![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
ঢাকা শহরের পথ ধরে হাঁটছিলাম। বিষন্ন মন, প্রচণ্ড একাকীত্ব নিয়ে। তখন সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ পত্রিকায় (এখন প্রকাশনা বন্ধ) 'মিডিয়া ওয়াচ' কলাম লিখি। পত্রিকার সম্পাদক, সাবেক অর্থমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় শাহ এমএম কিবরিয়া বর্বর গ্রেনেড হামলায় নিহত হন মাত্র কয়েক মাস আগে। সেই ভয়ংকর ঘটনার পর নিহতদের রক্ত যেন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, মিশে যায় রক্তস্নাত মানচিত্রে।
আমার ব্যক্তিগত দিনগুলোও তখন ছিল প্রচণ্ড সংগ্রামের। সম্পাদক, মালিক নিহত হওয়ায় মৃদুভাষণ ছিল অর্থকষ্টে। 'বড় সাংবাদিক, লেখক হওয়ার আশায়' জন্মশহর ব্রাক্ষণবাড়িয়া ছেড়ে ঢাকায় এসেছি। লেখালেখি করে মাসশেষে যা রোজগার হয়, বই বা পত্রিকা কিনে এরচেয়ে খরচ হয় বেশি। মনের অ্যালবামে ঠাঁই নেয়ার ওইদিনটাতে পকেটে দশ টাকা নিয়ে হাঁটছিলাম ঢাকার ফকিরাপুলের পথ ধরে।
এক ভিক্ষকু এসে পাঁচটা টাকা চাইলেন। পকেটে ছিল মাত্র দশ টাকার একটা নোট। ভাবলাম, পাঁচ টাকা দিলে তো পরের দিনটা পার করতে ভীষণ কষ্ট হবে। আবার ভাবলাম, দিয়েই দিই। টানাপড়েনের দিনকালে তাতে কী এমন বেশি কষ্ট হবে! এই টাকা পকেটে থাকলে কতো সাধ জন্মাবে, সাধ্য না থাকার কষ্টগুলোও সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর জন্ম নেবে। পকেটে থাকা দশ থাকার নোটটা মধ্য বয়সী ওই ভিক্ষুককে তাই দিয়ে দিলাম।
পকেট একেবারে টাকাশূন্য। হাঁটছি। কিছুক্ষণ পর সেই ভিক্ষুক আবার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, আপনার পকেটে শুধু দশ টাকাই ছিল। আমার পাঁচ টাকার দরকার। বাকি পাঁচ টাকা রেখে দিন। নতুবা আপনার চলতে কষ্ট হবে!
অবাক হয়েছিলাম এরকম মানসিকতার ভিক্ষুককে দেখে। তাঁর মতো মানুষ জীবনে আর খুব বেশি দেখা হয়নি। জানি না, তিনি আজও বেঁচে আছেন কী না! ঢাকার কোনো রাজপথেই থাকেন, নাকি মাটির বিছানায় চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে আছেন- তাও জানি না। মনে মনে সেদিন তাঁর জন্য, তাঁদের জন্য বা নিজের জন্য আওড়েছিলাম 'জেলগেটে দেখা' কবিতার কয়েকটা লাইন-
'আমি কতোবার তোমাকে বলেছি, দ্যাখো-
মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না
এর অন্য ব্যবস্থা দরকার, দরকার সামাজিক ন্যায়ের।
দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে'।
দুই.
তখন আমার প্রচণ্ড দু:সময়। সদ্য ঢাকায় এসেছি। এর অনেক আগে মা পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়েছেন। বাবা তখনো বেঁচে আছেন। থাকেন ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। বুকের ভেতরটা এক সন্ধ্যায় বাবার জন্য হঠাৎ খাঁ খাঁ করে ওঠে। বাবা পাশে না থাকায় এতো মানুষের ভিড়েও ঢাকা শহরটাকে সেদিন প্রচণ্ড খালি মনে হয়!
পকেটে থাকা মানি ব্যাগের চেইন খুলে দেখি-তাতে চারশো'র মতো টাকা আছে। ভাবলাম, টাকাটা বাবাকে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিই। ফকিরাপুল থেকে সেটা করলামও। টাকার সঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট লিখলাম বাবাকে- 'ভালো থেকো, বাবা, আমি ভালো আছি। কয়েকদিন পরই তোমার কাছে ছুটে আসছি।'
চিরকুটটা বাবা পেলেন, পেলেন না মাত্র ওই চারশ' টাকা। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, কুরিয়ারের এক কর্মী টাকাটা মেরে দেন। তার সামনেই টাকাটা প্যাকেটের ভেতর রেখেছিলাম। ঘটনাটার কয়েকদিন পরই বাবাও মায়ের মতো আমাকে, আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান।
এরপর ফকিরাপুলের সেই কুরিয়ারের সামনে দিয়ে অনেকবার যাওয়া-আসা করেছি। সেই কর্মীকেও দেখেছি। ক্রোধান্বিত হয়েছি অনেকবার। ইচ্ছে করেছে, মাত্র চারশ টাকার লোভ সামলাতে পারে না যে লোকটা, তাকে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিই। পরক্ষণে নিজেকে শান্ত করেছি- 'না, আমি সাংবাদিক, লেখক হবো! সাংবাদিক, লেখকদের রাগ, ক্রোধ থাকতে নেই'!
টাকার অঙ্কটা এখানে বড় নয়, বড় হচ্ছে- সততা। আমার বেলায় বড় হচ্ছে- ওই টাকা বাবার কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা!
বাবা, ভালো থেকো, তোমার জন্য অনেক ভালোবাসা। মায়ের জন্যও ভালোবাসা। তুমি তো মায়ের পাশে, কাছেই আছে। তোমার বয়সী সেই ভিক্ষুকের জন্যও অনেক ভালোবাসা।
©somewhere in net ltd.