| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হু হু হু ছুটছে তো ছুটছেই তুতু। এই বুঝি লেজটা চাপা পড়লো জুতোর তলায়। তুতুর ছোট্ট বুকটা ধক করে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে ফুটো দিয়ে আলমারিতে ঢুকে পরে। আলমারিটাতে হাজারো বই। বড়সড় একটা বইয়ের ফাঁকে ঢুকে পড়ে তুতু। মনে মনে ভাবে রবিনদের বাসার কাজের মেয়েটার কী যে শত্রুতা আছে তুতুর সাথে কে জানে! নইলে খেয়ে দেয়েতো কাজ নেই, খামাখা কেন তুতুকে প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে তাড়া করবে! বজ্জাত কাজের মেয়েটা গতকাল তুতুর ছোট ভাই ইতুকে মেরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। ইতুর কথা মনে করলে চোখের কোণায় পানি জমে যায় তুতুর। তুতু ভাবে মা কখন ফিরবে? খিদের জ্বালায় পেটে যে আগুন জ্বলছে। দুদিন ধরে ঠিক মতো খেতে পায়নি কিছুই। আজ যদিও বিস্কুটের গুঁড়ো খুঁজে পেলো, কাজের মেয়েটা তাড়িয়ে দিলো। তুতুর মা সবসময়ে বলেন, 'কখনো কাঁদতে নেই,কান্না মনোবলকে দুর্বল করে ফেলে।' তুতু মায়ের কড়া বাক্যের মাথা লেজ কিছুই বুঝেনা। শুধু বুঝে যে কাঁদতে নেই। তাই তুতু আর কাঁদেনা। তুতু বিড় বিড় করে আপন মনে বলতে লাগলো, মা যে কেন যেখানে সেখানে পড়ে থাকা ফেলনা জিনিস খেতে মানা করে! আজ মা আসলে জিজ্ঞেস করতে হবে। বইয়ের পৃষ্ঠাটার ভেতর হতে বেরিয়ে আসে তুতু। বইয়ের কভারে ইয়া বড় পাকা দাঁড়িওয়ালা মানুষের ছবি দেখে ভয় পেয়ে যায় তুতু। তুতু তার মাকে দেখতে পেয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে। ভয়ার্ত গলায় বলে, 'মা মা আলমারিতে মানুষ।' মানুষের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় তুতুর মাও। ভয় কেনইবা পাবেনা! পাঁচ পাঁচটা ইদুঁর ছানা ছিলো তুতুর মায়ের। তার মধ্যে তুতুই শুধু বেঁচে রয়েছে। বাকি সবাইকে মেরে ফেলেছে মানুষেরা। তুতুর মা সতর্কভাবে বলে কোথায় মানুষ? তুতু কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওইযে মা ওই বইটাতে। তুতুর মা লাফিয়ে বইয়ের ওপর ওঠে। মুচকি হেসে বলে, 'এটাতো মানুষের ছবি।' তুতু বলে, 'কিন্তু আমার তো মনে হলো রবিনের দাদুকে দেখলাম।' তুতুর মা বললো, উনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তুতু বলে, 'অ্যাঁ! এটা আবার কে?' তুতুর মা বিজ্ঞের মতো জবাব দেয়, 'নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়া সাঁকোয় বাসা....।' 'ধুর', তুতু বিরক্ত হয়ে যায়। এত কিছু কি ঢুকে নাকি এ ছোট মাথায়? এমনিতেই পেটে জ্বালা, ক্ষিদেয় মাথা ঘুরছে আবার মায়ের লাগাতার ভাষণ। তুতু বললো, 'মা ক্ষিদে লেগেছে তো।' তুতুর মা একটা আপেলের টুকরো দিলো খাওয়ার জন্য। খাবার পেয়ে তুতু মহাখুশী। পেট ভরে খেয়ে খুব ঘুম পেলো তুতুর। খাওয়ার বাকি অংশটা খেলো তুতুর মা। মায়ের কোলে মাথা রেখে মাকে জিজ্ঞেস করলো তুতু, 'মা, কেন আমায় ফেলনা খাবার খেতে মানা করো?' তুতুর মা বলে, 'মানুষেরা আমাদের শক্রু। ওরা আমাদের মারতে চায়। তাই খাবারে বিষ মিশিয়ে ফেলে রাখে।' তুতু আবার বলে, 'মা, মানুষেরা কেন মারতে চায় আমাদের?' তুতুর মা লম্বা চওড়া ভাষণ দেয়, তুতু কিছুই বোঝেনা। আজ সকালে রবিন যখন বই পড়ছিলো তখন শুনেছে 'মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।' তো মানুষ কেন তাদের মারতে চাবে! মায়ের নরম গলা জড়িয়ে ধরে সে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে তুতু। সকালবেলা আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে মাকে পাশে দেখতে পায়না তুতু। একটা মৃদু গন্ধ পেয়ে আলমারির ফাঁকটা দিয়ে এক লাফে নামতে যায় আর ডান পায়ে ব্যথা পায় তুতু। দূর থেকে কাজের মেয়ের ঝাড়ুর শব্দ শুনতে পায় সে। ভয়ে আলমারির নিচে ঢুকে যায়। তুতু শুনতে পেলো রবিনের বাবার গলা, 'আহা রুবি, খাসা রেধেছো পায়েসটা।' রুবি হলো রবিনের মা। রুবি বলে, 'আরেকটু নেবে?' রবিনের বাবা বলে, 'হ্যাঁ দাও দাও।' পায়েসের মিষ্টি গন্ধে তুতু ছুটে যেতে চায় খাওয়ার জন্য কিন্তু ফাজিল কাজের মেয়েটার ভয়ে যেতে পারেনা। সবার খাওয়া শেষ হলে তুতু চুপচুপ করে টেবিলে ওঠে। পায়েসের গন্ধ নেয়। টেবিলে পড়ে থাকা পায়েস চেটে চেটে খায় তুুতু। মনে মনে ভাবে, বাহ্ দারুণ রেঁধেছে তো। তুতু প্রশংসা করে রবিনের মায়ের। হঠাৎ করে রবিনের বাবার চিৎকার শুনতে পায়। চোখ তুলে দেখে রবিনের বাবা খাবার টেবিলেন সামনে দাঁড়িয়ে। রবিনের বাবা চিৎকার করতে করতে বলে, 'রুবি কতবার বলেছি তোমাকে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখতে। নেংটি ইঁদুর খাবার নষ্ট করে দিবে নইলে। সেই খাবার খেলে যদি প্লেগ ধরে যায়!' তুতু তাড়াহুড়ো করে ভয়ে ভয়ে আলমারিতে ঢুকে যায়। আলমারির কাচেতে কান পেতে শুনে রবিনের বাবা বলছে গতমাসে তার বন্ধুর ছেলে প্লেগে মারা গিয়েছে। যতসব ফালতু ইঁদুরের কারবারি। তুতুর মনে খুব অভিমান জমে যায় রবিনের বাবার কথা শুনে। তুতুর মা সন্ধ্যার দিকে খাবার নিয়ে এসে তুতুকে বলে, 'কি ব্যাপার সোনা? তোমার কি মন খারাপ?' তুতু বলে, 'মা প্লেগ কি?' তুতুর মা বলে, 'প্লেগ একটা রোগ। যা অামাদের শরীর থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায়, যা....।' তুতুর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। নিজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। ভাবে, ইঁদুরের জন্য মানুষের অসুখ হয়। রাগে অভিমানে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তুতু। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে, সে আর তার মা একটা গর্তের মধ্যে শুয়ে আছে। মা তাকে গল্প শোনাচ্ছে। সকাল হওয়ার সাথেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তুতুর। রাগ অভিমান সব খিদের চোটে চলে যায় তুতুর। মাকে ডাকা শুরু করে। তুতু বলে, 'মা মা খিদে পেয়েছে।' তুতুর মা বলে, 'আগে তো বাইরে যাই খাবার আনতে তারপর খেতে পারবি।' তুতুর মা খাবারে খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তুতু রবিনের দাদুকে দেখতে পায় চোখে চশমা এঁটে খবরের কাগজ পড়ছে। দূর থেকে তুতু দেখতে পায় খবরের কাগজে একটা ইঁদুরের ছবি। রবিনের দাদু রবিনকে ডাক দিয়ে বলে, 'দাদুভাই, খবরের কাগজটা পড়ে শোনাও তো।' রবিন প্রথমে রাজনীতির খবর পড়ে। তুতু কান খাড়া করে শোনে রবিনের পড়া। মা যদিও মানা করেছে রবিনের পড়া শুনতে। মা বলে, 'রবিন ভুলভাল পড়ে।' তুতুও জানে রবিন ভুলভাল পড়ে তাই প্রায় রোজ কানমলা খেতে হয় মাস্টারমশাইয়ের হাতে। রবিনের পড়া মনোযোগ দিয়ে শোনে তুতু। রবিন বলে, 'আজকাল শহরে প্লেগ রোগের কারণে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। যার জন্য দায়ী ইঁদুরেরা। এই ইঁদুরদের মেরে ফেলা উচিত নতুবা মহামারী......।' তুতুর বুকটা ধক করে ওঠে। মন খারাপ করে আলমারির মধ্যে বসে বসে অলস সময় কাটায় তুতু। সন্ধ্যা নেমে যায়। আকাশে মেঘ লেগে গুড়গুড় শব্দ হয়। তুতুর খুব ভয় হয়। তুতু ভাবে, রাত হয়ে এলো তবুও মা এলোনা না কেন? ভয়ে ভয়ে তুতু রাতটা কাটিয়ে দেয় বড় বইয়ের ফাঁকটাতে ঢুকে। সকাল হলে মায়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। তুতু কাকভেজা হয়ে মাকে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ রাস্তার ধার হতে একটা পরিচিত গন্ধ পেলো তুতু। এগিয়ে গিয়ে দেখে তুতুর মায়ের রক্তাক্ত শরীর পানিতে ভিজে পড়ে আছে। তুতু মায়ের শরীর জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। তুতুর কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায়না। কেবল তুতুর চোখের জল বৃষ্টির জলে মিশে গিয়ে হাহাকার ধ্বনি ছড়িয়ে দেয়। তুতু বুঝতে পারে তাকেও এভাবে একদিন মানুষেরা মেরে ফেলবে।
©somewhere in net ltd.