![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘ক্রসফায়ার’ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। গত এক মাসে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১৬ জন, চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে নিহত হন আরও ৬ জন। নিহতদের বেশিরভাগই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এসব ঘটনায় আতঙ্ক ভর করেছে সাধারণ জনগণের মনেও। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, গভীররাতে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার ও আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টায় অভিযানে বের হওয়ার পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ওৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীদের গুলিবিনিময় হচ্ছে। নিহত হচ্ছেন সুস্থ সবল আসামিরা। এতে পরবর্তিতে অপরাধের বিশদ তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় কালেভদ্রে আহত হচ্ছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও।
অধিকাংশ নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, ধরে নিয়ে অভিযানের নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, অভিযান’কালে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে শুরু করলে আত্মরক্ষার্থে তারাও গুলি ছোড়েন। আইনের প্রতি দৃষ্টি রেখেই গুলি চালায় অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা।
এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসব ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে বরাবরই তা বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। একই সঙ্গে অপরাধ নির্মূলের পাশাপাশি আসামিদের সর্বোচ্চ সুরক্ষার দিকে নজর রাখারও তাগিদ দিচ্ছেন তারা।
অপরাধ বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, যে কোনো অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা মাথায় হেলমেট, শরীরে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটসহ সুরক্ষা পোশাক পরে থাকেন। এটি তাদের মৌলিক অধিকার। অভিযুক্তরাও একই ধরনের সুরক্ষা লাভে অধিকারী। কিন্তু ‘মধ্যরাতের অভিযান’কালে অভিযুক্তদের শুধু হ্যান্ডকাফ ছাড়া কোনো সুরক্ষা পোশাক পরানো হয় না। ফলে দুপক্ষের গোলাগুলিতে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে অভিযুক্তদের। এতে তারা মৌলিক অধিকার ছাড়াও ন্যূনতম সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিযুক্তদেরও পুলিশ-র্যাবের মতো সুরক্ষিতভাবে অভিযানস্থলে নিয়ে গেলে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
গত এক মাসের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অভিযানকালে সুরক্ষিত থাকায় আহত-নিহত হওয়া থেকে বেঁচে যান অভিযানকারীরা। কিন্তু মৌলিক অধিকার (সুরক্ষা) না পেয়ে বিচারের আগেই ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যু হচ্ছে অভিযুক্তদের। এতে স্বজন হারিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে নিহতের পরিবার ও মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন মহল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলছেন। অন্যদিকে বন্দুকযুদ্ধে অভিযুক্তের মৃত্যু হওয়ায় অপরাধের বিশদ তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ জানায়, গত এক মাসে সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭ জন। অর্থাৎ প্রতি দুদিনে একজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে র্যাবের হেফাজতে থাকায় অবস্থায় ৬ জন, পুলিশ হেফাজতে ৫জন এবং যৌথবাহিনীর হেফাজতে একজন নিহত হন। অন্য ৫ জনের মধ্যে ৪ জন পুলিশের গুলিতে ও একজন র্যাবের পিটুনিতে মারা যান।
এছাড়াও গত ৯ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাঠেরপুল এলাকায় ডিবি পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে রাসেল সরদার নামে এক যুবক, ৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ওই এলাকায়ই র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জিহাদ ও রাহাত নামে আরও ২ যুবক, ৭ ফেব্রুয়ারি গভীররাতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জসিম উদ্দিন মুন্সী নামে এক শিবির নেতা নিহত হন। একই রাতে কুমিল্লার কোটবাড়ি থেকে আটকের পর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বের হলে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে স্বপন ওরফে কালা স্বপন ও আটকের পর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানকালে র্যাবের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের কথিত বন্দুকযুদ্ধে যশোরে রাজু ওরফে ভাইপো রাজু নামে একজন নিহত হন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার প্রায় একই কাহিনি। মধ্যরাতে অভিযান, তারপর উভয়পক্ষের গুলিবিনিময়, একপর্যায়ে গ্রেপ্তারকৃত আসামি/আসামিরা গুলিবিদ্ধ। হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান- তারা মৃত। কিন্তু গত ১০ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটলেও র্যাব-পুলিশের কয়জন সদস্য নিহত হয়েছেন?
তিনি আরও বলেন, অভিযানকারীরা যদি জানেন, আসামি/আসামিরা অত্যন্ত শক্তিশালী, ভয়ঙ্কর। দুর্বৃত্তরা ওঁৎ পেতে থাকতে পারে যে কোনো স্থানে, তাহলে তারা যাকে নিয়ে অভিযানে বের হন, বন্দুকযুদ্ধে শুধু তিনিই গুলিবিদ্ধ হন। অন্য দুর্বৃত্তরা পালায় কীভাবে? এলিনা খান বলেন, সংবিধানে সাধারণ মানুষের মতো আসামিদেরও সুরক্ষা দেওয়ার বিধান রয়েছে। আসামিদের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে তা অভিযানকারীরাই নির্ধারণ করবেন। মোদ্দা কথা, বিনাবিচারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আসামির মৃত্যুর ঘটনায় কোনো প্রশ্ন দেখা দিলে এর দায় এড়াতে পারেন না তারা।
তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠলে আমরা যথাযথ তদন্তের দাবি জানাই। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে তদন্ত হয় এমন নজির খুব কম। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে কেউ অভিযুক্ত হলে এবং তাকে বা তাদের বিচারের আওতায় আনা হলে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অনেক কমে যাবে।
কেস স্টাডি
গত ২৫ জানুয়ারি ভোররাতে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন আবুল কালাম ও সুলতান আলী বিশ্বাস। আহত হন র্যাবের দুই সদস্য। এ ঘটনায় র্যাব-৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার জানান, বনশ্রীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজসংলগ্ন সড়কে একটি প্রাইভেটকারে থাকা তিন সন্ত্রাসীকে র্যাবের চেকপোস্টে তল্লাশিকালে তাদের একজন পিস্তল বের করে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় একটি গুলি দায়িত্বরত র্যাব সদস্য সৈনিক মনিরের বুকে লাগে। কিন্তু তিনি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরায় তা শরীর ভেদ করতে পারেনি। তবে আঘাতের কারণে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ সময় আত্মরক্ষার্থে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। দুপক্ষের বন্দুকযুদ্ধের একপর্যায়ে প্রাইভেটকারের দুই আরোহী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। অন্যজন পালিয়ে যান। তবে সুলতানের স্ত্রী সাবিনার অভিযোগ, বন্দুকযুদ্ধের নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তার স্বামীকে।
গত ৩১ জানুয়ারি মধ্যরাতে রাজধানীর রূপনগর বেড়িবাঁধসংলগ্ন এনা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের সামনে মিরপুর থানা পুলিশের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ঢাকা কলেজের ছাত্র ও ছাত্রশিবির নেতা এমদাদুল্লাহ। মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় মিরপুর এলাকা থেকে পেট্রলবোমাসহ আটক করা হয় এমদাদুল্লাহকে। মধ্যরাতে তাকে নিয়ে অভিযানের একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে আসতেই সাদা মাইক্রোবাস থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি, ককটেল ও পেট্রলবোমা ছোড়ে এমদাদের সহযোগীরা। এ সময় সুরক্ষিত থাকায় ২ পুলিশ সদস্য আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। পরে দুই পক্ষে গোলাগুলিতে এমদাদুল্লাহ গাড়ি থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। একসময় পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তদের মাইক্রোবাসটি। পুলিশের এ বক্তব্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন এমদাদুল্লাহর স্বজনরা। তারা অভিযোগ করেন, বাসা থেকে ধরে এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এমদাদুল্লাহকে।
এর আগে ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে রাজধানীর এজিবি কলোনির কাঁচাবাজারের সামনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা ইমরুল কায়েস নিহত হন। ইমরুলের বুকে ১৭টি বুলেটের চিহ্ন ছিল। এর ২৪ ঘণ্টা পর খিলগাঁওয়ের জোড়াপুকুর মাঠের পাশ থেকে শরীরে ১৬টি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনির লাশ। দুটি ঘটনাকেই ‘ক্রসফায়ার’ হিসেবে উল্লেখ করে পুলিশ। কিন্তু জনির স্বজনদের অভিযোগ, আদালতে বিচার হলে জনি নির্দোষ প্রমাণিত হতো। এই আশঙ্কায়ই নাজিমউদ্দিন রোড থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ১৬ ঘণ্টা পর পরিকল্পিতভাবেই কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে কাছ থেকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় জনিকে। একই অভিযোগ করেন পৌর কাউন্সিলর ইমরুল কায়েসের পরিবারও।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান মতে, গত ৫ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩১ দিনে অন্তত ২৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন এবং জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। ২০১৪ সালে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১২৮ জন। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭২। এ ছাড়া ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ৭৫৩ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। আর গত ১০ বছরে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২ সহস্রাধিক ব্যক্তি।
অপরাধ বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনাতেই অভিযুক্তদের শরীরে সুরক্ষা পোশাক থাকলে হয়তো বিচারের আগেই মৃত্যু হতো না তাদের। অভিযোগের মুখোমুখি হতে হতো না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও।
বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি ঘটনায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। নিজেদের ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে আইনের ব্যত্যয় এমনকি আসামিদের সুরক্ষা লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে গুরুত্বসহকারে তা খতিয়ে দেখা হবে।
©somewhere in net ltd.