![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অভিজিৎ রায় নিহত হয়েছেন- এ সংবাদ শোনার পর কার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, বলা সম্ভব নয়। আমারটা বলতে পারি। একটা প্রচণ্ড ব্রেইনস্টর্ম হচ্ছিল। মস্তিষ্কের এই বিপর্যয়ে অভিজিতের মুখ ছাপিয়ে কিছু অসাধারণ ব্যক্তির ছবিই ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। এদের সবাই নিজের মতো করে কথা বলতে গিয়ে অথবা স্বাধীন জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন বলে তার খেসারত হিসেবে হয় প্রাণ হারিয়েছেন, নয়তো নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন। না, আমি তসলিমা নাসরিন অথবা দাউদ হায়দারের কথা বলছি না। এই দুই চিরনির্বাসিত বাঙালি নিয়ে লেখালেখি করতে হলে ঘাড়ের ওপর একাধিক মাথা থাকতে হবে। মাথা তো একটাই, ওটা চলে গেলে ধড়ের কী মূল্য!
যাদের কথা বলছি, তাদের সবাই ভিনজাতি। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের মানুষ তারা। তাদের অপরাধ ছিল, তারা অফ-ট্র্যাকে হেঁটেছেন। অথচ কে না বোঝে, আমাদের পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ অফ-ট্র্যাকে হেঁটেছেন বলেই পৃথিবীটা আজ এ জায়গায় আসতে পেরেছে।
হ্যাঁ, প্রচলিত দেবতাদের উপেক্ষা করে যুবসমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগ এনে বিচারকরা রায় দিয়েছিলেন সক্রেটিসকে হেমলক পানে মরতে হবে, সেভাবেই মরেছিলেন তিনি; রোমান শাসকবর্গের বর্বরতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন বলে শান্ত, সঙ্গীহীন যিশু মরেছিলেন ক্রুশবিদ্ধ হয়ে; ‘ডিভাইন কমেডি’র অমর স্রষ্টা কবি দান্তে পোপের দেয়া রায়ে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন নির্বাসনের জীবন, মারাও গিয়েছেন পলাতক জীবনে; নারী হয়ে পুরুষের পোশাক পরেছিলেন বলে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে জোন অফ আর্ক রূপান্তরিত হয়েছিলেন এক কেজি ছাইভস্মে; সূর্য নয়, পৃথিবীই ঘোরে- এই বিশ্বাসে বাইবেলের বিরুদ্ধাচরণ করায় উৎসব করে পোড়ানো হয়েছিল ব্র“নোর শরীর, মৃত্যুর আগে তিনি যেন তার বিশ্বাস শেষবারের মতো উচ্চারণ করতে না পারেন, সেজন্য বেঁধে দেয়া হয়েছিল তার জিভ; একই দোষে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল গ্যালিলিওকে, অন্তরীণ অবস্থায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে একসময় সেখানেই মরেছিলেন তিনি; দেশদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়ে প্রথমে বন্দিজীবন, অতঃপর কুঠারাঘাতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল ওয়াল্টার র্যালেকে; নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করার দায়ে সরকারবিদ্বেষী, বদমাশ, ফন্দিবাজ আখ্যা দিয়ে দস্তয়েভস্কিকে দেয়া হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড, বধ্যভূমি থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে এলেও ভোগ করতে হয়েছে কারাদণ্ড; কবি বায়রনকে আসামি হিসেবে রাজদরবার পর্যন্ত যেতে হয়নি সত্য, তবে নিজেই নিজের দণ্ড- নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। শিল্পী পল গগ্যাঁ আদিম থাকতে চেয়েছিলেন, আদিবাসীদের প্রতি সুবিচার দাবি করেছিলেন বলে তাকে ভোগ করতে হয়েছে কারাদণ্ড, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন নিঃসঙ্গ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে; অগ্রসর চিন্তার অধিকারী অস্কার ওয়াইল্ড নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই জন্মেছিলেন বলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন কারাগারে, অতঃপর সেখান থেকে বেরিয়ে এলেও অবহেলা-অবজ্ঞায় একাকিত্বের জীবন নিয়ে বেঁচে ছিলেন আরও কিছুদিন।
উপরে যাদের কথা বললাম, অভিজিৎ রায় তাদেরই একজন একুশ শতকীয় উত্তরসূরি। তার সঙ্গে কোনোদিনও কথা হয়নি আমার। তাতে কী? সক্রেটিসের সঙ্গে তো কখনও কথা হয়নি। সক্রেটিসের সঙ্গে যেমন একাত্মবোধ করি আমি, অভিজিতের সঙ্গেও তেমন। দু’জনই মনে করেছিলেন, নিছক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, জ্বলে ওঠার মধ্যেই থাকে যত কৃতিত্ব। অভিজিৎ তাই জ্বলে উঠতে চেয়েছিলেন। ঠিকঠাক মতো প্রশ্রয় পেলে যা-তা কাণ্ড ঘটাতে পারতেন তিনি। কিন্তু প্রশ্রয় দূরে, আশ্রয়ও পেলেন না এদেশে। তবে যারা তাকে হত্যা করেছে, তারা জানে না, হিংসার আগুন দিয়ে সত্যের আগুন নেভানো যায় না। বরং আগুনের শিখা আরও লম্বা হয়, আগুন আরও ছড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে যায় না তো কী? অভিজিৎ নিহত হয়েছেন ২৬ ফেব্রুয়ারি, একদিন পর অর্থাৎ বইমেলার শেষ দিন ২৮ তারিখে সেখানে গিয়ে অভিজিতের কোনো বই-ই কিনতে পারিনি, একদিনেই শেষ হয়েছে তার সব বই।
কারা খুন করেছে অভিজিৎকে? মানুষ যতই অধ্যয়ন করে, ততোই সে তার অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করতে পারে। অভিজিতের খুনিরা মহাপণ্ডিত, কারণ তারা অধ্যয়নের ধারে-কাছেও নেই। তারা পৃথিবীর কোটি কোটি গ্রন্থের অন্তত একশ’টি না পড়েই সাব্যস্ত করেছে, অভিজিৎ একজন পাপী। অথচ এক মুসলিম দার্শনিকই, ইবনে আবদুল্লাহ যার নাম, বলেছেন, মূর্খতার চেয়ে বড় পাপ জগতে আর কিছুই নেই। এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে, প্রকৃত পাপী নিষ্পাপকে পাপী জ্ঞান করে তাকে খুন করেছে! অবশ্য তাদের নিবৃত্ত করা যাবে কীভাবে? নদীর গতিপথ যেমন নির্দেশ দিয়ে পাল্টানো যায় না, মূর্খের মানসও তেমনি নির্দেশ দিয়ে মেরামত করা সম্ভব নয়। মূর্খতা এমন এক পাপ, সারা জনমেও যার প্রায়শ্চিত্ত হয় না।
আচ্ছা, সত্যিই কি এমন একদিন আসবে, যখন এদেশের সবকিছুই চলে যাবে মূর্খদের অধিকারে? আইএস-এর ক্রমবর্ধমান কলেবর দেখে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, ইউরোপই যেখানে ঠেকাতে পারছে না মূর্খদের অভিযাত্রা, আমরা পারব কীভাবে? পৃথিবীজুড়েই মূর্খদের সংখ্যা বাড়ছে, বস্তুত মূর্খরা যেখানে-সেখানে কিলবিল করছে। এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি আমি। তবে কি শুধু বাংলাদেশ নয়, ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়ও শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে এমন কোনো ত্রুটি, যা ক্রমাগত উৎপাদন করে চলেছে মূর্খ? অথবা ব্যাপারটা কি এমন যে, আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত দাবি করি, সেই দাবিতেই রয়েছে কোনো ফাঁক, আমাদেরই দুর্বলতার সুযোগে শক্তিশালী হচ্ছে মূর্খের দল? হবে হয়তো। হতে পারে, মূর্খদের সঙ্গে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়, সেই কলাকৌশলই রপ্ত করতে পারিনি আমরা, যে কারণে হেরে গেছেন তসলিমা। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর আমি অনেককেই বলতে শুনেছি, ও ব্যাটা নিজের দোষে মরেছে! এদের একজনকে বলেছি, হ্যাঁ নিজের দোষেই তো মরেছে, একশ’ বছর আগে জন্মালে দোষ ধরব না তো কী! একশ’ বছর পরের পৃথিবীটা কেমন হবে জানি না, তবে অভিজিৎরা হয়তো তখন এমন নির্দয় হত্যার শিকার হবে না। এই একুশ শতকেই সৃষ্টি-রহস্য উদঘাটিত হওয়ার কথা রয়েছে। থামবে কি তখন মূর্খদের দাপাদাপি? নাকি তারা তখন মাথার দাম ঘোষণা করবে রহস্য উদঘাটনকারীর?
অভিজিৎকে আমি বড় ভালোবাসি। আগেই বলেছি, তার সঙ্গে কথা হয়নি, তবে বেঁচে থাকা অবস্থায় চামড়ায় ঢাকা তার হৃদয় ও মস্তিষ্কটি কেমন ছিল, আমি অনুভব করতে পারি। তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে। সেখানকার ছাত্র হলে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম তার মস্তিষ্কের কোটরগুলো, কথা বলতাম কংকালটার সঙ্গেই। সেটা যখন পারছি না, তখন মূর্খদের সঙ্গেই দু’একটি কথা বলা যাক। পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্ভাগা কে? বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন উত্তর দিয়েছিলেন- বৃষ্টির দিনে নিঃসঙ্গ অথচ পড়তে জানেন না যিনি। মূর্খের মূর্খতা ঘোচাতে হলে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। মূর্খরাও হয়তো পড়ে, তবে কী পড়ে সেটা এক প্রশ্ন। অধিকাংশ লোক এমন খাওয়া খায় যে, মনে হয় তারা বাজারে গরুর মতো বিক্রি হওয়ার জন্য নিজেদের চর্বিদার করার তালে আছে। মূর্খরাও হয়তো এমন পড়া পড়ে, যা তাদের চিন্তায় শুধু মেদই বাড়ায়। ঝরাতে হবে এই মেদ। কীভাবে ঝরানো যাবে তা? পড়ার সিলেবাসটা ঠিকঠাক মতো নির্বাচন করলেই আপনাআপনি ঝরে যাবে চিন্তার মেদ।
আত্মরক্ষার প্রশ্ন থাকলে আলাদা কথা; কোনো কারণেই, কোনো অজুহাতেই কাউকে হত্যা করা সভ্যতাসম্মত নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার মানুষদের এখন শিরে সংক্রান্তি, ভারি বিপদ তাদের। তাদের জন্য এক সতর্কবার্তা জারি হয়েছে যে, তাদের গুটিয়ে থাকতে হবে শামুকের মতো। শুধু তাই নয়, ওই গুটানো অবস্থায় থেকে বলতে হবে- গোলাপে কোনো গন্ধ নেই, গন্ধ যা তার সব ওই গাঁদায়; হরিণ কুৎসিত, উটই সুন্দরতম প্রাণী; ময়ূরের গায়ে কোনো রঙ নেই, পৃথিবীর সব রঙ মেখেছে কাক! কোথায় যাবে হে মুক্তমনা? ডানে? সেখানে বোমা হাতে দাঁড়িয়ে আছে জেএমবি। বাঁয়ে? কাটারাইফেল তাক করে আছে তোমার দিকে হিজবুত তাহরির। সামনে? খাপ খোলা তলোয়ার ঘোরাচ্ছে হুজি। পেছনে? চকচকে কিরিচ দেখো ওই আনসারুল্লাহর হাতে। আর মাথার ওপর ওই এলো বলে আইএস। চৌরাস্তার মোড়ে হতবুদ্ধি মুক্তমনারা আসলে এক ভয়াবহ অবরোধের মধ্যে আটকা পড়েছে। কে উদ্ধার করবে তাদের? শেখ হাসিনা? তবে যে পত্রিকায় পড়লাম তিনিও শংকামুক্ত নন!
নাদান জঙ্গিবাদীরা পণ করেছে, যে কোনো প্রকারেই হোক, যেতে হবে বেহেশতে, মানুষ হত্যা করে হলেও।
এরা মুসলমান অথচ ইবাদত কীভাবে করতে হয় জানে না। স্রষ্টা মানুষকে দিয়েছে যুক্তিবোধ, যাতে সে প্রভেদ করতে পারে ভালো ও মন্দের। সৃষ্টির সেরা হিসেবে সেই যুক্তিবোধ কাজে না লাগিয়ে শুধুই স্রষ্টার প্রশংসা করলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন? স্রষ্টার বরং সন্তুষ্ট হওয়ার কথা অভিজিতের ওপর। কারণ তিনি স্রষ্টারই দেয়া এক অমূল্য উপহার যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। চিন্তার সৌন্দর্য দেখলে কে না খুশি হয়। হিন্দুধর্মে স্বর্গ-নরকের যে কথা বলা হয়েছে, তা সত্যি হয়ে থাকলে অভিজিৎ ইতিমধ্যেই স্বর্গে পৌঁছে গেছেন, তার কংকালটা শুধু পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
অভিজিৎ এখন শুধুই একটি নামবাচক বিশেষ্য পদ নয়, তিনি এখন গুণবাচক বিশেষণেও পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার প্রসঙ্গ এলেই অভিজিৎ এসে যাবেন- ড্রইংরুমে, রেস্তোরাঁর চায়ের আড্ডায়, হলরুমের আলোচনা সভায়, আন্তর্জাতিক সেমিনারে। তিনি সক্রেটিস-গ্যালিলিওদের গর্বিত বংশধর, বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে একটি আলাদা চ্যাপ্টার। ব্রিটিশরা সহস্রাব্দের সেরা ব্রিটিশ হিসেবে চার্চিলকে নির্বাচন করেছিল। এ সংবাদ পড়ার পর আমি ক্ষেপে গিয়েছিলাম। সহস্রাব্দের সেরা ব্রিটিশ আসলে ডারউইন। তিনি মানুষের চিন্তা-পদ্ধতিই পাল্টে দিয়েছেন। তার আগে মানুষ পৃথিবীটাকে ব্যাখ্যা করত যে নিয়মে, তিনি সেই নিয়ম ভেঙেছেন। বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা-পদ্ধতির সংস্কারে যেসব প্রতিভাধর মানুষ অবদান রেখেছেন, সেই তালিকায় অভিজিৎ যুক্ত হয়ে পড়েছেন। তাকে মৃত বললে ভুল বলা হবে। তিনি আসলে মৃত্যুঞ্জয়ী।
আর ধর্মে অবিশ্বাসীরা যাই বলুন, কারো কোনো বক্তব্য, লেখা বা অন্য কর্মকাণ্ডে কোনো ধর্মেরই অবমাননা হয় না। সব ধর্মই নিজস্ব মহিমায় বিশ্বাসীদের কাছে প্রতিষ্ঠিত। ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়, স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টিরা বিশ্বাসের সেতু। সব বিশ্বাসীর কাছেই নিজের ধর্ম শ্রেষ্ঠতম। তাই যে কোনো ধর্ম নিয়ে কেউ উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিলে সেই ধর্মে বিশ্বাসীদের মনে তাতে আঘাত লাগে। বিশ্বাসে আঘাত আর অবমাননা- দুটি এক বিষয় নয়। ছোট্ট টুনটুনি পাখি বারবার ডানা ঝাপটালেও হিমালয়ের সমান ধর্ম বিশ্বাসে এর কোনো ধাক্কা লাগে না। হিমালয়ের সামান্য ক্ষতিও হয় না। কেউ ধর্মে অবিশ্বসী হওয়ার অধিকার রাখেন। তবে অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার অধিকার চর্চা করতে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি।
হা.শা.
দৈনিক যায়যায়দিন
ভালোবাসা সড়ক,
তেজগাঁও, ঢাকা।
০৯.০৩.১৫ খ্রি.।
©somewhere in net ltd.