নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সম্রাট বহুদিন ধরে ভাবছেন রাজ্য সফরে বের হবে। রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সকল প্রজাদের দেখবেন। কিন্তু সেটা সম্রাটের পোষাকে সম্ভব নয়। আবার বেশ বদল করে ঘোরাফেরা সম্রাটের অহংকারে লাগে। উজিরদের কেউ বুদ্ধি দিল সেনাবাহিনীর একটা অংশ সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাতেও সমস্যা। বহিঃশত্রু দ্বারা যেকোনো সময় রাজ্য আক্রমণ হতে পারে৷ আবার রাজধানী খালি বলে কেউ বিদ্রোহ করে বসতে পারে। অতঃপর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, সম্রাট গোয়েন্দা মারফত খবর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছদ্মবেশে যাবেন। আর সাথে সাদা পোষাকে থাকবে একটা ফৌজ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী গোয়েন্দারা চলে গেল বিভিন্ন অঞ্চলে। উত্তরাঞ্চল থেকে খবর এলো সেখানে দুর্ভিক্ষ চলছে। সম্রাট ভাবলেন, এটাই মোক্ষম সময় নিজের ব্যাপারে জনগণের কাছ থেকে জানার। অতঃপর দীর্ঘপথ পারি দিয়ে পৌঁছালেন। খাবার ও পানির অভাবে মানুষের অস্থি দৃশ্যমান। সম্রাট তাদের অবস্থা দেখে অনেক দুঃখ পেলেন। এলাকার গভর্নরকে তলব করতে চাইলে সম্রাটের পরামর্শদাতা নিষেধ করেন। কারণ, এতে সম্রাটের গোপনীয়তা রক্ষা হবে না। বিপদ হতে পারে।
পরদিন তিনি ছদ্মদবেশে গভর্নরের কার্যালয়ে গেলেন। ছিমছাম সুন্দর কামড়া গভর্নরের। অনেক মানুষ এসেছে সাহায্যের জন্য। কেউ পাচ্ছে আবার কেউ পাচ্ছে না। সম্রাট নিজের জন্য সাহায্য চাইতে গিয়ে বললেন, “প্রতি বছর এত এত কর দেওয়া হয় রাজ্যের জন্য। কিন্তু সাহায্যের জন্য এত অল্পই পাবো কেন?”
গভর্নর অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “হতচ্ছাড়া! দু মুঠো খেতে পারছিস সেটা নিয়েই খুশি থাক। প্রশ্ন করতে আসলে হাত-পা ভেঙে দেব। এবার যা এখান থেকে।”
সম্রাট ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রস্থান করলেন। কিছুদূর এগিয়ে দেখতে পেলেন কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ লোক বসে বসে গল্প করছে, হাসি তামাশা করছে। তিনি তাদের কাছে গিয়ে বসলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “আমায় একটা কথা বোঝান তো। গভর্নর আপনাদের সঠিক প্রাপ্য দিচ্ছে না, সম্রাট ঠিকঠাক খোঁজ নিচ্ছে না; কিন্তু তবুও কেন আপনারা সম্রাটের আনুগত্য করে যাচ্ছেন?
উপবিষ্ট সকলের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি উত্তর দিলেন, “ওরে মশাই! আপনি বোধহয় এই রাজ্যের লোক নন। তাই এত আগ্রহ জানার। শুনেছি দক্ষিণে সূর্য উঠেছে। আশাকরি, খুব শিগগিরই এর আলো উত্তরে পৌঁছবে। এখন তো মধ্যরাত। ভোর খুব দ্রুতই হবে। আর অপারগতাকে আনুগত্য বলবেন না।”
সম্রাট বৃদ্ধের কথা বুঝতে সমর্থ হলেন। ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে রাজধানীতে ফিরে গেলেন। উত্তরাঞ্চলের জন্য বিপুল ত্রান সামগ্রী পাঠালেন। এরই মধ্যে একদিন দক্ষিণাঞ্চল থেকে গোয়েন্দা মারফত খবর এলো। গোয়েন্দা জানালেন দক্ষিণাঞ্চল বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। সম্রাট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওদের জনপ্রিয়তা কেমন?”
“জাঁহাপনা! তাদের জনপ্রিয়তা অনেক। এবং সমর্থনও আছে মানুষের।”
“বিদ্রোহীদের সংখ্যা কত?”
“সংখ্যা একেবারেই নগন্য। সংখ্যা জন পঞ্চাশের মত হবে। এদের কার্যক্রম পাশের গ্রামেও যায়নি।”
“আচ্ছা, হাজার সংখ্যার ফৌজ পাঠানোর নির্দেশ দিচ্ছি। সবগুলাকে হত্যা করবে৷ আর ওদের নেতাকে পারলে ধরে আনবে।
এখানেই বাধ সাধেন প্রধানমন্ত্রী। বললেন, “ জাঁহাপনা! ওদেরকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে আছে? এত বড় ফৌজ রাজ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।”
সম্রাট রাগান্বিত হয়ে বললেন, “ওদের এখন গুরুত্ব না দিলে পরে তোমার কোনো গুরুত্বই আমার কাছে থাকবে না।”
সেনা অভিযানে বিদ্রোহীদের প্রায় সকলে মারা গেলেন। কিন্তু এদের নেতাকে তারা ধরতে সক্ষম হল না। আর বিশাল সেনা অভিযান রাজ্য জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ইতিমধ্যে। কৌশলী বিপ্লবী নেতা বুদ্ধি খাটিয়ে সুযোগটা কাজে লাগান। বিপুল পরিমাণ বিপ্লবী তৈরি করে ফেলেন খুব অল্প সময়। বলা যায়, বিপ্লব যেন রক্তে মিশে গেছে। অবস্থা দেখে সম্রাট বেশ চিন্তিত হলেন। সমস্যা সমাধানে শুভাকাঙ্ক্ষীদের ডেকে পরামর্শ করে মত জানতে চাইলেন। সবাই নিজের মত প্রকাশ করল। কিন্তু কোনোটাই সম্রাটের মনপুত হলো না। অতঃপর বললেন, “বিপ্লবীদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে যেভাবেই হোক ওদের নেতাকে বের কর। এর জন্য ধরপাকড় আর গুম-খুন যা ইচ্ছা তাই কর।”
সম্রাটের ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা এই প্রস্তাবে বাধ সেধে বলে উঠলেন, “জাঁহাপনা! লোহার শেকল মানুষের দেহকে বন্দী করে, মন ও চিন্তাশক্তি কে নয়। আর সোনার শেকল মস্তিষ্কক বন্দী করে। অতএব ধরপাকড়ের চেয়ে লালসা বেশি ফলদায়ক।”
সম্রাট তার প্রস্তাব শুনে সেটাই করতে আদেশ দিলেন। সময়ের সাথে সাথে কিছু অক্ষম বিপ্লবী পাওয়া গেল। যারা অল্প মূল্যে তাদের মস্তিষ্ক বিক্রি করে দিল। অতঃপর বিপ্লবীদের নেতাকে গ্রেফতার করে আনা হলো। তাকে পেয়ে সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছ কেন? কি চাও আমার কাছে? আমি তো বরাবরই আইনের শাসন করে চলছি। তবুও কেন আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছ? তুমি চাইলে যেকোনো অঞ্চল তোমাকে দিতে পারি।”
বিপ্লবী বুক ফুলিয়ে উত্তর দিলেন, “আমি এসব কিচ্ছু চাই না। আমি শুধু চাই আপনি আইনের শাসন রেখে ন্যায়ের শাসন করুন। আইনের শাসন ফেরাউন নমরুদরাও করত। কিন্তু ন্যায়ের শাসন সবাই করতে পারেনি।”
সম্রাট বিপ্লবীর জবাব বুঝেছে কিনা সেটা বোঝা গেল না। রাগান্বিত অবস্থা থেকে কিছুটা বোঝা গেল যে, বিপ্লবী নেতার উদ্দেশ্য পূরণ হতে চলেছে। যাবার আগে সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, “মরার আগে তোমার কোনো শেষ ইচ্ছা আছে যেটা আমার দ্বারা পূরণ করা সম্ভব?”
বিপ্লবী হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দিল, “জ্বী, আছে। আমি চাই আমার মৃত্যুদণ্ড রাজধানীর মাঝ বরাবর কোনো বিরাট মাঠে হোক। যেখানে রাজ্যের সব অঞ্চলের কিছু করে মানুষ একত্রিত হতে পারে। আর আমি তাদের সামনে একটা বাক্য উচ্চারণ করতে পারি।অর্থাৎ, আমি চাই আমার মৃত্যুদণ্ড সবাই দেখুক। আশাকরি, মহানুভব সম্রাট এটা করতে অক্ষম নন।”
আত্ম অহমিকার কথা না হলে হয়তো সম্রাট এই প্রস্তাবে কোনোদিনও রাজি হতেন না। তাই সভাসদদের সামনে নিজের মর্যাদা বজায় রাখতে রাজি হলেন। অতঃপর রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকের আসতে শুরু করল। সময় এসে গেল মৃত্যুদণ্ডের। সম্রাটের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটা বাক্য উচ্চারণ করার উদ্দেশ্য বিপ্লবী বললেন, “সফলতা সর্বদাই বিধাতা হুকুম, তবে কখনো কখনো ব্যক্তি বিশেষের সফলতার সমষ্টির জন্য ক্ষতিকর।”
অতঃপর ভর দুপুরে ফাঁসি হয়ে গেল বিপ্লবী নেতার। সম্রাট ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় সেই বৃদ্ধের সাক্ষাৎ পেলেন। আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস উত্তরাঞ্চলের কথা। বৃদ্ধ কিছুটা দম নিয়ে বললেন, “দক্ষিণের সূর্য আজ মাথার উপরে। আমরা এখন সবাই আলো পাচ্ছি। মাঝে মাঝে একটু আধটু মেঘ দেখে ভয় পাই না.....
নোট: ১. সবসময় শাসক ব্যক্তি হিসেবে ভালো হলে রাজ্যের শাসন ভালো হবে এমন নয়। অনেক সময় শাসকের আশেপাশের মানুষে অপশাসনের জন্য অনাচার সৃষ্টি হয়।
২. আইনের নির্ধারণের ক্ষমতা শাসকের হাতে থাকলে ন্যায় বিচার হওয়া কঠিন হয়ে পরে। ন্যায়ের জন্য অপরিবর্তিত মানদণ্ড দরকার।
৩. অধিকাংশ সময় বিপ্লবীদের মৃত্যু আলো ফোটায়।
৪. লোভ লালসা নিজের আত্মমর্যাদা ধ্বংস করে। মস্তিষ্ক পঙ্গু করে দেয়।
©somewhere in net ltd.