নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্মরণকালের শীতে বিপর্যস্ত দেশের মানুষ। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে বন্যা-ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। গত কয়েক বছর ধরেই খরার সময় অতি খরা এবং বৃষ্টির সময় অতিবৃষ্টি মানব সভ্যতাকে ক্রমেই চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু কেন এই জলবায়ুর বৈরিতা? বিশেষজ্ঞরা বলছেন বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি এল নিনো ও লা নিনার প্রভাবেই এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। আবহাওয়ার চলমান সঙ্কটের মূলে আছে লা নিনা। কিন্তু কী সেই লা নিনা? এল নিনোই বা কী? এসব কিছুই তুলে ধরা হলো পাঠকের সামনে।
জলবায়ু চক্রের তিন ধাপ
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ু তিনটি ধাপের মাধ্যমে একটি চক্র অতিক্রম করে। এই চক্রকে বলা হয় এনসো চক্র। এনসো চক্রের তিনটি ধাপ : এল নিনো, লা নিনা; আর এ দুটি যখন প্রবল থাকে না, তখন তাকে বলা হয় এনসো নিউট্রাল। এল নিনো হলো শুষ্ক মওসুম, যখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম বৃষ্টি হয় এবং বন্যাও কম হয়। এ সময় তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায়। আর লা নিনার সময় বেশি বৃষ্টি আর বেশি বন্যা দেখা যায়। তাপমাত্রা কমে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে।
এল নিনো, লা নিনা
স্প্যানিশ ভাষায় এল নিনো মানে ছেলে আর লা নিনা মানে মেয়ে। কিন্তু এই জোড়া শব্দ দুটি মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়কারী হিসাবেই পরিচিত। মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে এদের সংজ্ঞা। এখানে তাপমাত্রার একটা সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। দীর্ঘকালীন গড় তাপমাত্রা এই সীমার ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সে. নিচে নেমে গেলে তাকে বলা হয় লা নিনা আর ওপরে গেলে বলা হয় এল নিনো। তবে তাপমাত্রার এই ওঠা বা নামা পাঁচ মাসের বেশি স্থায়ী হলে তাকে বলা হয় এল নিনো বা লা নিনা এপিসোড। সচরাচর এ অবস্থা ৯ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। কখনো কখনো ৩ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। দুই থেকে সাত বছর পরপর এই চক্র ফিরে আসতে পারে। সাধারণত এল নিনো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লা নিনার গঠন শুরু হয়। অর্থাৎ এল নিনো হলে লা নিনা হতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। তবে সব সময় এল নিনোর পরপরই লা নিনা যে হবেই এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ ১৯৭৬-৭৭ সালের এল নিনোর পর ৭৭-৭৮ সালে আবারো এল নিনোর ঘটনা ঘটেছিল। এরপর লা নিনা হয়েছে ১৯৮৮ সালে।
পৃথিবীর হৃদকম্পন
অনেক বিজ্ঞানীই এল নিনোকে পৃথিবীর হৃদকম্পন হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন। কয়েক বছর পরপর প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলে কয়েক মাসের জন্য সমুদ্র ও সংলগ্ন বায়ুম-ল হঠাৎ বেশ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে।
এর ফলে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়াম-লে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন পরিলতি হয়। আবহাওয়াম-লের এই চক্রাকারে ওঠা-নামাকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন পৃথিবীর হৃদকম্পন।
বিশ্বে এল নিনোর প্রভাব
এল নিনো খরা বা অনাবৃষ্টিকে ইঙ্গিত করলেও বিশেষজ্ঞদের মতে সাধারণত এর প্রভাবে ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া বরাবর ভূপৃষ্ঠে চাপ বেড়ে যায়। তাহিতি এবং পূর্ব ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের বায়ুচাপ কমে যায়। দণি প্রশান্ত মহাসাগরের বাণিজ্য-বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে বা পূর্বদিকে বইতে শুরু করে। পেরুর সন্নিকটে গরম বাতাস ঘনীভূত হওয়ার কারণে পেরুর উত্তরের মরু-অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে গরম পানি ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে। সঙ্গে করে নিয়ে যায় প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প অর্থাৎ বৃষ্টি। ফলে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল খরায় পুড়তে থাকে, আর পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে প্রচুর বৃষ্টি হয়।
লা নিনার প্রভাব
জলবায়ু বিজ্ঞানীদের মতে, লা নিনার প্রভাবে পূর্ব-প্রশান্ত মহাসাগরে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। উষ্ণম-লীয় সাইকোনের আশঙ্কা বেড়ে যায়। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দণি ও পূর্ব অংশে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। বৃষ্টিপাত বেড়ে যায় উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অংশে। কানাডাতে শীতের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং তুষারপাত বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। সম্ভবত এর প্রভাবে ১৯৮৮ সালে সুদানে বন্যা হয়। ১৯৮৯ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৯৮৮ সালের চেয়েও কমে যায়।
কেন এই চক্র
এল নিনো হওয়ার কারণ সম্পর্কে এখনো গবেষণা চলছে। এল নিনোর ঘটনা শুরু হয় যখন বাণিজ্যিক বায়ু, ওয়াকার সঞ্চালন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে অনেক মাস ধরে বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকে। অনেক কেলভিন তরঙ্গ মিলে কয়েক সেন্টিমিটার উঁচু এবং কয়েকশ কিলোমিটার প্রশস্ত তুলনামূলক গরম পানির সৃষ্টি হয় এবং উত্তর আমেরিকার কাছে একটি গরম ডোবার সৃষ্টি করে। ১৯৬৯ সালে জ্যাকব জার্কনেস এল নিনো বোঝার জন্য প্রস্তাব করেন যে, উত্তর শান্ত সমুদ্রে একটি ব্যতিক্রমী উষ্ণ বিন্দু উত্তর-দেিণর তাপমাত্রার পার্থক্য ঘটাতে পারে বাণিজ্যিক বায়ুকে এলোমেলো করে দিয়ে, যা কি না উষ্ণ স্রোতকে দেিণ ঠেলে দেয়। ফলে পূর্বে ক্রমাগতভাবে গরম পানির আবির্ভাব হতে থাকে। বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রস্তাব করা হয়েছে যার মাধ্যমে ইকুয়োটারিয়াল শান্ত সমুদ্রে কীভাবে গরম পানি আরো বাড়াতে থাকে এবং নিম্ন গভীরতায় এল নিনোর প্রভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাকি ঠা-া এলাকাগুলো আরেকটি এল নিনো ঘটানোর জন্য কয়েক বছর ধরে উষ্ণতা ধরে রেখে পুনরায় শক্তি জোগাড় করতে থাকে। অপরদিকে সাধারণত গ্রীষ্মম-লীয় প্রশান্ত মহাসাগরে শীতল পানির একত্রিত হওয়ার মাধ্যমেই লা নিনার সৃষ্টি হয়। পূর্বদিকে ধাবমান বায়ু ও সমুদ্রস্রোত কিছু জটিল ঘটনার মধ্য দিয়ে ঠা-া পানি একত্রিত করতে সহায়তা করে। এ সময় সমুদ্রের পানি ধীরে ধীরে আরো শীতল হতে থাকে। ১৯৮৮-৮৯ সালে এই পানির তাপমাত্রা হয়েছিল ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
এল নিনো লা নিনা বর্ষ
গত ৫০ বছরে এল নিনো হয়েছিল ৬৩-৬৪, ৬৫-৬৬, ৬৯-৭০, ৭২-৭৩, ৭৬-৭৭, ৭৭-৭৮, ৮২-৮৩, ৮৬-৮৭, ৯১-৯২, ৯২-৯৩, ৯৪-৯৫, ৯৭-৯৮, ২০০২-০৩, ০৪-০৫, ০৬-০৭ ২০০৯ সালে। অন্যদিকে লা নিনা হয়েছিল ৬৪-৬৫, ৭০-৭১, ৭৩-৭৪, ৭৫-৭৬, ৮৮-৮৯, ৯৫-৯৬, ৯৮-৯৯, ২০০০-২০০১ ও ২০০৬ সাল এবং ২০১০ সালের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত চলছে। এর আগের ৫০ বছরের এল নিনো হয়েছিল ১৪ বার এবং লা নিনা হয়েছিল ১২ বার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এ ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে বলে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন।
বাংলাদেশে এর প্রভাব
সাধারণত এল নিনো বছরগুলোতে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়; খরাজাতীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। যেমনটা হয়েছিল বাংলাদেশে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশে এ বছর কিন্তু বৃষ্টিপাত যতটা হওয়ার, ততটা হয়নি; কিছুটা খরাজাতীয় অবস্থা। এল নিনোর জন্য মওসুমি বায়ু পূর্বদিক থেকে পশ্চিমে যতটা বেগে আসার কথা ছিল, ততটা পারেনি। দুর্বল মওসুমি বায়ুর কারণে বৃষ্টিপাতও কম হয়েছে। ১৯৪০-১৯৯১ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত এবং এদের উপস্থিতির উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা বলেছেন বাংলাদেশে এল নিনোর প্রভাব মানে মারাত্মক খরা। আর লা নিনার প্রভাব মানে মারাত্মক বন্যা। আমাদের দেশের দুটি দুর্ভিরে অন্যতম কারণ খরা। আর খরার কারণ এল নিনো। এরপরের খরার বছরের (১৯৫১, ১৯৫৭, ১৯৭২, ১৯৭৬, ১৯৮৬, ১৯৮৩, ১৯৯৭, ২০০৬, এবং ২০০৯) অধিকাংশ বছরগুলোই এল নিনোর প্রভাবসম্পন্ন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাংলাদেশি জলবায়ু বিজ্ঞানী রাশেদ চৌধুরী গত বছর বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া সাাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের ঝড়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এল নিনো বছরগুলোতে ঝড়ের মাত্রা বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে নোয়াখালী-কক্সবাজার এলাকায় বিরাট ঝড় হয়েছিল। চট্টগ্রাম সমুদ্র-উপকূলীয় অঞ্চলে নভেম্বর ১৯৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের কথাও সবার জানা। একইভাবে মে ১৯৮৫-তেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে উপকূলীয় অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে বড় ঝড় হয় চট্টগ্রামে। এগুলোর সবই হয়েছিল এল নিনো বছরে। নভেম্বর ২০০৭-এর প্রলয়ঙ্করী সিডরের ত তো এখনো শুকায়নি। সেটা হয়েছিল লা নিনা বছরে। আগেই বলেছি, এর শুরু ২০০৬ সাল থেকে। একইভাবে এপ্রিল ২০০৯-এ যে বিজলি হয়, সেটাও হয় লা নিনা পর্যায়ে। সম্প্রতি মে মাসে যে আইলা হয়ে গেল, তা ছিল লা নিনা আর এল নিনোর সন্ধিণে। ঝড়গুলোর বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশে বড় ঝড়গুলো হয় এল নিনো বা লা নিনা বছরে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারে এনসোচক্র
উন্নত দেশগুলোতে এই এনসো চক্র দেখে অনেক আগেভাগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখনো এ ঘটনা থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার কোনো উদাহরণ নেই। জলবায়ু বিজ্ঞানী রাশেদ চৌধুরী বলেন, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত। এটা একটা নতুন চিন্তা। বিশেষ করে ব্রাজিল ও দণি আফ্রিকায় এ ব্যাপারে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে এবং তারা উপকৃত হয়েছে। চীন ও ভারতেও কাজ শুরু হয়ে গেছে। এটা একাডেমিক চর্চা না, বাস্তব প্রয়োজন। এটা আগে করা কঠিন ছিল, কিন্তু এখন সম্ভব। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের মতো এনসো চক্র দ্বারা বেশি মাত্রায় প্রভাবিত। কোনোভাবে যদি আমরা এ চক্র মনিটর করতে পারি, তাহলে সহজেই তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি আগাম আভাস দিতে পারব। ঝড় সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা দেওয়া যায়। প্রাথমিক ধারণাটা কতটা শক্তিশালী হচ্ছে, তার ভিত্তিতে মাসিক পূর্বাভাসও দেওয়া সম্ভব।
( সাপ্তাহিক ২০০০ | ফিচার | রবিবার 30 জানুয়ারি 2011 10:13 পুর্বাহ্ন ১৭ মাঘ ১৪১৭)
আমার লোখা আরো রিপোর্ট দেখতে ক্লিক করুন এখানে
আসাদ জোবায়ের
স্টাফ রিপোর্টার
সাপ্তাহিক ২০০০
[email protected]
০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:০১
জোবায়ের আসাদ বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ১২:১১
আধার রাতের মুসাফির বলেছেন: Very good to read it.
Thanks a lot for your given information.