নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বদলে যাও, বদলে দাও...

আকাশ ইকবাল

আকাশ ইকবাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম কিশোর শহীদ মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম

১৪ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:১০



যে দেশে একদল যুবক বিশ্বজিৎ নামের একটি নিরীহ তরুণকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে, যে দেশে একদল তরুণ হলি আর্টিজানের মতো নৃশংস হত্যাকাযজ্ঞ ঘটাতে পারে, যে দেশে ১৪-১৫ বছরের একটি কিশোর ধর্ষক হতে পারে, সেই দেশেই কি ক্ষুদিরামের জন্ম হয়েছিল? ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে! আর সে কারণেই মনে হয়, আজ থেকে ১১০ বছর আগে মুক্ত বাতাস, মুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কিশোর হাসিমুখে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছিল সেই অগ্নিকিশোর ক্ষুদিরামকে আমরা ভুলে গেছি, তাঁর দেখানো পথ আমরা অনুস্মরণ করি না। হ্যাঁ। কিছু কিছু তরুণ প্রজন্ম ঠিকই ক্ষুদিরামের মতো চরিত্র পেয়েছে। যার প্রমাণ আমরা পাই চলতি বছরে ঘটে যাওয়া আমাদের দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।
১৯০৩ সাল। ক্ষদিরাম তখন স্কুলের ছাত্র। বয়স তখন ১৪ বছর। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আরেক পুরোধা হেমচন্দ্র তখন প্রায় মেদিনীপুর যেতেন। একদিন সন্ধ্যা বেলা তিনি মেদিনীপুরের এক নির্জন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্ধকারে রাস্তার ধারে বসে থাকা একদল তরুণের মধ্যে একটি কচি ছেলে হঠাৎ দৌঁড়ে এসে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সহজ ভাবে বলে তাকে একটা রিভলবার দিতে হবে। হেমচন্দ্র খুব অবাক হলেন। হেমচন্দ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন তুমি রিভলবার দিয়ে কি করবে? জবাবে উত্তর দিলেন, ভারতের উপর ইংরেজরা যে অত্যাচার করছে তার প্রতিশোধ নিতে সে একটা শাহেব মারবে। হেমচন্দ্র পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ক্ষুদে বালকটি ছিল ১৪ বছরের ক্ষুদিরাম।
দেশ্রপ্রেমের আগুনে এই কিশোর বিপ্লবী ব্যক্তিগত সব ইচ্ছা আকাঙ্খা এমন ভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল যে, উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সব টাকা ও তিনি স্বদেশী আন্দোলনের থবিলে দান করে দিয়েছিলেন। এক বার তাঁর দিদি ঠিক করেছেন ছন্নছাড়া ভাইটিকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করলে হয়তো এই মরণপণ লড়াই থেকে দূরে রাখা যাবে। তাই ভাইয়ের কাছে গিয়ে বিয়ে কথা বললে ক্ষুদিরাম বললেন 'দিদি ! বিয়েটা এখন থাকুক! আগে সাদা পঙ্গপালগুলোকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিই। তার পর তোমার কথা মতো বিয়ে করবো। বোন জিজ্ঞেস করলেন পঙ্গপাল আবার কারা? উত্তরে ক্ষুদিরাম বললেন, ‘দেশের লোকে খেতে পায় না, ওদিকে ফিরিংগীর দল দেশের সমস্ত চাল নিয়ে জাহাজ বোঝাই করে ম্যানচেষ্টারে কাপড়ের মার দেবার জন্য সমুদ্র পাড়ে চালান দিচ্ছে।
পরিবারের সবাই ক্ষুদিরাম কে নিয়ে খুব দুঃচিন্তায় থাকতো। কারণ, কখন কাকে কি দিয়ে দিবে। হয়তো ক্ষুধার্থ মানুষকে নিজের খাওয়ার দিয়ে নিজেই সারাদিন অনাহারে থাকবে। তাই সকলেই থাকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করতো। কিন্তু অসহায় মানুষের বেদনায় যাকে কাঁদায় তাকে কি চোখে চোখে রেখে ধমিয়ে রাখা যায়?
স্কুল শিক্ষকের কাছে সে বরাবরই অপদার্থ। অসহায় মানুষের বিপদের মুহূর্তে জীবনবাজি রেখে ভয়ডরহীন ভাবে ক্ষুদিরাম ঝাঁপিয়ে পড়তো তাদের বাঁচাতে। অসহায় দুস্ত মানুষের প্রতি ক্ষুদিরামের অন্তহীন ভালোবাসা বোঝা যায় নি¤œক্ত ঘটনা থেকে। ‘শীতের সকালে এক ভিক্ষুক সাহায্যের জন্য এসেছিলো। শরীরের ছেঁড়া কাপড় শীত আটকাতে পারছে না। ঠান্ডা হাওয়ায় ভিক্ষুকটি কাঁপছে। অথচ ভিক্ষুককে কিছু দেবার মতো ঘরে কিছুই নেই। সম্বল আছে শুধু পিতার স্মৃতি জড়ানো একটি শাল। ক্ষুদিরাম নির্দ্বিধায় তার পিতার স্মৃতি জড়ানো শেষ সম্বলটিও ভিক্ষুককে দিয়ে দিলো।’
আরও একটি ছোট্ট ঘটনা। একবার মেদিনীপুরে কলেরা মহামারিতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তখন কলেরা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। অনেকে পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজনকে ফেলে রেখে নিজেদের জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাচ্ছে। খবর পাওয়া মাত্রই অকুণ্ঠচিত্তে কর্তব্য স্থির করে ফেলল ক্ষুদিরাম। সে যে মানুষকে ভালোবাসে, মানুষের এমন দুঃসময়ে সে কি দূরে থাকতে পারে? তাই পরিবার পরিজনের নিষেধ অমান্য করে ক্ষুদিরাম এসে দাঁড়ালো রোগাকান্ত মানুষের পাশে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত রোগাকান্ত মানুষকে সেবা করলো। সে সময় কলেরা আক্রান্ত মৃত মানুষকে দাহ করার জন্যও লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। এই কাজটিও করেছিলো স্কুলের পরিচিত অপদার্থ সেই ছেলেটি।
রোগে দারিদ্রতায়, অপুষ্টিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। খাদ্য নেই, শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই, ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার অপনাধে বেঁচে থাকার অধিকার থেকেও বঞ্চিত। অন্যায়- অত্যাচারের প্রতিকার চাই। আর তার জন্য দেশকে মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে রক্ত ঢালতে হবে, জীবন দিতে হবে। শিশুকালেই এই নির্মম সত্যকে উপলব্ধি করে নিজেকে তার উপযোগি করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে থাকে সে। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মদান করে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছে- ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/ হাসি হাসি পরবো ফাঁসি/ দেখবে ভারতবাসী।’
১৯০৮সাল। কিংস্ফোর্ডকে হত্যার দায়ে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। ফাঁসির আদেশ শুনেও ক্ষুদিরাম হাসছে। বিস্মিত হয়ে বিচারক ভাবলেন, কিশোর আসামী হয়তো রায়ের অর্থ বুঝতে পারেনি। তাই বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কোর্টের আদেশের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছেন কিনা। হাসিমুখেই ক্ষুদিরাম উত্তর দিলেন, নিশ্চয়! বিচারক আবার জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কিছু বলতে চান কি না। আদালতের কক্ষে ভিড়ে ঠাসা। উৎকর্ণ দর্শকদের চমকে দিয়ে ক্ষুদিরাম উত্তর দিলেন, আমাকে একটু সময় দিলে বোমা তৈরির কৌশলটা শিখিয়ে দিতে পারি। পাশে দাঁড়ানো এক পুলিশ সার্জেন্ট অনুচ্চ কন্ঠে বলে উঠলেন, এ সে দেখি সিংহের বাচ্চা!'
ফাঁসি হতে দু-চার মিনিট বাকি। তখন ক্ষুদিরাম নিজেই ফাঁসির রশির সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত। ফাঁসির দড়িতে মোম লাগিয়ে আবার আরামদায়ক করার দরকার কি? ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট হাসিমুখেই আত্মাহুতি দিলেন ফাঁসির মঞ্চের প্রথম শহীদ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। যাবার আগে চারণ কবির সেই প্রতিশ্রুতি যেন দিয়ে গেলেন-
'' আঠারো মাসের পরে
জনম নেব মাসীর ঘরে;
মা গো
চিনতে যদি না পার মা
দেখবে গলায় ফাঁসি''
স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে আত্মাহুতি দিয়ে হাজারো প্রাণে স্বাধীনতা আন্দোলনের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে যে প্রতিশ্রুতি রেখে গেলের তার পথ ধরেই এলো ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের শেষ ঘন্টা বাজানো সুভাস বোস, সূর্যসেন, প্রীতিলতার মতো হাজারো বিপ্লবীরা। ফাঁসির মঞ্চের সেই অমাল হাসি দিয়ে মরণজয়ী ক্ষুদিরাম যেন প্রমাণ করে গেলেন... 'আমি বিপ্লবী, আমি সত্যাশ্রয়ী, তাও মৃত্যুর চেয়েও বড়!'

লেখক:
আকাশ ইকবাল:
সংবাদকর্মী ও প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.