নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রকাশক পপি চৌধুরী

লেখক পপি চৌধুরী

প্রকাশক পপি চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

শান্তিনিকেতনের ছায়াবীথি তলে

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১:৩১

বই এবং পত্র-পত্রিকায় শান্তিনিকেতন সম্পর্কে এতবার পড়েছি এবং লোকমুখে এতবার শুনেছি, যে নিজের অজান্তেই একদিন শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। বেশ কয়েকবার কোলকাতায় বেড়াতে গেলেও প্রতিবারই কোন না কোন কারণে শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়ে ওঠে নি। অবশেষে এলো সেই শুভদিন। ২০০৯ এর মার্চ মাসে কবি-কথাসাহিত্যিক নীলাচার্যের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম আমি, লেখক সুফিয়া রহমান, সাংবাদিক সুলতান আহমেদ সোনা এবং কবি এম.এ করিম। নির্দিষ্ট দিনে আমি আর সুফিয়া আপা ট্রেনে করে যাত্রা করলাম কোলকাতার উদ্দেশে, সুলতান আহমেদ সোনা এবং কবি এম.এ করিম যাত্রা করলেন বাসে। নীলদা’র (কবি নীলাচার্য বাংলাদেশে সবার কাছে নীল’দা নামে পরিচিত) জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে আমি এবং সুফিয়া আপা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাবো। শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাওযার কথা শুনে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সুলতান আহমেদ সোনা।

অবশেষে মার্চের ১৯ তারিখ সকালে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে বোলপুরের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। একে একে পার হলাম কাঁকুড় গাছি, বিধান গড়, দমদম জংশন, দক্ষিনেশ্বর, বালুঘাট, চন্দন নগর, জো গ্রাম, নবগ্রাম, মস গ্রাম, বর্ধমান জংশন, থানা জংশনসহ বিভিন্ন স্টেশন। যতই বোলপুর এগিয়ে আসছে ততই কৌতুহলে মন চঞ্চল হয়ে উঠছে। অবশেষে বেলা এগারোটা নাগাদ বোলপুর পৌঁছুলাম। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম চারিদিক। এই সেই বিখ্যাত বোলপুর! নিতান্ত সাদামাটা একটি স্টেশন অথচ শান্তিনিকেতন তাকে এনে দিয়েছে জগতজোড়া পরিচিতি। কত বিখ্যাত ব্যাক্তিদের চরণস্পর্শ লেগে আছে এখানকার মাটিতে!
স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে আমরা শান্তিনিকেতনে যাত্রা করলাম। তবে আপনারা অবশ্যই রিকশায় যাবেন। মাত্র ২০-২৫ মিনিটের পথ, ট্যাক্সিতে ৪০ টাকা আর রিকশায় ২৫-৩০ টাকা। তবে রিকশায় গেলে লাভ বেশি। দু’পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।
যথাসময়ে ট্যাক্সি এসে থামলো শান্তিকেতনের দোরগোড়ায়। শিহরিত তণু-মন। এই আমাদের কবিগুরুর বিখ্যাত সেই শান্তিনিকেতন! পথ দিয়ে যেতে যেতে যেদিকে তাকাই বার বার মনেহয়- একদিন এখানে বিশ্বকবি ছিলেন, এই পথ দিয়ে হাঁটতেন, এখানে গাছতলায় বসে ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। মনে হতে লাগলো, এই বুঝি তাকে দেখতে পাবো আজানুলম্বিত পোশাক পরে পিছনে দু’হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন।

শান্তিনিকেতন আদি প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথের পিতা মহির্ষ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ধ্যান ও আধ্যাত্মচিন্তার জন্য মাঝে মধ্যেই কলকাতার কর্মকোলাহল থেকে হিমালয়ের নির্জনতার মধ্যে আশ্রয় নিতেন। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে একবার বোলপুর থেকে রায়পুর যাবার পথে দেখতে পেলেন এক সীমাহীন নির্জন প্রান্তর। চারিদিকে খোয়াই ও ধূ ধূ মাঠ। মাঝখানে শুধু দু’টি ছাতিমগাছ। তারই ছায়ায় তিনি সেদিন কিছু সময় বিশ্রাম নিলেন ও ঈশ্বরের উপাসনা করলেন। রাঢ় বাংলার গৈরিক মাটির শান্ত সমাহিত পরিবেশ মহর্ষির মনকে আকৃষ্ট করলো প্রবল ভাবে। ফলে ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছে এই যুগল ছাতিমগাছ সহ কুড়ি বিঘা জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় তিনি গ্রহণ করলেন। অত:পর ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি এখানে একটি অতিথিশালা স্থাপন করে তার নাম দিলেন- ‘শান্তিনিকেতন’।
ছাতিমতলার অদূরে ডানদিকে যে বড় দোতালা বাড়িটি তারই নাম ‘শান্তিনিকেতন বাড়ি’। এটি শান্তিনিকেতনের প্রাচীনতম বাড়ি। 'অতিথিগণ শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসে এই গৃহে কয়েকদিন থেকে যেন নিবিষ্ট মনে ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারেন' -এই ছিল মহর্ষির ইচ্ছা। বাড়িটির সামনে রামকিঙ্কর বেজের একটি সুন্দর ভাস্কর্য ‘অনির্বাণ শিখা’ রয়েছে। একসময় এই বাড়ির নামেই জায়গাটির নাম দাঁড়িয়ে যায় ‘শান্তিনিকেতন’।

শান্তিনিকেতন বাড়ির সম্মুখে উপাসনা-গৃহ। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে ৭ই পৌষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। নানা রঙের কাঁচ দিয়ে তৈরি মনোমুগ্ধকর এই মন্দিরটি। এর ছাদ টালির এবং মেঝে শ্বেতপাথরের। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছা ও পরিকল্পনায় এটি নির্মিত হয়েছিল। বিগ্রহহীন এই মন্দিরটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য অবারিত। রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত মন্দিরে উপাসনায় অংশগ্রহণ করতেন। এখন প্রতি বুধবার (সাপ্তাহিক ছুটির দিন) সকালে মন্দিরে উপাসনা হয়। এছাড়া নববর্ষ, মাঘোৎসব, কবির জন্মদিন ও মৃত্যুদিন, খৃষ্টোৎসব এবং বর্ষশেষে মন্দিরে বিশেষ উপাসনা হয়।
শান্তিনিকেতনের একটি এলাকার নাম ‘উত্তরায়ণ’। এটি আশ্রমের উত্তরদিকে অবস্থিত বলে এই নাম। মূলত পাঁচটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে উত্তরায়ণ এলাকা। এই পাঁচটি বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে তাঁর জীবনের শেষ দুই দশক বসবাস করেছেন। বাড়ি পাঁচটি হলো: কানার্ক, উদয়ন, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী। উল্লেখিত পাঁচটি বাড়ি ছাড়াও রয়েছে চিত্রভানু-গুহাঘর এবং বিচিত্রা বাড়ি।

কোনার্ক: উত্তরায়ণের উত্তর-পশ্চিম কোণে, শিমূল গাছের পাশে অবস্থিত বাড়িটির নাম ‘কোনার্ক’। উত্তরায়ণ এলাকার মধ্যে প্রথম তৈরি হয়েছিল দু’টি পর্ণকুটির। তারই একটিকে অদল-বদল করে তৈরি হয় ‘কোনার্ক’ বাড়ি। ১৯১৯ থেকে ১৯২১/২২ খ্রীষ্টাব্দের ভিতরে গড়ে ওঠে এই বাড়ি। রবীন্দ্রনাথের খেয়াল মতো অনেকবার ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে আজকের ‘কোনার্ক’। প্রথমে ছিল খড়ের চাল ও কাঁকরে পেটানো মেঝে। পরে পাকা করা হয়। ‘কোনার্ক’ বাড়ির ঘরগুলি একই সমতলে নয়। কোনোটির মেঝে উঁচু, আবার কোনোটির-বা নীচু। ছাদগুলিও সেই অনুপাতে উঁচু-নীচু।

উদয়ন: স্থাপত্য-বৈচিত্র্য বাড়িটির প্রধান আকর্ষণ। এই বাড়িটিও একবারে গড়ে ওঠে নি, নানা সময়ে নানা অংশ ভেঙে গড়ে আজকের রূপ পেয়েছে ‘উদয়ন’। প্রাসাদ-সাদৃশ্য বাড়িটির ভিতরে হলঘর, ছাদটি কাঠের কারুকাজ দিয়ে ঢাকা। চারিদিকে বসবার জায়গা, মাঝখানটা ফাঁকা। সেখানে কবির উপস্থিতিতে হত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মহড়া, সাহিত্যপাঠ, সভা-সমিতি। শীতলপাটি দিয়ে ভিতরের দেওয়ালগুলি ঢাকা। ভিতরের নক্সা কবিগুরুর নিজের করা। উদয়নের সামনের বারান্দাতে কবির শেষ জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। এই বাড়ি থেকেই রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে ২৫শে জুলাই কলকাতায় চিকিৎসার জন্য শেষবারের মতো চলে যান। রবীন্দ্র-সংগ্রহশালা প্রথমে গড়ে ওঠে এই বাড়িতেই। বহু স্মৃতিবিজড়িত এই ‘উদয়ন’ বাড়ি।

শ্যামলী: কোনার্ক বাড়ির পূর্বদিকে যে মাটির বাড়িটি রয়েছে, তারই নাম ‘শ্যামলী’। ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে মে মাসে জন্মদিনের শুভক্ষণে শ্যামলীতে প্রবেশ করেন কবি। বাড়ির দেওয়াল মাটির, ছাদও মাটির। শিল্পী নন্দলাল ও রামকিঙ্করের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে বাড়িটি। কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা শ্যামলীর চারিদিকের দেওয়ালে মূর্তি (রিলিফ) গড়ে ভরিয়ে দেয়। প্রবেশ পথের দু’পাশে ‘সাঁওতাল-সাঁওতালনী’ রামকিঙ্কর বেজের তৈরি। এই বাড়িতে নানা সময়ে থেকেছেন-গান্ধীজী, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, বিনোবা ভাবে, মাদার তেরেসা সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

পুনশ্চ: কবি কখনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারতেন না। তাঁর ভিতরের কবি মন কিছুদিনের মধ্যেই পরিচিত ঘর-দুয়ারে ক্লান্ত হয়ে ছটফট করে উঠতো- ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’। তাই শ্যামলীর পূর্বদিকে ‘পুনশ্চ’ বাড়িটি গড়ে ওঠে, কবিরই ইচ্ছেতে। এই বাড়ির ছাদ কংক্রিটের, দেওয়াল মাটির তৈরি। মাঝখানে একখানি ঘর, চারিদিকে খোলা বারান্দা। পরে কবির ইচ্ছে অনুসারে বারান্দাটি কাঁচ দিয়ে ঘেরা হয়। ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে পুনশ্চর গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান হয়। শ্যামলীকে কবি চিহ্নিত করেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ বাড়ি বলে। কিন্তু তারপর পুনরায় এই বাড়ি তৈরি করা হলো বলে এই বাড়ির নাম দেন ‘পুনশ্চ’।

উদীচী: পুনশ্চের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের দোতালা বাড়িটি ‘উদীচী’। যখন পুনশ্চও আর কবির মনে ধরল না, তখন তৈরি হল উদীচী। যথার্থ কবির শেষ বেলাকার বাড়ি। ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে কবির জন্মদিনে গৃহপ্রবেশ হয়। প্রথমে চারটি থামের উপর দোতালায় একটি ঘর ও তার সঙ্গে একটি বারান্দা তৈরি হয়েছিল। পাশ থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছিল দোতালার ঘরে। পরে কবির ইচ্ছা অনুসারে নীচের থামগুলি ঘিরে ঘরের সংখ্যা বাড়ান হলো। প্রথমে এই বাড়ির নাম ছিল ‘সেঁজুতি’, পরে উত্তর দিকের বাড়ি বলে নাম দিলেন ‘উদীচী’। উদীচী বাড়ির পাশে রথীন্দ্রনাথের তৈরি গোলাপ বাগানটি এখনও দেখতে পাবেন।

চিত্রভানু-গুহাঘর: উত্তরায়ণের দক্ষিণের উদ্যানসংলগ্ন বাড়ি ‘চিত্রভানু-গুহাঘর’। এই বাড়ির পাশে আছে ‘পাম্পা’ হ্রদ। বাড়িটির দোতালার অংশের নাম ‘চিত্রভানু’। আর নিচের অংশের নাম ‘গুহাঘর’। চিত্রভানু ছিল রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর স্টুডিও আর গুহাঘরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের কর্মশালা। গুহাঘরের বাইরের চেহারা পাথর বসানো গুহার মতো দেখতে, আর ভিতরটা ঠিক যেন জাহাজের কেবিন। ঘরের অঙ্গসজ্জা এবং আসবাবপত্রের পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব। আসবাবগুলিও ঘরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা।

বিচিত্রা (রবীন্দ্রভবন): উত্তরায়ণে প্রবেশ পথের বাঁ-পাশে যে দোতলা বাড়ি তার নাম ‘বিচিত্রা’। বিচিত্রাতে আছে রবীন্দ্র-সংগ্রহশালা ‘রবীন্দ্রভবন’। এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল রবীন্দ্র জন্ম-শতবর্ষে, ১৯৬১ সনে। বিচিত্রা বাড়ি উদ্বোধন করেন আচার্য জওহরলাল নেহরু। এখানে রয়েছে প্রদর্শনকক্ষ সমেত সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, রবীন্দ্র-চর্চা প্রকল্প, মালটিমিডিয়া প্রকল্প, দৃশ্য-শ্রাব্য বিভাগ, সংরক্ষণ বিভাগ ও দপ্তর।
রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় আছে, রবীন্দ্রনাথের মূল পান্ডুলিপি, চিঠিপত্র, মেডেল, দলিলপত্র, নির্দশনপত্র, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য শিল্পীদের আঁকা ছবি, নানাবিধ উপহার সামগ্রী, রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত পোষাক ও তাঁর নিত্যব্যবহার্য কিছু সামগ্রী এবং পারিবারিক ও দেশ-বিদেশের মনীষীদের সঙ্গে তোলা কবির বহু ছবি। রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগারে আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত বই, নিজের লেখা বই এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা বিভিন্ন লেখকের বই। এছাড়া আছে সাময়িক পত্রাদি, সংবাদপত্রের ক্লিপিংস এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুবাদ। দৃশ্য-শ্রাব্য বিভাগে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য শিল্পীদের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্র-কবিতার ক্যাসেট-ডিস্ক। আর আছে তাঁর সম্পর্কে তথ্যচিত্র এবং তাঁর গল্প ও উপন্যাসের চলচ্চিত্র সমূহ।
রবীন্দ্রভবনের মিউজিয়াম নিয়মিতভাবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। উত্তরায়ণ ও রবীন্দ্র-মিউজিয়াম দেখার সময় বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার সকাল ১০-৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা এবং দুপুর ২টা থেকে ৪-৩০ মিনিট পর্যন্ত। মঙ্গলবার: সকাল ১০-৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। প্রবেশ মূল্য: পাঁচ টাকা। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য: তিন টাকা। মিউজিয়ামের দু’টি প্রদর্শকক্ষ আছে। একটি স্থায়ী প্রদর্শন কক্ষ, এটি নীচ তলায় অবস্থিত। অন্যটি দ্বিতীয় তলায়। স্থায়ী প্রদর্শকক্ষে রবীন্দ্রনাথের আলোকচিত্র এবং নানা স্মারক-চিহ্নের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের জীবনী ও তাঁর কাজকর্ম তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শকক্ষে আছে রবীন্দ্রাথের ব্যবহৃত পোষাক, তাঁর নিত্য ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী, উপহার সামগ্রী এবং নানা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া নিদর্শনপত্র, মেডেল ও অন্যান্য সামগ্রী। এছাড়া আছে নোবেল প্রাইজের পদক (পদকটি চুরি হয়ে যাওয়ার পর পদকের নমুনা কপি) ও মানপত্রের প্রতিরূপ।
বিচিত্রাভবনের পাশেই উত্তর-পূর্ব কোণে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত হাম্বার গাড়িটি সযত্নে রাখা আছে। এর পাশেই আছে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি লতানো পেয়ারা, আম, লেবু, লিচু প্রভৃতি গাছের সমন্ময়ে একটি কুঞ্জপথ, আছে বেশ ক’টি মহুয়ার গাছ। আমরা যখন গিয়েছিলাম সে সময় মহুয়া ফুলে গাছগুলি ভরে উঠেছিল। চারিদিকে ছিল মহুয়ার মাদকতাময় মৌ মৌ গন্ধ। গাছতলায় ছড়ানো ইষৎ কমলাটে-হলুদ বর্ণের ফুলের স্তূপ। আমি এর পূর্বে মহুয়া ফুল দেখি নি। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের অনেক উপন্যাসে পড়েছি মহুয়া ফুলের কথা। খুব ইচ্ছে ছিল মহুয়া ফুল দেখার। এখানে এসে সে শখ পূর্ণ হলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে। সে সময় আশ্রমের পরিধি ছিল ছোট। তিনি এখানে এমন একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যেখানে প্রাচীন ব্রহ্মচর্যের আদর্শে শিক্ষার্থীরা জীবনযাপন ও শিক্ষালাভ করবে। তাই তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটাবার চেষ্টা করেছেন, যেখানে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক সুন্দর ও বন্ধুত্বপুর্ণ। খোলা আকাশের নীচে গাছের তলায় হবে ক্লাস। তাঁর সেই কল্পনার আদলেই তিনি গড়ে তুলেছেন এখানকার পাঠপদ্ধতি। এখানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সকল শিক্ষার্থীকে ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে, বিছানা গুছিয়ে রেখে যেতে হয় শরীরচর্চা করতে। ফিরে এসে স্নান করে সমবেত উপাসনা করতে হয়। উপাসনার পর গাছতলায় ক্লাস শুরু হয়। ক্লাসে ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক, সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান পড়ানো হয়। সেই সঙ্গে গান, নাচ, ছবি আঁকা, কাঠের কাজ, তাঁত-শিক্ষা, বই-বাঁধাই ইত্যাদি শেখাও শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন ক্লাসের অঙ্গ। এসব ছাড়াও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অনেক ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের সাহিত্যবোধ ফুটিয়ে তোলার জন্য রয়েছে সাপ্তাহিক সাহিত্যসভা। এই সভায় শিক্ষার্থীরা তাদের স্বরচিত রচনা পাঠ করতে পারে। আছে প্রাত্যহিক খেলাধুলারও ব্যবস্থা। প্রকৃতিচর্চা এখানকার শিক্ষার একটি মুখ্য বিষয়। আশ্রমের রাস্তা মেরামত, বাগান করা এবং দরিদ্রসেবা শিক্ষার একটি অঙ্গ। এইভাবে পড়াশুনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মধ্যে পরস্পরের সেবা এবং পরিবেশ রচনার কাজকে স্থান দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
এখানকার মনোরম পরিবেশ কেবল যে শিক্ষার্থীদের অনুকূল তাই নয়, পর্যটকদের জন্যও এটি একটি আকর্ষনীয় জায়গা। এ যেন এক আলাদা পৃথিবীর আলাদা জগত! যত দেখি ততই বাড়ে মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতার স্মৃতি থেকে শান্তিনিকেতন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য তুলে ধরছি আপনাদের অবগতির জন্য। আপনারাও জানুন বিশ্বকবির প্রিয় শান্তিনিকেতন সম্পর্কে।

ছাতিমতলা: শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রাণকেন্দ্র হলো ছাতিমতলা। এটি উত্তরায়ণের সম্মুখে অবস্থিত। ছাতিম গাছকে ঘিরে আছে একটি মনোরম বেদী। এখানে প্রতি বছর ৬ মাঘ মহর্ষি-স্মরণ এবং ৭ পৌষ রামমোহন-স্মরণ অনুষ্ঠান ও প্রার্থনাসভা হয়।

তালধ্বজ: উপাসনা-মন্দিরের পাশে ‘তালধ্বজ’। একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে একটি গোলাকৃতি খড়ের চালের মাটির বাড়ি। আশ্রম-বিদ্যালয়ের প্রথম যুগের শিক্ষক তেজেশচন্দ্র সেন একসময় এখানে বসবাস করতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বনবাণী’ কাব্যে তেজেশচন্দ্রের উদ্দেশে লেখেন ‘কুটিরবাসী’ কবিতাটি। বর্তমানে এই বাড়িটি আশ্রমের মহিলাদের কারুচর্চা কেন্দ্র ‘কারুসঙ্ঘ’।

তিন-পাহাড়: শান্তিনিকেতন মন্দিরের অদূরে পূর্বদিকে একটি উঁচু মাটির ঢিবি, নাম তার ‘তিন-পাহাড়’। এটি ছোটোখাটো পাহাড়ের মত। এটির উপরে আছে একটি বিশাল বটগাছ। একসময় এর সামনে একটি শুষ্ক পুকুর ছিল। মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের জল-সমস্যা সমাধানের জন্য পুকুরটি কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জল ওঠে নি। পুকুর কাটার মাটিগুলি ওখানে ফেলায় তিনটি ঢিবির সৃষ্টি হয়। তার থেকে এর নাম ‘তিন-পাহাড়’। পরবর্তীকালে দু’টি ঢিবি ধূলিসাৎ করে পুকুরটি ভরাট করা হলেও ‘তিন-পাহাড়’ নামটি রয়ে গেছে।

আম্রকুঞ্জ: উত্তরে মন্দির আর দক্ষিণে শালবীথি, এর মাঝখানে ‘আম্রকুঞ্জ’। এখানে মুক্ত আকাশের নীচে গাছতলায় বিদ্যালয়ের ক্লাস হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অনুষ্ঠানও হয় এখানে। একসময় এখানেই বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা-উৎসব, রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রাথকে সংবর্ধনাজ্ঞাপন এবং বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা ও সম্মান জ্ঞাপন করা হয়েছে। এখনও বিশ্বভারতীর বাৎসরিক সমাবর্তন উৎসব আম্রকুঞ্জে হয়।

দেহলি: নূতন বাড়ির পূর্বদিকে ছোট দোতলা বাড়ি ‘দেহলি’। ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে এর প্রতিষ্ঠা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর কবি একা দীর্ঘদিন এই বাড়িতে ছিলেন। এখানে থাকাকালীন তিনি অনেক কবিতা-উপন্যাস রচনা করেন। বর্তমানে দেহলিতে আছে শিশুদের বিদ্যালয় ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’। কবিপত্নীর স্মরণে ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দে এই শিশু বিদ্যালয়ের সূচনা। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে কবি দেহলি থেকে উত্তরায়ণের কোনার্ক বাড়িতে চলে যান।

নূতন-বাড়ি: শালবীথির পূর্বসীমায় খড়ের চালের বাড়ি ‘নূতন-বাড়ি’। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়িটি আশ্রমের অতিথি অভ্যাগতদের জন্য তৈরি করেছিলেন। ফলে কারো পক্ষে, এমনকি রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও সেখানে স্থায়ীভাবে থাকা সম্ভব ছিল না। এই কারণেই ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হলো ‘নূতন-বাড়ি’। রবীন্দ্রনাথ সস্ত্রীক পুত্রকন্যাসহ থাকবেন বলেই এই বাড়ি তৈরি করান। কিন্তু সম্পূর্ণ তৈরি হবার আগেই মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়। কবি মাতৃহীন পুত্র-কন্যাদের এনে রাখেন এই বাড়িতে। সন্তানেরা তাদের এক দূরসম্পর্কীয় দিদিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে এখানে বসবাস করতেন। পরবর্তীকালে আশ্রমের অনেক শিক্ষকও এখানে থেকেছেন। বর্তমানে এটি ‘আলাপিনী মহিলা সমিতি’র কার্যালয়।

শালবীথি: দেহলী বাড়ির সামনে মাধবীবিতান তোরণের পাশ দিয়ে লাল কাঁকরের যে রাস্তাটি সোজা চৈতির দিকে গেছে তার নাম ‘শালবীথি’। এই পথ কবির খুবই প্রিয় ছিল। এই রাস্তার ডান দিকে দীর্ঘ সার বাঁধা শালগাছ রয়েছে। তাই কবি এই পথটির নাম দেন ‘শালবীথি’।

সিংহদসন: গৌরপ্রাঙ্গণের দক্ষিণে ‘সিংহসদন’ অবস্থিত। এই বাড়ির ছাদের উপরে এক পাশে ঘণ্টা ও অন্য পাশে আছে ঘড়িঘর। ঘণ্টার সাংকেতিক ধ্বনি শুনে ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝতে পারে কখন কী অনুষ্ঠান হতে চলেছে। রায়পুরের জমিদার লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের অর্থ সাহায্যে এই বাড়ি তৈরি হয়। তাই এর নাম ‘সিংহসদন’। ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের ৭ আগষ্ট এই বাড়িতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। বর্তমানে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট খাটো অনুষ্ঠান ও সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হয়।

পাঠভবন দপ্তর: সিংহসদনের সামনে গৌরপ্রাঙ্গণের উত্তরদিকে পাঠভবন দপ্তর অবস্থিত। প্রথমে এই দ্বিতল বাড়িটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়ির একতলাটি নির্মাণ করেন। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরম্ভ করেন তাঁর ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়।

শমীন্দ্র শিশু পাঠাগার (প্রাককুটির): পাঠভবন দপ্তরের পূর্বদিকে বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ‘শমীদ্র শিশু পাঠাগার’। রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে এর নামকরণ।

ঘন্টাতলা: শালবীথির মাঝামাঝি মাধবীকুঞ্জ তোরণের দক্ষিণে, গৌরপ্রাঙ্গণে বটগাছের নীচে ‘ঘন্টাতলা’। প্রাচীন বৌদ্ধস্তুপের (সাঁচিস্তুপ) অনুকরণে এটি তৈরি। বর্তমানে এখানে ক্লাস হয়।

দ্বিজবিরাম: শান্তিনিকেতেনের সীমানার দক্ষিণ দিকের প্রথম ফটকের কাছে প্রাচীর ঘেরা টালির ছাদের বাড়ি ‘দ্বিজবিরাম’। রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা কবি-দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষ বছরগুলি এই বাড়িতে কাটিয়েছেন। বাড়িটির নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন বৃক্ষ-প্রেমিক। তিনি এই অঞ্চলটিকে ফুল-ফলের গাছ দিয়ে সাজিয়ে তোলেন।

হিন্দিভবন: নেপাল রোডের পূর্বপ্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের পাশে দ্বিতল বাড়ি ‘হিন্দিভবন’। এখানে হিন্দি সাহিত্যের উপর একটি সুন্দর গ্রন্থাগার আছে।

চীনাভবন: হিন্দিভবনের পশ্চিমদিকে প্রাচীরঘেরা দ্বিতল বাড়িটি ‘চীনাভবন’। ১৯২১-২২ খ্রীষ্টাব্দে অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি শান্তিনিকেতনে প্রথম চীনাভাষা ও বৌদ্ধশাস্ত্র আলোচনার সূত্রপাত করেন। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের মনে এ-বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এরই ফলশ্রুতি চীনাভবন। অবশ্য এর যথার্থ প্রতিষ্ঠা অধ্যাপক তান-য়ুন-শানের প্রচেষ্টায় ও চিয়াং কাইশেক সরকারের অর্থানুকুল্যে। চীনাভবনের গ্রন্থাগারটিতে চীনা সাহিত্য ও বৌদ্ধশাস্ত্রের নানা অমূল্য ও দু®প্রাপ্য পুস্তক ও পুঁথি আছে। বর্তমানে এই গ্রন্থাগারটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য হয়। চীনাভাষায় উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত পড়াশুনা ও গবেষণা করার ব্যবস্থা এখানে রয়েছে।

মুকুটঘর: চীনাভবনের সামনে সন্তোষালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে খড়ের চালের ছোট বাড়িটি ‘মুকুটঘর’। প্রাক্তন শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ছাত্ররাই এই বাড়িটি তৈরি করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ নাটকটি এখানে প্রথম অভিনীত হয়। তাই এই বাড়ির নামকরণ হয়েছিল ‘মুকুটঘর’।

সন্তোষালয়: মুকুট ঘরের উত্তর দিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা টালির ছাদওয়ালা বাড়িটি ‘সন্তোষালয়’। প্রথম যুগে বিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখানে থাকত। এখন এটি শিশুদের ছাত্রাবাস। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠান। আমেরিকা থেকে ফিরে এসে তিনি শ্রীনিকেতনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর অকাল-মৃত্যুতে তাঁর নামানুসারে এই গৃহটির নামকরণ হয় ‘সন্তোষালয়’।

দিনান্তিকা (চা-চক্র): বেণুকুঞ্জের পাশে আটটি কোণ আকৃতির ছোট দোতলা বাড়িটি ‘দিনান্তিকা’ বা ‘দিনেন্দ্র স্মৃতি চা-চক্র’। বাড়িটির সামনে থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলার ঘরে। ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কমলাদেবী এটি স্থাপনা করেন। দিনশেষে আশ্রমের কর্মক্লান্ত শিক্ষক ও কর্মীগণ এখানে বিকেলের চায়ের আসরে মিলিত হতেন। এখন এখানে বিদ্যালয়ের ক্লাস হয়।

চৈতি: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রান্নাঘরের (জেনারেল কিচেন) দক্ষিণদিকে চার রাস্তার সংযোগস্থলে একটি বেল গাছের নীচে চৈতিগৃহ অবস্থিত। চৈতি কুঁড়েঘর আকৃতির ছোট একটি বাড়ি। এর ছাদটিও মাটির। মাটি ও আলকাতরার সংমিশ্রণে তৈরি এই অভিনব স্থাপত্যের রূপকার ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কর ও নন্দলাল বসু। চৈতি মূলত একটি ছোট প্রদর্শকক্ষ। নিরাভরণ, নিরলঙ্কৃত, সামনে একটি কাঁচের দরজামাত্র। ছাত্র-ছাত্রীদের নতুন সৃষ্ট শিল্পসামগ্রী পালা করে এখানে প্রদর্শিত হয়। শিল্পকলার প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের মনকে আকৃষ্ট করার জন্যই এই অভিনব ঘরটির পরিকল্পনা।

কলাভবন (নবনন্দন): রবীন্দ্রভবন ও নাট্টঘরের দক্ষিণে শ্রীনিকেতনগামী পাকা রাস্তার ধারে ‘নবনন্দন’। ‘১৯৮১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী এর উদ্বোধন করেন। কলাভবনের পুরানো বাড়িটির নাম ছিল ‘নন্দন’। নন্দলাল বসুর দেওয়া নাম। এর অনুসরণে এই নতুন বাড়িটির নাম হ’ল ‘নবনন্দন’। এখানে আছে প্রদর্শকক্ষ সমেত সংগ্রশালা, গ্রন্থাগার ও দপ্তর। সংগ্রহশালায় খ্যাতনামা শিল্পীদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের সংগ্রহ আছে।

কালোবাড়ি: কলাভবন চত্বর থেকে একটু এগিয়ে সংগীতভবনের পাশে কলাভবনের ছাত্রাবাস ‘কালোবাড়ি’। এটি অ্যাসবেস্টস্ চালের মাটির বাড়ি। বাড়ির দেওয়াল ও থামগুলি ভাস্কর্যের দ্বারা অলংকৃত। এই ভাষ্কর্যগুলি যাতে বৃষ্টির জলে নষ্ট না হয় তার জন্য এগুলির উপর নিয়মিত আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়।

সঙ্গীতভবন: যে দু’টি বিশেষ বিষয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ও বর্হিবিশ্বে বিশ্বভারতীর সুনাম রয়েছে তার একটি হল কলাবিদ্যা আর অন্যটি সংগীত চর্চা। সংগীত চর্চার জন্য আছে সংগীতভবন। কলাবভবনের কালোবাড়ির পশ্চিমদিকে দ্বিতল বাড়িটি ‘সঙ্গীতভবন’।

নাট্যঘর: নন্দনের সামনে ও রবীন্দ্রভবনের পশ্চিমদিকে বিরাট যে হলঘর রয়েছে তারই নাম নাট্যঘর। একপাশে নারদ, অন্যপাশে নৃত্যরত লালনফকির। উপরে কিন্নরের রিলিফ। রবীন্দ্রসপ্তাহ, বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলি এখানে হয়।

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার: বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারের বই-এর সংখ্যা প্রায় ৩,৭৫,০০০। এই গ্রন্থাগার ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি বিভাগীয় গ্রন্থাগার আছে। যেমনÑ রবীন্দ্রভবন, কলাভবন, সংগীতভবন, শিক্ষাভবন, পাঠভবন, শিক্ষাসত্র, বিনয়ভবন, পল্লীশিক্ষাভবন, পল্লীসংগঠন বিভাগ, হিন্দিভবন, চীনাভবন এবং দর্শনভবন। এই গ্রন্থাগারগুলির মোট বই-এর সংখ্যা প্রায় ২,৩০,০০০। এছাড়াও বিভাগগুলিতে রয়েছে কিছু সেমিনার গ্রন্থাগার। কেবলমাত্র সদস্যবৃন্দই এই গ্রন্থাগারগুলি ব্যবহার করতে পারেন।

নিপ্পনভবন: জাপান দেশটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি পাঁচবার জাপানে গেছেন। আবার জাপান থেকেও অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি শান্তিনিকেতনে এসেছেন। শান্তিনিকেতনে চীনাভবনের মতো একটি জাপানী-সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র স্থাপন করার আগ্রহ রবীন্দ্রনাথের ছিল। তাই ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে জাপানী ছাত্র তৎশো শান্তিনিকেতনে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য এলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই আগ্রহের কথা তাকে বলেন। এরপর শিক্ষা শেষে তৎশো বিয়োগো দেশে ফিরে গেলেও দীর্ঘদিন ব্যপারটি তাঁর মাথায় ছিল। অবশেষে ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করলেন সংস্থি। এই সংস্থার মাধ্যমে বিয়োদো জাপানে অবস্থিত বিশ্বভারতীয় প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও রবীন্দ্র অনুরাগীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে তুলে দেন। ১৯৯১ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে ‘নিপ্পন’ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এরপর ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে নিপ্পনভবনের দ্বারোদঘাটন করেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি কে. আর. ইারায়ন। ১৯৯৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এই ভবন নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে চলেছে ভারত-জাপান সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মৈত্রী সম্পর্কিত পত্রিকা ‘তোসামারু’। এখানে জাপানী ভাষা ও সাহিত্যের উপর একটি সুন্দর গ্রন্থাগারও আছে।

পাঠক বন্ধুগণ, খুব সংক্ষেপে এই হলো শান্তিনিকেতন। তবে যা কিছু দেখেছি তার সবটুকু লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সময়ের অভাবে যেদিন গিয়েছি সেদিনই ফিরতে হয়েছে। আপনারা কিন্তু আমার মতো ভুল করবেন না। হাতে ২/১ দিন সময় নিয়ে যাবেন, ধীরে সুস্থে ঘুরে দেখবেন। এখানে দেখার অনেক কিছুই রয়েছে। রয়েছে বল্লভপুর অভয়ারণ্য ‘ডিয়ার পার্ক’। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ৪টা অব্দি খোলা থাকে, বুধবার পূর্ণ দিবস বন্ধ। দেখে আসতে পারেন ‘কোপাই’ নদীর ধারে অবস্থিত অন্যতম একান্ন পীঠস্থান কংকালীতলা। কথিত আছে, এখানে সতীর কাঁকাল বা কোমর পড়েছিল। কুন্ডের জলের মধ্যে আছে সতীর সে দেহাংশ। কুন্ডের পাড়ে একটি মন্দিরও আছে, চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানে উৎসব ও মেলা হয়। সেদিন এখানে শতাধিক ছাগল বলি হয়। আরেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের জন্মস্থান লাভপুর এখান থেকে সড়ক পথে ৩০ কি.মি দূরে অবস্থিত। সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। এছাড়া শ্রীনিকেতনের অদূরে সিউড়িগামী পাকা রাস্তার বাঁ-পাশে রয়েছে ‘আমার-কুটির’। এটি একটি কুটিরশিল্প কেন্দ্র। এখানে বাটিক, গালা, শোলা, তাঁত, চামড়া, সূঁচিশিল্পের বিভিন্ন কাজ হয়। এখানকার চামড়ার তৈরি জিনিস এবং কাঁথা স্টিচের শাড়ি খুব নামকরা। একটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে, সেখান থেকে কিনে নিতে পারেন পছন্দের জিনিস। এছাড়া পথে রয়েছে হাতের কাজ করা কাঁধে ঝুলানো চমৎকার ব্যাগের দোকান। এগুলো অন্য কোথাও পাবেন না, তাই এখান থেকেই কিনে নিন পরিচিত জনদের উপহার দেয়ার জন্য। তবে যাই কিনুন, দরদাম করে কিনতে ভুলবেন না।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:২৬

ভ্রমরের ডানা বলেছেন: অনেক কিছু জানতে পারলাম। শান্তিনিকেতনের অপূর্ব বর্ণনা। ভাল লাগলো।

২| ১১ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:৫৮

প্রকাশক পপি চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে ভ্রমরের ডানা।

৩| ১১ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৯:১৬

সুফিয়া বলেছেন: খুব ভাল লাগল। শান্তি নিকেতনে যাবার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। কিন্তু যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আপনার লেখাটা পড়ে সেই ইচ্ছে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

ধন্যবাদ আপনাকে শেয়ার করার জন্য।

৪| ১২ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১১:১৯

প্রকাশক পপি চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ সুফিয়া আপা। দেশে থাকলে আমি আপনার ভ্রমণের সঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করতাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.