নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আদনান সাদেক

আদনান সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুয়েট বাস ও একজন মামুর গল্প

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৩

ক্যাফের মামু, বাসের মামু, গেটের মামু, হল ডাইনিঙের মামু - এমন অসংখ্য মামুরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমান্তরালে থেকে আমাদেরকে সামনে এগিয়ে দেন। আমরা এগিয়ে যাই, সফলতা পূর্ণতা- এইসব নিয়ে হিসেব করি। মামুদের জীবন বদলায় না, তারা জীবন যুদ্ধের সেই এক জায়গাতেই আটকা পড়ে যান। এইরকম একজন মামুর গল্প।





বেশ কিছুক্ষণ হল দুইটা সিট দখল করে বসে আছি। সামনে থেকে মেয়েদের জন্য দুটো সারি বাদ দিয়ে তৃতীয় সারির দুটো সিট। আগের বার বাস ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দ্বিতীয় সারি থেকে এক বড় আপু মেয়েদের সীট বলে উঠিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে, পরে দুইজন দুই সারিতে বসে একঘণ্টা পথ বিমর্ষ মুখে কাটিয়েছি।



বুয়েট বাস, যাবে পল্লবী পর্যন্ত। দ্বিতীয়জন, মানে যার জন্য সীট রেখেছি, তার আসার কথা পৌনে পাঁচটার মধ্যে। সময় পার হয়ে গেলেও প্রিয় মুখটির দেখা মেলেনি এখনও। একটু পরেই সবার বাসে ওঠার পালা আরম্ভ হবে, তখন আরেকটা সিট ধরে রাখা ঝামেলা হয়ে যাবে।

-কি মামু, আফায় অহনো আইল না?



বুয়েট বাসের হেল্পার, সবাই তাদেরকে মামু বলে ডাকে। অসম্ভব হাসিখুশি একটা মানুষ। তারমানে মামুও খেয়াল করেছে প্রায়ই আমরা দুজন বাসে করে পল্লবী পর্যন্ত যাই?



আমি ধরা না পড়ার ভান করে ঘড়ির দিকে তাকাই। মামু নিজ থেকেই কথা বলতে থাকে।



- আফায় কি পল্লবী থাকে?

- হু।

- আপনে তো মনে হয় হলে থাকেন?

- হু।

- প্রাত্যেক দিন উনারে দিয়া আসতে যান এত দূরে?

- যাই মামা।

- আফারে একটা ফোন দেন, অখনই গাড়ী ছাইরা দিব।

- চলে আসবে, ফোন দিতে হবে না।



ভেতরে ভেতরে অবশ্য একটু টেনশনে পড়ে গেলাম, আর দশ মিনিট বাস ছাড়তে। টেনশন কমানোর জন্য মামার সাথে গল্প জমালাম।

- আপনি কতদিন ধরে বুয়েটের বাসে কাজ করেন?

- কম না মামু, এই ধরেন তিন বচ্ছর।

- আপনার বয়স কত?

- হইব মনে করেন ছাব্বিশ সাতাইশের মতন।

- বিয়া শাদি করছেন নাকি?

মামার মুখের হাসিটা আরও বড় হয়।

-করসি মামা, একটা মাইয়াও আসে। বয়স এক বচ্ছর।

- শুধু এই বুয়েটের বাসে হেল্পারি করে খরচ চালাতে পারেন?

- চইলা যায় মামা, ঢাকা শহরে একটু কষ্ট হয় আরকি।



বাসের মামুরা কত বেতন পায়, সেই টাকায় কি ছোট মেয়ে নিয়ে সংসার চলে? একবার ভাবি জিজ্ঞেস করি।



-ওই যে, আফায় চইল্লা আইসে।



বাস ছেড়ে দেয় একটু পরেই। নিউমার্কেটে ছুটির সময়ে যা তা জাম লেগে থাকে। একটু পরপর দরজা থেকে মামার চিৎকার শোনা যায়, “এই রিক্সা, এই লাগল, লাগল...”।

একই সাথে চলে বাসের গায়ে হাতের বেদম চাপড়। দুই চাপড় মানে পথ ফাঁকা, এক চাপড় মানে ব্রেক করতে হবে।



চারদিকে ধুলো বালি আর বাড়ি ফিরে আসার তাড়নায় ব্যস্ত মানুষ। জামে আটকে থেকে হুশ হুশ করে বোটকা ধোঁয়া ছাড়ে যন্ত্র দানবেরা। অন্য সময় হলে জামে বসে বড়ই বিরক্তি ধরে যায়। ট্রাফিক পুলিশ আর সিস্টেমের উপর খুব রাগ হয়। তবে বুয়েট বাসে পাশে এক চিলতে নরম আভা নিয়ে ট্রাফিক জামে বসে থাকলে সেটা আর হয় না। বাইরের সব কোলাহল ছাপিয়ে বাতাসে উড়ে আসা এক চিলতে চুলের আলতো ছোঁয়া আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়, কোমল একটা গন্ধ ভুলিয়ে দেয় বাইরের সব কালো ধোঁয়া আর বেঢপ হর্নের শব্দ। কোলে মেলে ধরা বইয়ের নিচে সবার চোখ এড়িয়ে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যায় কয়েকটা আঙ্গুল। আমার বুয়েট জীবনের অসম্ভব প্রিয় একটা সময় কাটে স্বপ্নের মতন।





দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। বুয়েট ছেড়ে চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসে এক সময়। একদিন লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আসতে শুনলাম কেউ যেন ডাকল পাশ থেকে।

- কি মামু, অনেকদিন দেহি নাই বাসে? আফাজান ভাল আছে?

- আরে মামু! আমাদের তো শেষ হয়ে গেছে পড়াশোনা, আর কয়েকটা দিন আছে শুধু আর।

- ও, চইল্লা যাইবেন এক্কেবারে। চাকরি পাইসেন মামু, নাকি বিদেশ যাইবেন?

- এই তো ভিসার জন্য অপেক্ষায় আছি, হয়ে গেলে সামনের মাসেই চলে যাব বাইরে। আপনার মেয়ে কেমন আছে?

- হ আছে বালা, এখন তো ইশকুলে যায়।

- আপনাদের কথা সব সময় মনে থাকবে মামু। সামনের সপ্তাহে আমাদের বিয়ে, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।



মামুকে এই প্রথম একটু অন্যরকম হাসিতে দেখলাম। অন্য আর সব সময়কার মতনই মুখ ভর্তি হাসি, শুধু চোখটা একটু যেন ছলছলে। উনি আমার কাঁধে একবার আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, বালা থাইকেন মামু, দোয়া করি অনেক বড় হন আপনেরা, আল্লায় আপ্নাগো বালা রাখুক।

পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করতে গিয়েও একবার থমকে গেলাম। সব ভালোবাসা টাকা দিয়ে শোধ দেয়া যায় না।





প্রায় ৬-৭ বছর পরে দেশে ফিরেছি ২০১২ তে। সাথে আমাদের ফুটফুটে দুটো মেয়ে। ছোট মেয়েটা এসেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল, তাকে নিয়ে হাসপাতাল ডাক্তার নিয়ে একাকার অবস্থা। তিন সপ্তাহের ছুটি দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসল। বুয়েটে একবার না গেলেই নয়। একদিন বিকেলে বড় মেয়েটাকে নিয়ে বুয়েটে হাঁটতে চলে গেলাম।



ক্যাফের সামনে একা একা বসে আছি। এদিক ওদিক তাকাই যদি চেনা কাউকে চোখে পড়ে। আশে পাশের নতুন তরুণ মুখগুলো দেখতে দেখতে ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসা মাথায় অজান্তেই হাত বুলাই। সময় বয়ে গেছে অনেক এর মাঝে, এদের দেখে বুঝতে পারি।



ছুটির সময় এখন, একটু পরেই বাসগুলো ছেড়ে যাবে। দেখে মনে হল নতুন বাস এসেছে বুয়েটে। কি মনে করে সেই চেনা মামুকে খুঁজলাম, দেখলাম না অবশ্য কোথাও। এত বছর হয়ে গেছে, এখনও কি আর বাসে হেল্পারি করছেন! নিজের মেয়েটাকে দেখে মনে পড়ল, তারও একটা মেয়ে ছিল।



গুম গুম করে স্টার্ট নেয় বাসগুলো। সবাই এখনও সেই আগের মতনই আছে, একদম শেষ সময় হলে তবেই একসাথে তাড়াহুড়ো ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠছে। শেষ বাসটা বেরিয়ে যেতে যেতে পরিষ্কার শুনলাম চেনা সেই কণ্ঠটা। জোরে একটা চাপড় হল বাসের গায়ে।

"এই আস্তে, আরেকজন আছে!"



মানুষটাকে দেখে চিনতে কষ্ট হল। সেই আগের মতনই এখনও হেল্পারই আছেন, আর বাসের গায়ে চাপড় বসাচ্ছেন। দেখতে রোগা হয়ে গেছেন, চোয়াল ভাঙ্গা। এই দশ বছরে কম করেও যেন ৩০ বছর বয়েস বেড়ে গেছে তার। নিজের অজান্তেই নিঃশব্দে একটা হাত উঠে গেল তাকে দেখে।



মামু আমাকে খেয়াল করলেন না। শেষ যাত্রীটা উঠে যেতেই দুটো করে চাপড় বসালেন। এর মানে রাস্তা ফাঁকা। আমার দেখানো হাত আর আমার ভেতর বাইরের সব পরিবর্তনকে উপেক্ষা করেই যেন বাসটা হুস করে চলে গেল ব্যস্ততার সাথে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৯

সাইফুল আজীম বলেছেন: আপনার বুয়েটের বাস মামু আমাকে খুবির বাস মামুর কথা মনে করয়ে দিল।

২| ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৫

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: চলমান বর্তমান- এরই নাম জীবন!!!!

এর মাঝে মাঝে মাঝে স্মৃতির ইতিউতি উড়াউড়ি...অতপর: আবার চলমানতায় হারিয়ে যাওয়া.....


++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.