নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রকাশক পপি চৌধুরী

লেখক পপি চৌধুরী

প্রকাশক পপি চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভয়

২৭ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৫৬

ভয়

পপি চৌধুরী



গভীর রাত। বেতনা গ্রামরে অধকিাংশ মানুষ গভীর ঘুমে মগ্ন। ঘুম নাই ফজল মাতব্বর এবং তার পরিবারের চোখ। গোপন বৈঠক বসেছে ভিতরের কক্ষে।

নিজের কিশোরী কন্যার সতীত্ব রক্ষা করতে না পারার অপরাধে অপরাধী জুলেখা। ভয়ে বুকের ভিতর দ্রিম-দ্রিম করে দামামা বাজছে। প্রয়োজনে স্বামী ফজল মাতব্বর যে কতটা নৃশংস আর ভয়ংকর হতে পারে সে কথা তার চাইতে ভালো আর কে জানে!

ভুল তোমার। মাইয়া বড় হইছে, তারে সামলাইয়া রাহোনের দায়িত্ব তোমার। তুমি সেই দায়ত্বি যথাযথ পালন করো নাই। আমি মনে করি লাইলীর পাশাপাশি তুমিও সমান অপরাধী। শাস্তি তোমারও পাওন দরকার। তয় আমার কথা যদি ঠিকঠাক মতন শোন, তাইলে এইবারকার মতন তোমারে মাফ কইরা দিতে পারি।

গভীর আতঙ্ক নিয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় জুলেখা।

পরিবারের সম্মান বাঁচাতে বজ্রকঠিন কন্ঠে ফজল মাতব্বর তার রায় ঘোষণা করে। স্বামীর রায় শুনে চমকে ওঠে জুলেখা। কাঁপতে কাঁপতে ভীতকন্ঠে বলে,

এইটা আপনে কী কন!

অনেক ভাইবা দেখলাম, আর কোন উপায় নাই।

তাই বইলা...

আমি পাঁচ গ্যারামের বিচার-শালিস করি। সবাই আমারে মান্য করে। ঘটনা জানাজানি হইলে আর আমারে কেউ মানবো? সম্মান দিবো?

তোমরা কী কও?

অদূরে দাঁড়ানো তিন পুত্রের কাছে জানতে চায় ফজল মাতব্বর।

তিনজনই প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে,

আপনে ঠিকঅই বলছেন, এইডা আমাগো মান-সম্মানের ব্যাপার। তাছাড়া ঘটনা জানাজানি হইলে আমাগো অন্য দুই বইনের সংসারেও অশান্তি হইবো।

লাইলীও তোমাগো বইন! বয়স মাত্তর বার বচ্ছর সাত মাস। পোলাপান মানুষ। অর কী অহনও ভালোমন্দ বুঝ হইছ? ক্যামন কইরা যে এমন একটা র্দুঘটনটা ঘটলো কিছুই কইবার পারে না। জিগাইলে খালি কান্দে আর কান্দ। অরে তোমরা এইবারকার মত মাফ কইরা দ্যাও।

অহন তো ঘরে সামলাইয়া রাখছো, দুইদিন পর যহন আর ঘটনা গোপন রাখতে পারবা না তহন মানুষেরে মুখ দেখাইবা ক্যামন?

দাঁতে দাঁত পিষে জানতে চায় ফজল মাতব্বর। স্বামীর কথা শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে জুলখো। ধমকে ওঠে মাতব্বর;

চুপ! ব্যাক্কল মাইয়া মানুষ।

জুলেখা আকুল হয়ে কাঁদে। সে তার নির্মম স্বামীরে ভালোভাবেই চেনে। মুখ দিয়ে এই মানুষটা একবার যে কথা বার করে তা ফিরানোর সাধ্য দুনিয়ার কারো নাই। ছেলে তিনটাও বাপের ধারা পাইছে।

অনেক দেরি হইয়া গ্যাছে, কান্নাকাটি থামাইয়া অহন আমি যা কই মন দিয়া শোন। ভুলটা তোমার, তুমি মাইয়ারে ঠিকঠাক মতন সামলাইয়া রাখতে পারো নাই। অহন তোমারেই এই সমস্যার সমাধান করতে হইবো।

আর্তনাদ করে স্বামীর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে জুলেখা।

আপনের পায়ে পড়ি এমন কথা কইয়নে না।

যদি তোমার মাইয়ার মতন পরণিতি না চাও তো যেমনে কইলাম তেমনে কাম করবা। ফরহাদ (বড়পুত্র) তোমারে সাহায্য করবো।

শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় ফজল মাতব্বর।

***

কাঁদতে কাঁদতে লাইলীর ঘরে প্রবেশ করে জুলেখা। বিছানায় কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে লাইলী। হাতের কুপিটি তুলে ধরে মেয়ের মুখের ওপর। কী মায়াবতী মুখ! কোন পাষণ্ড এই নিষ্পাপ মুখের ওপর এমন করে কালিমা লেপে দিল! পরক্ষণে স্বামীর সিদ্ধান্তের কথা মনে করে শিউরে ওঠে।

দ্রুত হাতের কুপিটি মেঝেতে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে। মোনাজাতের ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘হে খোদা, তুমি আমার সন্তানের জীবন ভিক্ষা দাও... ভিক্ষা দাও খোদা...

***

পরদিন সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গে প্রথমেই মাতব্বর তার স্ত্রীকে আজকের কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দেয়। জুলেখা আবার তার স্বামীর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। তার কান্নায় পাষাণও বুঝি গলে কিন্তু তার স্বামীর মন গলে না।

দুপুরে নিজের হাতে সাবান দিয়ে লাইলীকে গোসল করায় জুলেখা। পরিপাটি করে মেয়ের চুল আঁচড়ে দেয়। নিজের হাতে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে খাওয়ায়। খাওয়া শেষে সযত্নে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। এ কদিন মেয়েটাকে কত মারধোর আর গালমন্দ করেছে! কথাটি মনে হতেই বুকের ভিতরটায় হাহাকার করে ওঠে।

লাইলী বলে, তোমার আইজ কী হইছে, তুমি আমারে এত যত্ন করতাছো ক্যান?

মেয়ের প্রশ্নে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জুলেখা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বামী-পুত্রের নির্দয় মুখ।

মা তুমি কানতাছো ক্যান?

এমনেই, একটা খারাপ খোয়াব দেখছি গো মা...!

***

নয়টার দিকে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে যায় লাইলী। স্বামীর আদেশ পালন করতে পারে নি, তাই ভবিষ্যৎ শাস্তির কথা ভেবে আতঙ্কিত জুলেখা রান্নাঘরের এককোণে বসে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। এমন সময় যমদূতের ন্যায় হাজির হয় স্বামী এবং তিনপুত্র। কঠিন কন্ঠে ফিসফাস করে কিছু নির্দেশ দেয় তারা। মা হয়ে জুলেখা বড় পুত্রের দুই পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে। দু'হাতে ছেলের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলতে থাকে। কান্নার দমকে কথা কিছু বোঝা যায়, কিছু যায় না। বড় ছেলে তার হাতের মধ্যে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে দ্রুত পা টেনে নিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে।

কিছুক্ষণ পর একটা দুধের গ্লাস হাতে ভূতগ্রস্তের ন্যায় লাইলীর রুমের দিকে এগিয়ে চলে জুলেখা। পিছনে দাঁড়ানো স্বামী, তার পিছনে তিনপুত্র। কাঁপা হাতে মশারির কোনা তুলে ফ্যাঁসফ্যাঁসা কন্ঠে কন্যাকে ডাকে,

লাইলী, অ-মা লাইলী...

শোয়া থেকে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে লাইলী।

কী হইছে মা?

এই দুধটুক খাইয়া ল...

হাত বাড়িয়ে দুধের গ্লাসটা নিয়ে নিজের মুখের কাছে ধরে লাইলী।

জুলেখা মনে মনে আর্তনাদ করে ওঠে; খাইছ না গো মা, খাইছ না! তবে স্বামী-পুত্রের ভয়ে মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হয় না তার।

এক চুমুকে ঢক্ ঢক্ করে গ্লাসের সবটুকু দুধ পান করে লাইলী।

বাজপড়া মানুষের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে জুলেখা!

মা তুমি আমারে কী খাওয়াইলা, আমার গলা বুক যে জ্বইলা-পুইড়া যাইতাছে... বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে বিছানায় ঢলে পড়ে লাইলী।

চোখের সামনে প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যু মুহূর্তে জুলেখার মন থেকে সব ভয় ভীতি দূর করে দেয়। স্বামীর দিকে তাকিয়ে উম্মাদের ন্যায় চীৎকার করে ওঠে; রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার! আইজ আমি তর সব কু-কীর্তি ফাঁস কইরা দেবো। যুদ্ধের সময় তুই কত মাইয়ার সর্বনাশ করছোস, তার স্বাক্ষী আমি! আইজ তুই গাঁয়ের মাতবর সাজছোস? তর মাতবরী ঠিক রাখতে আমার অবুঝ মাইয়ার জীবনটা কাইড়া নিলি? আর আমি তরে ভয় পাই না... আর না...

ফজল মাতব্বরের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে। আতঙ্কিত কন্ঠে তিনি ছেলেদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ধর... ধর... তোর মায়ের মাথা খারাপ হইয়া গ্যাছে... তাড়াতাড়ি ধইরা রশি দিয়া বাইন্ধা রাখ...

বাবার নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে বড় ছেলে ও মেঝো ছেলে দ্রুত মায়ের দিকে এগোতে যায়, চোখের পলকে জুলেখা বেড়ায় গোঁজা গাছি দা (খেঁজুর গাছ কাটার লম্বা ধারালো দা) টেনে নিয়ে বলে,

আয়... গাছি দাওয়ের এক কোপে যদি মাথা নামাইয়া দিতে না পারি তয় আমি করম খাঁ'র মাইয়া না...

থমকে যায় ছেলেরা। মায়ের এই ভয়ংঙ্কর রূপ দেখে কেউ আর সামনে এগোতে সাহস পায় না!

ওরে তোমরা দেইখা যাও, রাজাকার ফজল মাতব্বর আর তার পোলারা মিইল্যা আমার লাইলীরে মাইরা ফালাইছে... আমার লাইলীরে মাইরা ফালাইছে...

গাছি'দা হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলতে থাকে জুলেখা।

মুহূর্তে নারী-পুরুষ-শিশুতে ভরে ওঠে উঠোন। চার দেয়ালের মাঝে থাকা ফজল মাতবরের পর্দানশীল বিবিকে এভাবে জনসম্মুখে দেখে বিস্মিত হয় সকলে। তার কথা শুনে উপস্থিত জনতার মাঝে শুরু হয়ে যায় গুঞ্জন।

তাইলে ফজল মাতব্বর রাজাকার আছিল...! যুদ্ধের সময় ঘোষবাড়ির নতুন বউটারে তাইলে সে-ই তুইলা নিয়া বেইজ্জতি করছিল...! সেই জন্যই কী বউডা গলায় দড়ি দিয়া ফাঁস দিছিল...! শুধু কী ঘোষবাড়ির বউ, আরো কত মাইয়া না ধইরা আনছিলো...! আমি আগেই এই রকম একটা সন্দেহ করছিলাম...! শেষ কালে নিজের মাইয়াডারেও...!



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:২৩

সুফিয়া বলেছেন: গল্পটা খুব ভাল লেগেছে পপি আপা।

সামু ব্লগে এটা আপনার প্রথম পোস্ট। অভিনন্দন রইল।

কয়েকটি জায়গায় অপ্রয়োজনীয় ইংরেজী শব্দ ঢুকে গেছে। এডিট এ গিয়ে ঠিক করে দিন।

ভাল থাকুন সব সময়।

২| ২৯ শে মার্চ, ২০১৫ ভোর ৪:০৩

প্রকাশক পপি চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ সুফিয়া আপা। আপনার ‌'আত্মজ' গল্পটিও খুব ভালো হয়েছে। তবে আমি তো নতুন ব্লগার তাই কমেন্ট করতে পারি নি।

৩| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৯:০১

দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: ভালো লাগল। শেষ কথাগুলো অনেক কিছু বলে দিল। বিবেকবর্জিত মানুষের কথা উঠে আসল গল্পে সেই সাথে সন্তানস্নেহা মায়ের করুণ কাহিনী। বেশ গোছানো সাবলীল লেখা।

৪| ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:৫৬

প্রকাশক পপি চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ দিশেহারা রাজপুত্র।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.