![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্সে এমবিএ করছি— স্বপ্ন দেখছি। একসময় প্রচুর বই পড়তাম, বইয়ে ডুবে থাকতাম। গল্প নামক হাবিজাবি লিখতাম। তারপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বিতর্ক করে বেড়িয়েছি কিছু কাল।
১.
শীতের সকালে লেপের নীচ থেকে ঘুম ভেঙে উঠার মতো কষ্টকর শাস্তি— পৃথিবীতে আর একটি আছে বলে আমার মনে হয় না । হাজতের আসামীদেরকে যদি পিটিয়ে শরীরে ‘আলু ক্ষেত’ বানানোর থেরাপি বা ‘সেদ্ধ ডিম থেরাপি’ না দিয়ে, শীতের সকালে লেপের নীচ থেকে ঘুম ভাঙিয়ে টেনে তোলার থেরাপি দেওয়া হতো; তবে আমাদের দেশের অপরাধ প্রবণতা শেয়ারের দামের মতো ধাইধাই করে কমে যেতো । কিন্তু এ দেশে কোন কিছুই জনগনের চাহিদা মতো হয় না । ঠিক এখন যেমন আমি আমার চাহিদা মতো ঘুমুতে পারছি না । রান্নাঘর থেকে আম্মু আমার নাম ধরে অনর্গল-ভাবে ডেকে যাচ্ছেন ।
চিৎকার-চেঁচামেচি সহ্য করতে না পেরে বিছানা ছেঁড়ে উঠে বসলাম । অনেক দিনের সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রেমিকা যখন চলে যায়, তখন প্রেমিক যেভাবে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে— ঠিক সেভাবেই লেপের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম । তারপর আজকের মতো লেপ-সঙ্গ বিসর্জন দিয়ে উঠে রান্না ঘরে গেলাম । চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে আম্মু? এভাবে ডাকছো কেন?’
‘ডেকেছি, কাজেই ডেকেছি । শোন, জরুরী একটা কথা । গত শুক্রবারের ঘটনা । তোর বাবাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে নিউ মার্কেটের দিকটায় গিয়েছিলাম । কয়েকটা দোকানে ঢুঁকে শাড়ি দেখেছিলাম । একটাও পছন্দ হচ্ছিল না । পরে ক্লান্ত হয়ে একটা দোকানে ঢুকে যা দেখলাম, তাতে আমার তো পুরো আক্কেল গুড়ুম । দেখি কী— আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী শেফালী; ছেলেকে নিয়ে শাড়ি কিনতে এসেছে । ওকে দেখে আমার কি যে খুশি লেগেছে, তা তোকে বলে বুঝাতে পারবো না ।’
‘আম্মু, তুমি কি এই খুশির ঘটনা বলার জন্য আমাকে ঘুম থেকে তুলে এনেছো? এটা তো গত চার দিনে কমপক্ষে সতের বার বলেছো তুমি !’
‘না, এটা বলার জন্য ডাকিনি । এর চেয়েও খুশির কথা বলার জন্য ডেকেছি ।’, আম্মু শীতকালের লিপজেলের বিজ্ঞাপনের মতো লম্বা করে হেসে বলল, ‘আজ সকালে শেফালী ফোন করেছিল । বলেছে— ও আজ দুপুরে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবে !’
সাংসদদের লেকচার শোনার প্রতি সাধারণ মানুষের যেরকম অনীহা; ঠিক সেরকম একটা অনীহার ভাব প্রকাশ করে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললাম, ‘আম্মু, তোমার বান্ধবী তোমার বাসায় বেড়াতে আসবে এটা তোমার জন্য খুশির ব্যাপার । আমার জন্য না । আমি ঘুমুতে যাচ্ছি । শুধু শুধু ডাকাডাকি করে আমাকে আর বিরক্ত করো না তো !’
‘ঘুমুতে যাচ্ছি মানে ! তুই এখন ঘুমুতে গেলে কিভাবে হবে ! তোকে তো এখন বাজারে যেতে হবে । আজ শেফালী আমার বাসায় আসছে— ওকে ভাল-মন্দ কিছু খাওয়াতে হবে না নাকি?’
‘আমি কি খাওয়াতে না করেছি নাকি? অবশ্যই খাওয়াবে । ফ্রিজে মুরগীর মাংস আছে না? ওটা রান্না করে ফেলো ।’
আমি নিজের রুমে এসে বিছানায় বসলাম । শুয়ে পড়ব— এমন অবস্থায় উল্কার গতিতে আম্মু এসে হাজির হলেন । আমার বিছানায় বসতে বসতে বললেন, ‘মুরগী, গরু, খাসিতে শেফালীর অ্যালার্জি আছে; ও এসব খেতে পারে না । ওর পছন্দের খাবার হচ্ছে ইলিশ মাছ । আতপ চালের ভাতের সাথে সর্ষে ইলিশ যে ওর কত পছন্দ কী বলব তোকে ! একবার হয়েছে কী...।’
‘আম্মু, টাকা দাও; বাজারে যাই ।’ আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম আমি । তাঁর এই সর্ষে ইলিশের কাহিনী কম করে হলেও নিরানব্বই বার শুনেছি আমি । এখন যদি এই কাহিনী আবার শুনতে নেই তবে একশ বার হয়ে যাবে । আমি সেটা হতে দিতে চাচ্ছি না । আমি আম্মুকে গল্প বলার সেঞ্চুরী থেকে বঞ্চিত করে বাজারের জন্য হাঁটা শুরু করলাম । বাবা বাসায় না থাকার ‘ঠ্যালা’ চরমভাবে উপলব্ধি করছি ।
২.
মাছের বাজারে ঢুঁকে খুঁজে খুঁজে ইলিশ মাছ দেখছি । মোটা গোঁফওয়ালা এক মাছওয়ালা ডেকে বলল, ‘ভাই সাব, এদিকে আসেন । একদম টাটকা ইলিশ মাছ; নিয়া যান । খাইয়া আরাম পাইবেন ।’
আমি লোকটার মাছের ঝুড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম । ঝুড়ির চেয়ে উনার পেটের সাইজ বড় এবং উনার ঝুড়ির সব মাছই আকারে ছোট— একদম লিলিপুটের মতো অবস্থা । আমি বললাম, ‘আপনার মাছ তো একদম অল্পবয়স্ক ঝাটকা মাছ; খেয়ে মজা পাওয়া যাবে না । আমার দরকার একটু বয়স্ক টাইপের মাছ ।’
‘কী কন ভাই, অল্প বয়েস ! এই মাছ সাইজে একটু বাইট্টা হইতে পারে, কিন্তু বয়েস অল্প না । মানুষের মইধ্যে যেমন লম্বা-বাইট্টা থাকে, মাছের মইধ্যেও থাকে । মনে হয় খানা দানা ঠিক মতো পায় নাই এইজন্যেই পুষ্টির অভাবে এই মাছগুলান একটু বাইট্টা...।’
মাছওয়ালার এই অহেতুক লজিক আমার পছন্দ হয় নি, তাই অন্য জনের কাছে চলে গেলাম । পেছন থেকে ঐ ভুঁড়িওয়ালা লোক মিনমিনে গলায় বলছে, ‘মাছ কিনতে আইছে নাকি ডাইবেটিস কমানোর লাইগা বাজারে হাঁটাহাঁটি করতে আইছে— কে জানে !’
আমি আর কথা বাড়ালাম না । অন্য মাছবিক্রেতার কাছ থেকে মোটামুটি সাইজের মাছ কিনে বাজার নামক নরক থেকে বের হয়ে এলাম । তবে বের হয়েই বুঝতে পারলাম— বাজার থেকে বেরুনো কত বড় ভুল কাজ হয়েছে । আমার ঠিক কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে চা খাচ্ছে কবির ভাই ।
কবির ভাই আমাদের এলাকার সবচেয়ে চালাক মানুষ— এই কথাটা কবির ভাই নিজেই বুক ফুলিয়ে বলেন । তবে উনার মা বলেন, ‘কবির হইতেছে এই এলাকার গাধা নাম্বার ওয়ান । এলাকায় কোন গাধা নেই বলে ওরে বাধ্য হয়ে বাসায় রাখি । নইলে ওরে আমি ঠিকই গাধার খামারে নিয়ে দিয়ে আসতাম ।’
আমরা এলাকার ছেলে-পুলেরা, কবির ভাইয়ের কাছ থেকে নানান সুবিধা বাগানোর উদ্দেশ্যে কবির ভাইয়ের সামনে আন্টির বলা এই কথার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই । তবে মনে মনে স্বীকার করি যে— আন্টি যা বলেছেন তা শতভাগ খাঁটি !
কবির ভাই আমাকে দেখে মোলায়েম হাসি দিয়ে বলল, ‘ব্যাটা তুই ডুমুরের ফুল হয়েছিস নাকি? গুগলে সার্চ করেও তো তোকে খুঁজে পাই না ।’
‘নেট কানেকশন না থাকলে গুগলে সারাদিন সার্চ করেও কোন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না ।’ কথাটা আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে । তবে অতীতে প্রাপ্ত ও ভবিষ্যতে প্রাপ্য সুবিধার কথা চিন্তা করে নিজেকে সামলে বললাম, ‘আসলে ভাইয়া নানান কাজে বিজি-ব্যস্ত থাকি তো, তাই এলাকার কারো সাথে খুব একটা যোগাযোগ নেই ।’
‘তুই এলাকার অন্য সবার সাথে আমার তুলনা করিস ! আমি আর এলাকার অন্য সবাই কি এক?’
‘কী বলেন ভাইয়া !’ আমি দাঁত দিয়ে জিভে কামড় দিয়ে বললাম, ‘আপনি কেন অন্যসব যদু-কদুর মতো হবেন? আপনি হচ্ছেন ইউনিক মানুষ । তা বলেন তো, কী জন্য আমাকে খুঁজছেন? ঘটনা কী?’
কবির ভাই চোখ মুখ বড় করে বললেন, ‘তোকে যে আমি একটা মেয়ের খোঁজখবর বের করতে দিয়েছিলাম, সেটার ব্যাপারে কিছুই তো জানালি না । খোঁজখবর পেয়েছিস কিছু?’
আমি ডান হাত মাথার পেছনে নিয়ে খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ‘আসলে ভাইয়া, হয়েছে কী— যাবো যাবো করেও মেয়ের এলাকায় যাওয়া হয়নি । আর সেকারণেই...।’
‘বুঝেছি, তুই একটা কলা কাঠের ঢেঁকি । আমড়া কাঠের চেয়েও তিন গ্রেড নীচে । তোকে দিয়ে কোন কাজই হবে না । অবশ্য হবেই বা কি করে, তুই তো একটা ভুলোমনার বাপ । কোন কিছুই তোর মনে থাকে না । মনে থাকবেই বা কী করে? তোর তো মন বলেই কোন কিছু নেই । যদি মন থাকতো তবে কী...।’ কবির ভাই টমেটোর মতো গোল ও লাল চোখ করে আমাকে কথাগুলো শোনাচ্ছেন । আমি তার কথার মেশিনগান থামানোর জন্য বললাম, ‘ভাইয়া, আমার মাছ পঁচে যাচ্ছে । আমি আপনার সাথে বিকেলে দেখা করি?’
‘আমার সাথে তোর আর দেখা করতে হবে না । তুই যা, ভাগ ! আর তোর মাছ তো পঁচবেই; তুই নিজেই তো একটা পঁচা । তোর শরীর থেকে ভকভক করে পঁচা গন্ধ বেরুচ্ছে ।’
কবির ভাই আরও কি সব যেন অনর্গল ভাবে বলে যাচ্ছেন; আমি সেসব কানে না তুলে উসাইন বোল্ট স্টাইলে দৌড়ে গিয়ে রিকশায় উঠলাম ।
কয়েক সপ্তাহ আগে ভার্সিটির এক অনুজ মেয়েকে পছন্দ করেন কবির ভাই; মেয়ের বাসা ধানমন্ডিতে । আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল সেই মেয়ের বাসা খুঁজে বের করে তার চলাফেরার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া । ভুলোমনা আমি সব কিছু ভুলে যাওয়ার সূত্র অনুসারে মেয়ের বাসা খুঁজে বের করতেও ভুলে গেলাম । যার পরিণতি— আজকের এই উত্তপ্ত বাক্য গ্রহণ।
৩.
বাসায় মায়ের বান্ধবীর শুভাগমন উপলক্ষে ইলিশ মাছ সহ যাবতীয় তেল ও চর্বিযুক্ত ভালো খানা-দানার আয়োজন করা হচ্ছে । আমি আরাম করে রুমে শুয়ে শুয়ে আগাথা ক্রিস্টির বই পড়ছি আর দুপুরের ভূরিভোজনের কথা চিন্তা করে গোঁফে জেল দিচ্ছি । তেল দেয়ার মত ব্যাকডেটেড আমি নই । অবশ্য যদিও আমার গোঁফই নেই খুব একটা ! এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ । বাসার কাজের মেয়েটা বাড়ি গিয়েছে, মা এখন রান্না ঘরে; তাই বাধ্য হয়ে আমিই গেলাম দরজা খুলতে ।
দরজা খুলে আমি পুরোই দ্বিধায় পড়ে গেলাম ! আমি কী দরজা খুলেছি নাকি টিভিতে রেসলিং’এর চ্যানেল খুলেছি বুঝতে পারছি না । দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সুমো কুস্তিগিরের মহিলা ভার্সন; তাও শাড়ি-কাপড় পরা । উনার সাথে আছে দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রস্থে বড় এক কমবয়সী ছেলে । আমার মায়ের দেয়া সূত্রমতে উনারাই সেই বিশেষ অতিথি । আমি এই ‘বিশেষ’ ধরণের অতিথিদের ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুকে ব্রেকিং নিউজের মতো করে বললাম, ‘আম্মু, তোমার শেফালী এন্ড সন চলে এসেছে । ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে । আমি নিশ্চিত এই সোফার আয়ু দুই মাস কমে গেছে !’
আম্মু আমার কথায় কান না দিয়ে আমার হাতে তরকারি নাড়ানোর খুন্তি ধরিয়ে দিয়ে ‘আরে শেফালি’ বলে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালেন । আমি টমি মিয়ার মতো খুন্তি ধরে পোজ দেয়ার স্টাইলে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
তবে এভাবে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ পেলাম না । আম্মু খানিক বাদে ফিরে এসে অর্ডার দিলেন, ‘শেফালীর নাকি গরমে হাঁসফাঁস লাগছে । লেবুর শরবত খেতে চাইছে । তারাতারি করে শরবত বানিয়ে দে তো ।’
শীতের দুপুরে রোদ বেশ ভালোই উঠেছে । তবে শরবত খাওয়ার মতো রোদ উঠে নি । তবুও কেন শেফালী আন্টির শরবতের প্রয়োজন পড়ল তা আমার মাথায় ধরছে না ।
মাথা না ধরা সত্ত্বেও আমি মায়ের আদেশ শিরোধার্য করে নেমে গেলাম ‘মিশন শরবত’ সম্পূর্ণ করা জন্য । ‘হাই ডে’ নামক একটা এন্ড্রয়েড গেইমে আমি নানান পদের জিনিস অনায়েশে বানাতে পারলেও এখানে মামুলি লেবুর শরবত বানাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি । তবে আমিও হাল ছেঁড়ে দেয়ার পাত্র নই । একবার না পারিলে দেখো শতবার— কথাটা মনে মনে চিন্তা করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম মিশনে । লেবু কচলে তেঁতো করে ফেলব আজকে !
যদিও একবার না পারিলে দেখো শতবার— কথাটা আমার কাছে মোটেও সঠিক মনে হয় না । গত সেমিস্টার ফাইনালের কথা, সেদিন ম্যাথ পরীক্ষা চলছে । আমি দুরুদুর বুকে পরীক্ষা দিচ্ছি । দিতে দিতে একসময় একটা অংকে ভারতীয় সিরিয়ালের মতো কুটিল প্যাঁচ লেগে গেলো । আমি কোন ভাবেই বেচারার সমাধান করতে পারছি না । বাধ্য হয়ে পাঁশের জনের খাতায় উঁকি দিয়ে অংকের সমাধানটা দেখার চেষ্টা করলাম । তবে আমি ওর খাতার কোন কিছু স্পষ্ট ভাবে না দেখতে পেলেও স্যার কিন্তু ঠিকই আমাকে স্পষ্ট দেখে ফেললেন । মহিষের মতো কন্ঠে বললেন, ‘এই ছেলে, তুমি যদি আর একবার তোমার পাঁশের জনের খাতা দেখার চেষ্টা করো তবে আমি তোমাকে এক হাত দেখে নেবো ।’
আমি গর্জন শুনে নেতিয়ে গেলাম । খানিক সময় নিজে নিজেই অংক করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবারও এক পলক দেখার জন্য যেই জিরাফের মতো গলা উঁচিয়েছি— অমনি স্যার এসে খাতা নিয়ে আমাকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দিলেন ।
আমি স্যারকে বলতে চেয়েছিলাম, ‘স্যার, কবি বলেছেন— একবার না পারিলে দেখো শতবার । কিন্তু আমি তো শুধু দুই বার দেখেছি; বাকী আটানব্বই বার দেখার সুযোগ কি আমি পাবো না?’
তবে ঐ দিন আমি কিছুই বলতে পারিনি । শব্দহীন ছিলাম । তবে এখন ঠিকই শব্দ হচ্ছে । ড্রয়িং রুম থেকে আম্মু শরবত নিয়ে যাওয়ার জন্য শব্দ করে ডাকছেন । আমি ছেলে হয়েও বিবাহযোগ্যা মেয়েদের মতো লাজুক ভঙ্গীতে শরবতের ট্রে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে ঢুকলাম । শেফালী আন্টি আমার আম্মুর দিকে তাকিয়ে দন্ত বের করে হাসি দিয়ে বললেন, ‘তোর ছেলে তো বেশে কাজের !’
‘হু, আমি কাজের ছেলে ।’ মনে মনে বললাম ।
৪.
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছি আমরা চারজন । আমি, আম্মু, শেফালী আন্টি আর উনার ছেলে । টেবিলের উপর সদ্য শেষ করা শরবতের খালি গ্লাস । শেফালী আন্টির ছেলে বাবুর হাতের গ্লাসে এখনো খানিকটা শরবত আছে । এটা তার তৃতীয় গ্লাস চলছে । প্রথম গ্লাস শেষ করে সে দ্বিতীয় গ্লাস চেয়ে নিয়েছে, তারপর তৃতীয় । শেফালী আন্টিও বোধ হয় মনে মনে দ্বিতীয় গ্লাস চাচ্ছিলেন; তবে চক্ষু লজ্জার কারণে মুখে বলতে পারলেন না ।
চৌকোণা টেবিল বৈঠকের প্রধান বক্তা দুই জন; আম্মু আর শেফালী আন্টি । আমি আর বাবু হচ্ছি শ্রোতা । শেফালী আন্টি বক্তব্য দিচ্ছেন, ‘আমার ছেলে বাবু কিন্তু খুবই মেধাবী । এবার ও ক্লাস সেভেনে সেকেন্ড হয়েছে । ওর ক্লাসের পঁচিশ জনের মধ্যে অংকে ও সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছে...।’
আম্মু মুখ কালো করে বসে রইলেন । আমিও মাথা নিচু করে রইলাম । কারণ বলার মতো রেজাল্ট আমার কোন কালেই ছিল না । এখনো নেই ।
আন্টি আবার শুরু করলেন, ‘আমার মেয়েও খোদার ফজলে বেশ ভালোই ব্রিলিয়ান্ট । তবে ভাগ্যের কারণে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পায়নি । ঢাকা ভার্সিটির পরীক্ষার সময় ওর ছিল আকাশ-পাতাল জ্বর । আর জাবির পরীক্ষার আগের দিন আমার মামাতো ভাইটা মারা গেল । এখন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছে ।’ এই পর্যায়ে শেফালী আন্টি খানিকটা মন খারাপ করলেন । তবে পর মুহূর্তেই মুখে হাসি এনে বললেন, ‘প্রাইভেটে পড়লেও ওর সিজিপিএ কিন্তু খারাপ না । ব্যাচের টপার !’
‘শেফালী, তুই তোর মেয়েকে নিয়ে এলি না কেন?’ আম্মু জিজ্ঞেস করলেন ।
‘আজকে নাকি ওর একটা জরুরী ক্লাস আছে; শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে যাবে । তাই আসতে পারে নি ।’
‘বিকেল তো প্রায় হয়ে যাচ্ছে । তোর মেয়েকে ফোন করে বলে দে ক্লাস শেষ করে যেন সোজা আমাদের বাসায় চলে আসে । বাসা চিনতে পারবে তো? না চিনলে সমস্যা নেই । আমার ছেলে গিয়ে চিনিয়ে নিয়ে আসবে ।’
আমি এই কথা শুনে হিটলার স্টাইলে আম্মুর দিকে তাকালাম । আম্মুকে হিটলার দৃষ্টিকে বাঁ হাতের বৃদ্ধা আঙুল দেখিয়ে শেফালী আন্টিকে বললেন, ‘অনেক বেলা হয়ে গেছে শেফালী; আয় ডাইনিং টেবিলে আয় । খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে ।’
‘তোর সাহেবকে ফেলে খেয়ে ফেলবো ! উনি আসুক; সবাই মিলে এক সাথে খাই?’
‘ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকলে মিশরের মমি হয়ে যেতে হবে । কখন আসবে, না আসবে— তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই । তোরা আয়, খেয়ে নে ।’ আম্মু শেফালী আন্টির হাত ধরে টেবিলের দিকে টানতে টানতে বললেন ।
আমরা সবাই মিলে একটি সমৃদ্ধ খানা-দানা শেষ করার পর শেফালী আন্টির ব্যাগ বাজখাই এক রিংটোন বেজে উঠল ।
শেফালী আন্টি ব্যাগ থেকে ফোন বের করলেন । এটা উনার রিংটোন । কানে ধরে উনি উচ্চস্বরে বললেন, ‘ত্রপা, তোর ক্লাস শেষ হয়েছে? ক্লাস শেষ হলে একটা রিকশা নিয়ে মোহাম্মদপুরে চলে আয় । আমি এখনো তোর আন্টির বাসায় আছি । তোর আন্টির ছেলে তোকে বাসা চিনিয়ে নিয়ে আসবে । ওদের বাসার ঠিকানাটা হচ্ছে...।’
আন্টি ফোন শেষ করলেন । আমার উপর দায়িত্ব পড়ল— উনার মেয়েকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের সহিত বাসায় নিয়ে যাওয়ার । আমি ‘নীতিবান পুলিশ অফিসার’ নামক বাংলা সিনেমার নায়কের মতো নীতিবান হয়ে চলে গেলাম বাসার সামনে । শেফালী আন্টি এবং উনার ছেলের যেহেতু বিশাল বপুর অধিকারী তাই রিকশায় যত মোটা মেয়ে দেখছি সবার দিকেই বিশেষ নজর রাখছি । আমার শতভাগ নিশ্চিত— শেফালী আন্টির মেয়েও উনার মতোই হবে ।
তবে আমার নজর ও ধারণা এড়িয়ে সুশ্রী ও সঠিক স্বাস্থ্যের এক তরুণী এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এক্সকিউজ মি, আপনিই কি রুদ্র?’
৫.
সন্ধ্যে হয়ে আসছে প্রায় । ছাদের উপর দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত দেখছি আমি আর ত্রপা । কবির ভাই তার যে অনুজের উপর ক্রাশ খেয়েছিলেন— ত্রপাই হচ্ছে সেই অনুজ ! তবে আমি সে কথার কিছুই বললাম না । উল্টো ত্রপাই নিজে থেকে বলল, ‘আপনাদের এলাকার কবির নামে একজন আমাদের ডিপার্টমেন্টে পড়ে । উনার মতো ছ্যাঁচড়া লোক আমি আমার লাইফে দেখিনি । ভার্সিটিতে সারাদিন আমার পিছনে ছ্যাবলার মতো ঘুরে । অসহ্য ! আপনি চিনেন নাকি উনাকে?’
আমি আমতা আমনা করে বললাম, ‘আমি বাসা থেকে খুব একটা বের হই না তো; তাই খারাপ কোন ছেলের সাথে আমার কোন পরিচয় নেই ।’
‘না থাকলেই ভালো ।’ বলে অনেক দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিল ত্রপা । কুয়াশায় ঢেকে যেতে থাকা পৌঢ় বিকেলের পৃথিবী দেখছে সে । আমি ত্রপার দিকে তাকিয়ে আছি অপলক ভাবে; ওর দিকে তাকিয়েই আমি আমার পৃথিবী দেখার চেষ্টা করছি ।
আমি যে ত্রপার দিকে তাকিয়ে আছি, আমি জানি ত্রপা সেটা নিশ্চিত বুঝতে পারছে; তবে সে আমাকে কিছুই বলছে না । হয়তো আমার দৃষ্টিতে মন্দ খুঁজে পায় নি বলেই কিছু বলছে না । কারণ, মেয়েরা নাকি তাঁদের প্রতি কোন মানুষ কোন দৃষ্টিতে তাকায় তা খুব ভালোই বুঝতে পারে ।
আচ্ছা, আমি যে এখন ত্রপার দিকে তীব্র ভালোবাসাময় পবিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ত্রপা কি এই তাকিয়ে থাকার মানে বুঝতে পারছে? আমি কিন্তু খুব করে চাইছি মেয়েটা এই তাকিয়ে থাকার মানেটা বুঝতে পারুক ।
০২ জানুয়ারি, ২০১৫১.
©somewhere in net ltd.