![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রিয়তম,
সেই কবে আমায় শেষ গালটি টিপে আদর করে দিয়েছিলে মনে পড়ে ? শেষ কবে হাতটি ধরে ধানক্ষেতের আইল ধরে হেঁটেছিলে সেটাও কি মনে পড়ে? একটা পুরানো কবরস্থানের পাশে একদিন আমার ডান হাতটি চেপে ধরে বলেছিলে- " অনুপমা, আমার হবি ? সাক্ষী খোদার আর কেউ কোনোদিন তোকে ছুবে না"। আমিও পাগল মেয়ে , ভেবেছিলাম সাক্ষাৎ ভগবান যেন নেমে এসেছে এই নিষিদ্ধ পল্লী থেকে আমাকে উদ্ধার করতে। আমি তো বেশ্যা ছিলেম আর তুমি কি ছিলে মনে পড়ে? হিন্দুর মেয়ে ছিলেম আমি, তেরো বছর বয়সে বিজন মাস্টারের বাড়ী পড়তে গিইয়েছিলাম পৌষের এক বিকেলে । সেই বিকেলে সাবিনা, আমেনা আর পপিও ছিল আমার সাথে। তবুও মাস্টারের চোখ যেন আমাতেই আটকে ছিল । সবাই চলে গেলো আর মাস্টার আরও অংক বুঝানোর উছিলায় আমাকে থাকতে বলল। আমিও ধন্যি মেয়ে তাই বিশ্বাস করে বসেছিলাম। সেদিন আমার চিৎকার কেউ শুনেনি, আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসলাম। মা বাবা সবাই গাল দিলো আমায় , পাড়ায় রটে গেলো আমার নষ্ট হবার খবর। সালিশ বসলো পরেরদিন । বিচার হলো বটে। বিজন মাস্টার বাবার হাতে শদুয়েক টাকা গুঁজে দিলো ক্ষতিপূরণ । তারপর বউ বাচ্চা নিয়ে চলে গেলো শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে । আর আমারও বিচার হলো । নষ্ট হবার যে কষ্ট আছে সেদিনই বুঝলাম।পুরোহিতরা বলল আমাকে শুদ্ধ হতে হবে। মন্দিরের সেবাদাসী বানিয়ে রাখলো জোর করে। দিনের বেলা পুরনো নদীর পাড় দিয়ে যে বুনোফুলের ঝাড় আছে, সেখান থেকে ঝাঁপি বোঝাই করে ফুল নিয়ে আসতাম দেবীর পায়ে সঁপে দেবার জন্য। আর রাতের বেলা আমার কাজ ছিল দেবতাদের পায়ে নিজেকে সঁপে দেওয়া। ঠাকুর বলেছিল রাতে নাকি দেবতার অবতার তিনি। রোজ রাতে আমার ছোট্ট শরীরটা নিয়ে সেই দেবতা উল্লাসে মেতে উঠতো । কখনও পাশের পাড়ার ঠাকুর মানে আরেক দেবতাও আসতো সেই অর্ঘে ভাগ বসাতে। দানের মেয়ে সবার জন্যই আমোদ ছিল। কি যে কষ্ট হতো মাঝে মাঝে। কখনও দুপুরবেলা বাবা আসতো আর বলতো -" অনু , তোকে শুদ্ধ হতে হবে মা। "
জানতাম না কতদিনে আমি শুদ্ধ হতে পারবো। একদিন প্রবল বিষাদে আচ্ছন্ন হলো মন। মনে পড়ে সেদিন খুব বর্ষা ছিল । আমার গায়ের সাদা শাড়ি বৃষ্টিতে ভিজে একাকার, নাকে সোঁদা গন্ধ লেগে ছিল আমার। সেই এক কাপড়েই হরিপদ কাকার বাটিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে বলেছিলাম সব কথা , বলেছিলাম আমি আর শুদ্ধ হতে চাই না। কোথাও রেখে আসতে বলেছিলাম আমাকে। তাকেই বলেছিলাম কারন বাবার পরে এই কাকাকেই বেশী ভরসা করতাম আমি।তাই উনিও সেই বিশ্বাসের মান রাখলো । রেখে আসলো আমায় নতুন এক পাড়ায়, লোকে যাকে বলে বেশ্যা পাড়া। জানালার শিক ধরে অবাক দৃষ্টিতে তাকে আমি দেখেছিলাম, সেই সাথে দেখেছিলাম এক তাড়ি টাকা গুনতে গুনতে চলে গেলো । আর আমি অনুপমা হয়ে গেলাম বেশ্যা।চার বছর কত কত দেবতার রোজ পূজা করে গেলাম। সে এক অন্যরকম পূজা, এখানে পূজার আগেও স্নান , পরেও তাই। ভেজা চুলে খালি পিঠে কত দেবতার বন্দনাগীত লিখেছি আমি, আর তারাও আগ্রাসী হয়ে শুষে নিতো সব। এমন জীবনে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এমন সময় একদিন আমার দোরগড়ায় তুমি এলে।
আমি যদি বেশ্যা হই তবে তুমি সেদিন কি ছিলে প্রিয়তম ?
তুমি আমার নতুন দেবতা ছিলে যার প্রচণ্ড খোদাভীতি ছিল। তবুও রোজ আসতে আবার যাবার সময় অজু করে তওবা পরতে পরতে যেতে। কখনও নিয়ম ভেঙে ভরদুপুরে উত্তরের কবরস্থানের পিছনে আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে। আমার সতেরো বছরের জীবনে কেউ কোনোদিন কিছু দেয়নি আর তুমি রোজ এটাসেটা নিয়ে এলে। নিজ হাতে আমার পায়ে আলতা পরিয়ে দিতে। একদিন ভুল করে তো "বউ" বলে ডেকে বসলে। আমিও পাগল মেয়ে সেদিন সারাটা বিকেল আকাশকুসুম ভাবনায় ডুবে রইলাম ।সব দেবতার মাঝে কেবল তোমার ছায়া পেতাম। আমিও ভালবেসে ফেললাম তোমায়। হয়তো এখনও বাসি, কামিনীর কাছে এটা শুনার পরও যে তোমার মুখে সে আমার কথা অনেক শুনেছে। বলেছ -" অনুপমা একটা বোকা বেশ্যা মাগী।"
কামিনীর ঘরে এখন তোমার রোজ আনাগোনা , আমিও দূর থেকে দেখি। দেখে ভাবি-" আমার এখনও শুদ্ধ হবার বাকী।''
ইতি
অনুপমা
নিষিদ্ধপল্লী থেকে বলছি
©somewhere in net ltd.