![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০০৬ সালের কথা। বার্লিনের প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছি, এমন সময় পাশে কারো একজনের কান্নার শব্দে পাশ ফিরে তাকালাম। জার্মানিতে বয়স্ক কেউ কাঁদছে এমন দৃশ্য কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বেশ বয়স্কা একজন জার্মান মহিলা, মাথায় স্কার্ফ পড়া, দেয়ালে হাত দিয়ে কিছু একটা হাতড়ে দেখতে দেখতে ফুঁপিয়ে উঠে কাঁদছেন। এই দেশে কেউ কাঁদুক কিংবা হাসুক সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেটা নিয়ে অন্য কারো মাথা ব্যথা দেখানোর কোন উপায় নেই। সবারই প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার আছে, সেটাকে অন্যদের সম্মান করতে হবে। আমি বাংলাদেশের ছেলে, আমার পাশেই আমার মা-র বয়েসি একজন কাঁদছেন, সেটা উপেক্ষা করতে কষ্ট হচ্ছিল। আশেপাশে অনেক টুরিস্ট, গরমের এই সময়টায় বার্লিনে অনেক লোকজন আসে, চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব। এর মধ্যে একটা বুক ভেঙে ওঠা কান্না আমাকে বিষণ্ণ করে দিল। খুব ইচ্ছে হল বলি, মা, আপনার কিসের কষ্ট, আমাকে কি বলবেন দয়া করে?
ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানো বন্ধুটি তাড়া দিল, “সবাই! চিজ!”
আরও অনেক কিছু দেখা বাকি এখনো বার্লিনে, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা হবে না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে সেই একটু আগে দেখা ভদ্রমহিলার কথা ভাবছিলাম। তাঁকে আর দেখলাম না আশেপাশে। আমাদের ছবি সেশন শেষ হল যখন, দেয়ালের ওই কোনায় এগিয়ে গেলাম। ভদ্রমহিলা যেখানে হাত দিয়ে ছিলেন সেইখানে দেখলাম অনেক পুরনো একটা আলপনা আঁকা। একটা মুষ্টিবদ্ধ হাত, তারকাটা দিয়ে জড়ানো, পাশে ছোপ ছোপ লাল রক্ত। কালের সাক্ষী? হয়তো ভদ্রমহিলার নিজের আঁকা কোন আলপনা, কিংবা কোন হারানো প্রিয়জনের স্মরণে?
ঠিক ১০ বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। শিবির কর্মীদের হাতে একজন ছাত্রকে নির্মম ভাবে মার খাবার পর বুয়েটের হলে হলে তখন জামাত শিবিরদের বিরুদ্ধে একটা ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠেছে। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে রাত জেগে পলাশীর মোড়ে চা খাচ্ছি আর দেয়াল লিখনের প্ল্যান করছি। সবার মধ্যে কি একটা চাপা উদ্দীপনা! একটা সময় সব হিসেব নিকেশ করে আলপনার কাজ আর হল না, ফাইন্যান্স আর বাজেটের বিশাল ব্যবধান। আমরা মোটা সাইন পেন দিয়ে দেয়ালে আকা-বুকি করে মন খারাপ করে হলে ফিরে গেলাম।
কি মনে করে হোটেল রুম শেয়ার করছি যেই বন্ধুর সাথে, তাকে বললাম বিকেলের ট্রিপে আমি সাথে থাকছি না। রাতে একবারে হোটেলে ফিরে আসব, এখানে একটা কাজ আছে।
আমাদের দলবল চলে যেতেই আমি এদিক ওদিক তাকালাম। মনে মনে সেই ভদ্রমহিলাকে খুঁজলাম আশেপাশে। লোকে চারদিক গিজগিজ করছে, অনেকক্ষণ খুঁজেও পেলাম না তাঁকে আর। সবাই বাসে করে পোস্টডামে চলে গেছে, নিশ্চয়ই অনেক মজা হচ্ছে সেখানে। গেলেই পারতাম। কিছু করার না পেয়ে ব্রান্ডেনবুরগ গেটের পাশে দেয়ালের আলপনা দেখতে লাগলাম। এক পাশে অনেক বড় করে লেখা “ফ্রিডম”, লাল অক্ষরে। জার্মানরা একসময় অন্যদের ফ্রিডম কেড়ে নিয়েছিল, নিয়তি তার কিছু বছর পরেই আবার তাদের দিয়েই লিখিয়েছে “ফ্রিডম”! এই স্বাধীনতা পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মধ্যে আটকা পড়ে গেল সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি বার্লিনের প্রাচীর দিয়ে। শুধু বার্লিনে শহরের মধ্যে দিয়ে চলে গেল এই বিভক্তি রেখা, এক শহরের মানুষগুলোকে ভাগাভাগি করে দিল আমেরিকা আর রাশিয়া যুদ্ধের পর। সব ইতিহাস আমার নিজেরও জানা নেই, ভাঙা দেয়ালটার গায়ে গায়ে দেখি অনেক ছোপ ছোপ রঙ তুলির ছাপ, অনেক অনেক নাম খোদাই করা পাথরের গায়ে।
পূর্ব জার্মানি ছিল রাশিয়ার দখলে, বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার সাথে শুরু করা কোল্ড ওয়ারে পূর্ব ইউরোপের দখলকৃত দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল কম্যুনিজমের বীজ, সেটা থেকে বাদ পড়লো না পূর্ব জার্মানিও। আমেরিকার দখলে থাকা পশ্চিম জার্মানি যখন পুঁজিবাদী ও গণতন্ত্রের চর্চা করছে, পূর্বে তখন চলল স্টালিনের মূর্তি আর চেতনা বপনের কাজ। কম্যুনিজমের অপব্যবহারে একসময় ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু থাকল না। বার্লিনের প্রাচীরের দুই পাশে একই বৃন্তে ফোটা জার্মানরা বিভক্ত হয়ে দুই নীতিতে দ্বিধাবিভক্ত থাকল ৪০ বছরের উপর। কোল্ড ওয়ারে হেরে গেল একসময় রাশিয়া, কম্যুনিজমের দেয়ালে ধরা ফাটলগুলো বড় হতে থাকল। আশির দশকের শেষে একে একে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর তাঁর কম্যুনিস্ট সাম্রাজ্য। মুক্তির ডাকে সুর মেলাল বার্লিনে প্রাচীর ১৯৮৯ সালে।
কেউ একজন দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ব্যাখ্যা করছে, তার আশেপাশে একটা ছোটোখাটো ভিড় জমে গেছে। একটু এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখি সেই বয়স্কা মহিলাটি। আমি কৌতূহলে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাই। ভদ্রমহিলার সামনে অনেক পুরনো ছবির ফ্রেমে বাঁধা একজন সুদর্শন যুবকের ছবি, বয়স বেশি হলে ১৮ বা ২০ হবে। তিনি তাঁর জীবনের সত্যিকার গল্প বলছেন। আমি তখন মোটামুটি জার্মান বুঝতে পারি, দাঁড়িয়ে পড়ে তাঁর গল্প শুনতে লাগলাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের কথা। অ্যানি যখন মানুয়েলের প্রেমে পড়ে তখন বার্লিন নিয়ে ভাগাভাগি চলছে রাশিয়া আর আমেরিকার। অ্যানি প্রেগন্যান্ট, তখন বার্লিন প্রাচীরের গোপন ঘোষণা আসল। রাতারাতি শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে গেল দেয়াল। মানুয়েল দিন দশেকের জন্য পশ্চিম জার্মানিতে তাঁর বাবার বাড়িতে ছিল, অ্যানির কাছে তাঁর আর ফিরে আসা হল না। প্রাচীরের প্রাথমিক প্ল্যান দাড় করানোর পাশাপাশি আর কাউকেই আর ক্রস করতে দেয়া হল না সেই সীমারেখা। যারা পূর্বে ছিল, তারা আর পশ্চিমে যেতে পারল না। কেউ কেউ চেষ্টা করল লুকিয়ে পার হতে, তাদেরকে পাখীর মতন গুলি করে করে ফেলে রাখা হল প্রাচীরের দেয়ালের পাশে, লাশ পর্যন্ত সরানো হল না। অন্যরা যাতে দেখে শিক্ষা নিতে পারে।
অ্যানিকে তাঁর শিশু মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য করা হল পূর্ব বার্লিন থেকে আরও অনেক দূরে লাইপজিগ শহরে। অ্যানি তাঁর মেয়েকে নিয়ে মাঝে মাঝেই আসত প্রাচীরের কাছে, যদি অন্য পাশে কখনো মানুয়েলের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় এই আশায়। তারা দেয়ালে আঁচড় কাটত, আলপনা আঁকত, নাম লিখত তাদের হারানো প্রিয়জনের। তাদের মতন আরও অনেক স্বজন হারা মানুষ অপেক্ষায় থাকতো দেয়ালের দুইপাশে। তারা কল্পনা করতেন মানুয়েল হয়তো অন্য পাশে বসে তাদেরই মতন আঁচড় কাটছে প্রাচীরে।
তাদের আর কখনো দেখা হয়নি। মানুয়েলকে দেয়ালের উপরে গুলি করে মেরে ফেলা হয় ১৯৫৭ সালে। রাশিয়ানরা উদাহরণ হিসেবে তাঁর মৃত হাতে কাঁটাতার দিয়ে বেঁধে প্রাচীরের উপর ঝুলিয়ে রাখে লাশ পচে যাবার আগ পর্যন্ত – ঠিক সেইখানে যেখানে ভদ্রমহিলাকে
আজ কাঁদতে আজ দেখেছিলাম।
এই লেখার অনুপ্রেরণা বুয়েটে ২৫শে মার্চ রাতে দেয়াল লিখন থেকে।
২০১৩ সাল। ২৫শে মার্চের কালরাত থেকে বুয়েটে মুক্তির রঙ দিয়ে শুরু হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে আলপনা আঁকার কাজ। কয়েক হাজার মাইল দূরে রাত জেগে ফেইসবুকে বসে আছি, কেউ যদি কাজের ফাঁকে দুই একটা ছবি আপলোড করে দেয়। আমাদের অনেক বছর আগের চিকা মারার স্বপ্ন এখন অনেক বড় হয়ে সত্যি সত্যি বাস্তবে রূপ নেবার পথে। বুয়েটের দেয়ালগুলো এখন শুধু আর ইট পাথরের স্তম্ভ নয়, ওরা এখন থেকে গল্প বলে শোনাবে আমাদেরকে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে। আমাদের মা-বোনদের হারানো সম্ভ্রমের ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস, আর তার থেকে জেগে ওঠা কোটি প্রতিবাদের মুঠি, মুক্তির গল্প, আমাদের স্বাধীনতার গল্প। রক্তের মতনই মুক্তির রঙগুলো পৃথিবীর সব দেশেই এক।
চলবে
২| ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৩০
ল্যাটিচুড বলেছেন: আপনার লিখা পড়ে আবেগে আপ্লুত হলাম। দির্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি - আমরা কোন স্বাধীনতার গল্প বলবো ? আমরা কোন গৌরবের গল্প বলবো ?
স্বাধীনতার ৪১ বছর পর,পাক হানাদার ইয়াহিয়, টিক্কার দেশীয় প্রেতাত্মারা আজ - শুধুমাত্র সংবিধানের দোহাই দিয়ে দেশের ৯৯% জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্দে দাড়িয়ে গেছে। এরা আজ পাক হানাদারদের মত যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চায়, এরা জনতার লাশের উপর দাড়িয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়।
আজও প্রতিদিন - নিরাপক্ষ ভোট অধিকারের জন্য রাজপথে যুবককে লাশ হতে হচ্ছে ........
এর নামই কি স্বাধীনতা ?
৩| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ ভোর ৪:২৬
আদনান সাদেক বলেছেন: খুব দুঃখজনক, তাই না!
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, আমার মতে, যে আমরা এই সমস্যা বা জাতীয় লজ্জা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কারও কোন বিকার নেই। এর মানে হল, দেশের কি হল, আদর্শএর কি হল, এইসবে কি আসে যায়!
দেশ নিয়ে আসলে কেউ ভাবে না, এই জন্যই দেশের এই দশা।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:০৩
শরৎ চৌধুরী বলেছেন: বাহ বেশ।+