নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জাত তথা জাতি বলতে গেলে বিশেষ করে এটা দু’প্রকারে উদ্ভূত হয়। এক হলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থাৎ- সে কোন জাতি বা তার ধর্ম কী? সে কি মুসলমান, হিন্দু, খ্রীষ্টান, ইহুদী, নাকি বৌদ্ধ? আবার দেশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে এর অর্থ দাঁড়ায় তার জাতীয়তা কী বা সে কোন দেশের নাগরিক? আবার এ দু’য়ের সাথে গৌণ আরও প্রকার রয়েছে, তা হলো ভাষাগত দিক থেকে, গোষ্ঠিগত দিক থেকে। এভাবে বলতে গেলে আরো অনেক জাত তথা জাতির প্রকারভেদ বের হবে। যাহোক, আমার আলোচনার মূখ্য বিষয় হলো, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি জাতির উত্থানের নিমিত্ত নিয়ে আলোকপাত করা। এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন যে, যে দেশে যে ধর্মের লোক বেশি সে দেশকে উক্ত ধর্মের নামেই আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। তাই সে দেশের উন্নতি মানেই উক্ত দেশের ধর্মীয় জাতির উন্নতিইকে প্রকারান্তরে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। তাই যে দেশ যখন সারা বিশ্বে মোড়লগিরি করে বেড়ায় সেটা সে দেশের ধর্মের লোকদের আধিপত্যকেই বোঝানো হয়ে থাকে। কারণ সে দেশে অন্যান্য ধর্মীয় লোকের বসবাস সংখ্যালঘু এবং তাদের সে দেশে লক্ষণীয় কোন আধিপত্য থাকে না। তাই একটি জাতির উন্নতি বলতে গেলে বলতে হবে একটি ধর্মের উন্নতি।
আজকের আলোচ্য বিষয় হলো, আমরা মুসলিম জাতি। আমাদের ধর্ম ইসলাম। আর এ ধর্ম হলো আল্লাহর প্রিয় এবং তার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম। এ ধর্ম আসার পর অন্যসব ধর্ম রহিত হয়ে গেছে। তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তাই সঙ্গত কারণেই এটা যুক্তিযুক্ত যে, মুসলিম জাতি সারাবিশ্বে আধিপত্য করে বেড়াবে। দিক নির্দেশনা ঠিক করে দিবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমরা কি তা পারছি? বর্তমান বিশ্বে মুসলিমজাতি একটি নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিগৃহিত জাতি। বর্তমান সময়ে মুসলিমদের অবস্থা কেমন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অবস্থাদৃষ্টে সবই জ্ঞাত। এ পরিস্থিতি নির্দিষ্ট কোন দেশের নয়, নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের নয়; বরং বিশ্বের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত এবং উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ সবখানেই মুসলিমদের অধ:পতন। কোথাও পরিস্থিতি একটু বেশি খারাপ আবার কোথাও একটু কম। মুসলিমদের চলমান পরিস্থিতিতে উল্লেখ করার মতো দৃশ্যমান কোন উৎকর্ষমন্ডিত কার্যক্রম কিছু নেই বললেই চলে। না আছে আধিপত্য, না আছে প্রতিপত্তি, না আছে অর্থকড়ি, না আছে সুন্দর আখলাক। জাগতিক দিয়েও না আছে তাদের কোন প্রভাব, আধ্যাত্মিক দিয়েও না আছে তাদের কোন সৌন্দর্য। জ্ঞানের দৌরাত্মেও এ জাতি অন্যদের তুলনায় অনেক পেছনে। ধর্ম পালনের দিক দিয়েও তারা পেছনে, আবার জাগতিক দিয়েও তারা পেছনে। তাদেরকে আজ চরিত্রহীনতা পেয়ে বসেছে। অন্তর হয়েছে কলুষিত। তাতে বাসা বেধেছে হিংসা-ক্রোধ। ফলে তারা অন্ত:কলহে লিপ্ত হচ্ছে। মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। ঐক্যতা ও সংহতি তাদের মাঝে আজ বিলুপ্ত। অন্যকে প্রতারিত করার জন্য মিথ্যা বলা একটি চমৎকার হাতিয়ার। হারাম কাজ করছে দেদারছে; মনে এতটুকুও বাঁধ সাধে না। চাতুরতা, সঠতা, হঠকারিতা আজ তাদের নিত্যসঙ্গী। আজ তারা তাদের সুন্দর অন্ত:করণ হারিয়ে ফেলেছে। আজ তাদের মাঝে ঈমানের নামটাই শুধু বাকি রয়েছে, ইসলামের রংটাই শুধু শরীরে লেগে রয়েছে। কোরআনের তত্ত¡ ও তাৎপর্য আজ অবোধগম্য। কোরআন তেলাওয়াতের গুনগুন আওয়াজটাই শুধু রয়েছে। আবার অনেকে সে গুনগুন আওয়াজটি করতেও নারাজ। এ গ্রন্থের তাৎপর্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিলক্ষিত হয় না। কোরআনের বিধি-নিষেধ মানা হয় না। আমরা আজ পরিণত হয়েছি এক বৈশিষ্ট্যহীন জাতিতে। কিন্তু আমরা কি অতীতে এমন জাতি ছিলাম? আদৌ নয়। আমরা ছিলাম একটি প্রতাপশালী সম্ভ্রান্ত জাতি। আমাদের অতীত ছিল অনেক সুন্দর। আমাদের কিসের অভাব? বিশ্বের অধিকাংশ খনিজ সম্পদ মুসলিম দেশগুলোতে। মুসলিম দেশগুলি খনিজ সম্পদের প্রাকৃতিক কল্যাণ অনুগ্রহিত। আল্লাহ তায়ালা মুসলিমভূমিতে তার কল্যাণ ঢেলে দিয়েছেন; কিন্তু আমরা কেন সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারছি না? আমাদেরকে কেন এ পশ্চাদ্ধাবণতা ঘিরে রেখেছে? আমরা কেন এ শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারছি না? আমরা কেন বিশ্বকে আবার দেখাতে পারছি না ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব? আমরা কেন ব্যর্থ? অথচ যে ইসলাম চৌদ্দশত বছর আগে ছিল সেটাই আজও বিদ্যমান আছে; যে কোরআন চৌদ্দশত বছর আগে ছিল সেটাই আজও বিদ্যমান আছে। এতে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়নি। তাহলে কেন পরিবর্তন হয়েছি আমরা? পরিবর্তন হয়েছে আমাদের চিন্তা-চেতনার? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদেরকে আগে জানতে হবে অতীতে মুসলিমজাতির উত্থানের কারণ কী ছিল।
হিজরী সন অনুযায়ী আজ থেকে প্রায় ১৪৫০ বছর আগে আরবদ্বীপপুঞ্জে একটি বর্বর পরিবেশে ইসলামের আগমন ঘটে। সে পরিবেশে গোত্রে গোত্রে ঝগড়া-বিবাদ ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। একে অপরের প্রতি নিষ্ঠুর মনোভাব পোষণ করত। তারা এক আল্লাহর এবাদত ছেড়ে বহুবিদ পৌত্তলিক পূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের অন্ত:করণ ভরে গিয়েছিল কলুষিতায়। বাজারে পণ্যের ন্যায় নারী-পুরুষদের বেচাকেনা হতো। মনুষ্যত্ব ও মানবতার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিল না। এমন এক প্রতিকূল পরিবেশে ইসলাম এসে তাদেরকে আহŸান করল এক আল্লাহর উপর ঈমান আনতে ও তাঁর এবাদত করতে। ঝগড়া-বিবাদ ছেড়ে দিয়ে এক্য ও সাম্যের গান গাইতে। গোত্রে-গোত্রে সংহতি প্রকাশ করতে। ইসলাম তাদেরকে বর্বরজাতি থেকে পরিণত করল সভ্যজাতিতে, মূর্খ জাতি থেকে শিক্ষিত জাতিতে। ইসলাম তাদের মনে এনে দিল কঠোরতার স্থলে ন¤্রতা, অভদ্রতার স্থলে ভদ্রতা। তাদের অন্তরকে করল পাপ-পঙ্কিলমুক্ত। তাদেরকে শেখাল আধ্যাত্মিকতা। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে তারা বুঝতে পেরেছিল জীবনের মাহাত্ম। ইসলামের স্পর্শে তারা হয়েছিল মহিমান্বিত, সম্মানিত, প্রতাপশালী ও সম্ভ্রান্ত; যার ছোঁয়ায় তারা অর্ধশত বছরে বিশ্বের অর্ধেক অঞ্চল জয় করে ফেলেছিল। ইশ! যদি ওসমান রাদ্বি-আল্লাহু আনহুর শাসনামলের শেষদিকে এবং আলী রাদ্বি-আল্লাহু আনহুর শাসনামলে মুসলিমদের মাঝে আপসে ঝগড়া-বিবাদ না হত তাহলে পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে গোটা বিশ্বই ইসলাম জয় করে ফেলত। কোন তাগুতী শক্তি তার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। সারা বিশ্ব হতো ইসলামের পদানত।
এই অল্প সময়ে তাদের এই অভাবনীয় জয় সারা বিশ্বের চিন্তাবীদ, দার্শনিক, রাজনীতিবীদ, ইতিহাসবীদসহ অন্যদেরকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তন্মধ্যে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট অন্যতম। মুসলিমদের স্বল্প সময়ের এই অবিশ্বাস্য বিশাল জয় তাকে হতবুদ্ধ করেছিল। নেপোলিয়ানের যারা অনুসারী ছিলেন তারা বলেন যে, “তিনি যখন মিসরে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি মুহাম্মদ (স.), ওমর রাদ্বি: ও অন্যান্য মুসলিম শাসকবর্গের রাষ্ট্র পরিচালনায় বিমোহিত হয়েছিলেন। এমনকি মিসর থাকাবস্থায় তিনি ইসলাম ধর্মকে তার জীবনের একমাত্র পথ ও পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন।”
আরবের মূর্তিপূজকরা যখন পৌত্তলিক ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করতেন, অন্তরে ইসলামী আক্বীদা পোষণ করতেন, তখন তাদের মাঝে চিন্তা-চেতনার আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো। তাদের দেহটাই যেন ছিল শুধু পুরাতন, আর সবই ছিল তাদের নতুন পাওয়া। বলা অত্যুক্তি হবে না যে পারলে তারা তাদের দেহটাকেও পরিবর্তন করে ফেলতেন। তাদের এ আক্বীদাই তাদেরকে পরিচালিত করতো সঠিকপথে। তাদের আক্বীদা ছিল গঠনশীল। তাদের আক্বীদা ছিল তাদের মস্তিস্কের চালিকাশক্তি। উক্ত আক্বীদার মাধ্যমেই তারা ওহীর তাৎপর্য বুঝতেন। এই আক্বীদা তাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা তথা মস্তিস্ক ও ওহীর মাঝে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল। তারা জ্ঞান দিয়ে ওহী ও তার কার্য প্রক্রিয়াকে বুঝতেন আবার ওহীর মাধ্যমে তারা ইহকালীন ও পরকালীন কার্য প্রক্রিয়ার সার্বিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সঠিক জ্ঞানের দিশা পেতেন। ফলে তারা তৎকালীন চলমান সমস্যাকে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সুন্দর সমাধান দিতে পারতেন।
কিন্তু আমাদের মাঝে আজ এ বিষয়টি কি বিদ্যমান? আমাদের আক্বীদা কি গঠনশীল? আমাদের আক্বীদা কি আমাদের চালিকাশক্তি? আমরা কি ওহীর তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম? আমরা কি চলমান সমস্যার যথাযথ সমাধান দিতে সক্ষম? আমাদের আক্বীদা-বিশ্বাস কি জ্ঞান ও ওহীর মাঝে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে? আমরা কী ওহীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে জ্ঞানের সঠিক দিশা পেয়েছি? আমরা কি মুসলিমজাতিকে ভবিষ্যতে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সারাবিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি কার্যকরী সঠিক ও নির্ভুল পরিকল্পনা উপস্থাপনে সক্ষম? আমরা কি আধুনিক বিশ্বকে পরিচালনা করার জন্য একটি আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রণয়ন ও গঠনে সক্ষম?
এসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করতে গেলে প্রত্যেকটিরই উত্তর হবে নেতিবাচক। একটির উত্তরও ইতিবাচক পাওয়া যাবে না। আর এসবের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল তৎকালীন মুসলিমদের উত্থানের মূল কারণ। মুখে বুলি আওড়ানো অনেক সহজ যে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করব, মদীনার সনদে দেশ চালাব। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। এখানে আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা যায় না, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়। আর এ কারণে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) আমাদেরকে দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন; ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার দায়িত্ব দেননি। কারণ যখন জনগণের মাঝে দ্বীন এসে যাবে তখন তারাই কোন পাপ করলে ইসলামের দৃষ্টিতে তার শাস্তি কী তা তার উপর প্রয়োগ করতে বলবে যেমন হয়েছিল সাহাবাদের যুগে।
গবেষণা করলে দেখা যায় যে অতীতে সাহাবাগণ যে কারণে জয়লাভ করেছেন, শক্তিশালী দুশমনদের কুপোকাত করেছেন, অত্যাচারীর অত্যাচার প্রতিহত করেছেন, চারদিকে ইসলামের ঝান্ডা উড়িয়েছেন, সে কারণগুলো আমাদের মাঝে আজ নেই। বাহ্যিক কাঠামোগতভাবে তারা যেমন মানুষ ছিলেন আমরা ঠিক সৃষ্টিগতভাবে মানুষ আছি। কিন্তু তারা চেতনার দিক দিয়ে, আধ্মাতিককতার দিক দিয়ে তথা রূহানী কাঠামোতে যেভাবে গড়ে উঠেছিলেন, আমরা কি সেভাবে গড়ে উঠতে পেরেছি? অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেমন পিতা-মাতার ধর্ম অনুসরণ করে, আমরাও ঠিক তেমনি ইসলামকে পিতা-মাতার ধর্ম বানিয়ে ফেলেছি। আমরা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী নই। আমরা পিতা-মাতার ধর্মের অনুসরণ করি। বাবা-মা মুসলিম, সে সুবাদে আমিও মুসলিম। যদি আল্লাহ মুসলিমদেরকে কর্ম ছাড়া শুধু নামে মাত্র মুসলিম হওয়ার জন্য সম্মান প্রদানের প্রতিশ্রæতি দিতেন তাহলে এটা বলা যেত যে, আল্লাহ তায়ালা কোরআনে আমাদেরকে সম্মানের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন সে প্রতিশ্রæতি আজ কোথায়? মুসলিমদের সম্মান আজ কোথায়? কেন তা আজ ভূলুণ্ঠিত? যেমন আল্লাহ বলেন, “সম্মান তো হলো কেবলমাত্র আল্লাহ, তার রসুল ও মু’মিনদের জন্য।” সূরা মুনাফিকুন, আয়াত-৮।
মুসলিমজাতি আজ অবহেলিত। তাদের মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত। তারা আজ অভিভাবকহীন। তাদের দেখার যেন কেউ নেই। তাদের ডাকে সাড়া দেয়ার কেউ নেই। তাদেরকে সাহায্য করার কেউ নেই। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর আমার উপর কর্তব্য হলো মু’মিনদেরকে সাহায্য করা।” (সূরা রূম-৪৭)
যদি আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদেরকে কোন বৈশিষ্ট্য ছাড়া শুধুমাত্র মুসলিম হওয়াকে ঘোষণা করার দ্বারা সাহায্য করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে থাকতেন তাহলে আজ আমাদের এতো অপদস্ত ও অপমানিত হওয়ার ব্যাপারে আশ্চর্য হওয়ার একটি কারণ ছিল। একটি সন্দেহ পোষণ করা যেত যে ইসলাম ধর্ম সত্য কিনা। কিন্তু কোরআনের বাণীর উদ্দেশ্য তো এমন নয়। এ বাণীর উদ্দেশ্য তো হলো ভিন্ন ধরণের। কারণ আল্লাহ তায়ালা কখনও তার প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করেন না। কোরআন পরিবর্তনশীল নয়। বরং পরিতাপের বিষয় যে আমরাই আজ পরিবর্তন হয়ে গেছি। ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। আমাদের নামে মুসলিমের ঘ্রান পাওয়া গেলেও কাজে সব ইসলাম বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। আমরা যদি আল্লাহর প্রতিশ্রæতি পেতে চাই তাহলে আমাদের নিজেদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন করতে হবে। ওহীর তাৎপর্য বুঝতে হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা সতর্কবাণী দান করেছেন, “আল্লাহ তায়ালা কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে।” (সূরা রা’দ-১১)
যেহেতু আমরা নিজেরাই পরিবর্তন হয়ে গেছি তাই আল্লাহ আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা তা পরিবর্তন করব। সুতরাং তিনি আমাদেরকে এই লাঞ্ছনা আর অপমানের পরিবর্তে সম্মান ও উচ্চাসন দান করবেন না। আর এটা তার জন্য শোভনও নয়। কারণ এটা করাটা হবে তার ন্যায়পরায়নতার সাথে সাংঘর্ষিক। যে যেটা পাওয়ার উপযুক্ত তিনি তাকে সেটাই দিয়ে থাকেন। অতীতে এমন কোন জাতি অতিক্রম করেনি যারা প্রয়োজনীয় কার্যকারণ গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছেন আর আল্লাহ তাদেরকে তার কল্যাণ ও বরকত ঢেলে দিয়েছেন। পার্থিব জগতে প্রত্যেক জাতি তার কার্যকারণ গ্রহণ করা ও তার প্রয়োগের ভিত্তিতে ফল ভোগ করে। কার্যকারণ গ্রহণ ও তার বাস্তব প্রয়োগ না করে ফল ভোগ করার চিন্তা হবে একটি বাতুলতা প্রসূত চিন্তা ও আকাশ কুসুম কল্পনা। ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি কী বলবেন যে সম্মানের উপযুক্ত নয় অথচ তাকে সম্মান দিতে হবে? যে ব্যক্তি চাষাবাদ না করেই শস্য ঘরে তুলতে চায়? কোন কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষা না করেই কল্যাণ পেতে চায়? একমাস কষ্ট না করেই মাস শেষে বেতন পেতে চায়? এটা কি সম্ভব? আদৌ নয়।
এগুলো যদি সম্ভব হতো তাহলে পৃথিবীর প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যেত যে প্রকৃতির ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। মানুষ অলস হয়ে যেত। সত্য-মিথ্যা, লাভ-ক্ষতি, ইতিবাচক-নেতিবাচক সব সমান হয়ে যেত। আর আল্লাহর সৃষ্টিতে এমন হওয়া অসম্ভব। কারণ তিনি এ জগতটাকে এটার নিজস্ব স্বকীয়তা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন (যে স্বকীয়তাকে পূঁজি করেই নাস্তিকরা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে)। যদি আল্লাহ তার সৃষ্টিজীবকে কোন কাজ ছাড়া এমনিতেই সাহায্য করতেন তাহলে তার রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমনিতেই সাহায্য করতেন। ইসলাম প্রচারের জন্য কোন যুদ্ধ-জিহাদের প্রয়োজন পড়ত না। তাঁর দাঁত শহীদ হতে হতো না। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার হাজার জীবনকে আল্লাহর রাহে শহীদ হতে হতো না।
মনে করুন, কোন এক ব্যক্তি তার এক কর্মীকে নির্দেশ দিল দশটি কাজ করার জন্য। সে দশটি না করে ২/৩টি কাজ করল এবং ভাবল যে সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে এবং ১০টির প্রতিদান চাইল তাহলে মালিক কি তাকে ১০টির প্রতিদান দিবে? অবশ্যই না। পক্ষান্তরে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পুরস্কার দিবেন যদি আমরা তারে বেধে দেয়া নিয়মগুলো যথাযথভাবে পালন করি। যেমন আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা মু’মিনদের থেকে তাদের জান-মাল ক্রয় করে নিয়েছেন এই শর্তে যে তারা বিনিময়ে জান্নাত পাবে। তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে, তারা হত্যা করবে এবং তাদেরকে হত্যা করা হবে, তিনি দিয়েছেন একটি সত্য প্রতিশ্রæতি যেটা রয়েছে তাওরাত, ইঞ্জীল ও কোরআনে। আর আল্লাহর চেয়ে কে রয়েছে অধিক প্রতিশ্রæতিপূরণকারী? তোমরা উক্ত ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে খুশি হও যা তোমরা করেছ। আর এটাই হলো উৎকৃষ্ট সফলতা।” (সূরা তওবা, আয়াত-১১১)
আল্লাহ কর্তৃক মুসলিমদের গুণাবলীর কথা বর্ণনা থেকে আমরা মুসলিমরা আজ কোথায়? আমরা কোথায় আর সাহাবাগণ কোথায়? তারা দ্বীনের জন্য জীবন দিয়ে দিতেন, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। মৃত্যুকে পরওয়া করতেন না। জিহাদে অংশ নিলেই তারা শাহাদতের অমিয় সুধাপানের আকাঙ্খা করতেন। কেউ শহীদ হতেন আবার কেউ শহীদ না হয়ে গাজী হতেন। অনেকেই বলতেন, ‘আমি জান্নাতের ঘ্রান পাচ্ছি!’ এই বলেই সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। দুশমনদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিতেন। তাদের দেহ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতেন। যদি তিনি উক্ত যুদ্ধে শহীদ হতেন তাহলে দিনটি হতো তার জন্য শ্রেষ্ঠ দিন। আর যদি শহীদ না হতেন তাহলে ভারাক্রান্ত মনে, ক্লান্তবদনে একরাশ দূঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
আমাদের পূর্ব পুরুষদের মাঝে যে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, ধর্মের জন্য যে ত্যাগ ছিল তা আজ আমাদের মাঝে ন্যূনতমও অবশিষ্ট নেই। আমরা নামে মাত্র মুসলিম। ধর্মের জন্য যে ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন তা আমরা আজ করছি না। অথচ আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য কী? আমরা আমাদের জীবন, ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যায় করব। ধর্ম প্রচারের জন্য সদা প্রস্তুত থাকব। যুদ্ধ-জিহাদের প্রয়োজন হলে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করার জন্য মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ব। মারা গেলে শহীদ, নয়তো গাজী। আর এ যুদ্ধের জন্য যেসব প্রস্তুতির প্রয়োজন তা যথাযথভাবে নিয়ে রাখব। আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন আমাদেরকেই করতে হবে। এই ভেবে বসে থাকা বাতুলতার নামান্তর যে আমরা মুসলিম। আমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তায়ালাই আমাদের সমুচ্চিত রাখবেন। এ ধরণের চিন্তাধারা আদৌ ঠিক নয়। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে তার প্রয়োজনীয় উপকরণ গ্রহণের ভিত্তিতে ফল দিয়ে থাকেন। এটা হলো আল্লাহ তায়ালার ধর্ম। আর এর ভিত্তিতেই এ নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। আমরা যেমন প্রস্তুতি নেব তেমন ফল পাবো। অমুসলিমরা যেমন প্রস্তুতি নেবে তারা তেমন ফল পাবে।
আল্লাহ তায়ালা ধর্মকে উঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে যেসব নির্দেশনাবলী দিয়েছেন সেসব গ্রহণ করা থেকে আমরা যোজন যোজন মাইল দূরে। অথচ বর্তমান ফিরিঙ্গিদের মাঝে এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তাদের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৌশলী সেনাবহর। তারা ধর্মের নামে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যায় করে। যুদ্ধে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেয়। মৃত্যুকে স্বাদরে আলিঙ্গন করে নেয়। যুদ্ধে অন্যকে দমিয়ে রাখার জন্য অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র তৈরি করে। কিন্তু আমরা মুসলিমরা আজ এ বৈশিষ্ট্য থেকে কোথায়? আমাদের প্রস্তুতি কোথায়?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের ব্যায় ও ত্যাগ-তিতিক্ষা মানুষের চিন্তার উর্দ্ধে। জার্মানী দুই মিলিয়ন যোদ্ধা হারায়। ফ্রান্স এক মিলিয়ন চার লাখ যোদ্ধা হারায়। ইংল্যান্ড ছয় লাখ যোদ্ধা হারায়। ইটালী চার লাখ ষাট হাজার যোদ্ধা হারায়। আর রাশিয়া যে কত যোদ্ধা হারিয়েছে তা গণনার উর্দ্ধে। এতো গেল জীবনত্যাগের দিক থেকে। পক্ষান্তরে, অর্থকড়ি ব্যায়ের দিক থেকে ইংল্যান্ড ব্যায় করেছিল সাত বিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রা, ফ্রান্স ব্যায় করেছিল দুই বিলিয়ন, জার্মানি ব্যায় করেছিল তিন বিলিয়ন, ইটালী ব্যায় করেছিল পাঁচ বিলিয়ন, আর রাশিয়া এমন পরিমাণ ব্যায় করেছিল যে জনগণকে ক্ষুধার্ত থাকতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ব্যায় করেছিল ৩৪১.৪৯১ বিলিয়ন ডলার, জার্মানি ব্যায় করেছিল ২৭০.০০০ বিলিয়ন ডলার, সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যায় করেছিল ১৯২.০০০ বিলিয়ন ডলার, চীন ব্যায় করেছিল প্রায় ১৯০.০০০ বিলিয়ন ডলার (১৯৩৭-৪৫ এর জন্য), যুক্তরাজ্য ব্যায় করেছিল ১২০.০০০ বিলিয়ন ডলার, কানাডা ব্যায় করেছিল ১৫.৬৮০ বিলিয়ন ডলার, ইটালী ব্যায় করেছিল ৯৪.০০০ বিলিয়ন ডলার, জাপান ব্যায় করেছিল ৫৬.০০০ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্স ব্যায় করেছিল ১৫.০০০ বিলিয়ন ডলার (শুধু ১৯৩৯-৪০ এর জন্য), বেলজিয়াম ব্যায় করেছিল ৩.২৫০ বিলিয়ন ডলার (শুধু ১৯৩৯-৪০ এর জন্য), পোল্যান্ড ব্যায় করেছি ১.৫৫০ বিলিয়ন ডলার (শুধু ১৯৩৯ এর জন্য), আর ন্যাদারল্যান্ডস ব্যায় করেছিল ০.৯২৫ বিলিয়ন ডলার।
সারা বিশ্বে তারা যে আজ মোড়লগিরি করছে তা এমনিতেই আসেনি, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। তারা দেশের জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, ধন-সম্পদ ব্যায় করেছে। আর পরিণতিতে তারা পেয়েছে উন্নত জীবন, পার্থিব মান-সম্মান। আশ্চর্য হয়ে বলতে হয়, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কেন এতো নেয়ামত, ধন-সম্পদ ও সম্মান দিয়েছেন? আর আমাদের মুসলিমদের এর ছিটে ফোঁটা থেকেও কেন বঞ্চিত করেছেন? এর উত্তর অবশ্য আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে তাহলো আল্লাহ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা স্বয়ং নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে স্বচেষ্ট হয়। এখন কেউ যদি হালাকু খানের মেয়ের মতো বলে যে আল্লাহ তায়ালা আজ মুসলিমদের সাথে নেই, কাফেরদের সঙ্গ দিয়েছে তাহলে তার এ কথা হবে একটি কুফরিসুলভ কথা।
হালাকু খানের নাম আমরা কমবেশি সবাই জানি। সে ছিল তাতারদের নেতা। এই তাতারীরা আরববিশ্বে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। উক্ত ঘটনাটি এমন, একদা তার মেয়ে বাগদাদ শহরে ঘুরতে বের হয়েছিল। হঠাৎ সে কিছু লোকসকলকে দেখতে পেল যে তারা এক বৃদ্ধকে ঘিরে রেখেছে। সে জনৈক লোককে ঐ লোকটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। তাকে বলা হল যে তিনি একজন আলেম। হালাকু খানের মেয়ে তার দেহরক্ষীকে হুকুম দিল তাকে তার সামনে উপস্থিত করাতে। তাকে আনা হল। মেয়েটি তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা তো আল্লাহর উপর ইমান রাখ, তাই না?’ উত্তরে আলেম বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কি বিশ্বাস কর না যে আল্লাহ যাকে চান তাকে সাহায্য করেন?’ উত্তরে আলেম বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ মেয়েটি বলল, ‘আল্লাহ তায়ালা কি আমাদেরকে তোমাদের উপর বিজয় দান করেন নি?’ উত্তরে আলেম বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ মেয়েটি বলল, ‘তাহলে এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে আমরা তোমাদের চেয়ে আল্লাহর কাছে প্রিয়?’ আলেম বললেন, ‘না এটা কখনই নয়।’ মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন নয়?’ আলেম বলল, ‘তুমি কি ছাগলের রাখাল চিন?’ মেয়েটি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, চিনি।’ আলেম জিজ্ঞাসা করল, ‘রাখালের ছাগলের পালের সাথে কি কিছু কুকুর থাকে না?’ মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ, থাকে।’ আলেম বলল, ‘যদি কিছু ছাগল তার অধীনের বাইরে চলে যায় বা পাল চড়ানোর সীমানা ছেড়ে দূরে চলে যায়, তাহলে রাখাল কী করে?’ মেয়েটি বলল, ‘সে তখন তার কুকুর ছেড়ে দেয় সেগুলোকে তার অধীনে ফিরিয়ে আনার জন্য।’ আলেম জিজ্ঞাসা করল, ‘কুকুরগলো কতক্ষণ পর্যন্ত ছাগলগুলোকে তাড়া করতে থাকে?’ মেয়েটি বলল, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদেরকে পাল চড়ানোর সীমানার মধ্যে এবং তার অধীনে ফিরিয়ে আনতে পারে।’ তখন আলেম বলল, ‘হে তাতার! তোমরা হলে আল্লাহর কুকুর। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর অনুসরণ করবো, তার পথে ফিরে আসবো ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তোমাদেরকে আমাদের পিছে লেলিয়ে দিয়ে রাখবেন যাতে আমরা তার অনুসরণে ফিরে আসি।’
বর্তমান বিশ্বে ফিরিঙ্গিদের আধিপত্য এবং মুসলিমদের নির্যাতিত হওয়ার একমাত্র কারণ হলো আমরা আল্লাহর দেয়া জীবন পদ্ধতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণ করবো ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ফিরিঙ্গিদের আমাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে রাখবেন।
ফিরিঙ্গিদের তুলনায় আজ আমাদের ত্যাগ কোথায়? হয়তো বলা হতে পারে, আজ মুসলিমজাতি নিস্ব, রিক্তহস্ত; তেমন অর্থকড়ি নেই। আসলে এটা একটা অজুহাত মাত্র। তারা যে পরিমাণ অর্থকড়ি ব্যয় করেছিল তা যদি মাথাপিচু ভাগ করে প্রত্যেক মুসলিমকে দিতে বলা হয় তারা তাও দিবে না। মুসলিমরা আজ এটা এককভাবেও করবে না এবং সমষ্টিগতভাবেও করবে না। এ জাতি আজ যাকাতটা পর্যন্ত ঠিক মতো আদায় করে না। যদি মুসলিম জাতি সঠিকভাবে যাকাত আদায় করত তাহলে মুসলিম বিশ্বে গরিব বলে কেউ থাকত না। তাই শায়খ মুহাম্মদ মুতাওয়াল্লী আল-শা’রাভী (রহঃ) যথার্থই বলেছেন, ‘যদি তোমরা মুসলিম দেশে কোন গরিব, নিঃস্ব, ভুখা-নাঙ্গা লোক দেখতে পাও, তাহলে মনে করবে তার ধন-সম্পদ কেউ অবৈধভাবে দখল করেছে।’
মুসলিমজাতির পশ্চাদপদতার কারণগুলো কী কী তা অনুসন্ধান করে বের করার পর তা কাটিয়ে উঠতে পারলে এ জাতি উন্নতি লাভ করবে। উন্নত হওয়ার পর আসবে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব করার প্রশ্ন।
মুসলিমদের পিছিয়ে পরার কারণসমূহ:
আধুনিক বিশ্বে মুসলিমদের পিছিয়ে পরার প্রধান কারণ হল অজ্ঞতা। মুসলিমদেরকে অজ্ঞতা পেয়ে বসেছে। জ্ঞানী লোকের চেয়ে অজ্ঞ লোকের সংখ্যাই বেশি। ধর্মীয় জ্ঞানের পরিমÐলে যতটুকু পদচারণা আছে সে তুলনায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিমÐলে এ জাতির পদচারণা অত্যল্পই। এ জাতি গবেষণা ছেড়ে দিয়েছে। তাই ডক্টর মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান (ইটালিয়ান নব মুসলিম) বলেছেন, “যেখানে প্রতি মিলিয়নে খ্রীষ্টানদের মাঝে বৈজ্ঞানিকের সংখ্যা চার হাজার, সেখানে মুসলিমদের মাঝে প্রতি মিলিয়নে বৈজ্ঞানিকের সংখ্যা মাত্র দুইশত। মুসলিমদের এ সংখ্যা বাড়াতে হবে।”
আমি যখন আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলাম, তখন ডক্টর মারওয়ান আমাদের থিমেটিক হাদীস পড়াতেন। তিনি ইসলামী জ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “ইসলামী জ্ঞান কী? ইসলামী জ্ঞান হলো মুসলিমজাতি প্রাত্যহিক জীবনে চলার জন্য যে সব জিনিসের প্রয়োজন বোধ করে সে সব সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনই হল ইসলামী জ্ঞান। ইসলামী জ্ঞান শুধু কোরআন, হাদীস ও ফিকহশাস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সারাবিশ্বে আজ ইসলামী স্কলারের অভাব নেই। ইসলাম ইসলামী স্কলারের অভাবে ধ্বংস হবে না। বর্তমান সময়ে ইসলাম যদি ধ্বংস হয় তাহলে তা হবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষকদের অভাবে। আমাদের এ ধর্মে আধুনিক জ্ঞানের স্কলারের বড়ই অভাব। কেউ যদি ফিজিক্স, কেমিষ্ট্রি, মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি আধুনিক জ্ঞান নিয়ে পড়ে আর সে মনে এ নিয়ত রাখে যে সে তার জ্ঞান দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমজাতিকে বিশ্বের বুকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাহলে তার মর্যাদা ও আল্লাহর রাহে একজন দায়ী’র মর্যাদা সমান।”
ইসলামী জ্ঞান মানুষকে সুন্দর পথে পরিচালিত করবে, আর আধুনিক জ্ঞানের স্কলারগণ পার্থিব জীবনকে উন্নত করবে। তবে আধুনিক জ্ঞানের স্কলারদের মাঝে ইসলামী মূল্যবোধের উপস্থিতি থাকতে হবে। যদি তাদের মাঝে ইসলামী মূল্যবোধের উপস্থিতি না থাকে তাহলে তারা দেশের উন্নতি দেখবে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা তথা শিক্ষার ইসলামীকিকরণ।
ইসলামী জ্ঞান না থাকলে সে আরো ইসলামের ক্ষতি করবে। যেমন আহমদ দিদাত (রাহ.) বলেন, “ইসলামের নিকৃষ্টতম ন্যাক্কারজনক দুশমন হলো মুসলিম জাহেল যে ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে পক্ষপাতিত্ব করে এবং কাজে কর্মে ইসলামের প্রকৃত রূপের বিকৃতি ও ধ্বংস সাধন করে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চায় যে এটাই হলো ইসলাম।”
মুসলিমজাতি পিছিয়ে পরার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, স্বল্প বিদ্যা। এই স্বল্প বিদ্যার লোক অজ্ঞ লোকের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ অজ্ঞ লোকের জন্য যদি কোন পথ প্রদর্শক নিযুক্ত করে দেয়া হয়, তাহলে সে তার কথা মানে; তার অনুসরণ করে। পক্ষান্তরে স্বল্প বিদ্যার লোক সে নিজেও জানে না; আর সে এটা মানতেও চায় না যে সে জানে না। তাই বলা হয়, অর্ধ পাগলের মসিবতে পরার চেয়ে পুরা পাগলের মসিবতে পরা অনেক ভাল। আর ফার্সিতে একটি প্রবাদ আছে, “নীমে তবীব খতরে জান, নীমে মুল্লা খতরে ইমান।” অর্থাৎ- আধা ডাক্তার রোগীর প্রাণের জন্য ভয়ংকর, আর আধা মোল্লা মানুষের ইমানের জন্য ভয়ংকর।
মুসলিমদের পিছিয়ে পরার তৃতীয় কারণ হলো, মুসলিমদের চরিত্র আজ নষ্ট হয়ে গেছে। এটি উপরোক্ত দু’টির চেয়েও মারাত্মক। কোরআন আমাদেরকে যেসব সুন্দর গুণে গুণান্বিত হতে নির্দেশ দিয়েছে তা থেকে আমরা অনেক দূরে। অথচ সাহাবাদের উন্নত আখলাকই ছিল ইসলাম প্রচারের মূল কারণ। তাদের চরিত্র দেখে বিধর্মীরা ইসলাম গ্রহণ করত। এর স্বপক্ষে ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসের বইয়ে। ইসলাম জিহাদের দ্বারা ছড়ায়নি; ইসলাম ছড়েছে আখলাকের দ্বারা। সাহাবাগণ জিহাদ করেছেন প্রতিরক্ষার জন্য অথবা কোন ভূখÐ থেকে অন্যায়-অত্যাচার দূরীকরণের জন্য। ইসলাম প্রচারের জন্য অন্যের উপর আক্রমণ করেছেন এমনটির কোন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। তাই সর্বাগ্রে উচিত আমাদের আখলাক সুন্দর করা। আখলাকের অনুপস্থিতির কারণেই যত্রতত্র চলছে ইভটিজিং। নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।
মুসলিমদের পিছিয়ে পরার কারণের মধ্যে আরো হলো এ জাতির মধ্যে দুর্বলতা ও কাপুরুষতা দেখা দিয়েছে। যার ফলে এদের মাঝে মৃত্যুভীতি দেখা দিয়েছে। অথচ বিশ্বে কর্তৃত্ব করার জন্য এ দু’টিকে জয় করতে হবে। ইসলামের চেয়ে আমাদের নিজেদের জীবন আজ অনেক মূল্যবান হয়ে গেছে। অথচ ফিরিঙ্গিরা বিশ্বে মোড়লগিরি করার জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কত জীবনেরই না বিসর্জন দিয়েছে। আমাদের দুর্বলতা ও মৃত্যুভীতির কারণে আমাদের মাঝে নিরাশতা ও হীনমন্যতা স্থান করে নিয়েছে। ফলে আমরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। অথচ উন্নতির জন্য চাই আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসহীনতার কারণে আমরা নতুন কিছু আবিস্কার করতে পারছি না। আমরা নতুন কিছু আবিস্কারের জন্য মুখিয়ে থাকি ইউরোপ-আমেরিকার দিকে; দেখি তারা জগৎকে কী কী নতুনত্ব দান করে। কোন কিছু আবিস্কার করার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন জ্ঞানের। তারপর আত্মবিশ্বাস। অত:পর পরিকল্পনা। অত:পর দৃঢ়প্রত্যয়। অত:পর পরিশ্রম ও অর্থ যোগানের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার। তারপর আবিস্কৃত হবে নতুন কিছু। কিন্তু আমাদের মধ্যে কি এসব গুণাবলী বিদ্যমান আছে? এটা সত্য যে বর্তমান মুসলিম দেশগুলোতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করছে, কিন্তু তারা লেখাপড়া করছে কোন উদ্দেশ্যে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? তারা কি কোন কিছু আবিস্কার করার জন্যই আধুনিক বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করছে? তাদের মধ্যে কি ইসলামী ভাবাদর্শ বিদ্যমান? তারা কি ইসলাম ও মুসলিমবিশ্বকে এগিয়ে নেয়ার নিমিত্তে এসব জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করছে? আদৌ নয়। তারা এসব আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করছে ভাল একটা চাকরি পাওয়ার জন্য। চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে-শাদি করে বাকি জীবন শান্তিতে কাটানোর জন্য। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এর মধ্যে থেকেও কিছু কিছু গবেষক তৈরি হচ্ছে। কোন মুসলিম বিজ্ঞানী কোন কিছু আবিস্কার করলে সেটা প্রকারান্তরে ইসলাম ও মুসলিমবিশ্বেরই সুনাম। (কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি মুসলিম দেশেই জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে, যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে বিভিন্ন স্থানে হামলা করছে। গেরিলা হামলার মাধ্যমে এরা নির্বিচারে নিরীহ ও নির্দোষ পুরুষ-নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। মূলত: এরা ইসলামের ভাবমূর্তিকে বিশ্বের বুকে নষ্ট করে দিচ্ছে।)
আমরা আমাদের ইতিহাস ভুলে গেছি। আমরা ইতিহাস চর্চা করি না। অথচ আমাদের স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য জানার জন্য ইতিহাসের বিকল্প নেই। তদুপরি আমাদের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা দল-উপদল। মুসলিমজাতি আজ এক দেহ বিশিষ্ট নয়। এরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে।
২| ২৭ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:১৫
রাজীব নুর বলেছেন: করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনে গবেষণায় মরিয়া পশ্চিম, চীন। আর মুসলিম বিশ্ব মরিয়া একযোগে কোরআন তেলাওয়াত আর আযান দেওয়ায়।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১০:৪৬
নেওয়াজ আলি বলেছেন: সৌদিতে এখন সাগরে ললনা নাচে ঢেউয়ের তালে তালে