নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রকাশক পপি চৌধুরী

লেখক পপি চৌধুরী

প্রকাশক পপি চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

পিয়ন্তি (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি)

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৯:২১

মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব ছোট ছিলাম। অনেক কিছুই মনে নেই। আছে কিছু ভাসা ভাসা স্মৃতি। আমি সে সময় বাগেরহাটের নাটইখালী গ্রামে মামাবাড়িতে ছিলাম। মামাবাড়িটা ছিল নাটইখালী গ্রামের সব শেষ বাড়ি। এরপর বেতখালী গ্রাম শুরু। এটি মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। মামাবাড়ির পর থেকেই হিন্দু এলাকা শুরু। যার ফলে নানা, মামা এবং আমাদের সবার সাথে অন্যান্য মুসলিম পরিবারের তুলনায় হিন্দুদের সম্পর্ক এবং সখ্যতা বেশি ছিল।

নানার একজন হিন্দু বন্ধু ছিলেন। নানা তাকে সখা বলে ডাকতেন। নানার সেই সখার বাড়িতে বিয়ে-শাদী, মুখে ভাত, শ্রাদ্ধ বা যে কোন অনুষ্ঠানে এ-বড়ির সকলের দাওয়াত ছিল অবধারিত। আর প্রতিবছর নবান্নের দাওয়াত তো ছিল বাধা। এখনও মনে পড়ে কানা উচু বড় বড় কাঁসা থালায় নবান্নের সেই খই-মুড়ি-চিড়া-নারকেল-দই-মিষ্টি খাওয়ার কথা। সাথে আর একটি জিনিস দিতো- আতপ চাল, নারকেল, দূর্বাঘাস, চিনি দিয়ে তৈরি ঘন তরল একটি খাবার। খুবই সুস্বাদু। নামটি ঠিক মনে নেই। সম্ভবত মলিদা। নানা হাজী ছিলেন, তারপরও তিনি সখার বাড়ির সব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং চিড়া-মুড়ি, দই-মিষ্টি খেতেন (তখনও হিন্দু বাড়িতে মুসলমানদের ভাত খাওয়ার প্রচলন হয় নি)।

হয়তো নানার সঙ্গে এসব হৃদ্যতার কারণে, যুদ্ধের সময় আশেপাশের অনেক হিন্দু পরিবার এসে নানাবাড়িতে আশ্রয় নিলেন। তাদের মধ্যে একটি পরিবার এসেছিল বেশ একটু দূর থেকে। প্রায় দশ পনেরটি বাড়ির পর তাদের বাড়ি।

ঐ পরিবারে অপরূপ সুন্দরী দুটি মেয়ে ছিল। বড়জনের নাম বাসন্তি, ছোট জনের নাম পিয়ন্তি। অন্যান্য যুবতী মেয়েদের সঙ্গে রাতের বেলা ওরা দু’বোন নানাবাড়ির কাঠের পাটাতনের (অনেকটা উচুতে সারা বছরের চাল, ডাল এবং অন্যান্য সাংসারিক দ্রব্যাদি রাখার রাখার জন্য তৈরি) ওপর ঘুমাতো এবং সকাল বেলা উঠে যে যার বাড়িতে চলে যেতো।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে আসতো সবাই। মেঝেতে লম্বা ঢালাও বিছানা, অনেক মানুষ, কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব। পিয়ন্তির বয়স তখন প্রায় দশ আর আমার পাঁচ। বয়সের পার্থক্য থাকার পরও কিভাবে যেন পিয়ন্তির সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ফলে প্রতিদিন সবার আগে বেলা থাকতেই চলে আসতো পিয়ন্তি। দুজনে নদীর ঘাটের সিঁড়ির ওপর বসে কত যে গল্প করতাম। কী গল্প করতাম আজ আর তা মনে নেই। দিনে দিনে পিয়ন্তি আমার একান্ত আপনজন হয়ে উঠলো। কোন দিন ওর আসতে একটু দেরি হলেই আমার কেমন যেন অস্থির লাগতো। বারে বারে ছুটে যেতাম ওর আসা যাওয়ার পথের ধারে।

ওরা প্রায় একমাস ধরে ঘুমাতে আসতো মামাবাড়িতে।

একদিন পিয়ন্তি আমাকে চুপিচুপি বলল, ‘জানো, আমরা না ভারত চলে যাবো। তুমি কিন্তু কথাটা কাউরে বলবা না।’ আমি মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। অর্থাৎ বলবো না, এবং সত্যিই কথাটা কাউকে বলি নি। এরপর পিয়ন্তি ওর হাত থেকে দু’গাছি কাঁচের চুড়ি খুলে আমার দু’হাতে পরিয়ে দিল। আমার হাতে চুড়িগুলো একটু বড় হলো কিন্তু যারপরনাই আনন্দিত হলাম চুরি পেয়ে। বার বার চুরিসহ হাত দুটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে বিমোহিত হলাম।

পর দিন থেকে পিয়ন্তিরা রাতে আর ঘুমোতে এলো না। পরপর দু’দিন যখন পিয়ন্তিরা ঘুমোতে এলো না, তখন নানা লোক পাঠালেন খবর নিতে। লোকটি ফিরে এসে জানালো ওরা গত রাতে বাড়িঘর সব কিছু ফেলে ভারত চলে গেছে। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। পিয়ন্তি আর ঘুমোতে আসবে না, ওকে আর কোনদিন দেখতে পাবো না! অথচ পিয়ন্তি গত পরশু যখন বলেছিল যে, ওরা ভারত চলে যাবে, তখন একবারও মনে হয় নি পিয়ন্তি চলে গেলে কি হবে। এখন ওরা চলে গেছে শুনে বুকের ভিতরটায় কেমন যেন একটা কষ্ট কষ্ট অনুভূতি হতে লাগলো।

পরদিন থেকে একা একা ঘুরে বেড়ালাম যেসব জায়গায় পিয়ন্তির সাথে বসে গল্প করতাম, রান্নাবাড়ি খেলতাম সেখানে। নয় মাস বয়সে মাকে হারিয়েছি। কোন ভাইবোন ছিল না, তাই অনেকটা নিঃসঙ্গভাবে বেড়ে উঠেছি। তাছাড়া লাজুক আর একটু চাপা প্রকৃতির ছিলাম, তাই সহজে কারো সাথে বন্ধুত্ব হতো না। একমাত্র পিয়ন্তির সাথেই আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়। যুদ্ধ অনেকের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে পিয়ন্তিকে। ’৭১ এর যুদ্ধ মাতৃহারা একটি ছোট্ট শিশুর একমাত্র বন্ধুটিকে কেড়ে নিয়ে শিশুটির বুকটাকে এমনভাবে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, যা জোড়া লাগতে দীর্ঘদিন লেগেছে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:২১

ভ্রমরের ডানা বলেছেন: ছোট বেলার বন্ধুর জন্য জন্য মনের গহিনে একটা আলাদা স্থায়ী জায়গা থাকে। এই লেখনীটা আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে গেল।

অনেক ভাল লাগলো। ভাল থাকবেন।

২| ১১ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:৫৯

প্রকাশক পপি চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.