিসিয়াস বলেছেন: আদনান ভাই, ধন্যবাদ সুন্দর একটি লেখা শেয়ার করার জন্য।
হিংস্র ঈগল আপনি নিচের লেখাটি দেখতে পারেন.. ধন্যবাদ Click This Link

৭| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:৫৪

খেয়া ঘাট বলেছেন: মনে হচ্ছে ফ্লাইং সসার থেকে নেমে এসে কোন এলিয়েন কথা বলছে। হাহাহাহাহা।
লিখাটি খুউব ভালো লেগেছে ভাই

৮| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:১১

বেলা শেষে বলেছেন: So ,we have to learn German Language too.

৯| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:১৬

আদনান সাদেক বলেছেন: ধন্যবাদ সবাইকে। ভাল লেগেছে জেনে অনুপ্রাণিত বোধ করছি।

১০| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:৫৬

রেজওয়ানা আলী তনিমা বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো।আরও আরও লেখার পাবার প্রত্যাশা রইলো।

১১| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৩১

Tanvir Rajeev বলেছেন: ভাল লেগেছে। চলুক।

১২| ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:২৩

দিবা স্বপ্ন বলেছেন: জার্মান দেশটাই এরকম যে এখানকার তরুনরা অসাধারন ইংরেজি জানলেও পারতো পক্ষে ইংরেজি বলতে চায় না। বয়স্করা বেশির ভাগই ইংরেজি জানেই না। আমরা নিজেদের ভাষার জন্য রক্ত দিলেও এই জার্মানদের কাছ থেকে আমাদের মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসাটা শেখা উচিত।

১৩| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৫০

েবনিটগ বলেছেন: ekhon kemon german paren?

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:০৫

আদনান সাদেক বলেছেন: এটা অন্য একটা পর্বে বলব :)

১৪| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:১৬

অপর্ণা মম্ময় বলেছেন: এতো ভালো লাগলো এই আত্মকথন ভাবে লেখা জার্মান এর কথা পড়তে। দ্বিতীয় পার্টে যাচ্ছি

১৫| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৫৯

আহমেদ আলিফ বলেছেন:
ভালোলেগেছে....
ভালোলেগেছে....

১৬| ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১:৪৩

উৎকৃষ্টতম বন্ধু বলেছেন: আপনার সাবলীল লেখা পড়ে সত্যিই পুলক অনুভব করলাম। পরের পর্বগুলোও পড়ে নিব। আপনার প্রতি শুভকামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.