নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জালটাকা

আমি অপেক্ষায় আছি ...................... কিছু অথবা কারও জন্য.............

জালটাকা › বিস্তারিত পোস্টঃ

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কিছু কথা

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ ভোর ৪:০২

২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর করে চট্টগ্রাম ও খুলনা ১৩০০ী২ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং খুলনার লবণচোরাকে বাছাই করা হয়। শুরুতেই চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, সচেতন জনগণ, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে বাতিল হয়ে যায় আনোয়ারা প্রকল্প। কয়লা পরিবহনসহ নানা সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে খুলনা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা নির্ধারিত হয় সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার পশুর নদীর তীরবর্তী স্থান। স্থানীয় ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদের সহযোগিতায় সরকার সহজেই রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।


বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সুন্দরবনের কাছে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমেই এর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিল বন বিভাগ। প্রধান বন সংরক্ষক ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সচিবকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, সুন্দরবন ‘রামসার সাইট’ সুন্দরবনের অংশ যার লিগ্যাল কাস্টোডিয়ান বন অধিদফতর। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং ল্যান্ডস্কেপজোনে এমন কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করা যুক্তিযুক্ত হবে না, যা সুন্দরবন তথা এর রামসার সাইটের জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কয়লাভিত্তিক পাওয়ারপ্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা সমগ্র জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। প্রধান বন সংরক্ষক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রামপালে স্থাপনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান চিঠিতে।


সরকার ২০১১ সালে রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করে। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড’ নির্মাণের অনুমতি দেয়। ১২ এপ্রিল ২০১৩ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ)’ বিষয়ে জনমত পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে পিডিবি। সেটা ছিল নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সরকার বিভিন্ন মহলের আপত্তি আমলে না নিয়ে, বরং কৌশলে সব আয়োজন সম্পন্ন করে পরিবেশ অধিদফতরকে বুঝিয়ে দেয় যে, সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। সুতরাং পরিবেশের ছাড়পত্রটি যেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পক্ষেই দেয়া হয়। আলোচকদের সুপারিশ বা মতামত উপেক্ষা করে ৫ আগস্ট ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদফতর ৫৯টি শর্ত সাপেক্ষে ইআইএ অনুমোদন করেছে। অথচ সুন্দরবনের চার পাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিবেশ অধিদফতর এই এলাকাতেই ১৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। অর্থাৎ সরকার চাইলে পরিবেশের তোয়াক্কা না করে সব ছাড়পত্র বা অনুমোদন কোনো বিষয় নয়।
মানুষের আগ্রাসনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। নির্মাণাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সেই আগ্রাসনে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে এবং সুন্দরবনের জন্য হুমকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী আন্দোলন চলছে। আমরাও সেই আন্দোলনে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট। সুন্দরবনের অংশবিশেষ ‘রামসার এলাকা’। তা ছাড়া ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের বেশ কিছুটা অংশ ইউনেসকোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। উভয় কর্তৃপক্ষ সুন্দরবন সুরক্ষার প্রশ্নে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।


রামসার ও ইউনেসকো উভয় কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উদ্বেগ আমলে নেওয়া হয়নি, এমন অভিযোগ উঠেছে। সে সময় এ প্রকল্পের ওপর প্রদত্ত মতামতে পরিবেশ অধিদপ্তর সরকারকে বলেছে, রামসার এলাকায় সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের ওপর এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ক্ষতিকারক প্রভাবের ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন। বন বিভাগও আপত্তি জানিয়েছে। ২০১১ সালে প্রদত্ত পত্রে প্রধান বন সংরক্ষক সরকারকে বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের বাঘ তথা জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব দেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সরকারকে জানিয়েছে, কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই থেকে সালফার ডাই-অক্সাইড ছড়ানোর কারণে বন্য গাছপালা ধীরে ধীরে মারা যাবে। একই সঙ্গে অ্যাসিড নিঃসরণের কারণে ভূমির উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পাবে। বায়ুদূষণকারী উপাদানগুলো মেঘমালার মাধ্যমে ছড়াবে। নাব্যতা হ্রাস পাওয়া পশুর নদীর সংকট বাড়বে। আলট্রা সুপার থার্মাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এসব কোনো ক্ষতি হবে না, এমন কথা বিজ্ঞানভিত্তিক নয়।

বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়: (ক) রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন ও সেখানকার জীববৈচিত্র্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতিকর—এ প্রশ্নে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। কিন্তু প্রকল্প কর্তৃপক্ষের মতে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর হবে না। (খ) কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে মাত্রায় দূষক উৎপন্ন হয়, তাতে পরিবেশ দূষিত হয়। রামপালেও কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশ দূষিত হবে সত্য। কয়লা পুড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বিষাক্ত গ্যাস ও বিষাক্ত ধাতব পদার্থ মিশ্রিত ছাই উৎপন্ন হবে; এতে পানি ও মাটি দূষিত হবে। এসব দূষণের কারণে সুন্দরবনের জীব ও উদ্ভিদ বিপন্ন হবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তির গুণ ও মানের তারতম্যে উৎপাদিত দূষকের দূষণমাত্রা কম-বেশি হতে পারে। কোন পরিবেশে কতটা দূষণ সহনীয়, তা বড় বিবেচ্য বিষয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এখানেই বিপত্তি। এ প্রকল্পের ‘ইআইএ’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, রামপাল গ্রামীণ আবাসিক এলাকা। এমন এলাকা পরিবেশ স্পর্শকাতর নয়। পরিবেশ স্পর্শকাতর এলাকার তুলনায় এমন এলাকার জন্য সহনীয় দূষণমাত্রা অনেক বেশি। বলা হয়, সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। সুন্দরবন থেকে এমন দূরত্বে অবস্থিত এলাকাও পরিবেশ স্পর্শকাতর এবং পরিবেশগত সংকটাপন্ন, তা বিবেচিত হলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উদ্ভূত দূষকের দূষণমাত্রা ওই এলাকার জন্য অসহনীয় গণ্য হতো। ‘ইআইএ’ প্রতিবেদনে ওই প্রকল্পের জন্য রামপাল অনুপযুক্ত বলে গণ্য হতো। (গ) ওই প্রকল্পের প্রশ্নে রামপাল কেন পরিবেশ স্পর্শকাতর নয়, সে ব্যাপারে যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অভাব রয়েছে। তা ছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনকল্পে প্রস্তাবিত ব্যবস্থাদির ফলাফল হিসেবে গাণিতিক মডেলের যেসব সিমুলেটেড ফলাফল দেখানো হয়েছে, তা বিজ্ঞানভিত্তিক যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে। নৌপথে কয়লা আনা-নেওয়া কারিগরি ও পরিবেশগত বিবেচনায় কতটা যৌক্তিক, তা–ও যাচাই-বাছাই হয়নি। এসব কারণে বিজ্ঞানভিত্তিক না হওয়ায় ‘ইআইএ’ অগ্রহণযোগ্য। তাই বলা যায়, সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিক ভিত্তি আছে।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশবাসী জনপ্রতি মাত্র ৮ ওয়াট বিদ্যুৎ পাবে। এ বিদ্যুতে একটি এনার্জি সেভিং বাল্ব জ্বালানোও কঠিন। এটুকু জ্বালানি নিরাপত্তার কারণে সুন্দরবন কতটা ঝুঁকিতে পড়তে পারে, তা বিদ্যুৎ বিভাগ অনুধাবনে অক্ষম। পরিবেশবাদীসহ রামসার ও ইউনেসকো কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ ও সুপারিশ আমলে নিয়ে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, স্বার্থ-সংঘাতমুক্ত ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য পেশাদার বিশেষজ্ঞ দিয়ে নতুনভাবে ‘ইআইএ’ করানোর জন্য আমরা সরকারকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা মনে করি এবং প্রতিমন্ত্রীও তাঁর আমন্ত্রণপত্রে বলেছেন, সরকার আমাদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার আমাদের এ মতামত বা অনুরোধ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।


রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও প্রকৃত তথ্য
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: “বায়ু প্রবাহ সুন্দরবনের বিপরীত দিকে, সুন্দরবনের উল্টো দিকে প্রবাহিত হবে।”
প্রকৃত তথ্য: বছরে অন্তত চারমাস বাতাস বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর যাই হোক বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তন করার দাবী নিশ্চয়ই কেউ করবেন না! সরকারি ইআইএ রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি– বছরের এই ৪ মাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবে:
“Only during November to February, prevailing wind flows towards South and rest of the year it flows mostly towards North. In most of the time of a year, emissions from power plant shall not reach the Sundarbans except November to February.”(সূত্র: রামপাল ইআএ পৃষ্ঠা- ২৮৪)
সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এই চার মাসই যথেষ্ট। তাছাড়া ঘূর্ণি বাতাস ঝড় ইত্যাদি নানা কারণেই এই চারমাস ছাড়াও বছরের অন্য সময়েও বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ শুধু বায়ুবাহিত নয়, যে বাতাস চার মাস ধরে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবে বলে কেবল চার মাসই পরিবেশ দূষণ ঘটবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানিদূষণ, শব্দদূষণ, ছাইয়ের দূষণ, কয়লা পরিবহণের কারণে দূষণ সারা বছর ধরেই ঘটবে যার সঙ্গে বাতাসের দিকের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: দূষিত বা গরম পানি পশুর নদীতে ফেলা হবে না।
প্রকৃত তথ্য: পশুর নদীতে যে স্বাভাবিকের চেয়ে ২ ডিগ্রী বেশি গরম পানি ফেলা হবে সেটা খোদ কোম্পানি স্বীকার করছে। সূত্র:http://www.prothom-alo.com/opinion/... প্রকৃত পক্ষে আরো বেশি গরম পানি ফেলার আশংকা রয়েছে কারণ কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র বিষয়ে জাইকার একটি রিপোর্টে থার্মাল ইফ্লুয়েন্ট নির্গমনের ফলে পানির তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং এর ফলে মাছের ক্ষতি হওয়ার কথা উল্ল্যেখ করা হয়েছে। সূত্র:http://open_jicareport.jica.go.jp/pdf/12233847.pdf
আর ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে দূষিত পানি পরিশোধন করে নদীতে নির্গমনের কথা বলা হলেও কার্যকারিতা নিয়ে আশংকা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৭২ টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৮৮টি থেকে নদীতে পানি নির্গমনের বেলায় আর্সেনিক, বোরন, কেডমিয়াম, সীসা, পারদ এবং সেলিনিয়ামের কোন সীমা বা মাত্রা মেনে চলা হয় না। (সূত্র:http://action.sierraclub.org/site/DocServer/ClosingTheFloodgates-Final.pdf?_ga=1.209408273.2015114875.1470569568)
নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা, কেনটাকি, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও সহ ১০টি রাজ্যের ২১টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নদী ও জলাভূমিতে ফেডারেল ড্রিংকিং স্ট্র্যান্ডার্ডের চেয়ে ১৮গুণ বেশি আর্সেনিক সম্পন্ন পানি নির্গত করেছে। আর ঢাকার নদীগুলোতে প্রতিদিন ৯০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোন ধরণের পরিশোধন ছাড়াই ডিসচার্জ করা হয়। ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা হয় না, কারণ প্রতিঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে ৩০ টাকা করে লাগে!(সূত্র: বণিক বার্তা, ২ এপ্রিল, ২০১৬) শুধু বেসরকারি কারখানা্ নয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) ১৪টি কলকারখানার ১০টিতেই নেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা। সাতটিতে নেই কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি)। আর পাঁচটি কারখানার কোনো পরিবেশ ছাড়পত্রই নেই। গত মে মাসে পরিবেশ অধিদপ্তরের তৈরি করা প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।সূত্র: Click This Link এইরকম একটা অবস্থায় কিভাবে ভরসা রাখা যেতে পারে যে, ঢাকা থেকে বহু দূরে সুন্দরবনের প্রান্তে ঠিকঠাক মতো পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলা হবে!
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: (বনাঞ্চলের ২৫ কিমি এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করা বিষয়ে ভারতের গাইড লাইন প্রসঙ্গে) “ভারতের মতো বিশাল দেশের সাথে তুলনা করা আমাদের খাটে না”
প্রকৃত তথ্য: কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ কোন দেশের আয়তনের উপর নির্ভর করেনা অর্থাৎ দেশের আয়তন বড় হলে দূষণ বেশি হবে আর আয়তন কম হলে দূষণ কম হবে এরকম মনে করার কোন যুক্তি নেই। ফলে ভারতে ২৫ কিমি সীমার মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি নিরাপদ না হয় তাহলে বাংলাদেশ ছোট দেশ হওয়ার কারণে সেই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরাপদ হয়ে যাবে- এটা কোন যুক্তি হতে পারেনা। বরং ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি ও বনাঞ্চল-নদী-কৃষি-জীবন-জীবিকা ইত্যাদি জালের মতো পরস্পরের ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকার কারণে এখানে বরং ক্ষতি আরো বেশি হওয়ার কথা, সেই কারণে ভারত থেকে আরো বেশি সাবধান হওয়া দরকার।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: কয়লা পরিবহনের বেলায় শব্দ আলো দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হবে, কাভার্ড বার্জে করে কয়লা পরিবহন করা হবে।
প্রকৃত তথ্য: রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার জাহাজ চলাচলের ফলে সুন্দরবনের যে বিপদ সম্পর্কে আমরা এতদিন ধরে বলে আসছি, খোদ কোল ট্রান্সপোর্ট ইআইএ রিপোর্টেও তার অনেকগুলোই উঠে এসেছে: যেমন- জাহাজ থেকে কয়লার গুড়ো ও ধুলা ছড়ানো, জাহাজ ডুবে তেল ও কয়লা ছড়ানো, কয়লার জাহাজ থেকে বর্জ্য নি:সরণ, আলো দূষণ, জাহাজ রুটের মধ্যে থাকা ডলফিন অভয়ারণ্য সহ বিপন্ন প্রায় বণ্য প্রাণী আরো বিপন্ন হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ইআইএ রিপোর্টে এইসব ক্ষতি ও ঝুকি মোকাবেলার জন্য দায়সারা ভাবে আইএমও কনভেনশান মেনে চলার কথা বলা হয়েছে, কয়লার জাহাজ ধীরে চালানোর কথা বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় সিটি না বাজানোর কথা বলা হয়েছে, জাহাজের বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলার কথা বলা হয়েছে, কয়লার স্বপ্রজ্জ্বলন এড়ানোর জন্য অগ্নি প্রতিরোধক পিচ্ছিলকারক ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে… যেগুলোর ব্যবহার ও বাস্তবায়ন ভীষণ অনিশ্চিত।সবচেয়ে বড় কথা এগুলো বাস্তবায়িত হলেও সুন্দরবনের বিপদ কমবেনা কারণ- জাহাজ চলাচল করলে দুর্ঘটনা ও দূষণের ঝুকি থাকবেই, জাহাজ চলাচল রুটের ডলফিন অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবেই, জাহাজের ঢেউ, শব্দ, আলো ইত্যাদির মাধ্যমে জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হবেই।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বিদ্যুৎকেন্দ্রের শব্দ ১৪ কিমি দূরে যাবে কি ভাবে?
প্রকৃত তথ্য: বিদ্যুৎকেন্দ্রের শব্দ ১৪ কিমি দূরে সুন্দরবনের মধ্যে যাবে না কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহজে করে যে কয়লা পরিবহন করা হবে, কয়লা লোড আনলোড করা হবে, ড্রেজিং করা হবে তার ফলে সুন্দরবনের মধ্যে শব্দ দূষণ ঘটবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বিদ্যুতের দাম ৮.৮৫ টাকা সঠিক তথ্য নয়। প্রকৃত তথ্য: প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম আট টাকা উপরে সরকারি রিপোর্টেই বলা হয়েছিলো এবং সে সময় এফজিডির মতো ব্যয়বহুল টেকনোলজি ব্যবহার ছাড়াই এই হিসেবটি করা হয়েছিলো। ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে।
the cost of electricity production has been estimated as BDT. 8.49 per kwh for first full year and BDT. 8.04 per kwh for levelised cost of energy. (সূত্র: রামপাল ইআইএ পৃষ্ঠা-৪১৩)
সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে সুন্দরবনকে ঝুকিতে ফেলে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, তাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকী লাগবে। Institute of Energy Economics & Financial Analysis এর হিসেব অনুসারে ভর্তুকী না দিলে ইউনিট প্রতি খরচ পড়বে ৯.৫৪ টাকা!
The Rampal power plant would require a levelized tariff of Tk9.54/kWh (US12.1c/kWh) in the absence of any subsidies. সূত্র:http://ieefa.org/wp-content/uploads/2016/06/Risky-and-Over-Subsidised-A-Financial-Analysis-of-the-Rampal-Power-Plant-_June-2016.pdf
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: ”বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেখানকার মানুষের বর্তমান পেশা সুন্দরবন থেকে চুরি করে গাছ কাটা, গাছ কাটতে গিয়ে বাঘের পেটে যাওয়া”
প্রকৃত তথ্য: এটা সুন্দরবনের চারপাশে থাকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিদারুণ অপমানজনক এবং অসত্য একটি কথা। বাস্তবে দরিদ্র জনগণ অর্থাৎ মৌওয়াল, বাওয়ালি, জেলেসহ সুন্দরবন অঞ্চলের দরিদ্র জনগণ সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেমের অংশ হিসেবে যুগ যুগ ধরে সুন্দরবনের সঙ্গে সহাবস্থান করছে। সুন্দরবনের আসল বিপদ হল বিভিন্ন লুটেরা কর্তৃক সুন্দরবনের গাছ লুট, বাঘ-হরিণ শিকার, বন্যপ্রাণি পাচারসহ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো কথিত উন্নয়ন প্রকল্প যেসবের হাত থেকে প্রিয় বনবিবিকে রক্ষা করতে সুন্দরবনের দরিদ্র মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই করছে। আর ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পর্যায়ে ৪ হাজার অস্থায়ী কর্মসংস্থান এবং পরিচালনা পর্যায়ে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬০০ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় মূলত কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন লোকের কর্মসংস্থান হয় বলে এসব কর্মসংস্থানের খুব সামান্যই স্থানীয় জনগণের ভাগ্যে জুটবে। চার থেকে সাড়ে চার বছরের নির্মাণ পর্যায়ে বড় জোর মাটি কাটা, মালামাল পরিবহণ, নির্মাণ কাজের শ্রমিক ইত্যাদি কিছু অস্থায়ী মজুরি ভিত্তিক কর্মসংস্থান জুটতে পারে স্থানীয় কিছু মানুষের। কিন্তু পরিচালনা পর্যায়ে যে ৬০০ কর্মসংস্থান হবে তার বেশিরভাগই কারিগরী হওয়ার কারণে সেখানে খুব কম সংখ্যক স্থানীয় মানুষেরই কাজ জুটবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও চালু হলে কি পরিস্থিতি হবে তার লক্ষণ কিন্তু এখনই ধরা পড়ছে। কৃষি জমি থেকে যাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের পরিস্থিতি কি? তাদের কি অনেক উন্নয়ণ হয়েছে? সাপমারী ও কৈগরদাসকাঠী মৌজায় ৮টি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের ২ হাজার পরিবার এই প্রকল্পের কারণে ইতিমধ্যেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে মাটি পানি বাতাস মারত্মক দূষিত হয়ে সুন্দরবন ও তার চারপাশের জলাভূমির উপর নির্ভরশীল জেলে, কৃষক, বাওয়ালী, মউয়াল সহ কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। উদাহরণ স্বরুপ মৎসজীবিদের জীবিকা বিনষ্ট হওয়ার কথা খোদ কোল ট্রান্সপোর্ট্ ইআইএ রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে:
“স্থানীয়দের জীবিকার উপর প্রভাবঃ কয়লা পরিবহনের ফলে পশুর নদীতে নৌচলাচল বৃদ্ধি পাবে। ফলে নৌপথে জেলের মাছ ধরতে পারবে না। ফলে তাদের কিছু অসুবিধায় পড়তে হবে যদি নৌপথে মাছ ধরা নিষিদ্ধ [হয়]।”(কোল ট্রান্সপোর্ট ইআইএ সামারি, পৃষ্ঠা-৪) Click This Link
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। উন্নত প্রযুক্তি অসম্ভবকে সম্ভব করে। রিয়েলটাইম মনিটরিং এর ব্যবস্থা থাকবে। ইএসপি এফজিডি উচু চিমনী ব্যবহার করা হবে।
প্রকৃত তথ্য: কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুষণ বিষয়টা এরকম যে কোন টেকনোলজি ব্যবহার করেই সেই দূষণ শতভাগ দূর করা যায় না। উদাহরণ স্বরুপ এফজিডির কথাই ধারা যাক। এফজিডি ব্যবহারে করে বিপুল অর্থ ব্যায়ের মাধ্যমে বাতাস থেকে সালফার অপসারণ করা সম্ভব হলেও তার ফলে পানি দূষণ বেড়ে যায়। এফজিডি বা স্ক্রাবার ব্যবহারের বিপদ হলো-কয়লা ও লাইমস্টোন থেকে ‘এফজিডি ওয়েস্ট ওয়াটার’এ চলে আসা দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ( ক্লোরাইড, সালফেট, বাইকার্বনেট), ভাসমান কঠিন পদার্থ(জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ), অ্যামোনিয়া, বিষাক্ত ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, মার্কারি, সেলেনিয়াম, বোরন ইত্যাদি। ব্যবহৃত কয়লা ও লাইমস্টোনের ধরণ অনুযায়ী এসবের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয় বলে এসব পরিশোধণের কোন একক “ওয়ান-সাইজ-ফিট-ফর-অল” পদ্ধতি নেই, এগুলো পরিশোধন করাও দূরহ ও ব্যয়সাপেক্ষ। (সূত্র: Click This Link) নিউইয়র্ক টাইমসের Cleansing the Air at the Expense of Waterways শীর্ষক রিপোর্ট অনুসারে (লিংক: Click This Link) বায়ু দূষণমুক্ত করার জন্য স্ক্রাবার ব্যবহার করা হবে জেনে ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভিনিয়ার হ্যাটফিল্ড’স ফেরী(Hatfield’s Ferry) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের ভুক্তভোগীরা খুশীই হয়েছিলেন। কিন্তু তারা দেখলেন স্ক্রাবার ব্যবহার করার ফলে বাতাস কিছুটা দূষণ মুক্ত হচ্ছে, কিন্তু তার বদলে দূষিত হচ্ছে পানি! এ প্রকৃয়ায় সৃষ্ট বিপুল পরিমাণ তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী মননগাহেলা( Monongahela) নদীতে যে নদী ৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের খাওয়ার পানির যোগান দেয়। তাইতো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫ মাইল বা ২৪ কিমি দূরে বসবাসকারি ফিলিপ কোলম্যানের উপলব্ধি- “মনে হচ্ছে তারা আমাদেরকে নি:শ্বাসের মাধ্যমে বিষ গ্রহণ থেকে মুক্তি দিয়েছে, বিনিমিয়ে আমাদেরকে সেই বিষ পানির সাথে পান করতে হচ্ছে।”( সুন্দরবনের দূরত্ব কিন্তু ১৪ কিমি এবং পশুর নদী ঠিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশ দিয়ে গেছে!)
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বড় পুকুরিয়ায় সাবক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন ক্ষতি হচ্ছে এরকম কথা একবারও কেউ লিখতে পারে নাই।
প্রকৃত তথ্য: এই বক্তব্যরে মধ্যে অনকেগুলো ভুল ধারণা আছ। প্রথমত, আমরা জানি না কোন সমীক্ষার ভিত্তিতে তিনি এই কথা বলছেন।বাস্তবে কেউ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে গেলেই দেখতে পাবেন পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ উদাহরণ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশের কৃষিজমি কয়লা দূষণে রীতিমত কালো রঙ ধারণ করেছে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে গেছে, ছাইয়ের পুকুরে গাদা করে রাখা বিদুৎ কেন্দ্রের ছাই পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। ২০১৪ সালে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি থেকে গবেষণা হয় বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে। গবেষণা থেকে দেখা যায়-
১)কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ঘন্টায় ৯ ঘনমিটার হারে দূষিত পানি নিকটস্থ তিলাই নদীতে ডিসচার্জ করা হচ্ছে কোন ধরণের পরিশোধন ছাড়াই;
২)ছাইয়ের পুকুরে থাকা তরল বর্জ্যে অতিরিক্ত বোরন, আর্সেনিক, পারদ পাওয়া গেছে যা চুইয়ে মাটিতে মিসছে যার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে এবং ক্রমশ ব্যবহারের অনুপযোগি হচ্ছে;
৩)বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইড ও ধুলোকণার ইমিশনের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি;
৪)আশপাশের ১৪ শতাংশ মানুষ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে অ্যাজমা, এলার্জি, চর্মরোগ সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। গবেষকদল নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকের সাথে কথা বললে তারাও বলেছেন ২০০৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর থেকে এইসকল অসুখ বেড়েছে।
৫) ফ্লাই অ্যাশের কারণে আশপাশের মাটির ক্ষারত্ব বেড়ে গেছে যা মাটিতে বসবাসকারী কেচোর জন্য ক্ষতিকর।
৬)৪৭.৩৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ফসলের উৎপাদন হ্রাস, বাতাসে ও গাছের পাতায় ছাইয়ের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। Click This Link
দ্বিতীয়ত, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনা করাই সঠিক নয়। কারণ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছোট আকারের এবং বড়পুকুরিয়ার পাশে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর বনাঞ্চল নেই। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট যার মধ্যে আবার কার্যত ১২৫ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটই কেবল চালু থাকে। অথচ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট যা বড়পুকুরিয়ার কার্যকর (১২৫ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ গুণেরও বেশি। ফলে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে তার দশগুণেরও বেশি ক্ষতি হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বড় পুকুরিয়ায় জমি উর্বর হচ্ছে, ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।(বেগুন ক্ষেতে ছাই ছিটিয়ে জমি উর্বর করার উদাহরণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী)
প্রকৃত তথ্য: প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত কাঠ পুড়িয়ে তৈরী জৈব ছাই এবং খনিজ কয়লা পুড়িয়ে তৈরী ছাইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নন। কয়লা পুড়িয়ে তৈরী ছাই বিষাক্ত বলে এই ছাইয়ের মাধ্যমে জমি উর্বর করার চিন্তা বিপদজনক। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রাণলয়ের এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটি গত ৬-৭ ডিসেম্বর ২০১০ এ কৃষি জমিতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলে:
“Regarding use of Fly Ash in agriculture, the Committee also expressed its strong reservations considering that the available information is limited and not supported by long term scientific study. Considering that fly ash is reported to contain about 48 elements including radioactive elements and toxic heavy metals (in mild dose), the Committee advocated that unless scientific study rules out long term adverse health impacts, as such, this method of fly ash disposal shall not be resorted to.”
বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ফসলের ফলন বাড়ছে কথাটি সঠিক নয়। সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের কারণে কয়েক আশপাশের কয়েক কিমি এলাকার নারিকেল গাছে এখন আর নারিকেল হয় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ভূগর্ভের পানি নীচে নেমে যাওয়ার কারণে পানি সংকট ও স্থানীয় জনগণের অসন্তোষের খবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বরাবর বিশেষ সংস্থা থেকে চিঠি দিয়ে পর্যন্ত জানানো হয়েছে।


প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: পৃথিবীর বহু দেশে শহরের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যেগুলো থেকে কোন ক্ষতি হচ্ছে না
প্রকৃত তথ্য: প্রধানমন্ত্রী ভারতের সাথে বাংলাদেশের তুলনা দিতে রাজী নন, কিন্তু কঠোর পরিবেশ আইন মেনে চলা হয় এরকম দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনা কিন্তু ঠিকই দিলেন। অথচ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো, যেসব দূষণ কারিগরি ভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করা হয় না যেকারণে বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষা কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ঘনমিটার পানি পরিশোধণ না করেই ফেলা হয়। আরেকটা মুশকিল হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই দূষণ হচ্ছে কি হচ্ছে না। সব গাছ পালা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণে সমান ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হয় না। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে গাছপালা থাকা মানেই যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে কোন ক্ষতি হচ্ছে না- এরকম ধরে নেয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী যে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলেছেন সেগুলো সম্পর্কে খোজ খবর করলেই দেখা যাবে সেগুলোর প্রকৃত অবস্থা কি। যেমন: ইউসেস্কো ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট হা লং বে’র পাশ্ববর্তী ভিয়েতনামের Quang Ninh কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বন্যা ও জলোচ্ছাসের সময় বিপুল পরিমাণ কয়লা দিয়েন দিয়েন ভং নদীতে ভেসে গেছে, ব্যাপক নদী দূষণ ঘটেছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ আরো কিছু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হা লং বে’ও মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে।

সূত্র: Click This Link Click This Link শহরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলে আশপাশে কি ধরণের সমস্যা হতে পারে তার নজির Quang Ninh প্রদেশে যথেষ্টই রয়েছে। the pollutants started to flow into the Cam River days after the plant opened. Dust generated by the plant also blankets the area, choking residents.... বিস্তারিত দেখুন এখানে: Click This Link
ছবিতে যেমনই দেখা যাক, তাইওয়ানের Taichung কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দুনিয়ার অন্যতম দূষণকারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বলা হয়। এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে তাইওয়ানের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে বায়ু দূষণ এত বেড়েছে যে এক পর্যায়ে আন্দোলনের মুখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। Click This Link Click This Link
[এই লেখায় কেবল কারিগরী দিকগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।]

গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন
গত ৫ সেপ্টেম্বর একটি পত্রিকায় রামপালবিষয়ক একটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘আনসার টু সাম কন্ট্রোভার্সিস’ শিরোনামে। ঋণের গ্যারান্টার থেকে শুরু করে সব প্রশ্নে শেষ কথাটি সরকারি কর্মকর্তাদের হওয়ায় তা অনেক ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা করে প্রকৃত চিত্র উপস্থাপনের জন্যই এ লেখা।
প্রথমত, রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কম্পানি মারফত। এ প্রকল্পে বাংলাদেশ ১৫ শতাংশ ও ভারত ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করবে। বাকি ৭০ শতাংশ ঋণ করা হবে। এই ঋণের গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ। অর্থাৎ কোনো কারণে প্রকল্প বাতিল হলে বা ঋণের কিস্তি দিতে কম্পানি ব্যর্থ হলে তার দায় নেবে বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের লাভ ৫০ শতাংশ করে ভাগ হবে। এ ছাড়া ঠিকাদারি কাজ, কয়লা সরবরাহ ব্যবসা ইত্যাদিও পাবে ভারত। এর আগে কেবল সরকারি প্রকল্পেই বাংলাদেশ এ রকম সর্ভেন্টি দিত। এর ব্যাখ্যায় সরকারি কর্মকর্তারা যা বলছেন তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকল্প বাংলাদেশে হবে বলে বাংলাদেশকেই সর্ভেন্টি দিতে হবে, এমন কোনো ব্যাপার আসলে নেই। বরং মালিকানা-লাভ সবই যেহেতু ভাগাভাগির, কাজেই এটাও যৌথভাবে হওয়াই যুক্তিযুক্ত। উপরন্তু এখানে কয়লা আনার ঠিকাদারি, অন্যান্য ব্যবসার ঠিকাদারি, এমনকি নিম্নমানের কয়লা বেচার সুযোগ সবই পাচ্ছে ভারত। বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে বাংলাদেশ, অতএব তারই দায় নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ কিন্তু বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে না, বরং বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে নেবে। কাজেই এ যুক্তি অবান্তর। বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা ঋণ দিতে রাজি হয়নি শুধু সর্ভেন্টির অভাবে, তথ্যটাও সত্য নয়। অনেকে এটা দিতে রাজি হয়নি, এতে সুন্দরবনের ওপর বিরূপ প্রভাব বিবেচনায়। এ সত্যকে আড়াল করা হয়েছে। আর এরপর অন্যান্য চুক্তিতেও বাংলাদেশের গ্যারান্টার হওয়াটা একটা ভুলের লেজ ধরে আরো ভুল করে যাওয়া এবং এক ভুলকে অন্য ভুল দিয়ে সিদ্ধ করারই ধ্রুপদী উদাহরণ।
দ্বিতীয়ত, ১.৪৯ বিলিয়নের প্রকল্পে কোনো ঝুঁকি না নিয়েই এনটিপিসির মুনাফার দীর্ঘমেয়াদি ভাগীদার হওয়া ও অর্ধেক নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার উত্তর সবচেয়ে হাস্যকর। তাঁরা বলেছেন, এটা বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে তাদের দেওয়া হচ্ছে। যখন দুই পক্ষ একটি ব্যবসায়িক চুক্তি করে তখন সবাই চেষ্টা করে নিজের পক্ষে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে। এ রকম বন্ধুত্বের যুক্তি বোধ হয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেই অনন্য। এরপর তারা যুক্ত করেছেন এনটিপিসির কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা ও সেই অভিজ্ঞতা থেকে শেখার প্রশ্ন। এনটিপিসি অভিজ্ঞ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এনটিপিসির অভিজ্ঞতাটা কী রকম সেটাও জানা থাকা জরুরি। ভারতের এনটিপিসি কম্পানি সবচেয়ে দূষণকারী কম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারতের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের গবেষণা অনুসারে এনটিপিসির বরদপুর বিদ্যুেকন্দ্র ছিল গবেষণা চালানো বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষণ সৃষ্টিকারী। গবেষণা চালানো ৪২টি বিদ্যুেকন্দ্রের মধ্যে ছয়টি ছিল এনটিপিসির—যাদের সর্বোচ্চ অর্জিত নম্বর ছিল ২৮, যেখানে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৮০। এ রকম দূষণের চ্যাম্পিয়ন কম্পানিকে সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুেকন্দ্র করতে দিয়ে তারপর তার কাছ থেকে দূষণহীন বিদ্যুেকন্দ্র আশা করাটা রাজাকারের কাছে দেশপ্রেম শিক্ষার মতোই।
তৃতীয়ত, উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ৮-৮.৮৫ টাকা, যা দেশে কয়লাভিত্তিক অন্যান্য বিদ্যুেকন্দ্রের দ্বিগুণেরও বেশি। যেমন পুরনো মেঘনা ঘাটের বিদ্যুেকন্দ্রে বিদ্যুতের দাম ২.৩ টাকা, ওরিয়ন বা এস আলম গ্রুপের বিদ্যুেকন্দ্রের বিদ্যুতের দাম ৩.৫ টাকা। এমনকি ভারত থেকে এখন যে দামে (৫.৫-৬ টাকা) বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় তার চেয়েও বেশি। এ বিদ্যুেকন্দ্রের বিদ্যুতের দাম যখন ধরা হয় তখন দূষণরোধে ব্যবস্থা, কয়লার মান, সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ইত্যাদি ধরা হয়েছে ইআইএ অনুযায়ী। সরকারপক্ষের লোকজন দাবি করছে, নাগরিকদের প্রতিবাদের কারণে সরকার এখন দূষণরোধে নতুন নতুন ব্যবস্থা নিচ্ছে। যেমন এফজিডি ব্যবহার করছে, এসসিআর ব্যবহার করবে, মার্কারি দূর করার ব্যবস্থা করবে ইত্যাদি। এসসিআর করলে মোট খরচের ২ শতাংশ বাড়বে, এফজিডি করলে ১২ শতাংশ বাড়বে আর মার্কারি দূর করার প্রযুক্তি চালু করলে বয়লারপ্রতি তার স্থাপনা খরচ ৬.২ মিলিয়ন ডলার আর পরিচালনা ব্যয় ছয় লাখ ৭৪ হাজার ডলার পড়বে প্রতিবছর। ফলে সরকারপক্ষের বিভিন্ন ব্যক্তি যেসব কথা বলেছেন, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তো এসব খরচ যোগ করার পর বিদ্যুতের দাম আরো বাড়ার কথা। সে ক্ষেত্রে উদ্ধৃত কর্মকর্তা কিসের ভিত্তিতে বলছেন যে দাম কমবে?
চতুর্থত, ইআইএতে বলা আছে, ড্রেজিং করতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে ড্রেজিং নিয়মিতই করা হয়, কয়লার জাহাজ আসতে হলে ড্রেজিং করতে হবে, সেটা এ পর্যন্ত সবাই বলছেন। কিন্তু উদ্ধৃত কর্মকর্তা কিসের ভিত্তিতে ড্রেজিং না করেও কয়লা আনা সম্ভব বলছেন সেটা পরিষ্কার নয়। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসারে এখানে কয়লা পরিবহনের জন্য ড্রেজিং করতে হবে, যার ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ সুন্দরবনের ভেতরে। এ অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ইরাবতি ও গাঙ্গেয় ডলফিন, নোনা পানির কুমিরসহ অন্যান্য বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বসবাস। ড্রেজিংয়ের ফলে এদের বসবাস প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
পঞ্চমত, এনটিপিসি ১২ থেকে ১৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করে প্রতিবছর। এটাকে আনা-নেওয়া করার সময় দুর্ঘটনা না ঘটার গ্যারান্টি হিসেবে যেভাবে বলা হয়েছে তাতে বলতেই হয়, ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ তত্ত্বেই তার আস্থা শতভাগ। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পে বছরে কয়লা লাগবে ৪৭ লাখ মেট্রিক টন। এই কয়লা বড় যেসব জাহাজে আসবে সেগুলোকে সমুদ্রের ভেতর থেকেই নোঙর করে ছোট ছোট জাহাজে বা লাইটার জাহাজে করে আক্রাম পয়েন্ট থেকে রামপালে নিয়ে আসতে হবে। একটি বড় জাহাজে কয়লা আসবে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ এ রকম ১০০টি বড় জাহাজে কয়লা নিয়ে আসতে হবে, যেগুলো খালি করতে আবার প্রায় চার হাজার লাইটার জাহাজ লাগবে। সেই চার হাজার জাহাজ আবার রামপালে এই কয়লা আনলোড করবে।
এই বিপুলসংখ্যক জাহাজ চলাচলের ফলে তেল, কয়লা, ধোঁয়ার মাধ্যমে দূষণ হবে। এরপর আসে কয়লা লোড-আনলোড করার সময় দূষণের প্রশ্ন। এই কয়লা লোড-আনলোড করার সময় বাতাসে কার্বনের কণা ছড়িয়ে পড়ে, পানি দূষিত হয় বিপুল পরিমাণে। কয়লার কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ হার কমাবে। এ ছাড়া আছে এই জাহাজগুলোর শব্দ-আলো। সুন্দরবনের নীরব পরিবেশে এগুলো বন্য প্রাণীর জন্য বড় অসুবিধার কারণ হবে। ফলে নানাভাবে এই প্রভাব কমিয়ে দেখানোর যে চেষ্টা আগে থেকেই জারি আছে রিপোর্টে উদ্ধৃত কর্মকর্তা তার চেয়ে নতুন কিছু বলেননি এ ক্ষেত্রে।
ষষ্ঠত, ফ্লাই অ্যাশ ও মার্কারির ব্যাপারে উদ্ধৃত কর্মকর্তা যা বলেছেন, এরই মধ্যে সরকারি বিভিন্ন ব্যক্তি যা বলেছেন তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে যেসব কথা বলেছেন তার সঙ্গেও মেলে না। যেমন প্রধানমন্ত্রী এফজিডি দিয়ে মার্কারি দূর করার কথা বলেছেন, তিনি বলছেন ইএসপি দিয়ে করার কথা। আসলে ইএসপি অন্যান্য ক্ষুদ্র কণা কমালেও মার্কারি দূর করতে তেমন কার্যকর নয়। এমনকি এফজিডিও মার্কারি দূর করতে খুব কার্যকর নয়। এফজিডি, এসসিআর ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা কম্পানির প্রচারপত্রে বলা হয়েছে অথচ ইআইএতে নেই; সেগুলোর কথাও এই কর্মকর্তা উল্লেখ না করার কারণ আসলে কী? তাহলে কি সেগুলো শুধু বিজ্ঞাপন, বাস্তবে ব্যবহার করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই? আর ছাই বিষয়ে চাহিদার কথাটার পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ এখনো পর্যন্ত কেউই দেখাননি। ছাই সব বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথাটা আসলে কোনো দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। বরং বড় পুকুরিয়ার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ছাই বিক্রি হয়নি। কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই বিষাক্ত এবং অন্যত্র ব্যবহারও নিরাপদ নয়। সিমেন্ট কম্পানিগুলোকেও আপনারা দেখবেন ফ্লাই অ্যাশবিহীন সিমেন্টের বিজ্ঞাপন দিতে।
আসলে এসব কথার আড়ালে ভয়ংকর ফাঁকি আছে। রামপাল বিদ্যুেকন্দ্রে দৈনিক ১৪২ টন সালফার অক্সাইড, ৮৫ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড ও বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড উত্পন্ন হবে। সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইড বাতাসের অন্যান্য উপাদান ও পানির সঙ্গে মিশে এসিড রেইন তৈরি করবে, যা সরাসরি গাছের ক্ষতি করবে, আবার মাটির পুষ্টিগুণ নষ্ট করেও ক্ষতি করবে। কার্বন ডাই-অক্সাইড বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করবে, যার রয়েছে বহুমাত্রিক প্রভাব। এটা ফ্লাই অ্যাশ ও বটম অ্যাশের জন্ম দেবে, যার ভেতরে বহু বিষাক্ত ভারী ধাতু মিশে থাকে। এখান থেকে যে বিপুল পরিমাণ মার্কারি উৎপাদিত হবে তা বিরাট এলাকা দূষিত করতে সক্ষম। মার্কারির বিষক্রিয়া ভয়ংকর, এটা খাদ্যশৃঙ্খলের যতই ওপরের দিকে উঠতে থাকে তার ঘনত্বও বাড়তে থাকে। কয়লায় যে মিথাইল মার্কারি ও মার্কারি ক্লোরাইড থাকে তা মানুষের ক্যান্সারের কারণ।
কম্পানি নাইট্রোজেন অক্সাইড দূর করার জন্য যে লো নাইট্রোজেন অক্সাইড টি বার্নার ব্যবহার করার কথা বলছে, তা ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির তথ্য মতে ৩৭ শতাংশ নাইট্রোজেন অক্সাইড কমাতে পারে। অথচ সরকারি ইআইএ দাবি করেছে ৮৭ শতাংশ কমাতে পারার কথা। এর ফলে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন গ্যাস নিঃসরণ হবে তা সুন্দরবনের বর্তমান পরিমাণকে ১২ গুণ বাড়াবে, এমনকি বসতি এলাকার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়েও তা তিন গুণ বেশি। সালফার ডাই-অক্সাইড দূর করার জন্য যে এসজিডি ব্যবহার করা হবে বলে বলা হচ্ছে, তা বাতাসে সালফার কমালেও পানিতে তার পরিমাণ বাড়াবে। মার্কারি দূষণ রোধ করার জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সালফার দূর করতে গিয়ে যেটুকু মার্কারি দূর হবে তাকেই ৯০ শতাংশ দূর হবে বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৯০ শতাংশ দূর করার জন্য যে পাওয়ারড অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ব্যবহার করতে হয় তার উল্লেখমাত্র কোথাও নেই। আর ১০ শতাংশ মার্কারিও বিপুল দূষণের জন্য যথেষ্ট।


(সংগৃহীত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.