নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি বংকিরার মানুষ

আসিফ ইকবাল কাজল

গনমাধ্যমকর্মী

আসিফ ইকবাল কাজল › বিস্তারিত পোস্টঃ

হরিশংকরপুরের সেই কালীপদ বসু যেভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন

০৫ ই অক্টোবর, ২০২৩ বিকাল ৪:১৭

বাংলাদেশের ছোট অথচ ঐতিহাসিক বৈচিত্রে ঘেরা একটি জনপদ ঝিনাইদহ। এই জনপদের আনাছে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঐতিহাসিক কবি, সাহিত্যিক, রাজা-বাদশা, বাউল আর শাস্ত্রবিদদের স্মৃতিচিহ্ন। ঝিনাইদহে জন্মেছিলেন বিখ্যাত কবি লালন শাহ, পাগলাকানাই আর গোলাম মোস্তফার মতো বিখ্যাত কবি। আব্বাস উদ্দীন (রহঃ), গণি মাস্তান (রহঃ) আছালত ফকির (রহঃ), বদর উদ্দীন ফকির (রহঃ)সহ আরো অনেক বিখ্যাত সূফি-সাধকের আবাস ভুমি এই ঝিনাইদহ।
ঝিনাইদহের এই উর্বর মাটিতে জন্মগ্রহন করেছিলেন বিশ্বখ্যাত আধুনিক বীজগণিত প্রণেতা কেপি বসু। যার পুরো নাম অধ্যাপক কালিপদ বসু। ইংরেজি ১৮৬০ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পতিহরিশংকরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মহিমা চন্দ্র বসু হরিশংকরপুর রেজিস্ট্রি অফিসের একজন সামান্য ভ্যান্ডার ছিলেন। তৎকালীন সময়ে ঝিনাইদহের রেজিষ্ট্রি অফিস হরিশংকরপুর গ্রামে ছিল এবং হরিশংকরপুর ছিল সে সময়কার রাজধানী।
গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি লর্ড রিপন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। কেপি বসুর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় নিজ গ্রামের পাঠশালায় মেধাবী শিক্ষক নছিম উদ্দিন মন্ডলের কাছে। কেপি বসু’র গণিত মনস্কতা সৃষ্টিতে শিক্ষক নসিম মন্ডলের ভূমিকা অপরিসীম। কেপি বসু ১৯০২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় ম্যাথামেটিক্স কনফারেন্সে 'হাউ টু টিচ ম্যাথামেটিক্স' প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন। তিনি তখনকার প্রচলিত কড়াকিয়া ও গন্ডাকিয়া পদ্ধতি বর্জন করে দশমিক পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেন। কেপি বসু ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশনের সুপারিশকৃত ইউরোপীয় সংস্করণ ‘আধুনিক এলজাবরা’ বইটির অধ্যয়ন ও অনুশীলনের পথকে সুগম, প্রাঞ্জল ও সহজ করে তোলেন। এ ভাবে তিনি অসংখ্য নতুন উদ্ভাবনী, অংক শাস্ত্রের কলেবর বৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, কেপি বসুর পূর্ব পুরুষরা বরিশাল থেকে হরিশংকরপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। গ্রাম্য পাঠশালার একজন মেধাবী শিক্ষক নসিম উদ্দীন মন্ডলের কাছে কেপি বসুর বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। নসিম তার এই প্রিয় শিষ্যকে অংক শাস্ত্রের জ্ঞান উজাড় করে দিয়ে কেপি বসুর জ্ঞান ভান্ডারকে ক্ষুরধার ও শাণিত করেছিলেন। নিত্যনতুন অংক উদ্ভাবন করে প্রিয় শিষ্যের অর্ন্তরলোককে করেছিলেন আলোকিত।
কেপি বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়েও তাঁর প্রিয় শিক্ষক নসিমের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। নব উদ্ভাবিত অংকের আনন্দ তার প্রিয় ছাত্রের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য নসিম প্রায় কলকাতা যেতেন। একদিনের এক স্মরণীয় ঘটনা। নসিম মন্ডল কলকাতা এসেছেন। সাথে এনেছেন এক বিশাল অংক। তার প্রিয় ছাত্রের জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্য কেপি বসুর বাসায় যখন পৌছালেন, তখনও ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরেননি কেপি বসু। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। কয়লা দিয়ে বাসার দেয়ালে একে রাখলেন অংকের আলপনা। এরপর তিনি অন্য কাজে চলে গেলেন। বাসায় ফিরে কেপি বসুর দৃষ্টি পড়লো অংকের আল্পনার দিকে। এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলেন। তারপর বসু শুরু করলেন অংকের সমাধান। একাগ্রমন আর উদ্বিগ্ন চেহারায় অংকের সমাধান খুঁজতে খুঁজতে মুখে স্মিত হাসি ফিরে এলো। ততক্ষনে তথায় উপস্থিত হলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নসিম উদ্দীন মন্ডল। কিছুটা আড়ালে দাড়িয়ে তিনি দেখতে লাগলেন তার শিষ্যের সযতœ প্রয়াস। মুখে তার মুচকি হাসি। চোখে কৌতুহল, আর বুকের মধ্যে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। একসময় অংক মিলে গেল। বিজয়ের হাসি হাসলেন কেপি বসু। তারপর পিছন ফিরে তাকাতেই গুরু শিষ্যের চোখাচোখি। সে কি এক অদ্ভুত দৃশ্য। আনন্দ অশ্রæতে ভিজে গেল কেপি বসুর মুখমন্ডল। ছুটে এসে বসু প্রণাম করলেন শিক্ষক নসিম মন্ডলকে। গর্ভে ভরে উঠল শিক্ষকের বুক। আবেগ আর বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে তিনি তার যোগ্য শিষ্যকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন।
বিদ্যালয়েরর পাঠ শেষ করে ১৮৯২ সালে ৩২ বছর বয়সে ঢাকা কলেজের গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি অংকের শিক্ষক হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি আলজেব্রা ও জ্যামিতি শাস্ত্রের উপর গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধনায় এলজেব্রা, মেডইজি, মডার্ন জিওমেট্রি, ইন্টারমিডিয়েট সলিড জিওমেট্রি প্রভূত গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার আমলে মুদ্রণ শিল্প তেমন উন্নত ছিল না। এই অভাব পূরণের জন্য তিনি কলকাতার কেপি বসু পাবলিশিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেন, যা ৪২ বিধান স্মরণি কলকাতায় অবস্থিত ছিল।
উপযুক্ত বয়সে কেপি বসু গ্রামের অনিন্দ্য সুন্দরী মেঘমালা ঘোষকে বিয়ে করেন। একসময় কেপি বসুর একমাত্র শালিকা অতুল্য ঘোষ প্রথম কংগ্রেস সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া বসুর দুই ভাই ছিলেন তৎকালীন সময়ে খ্যাতিমান আইনজীবী। কেপি বসুর ছিল তিন সন্তান। দুই পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে ছিল তার সংসার। কেপি বসুর বড় ছেলে যতীন্দ্র কুমার ১৯৮০ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় পুত্র ত্রিদিবেশ বসুর মৃত্যু হয়। কন্যা ভ্যান্দা বসুর অকাল মৃত্যু ঘটে। ত্রিদিবেশ বসুর একমাত্র কন্যা শান্তা বসু চিরকুমারী ও আজীবন শিক্ষাব্রতী ছিলেন। দেশী ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি ডিগ্রী অর্জন করে তিনি ভারত সরকারের শিক্ষা বিভাগের উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন।
কেপি বসু ঢাকায় বসবাস করলেও ১৯০৭ সালে তিনি হরিশংকরপুর গ্রামে এক বিশাল দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন। ছয় কক্ষ বিশিষ্ট রান্নাঘরসহ এই প্রসাদোপম ভবনটিতে মোট ১৭ টি কক্ষে বিভক্ত ছিল। বাড়িতে মোট ৪০ জোড়া দরজা, দর্শনীয় খাট পালং ও অন্যান্য আসবাবপত্র তৈরির জন্য সে সময় সুদূর বার্মা থেকে সুন্দরী ও সেগুন কাঠ আমদানি করা হয়। বাড়ির ধার ঘেঁষে প্রবাহিত নবগঙ্গা নদীতে তিনি গোসলের জন্য সিঁড়িঘাট নির্মাণ করেন।
বাড়ি থেকে ঘাট পর্যন্ত তিন’শ মিটার সুরকি বিছানো পথের ভগ্নাবশেষ আজও বিদ্যমান। ক্ষনজন্মা পুরুষ কেপি বুস তার স্বল্পকালীন জীবনে প্রতিভা ও সাধনার বলে প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন এক অক্ষয় সৃষ্টি। ঐতিহ্য ও ভাবের মহিমায় তার অমূল্য সৃষ্টি চিরদিন আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে। এখন এই গরিণতবিদরে স্মৃতি সযত্নে সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা আমাদের বিস্মৃতির অপবাদ ঘোচাতে চেষ্টা করেও পারিনি। তার বাড়িটি অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। সরকারী ভাবে সংরক্ষনের মাধ্যমে বিখ্যাত এই গণিতবিদের স্মৃতি রক্ষা করা সম্ভব হতো।
ঝিনাইদহ শহরে কেপি বসুর নামে একটি সড়ক আছে। বিখ্যাত এই গণিতবিদ ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে পার্নিসাস ‘ম্যালেরিয়া’ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে ঢাকা। কলেজে কলেজে শোক বিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কেপি বসুর মৃতদেহ সড়ক পথে ঝিনাইদহে পৌঁছালে সকল অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়। শোকাভিভূত হাজার হাজর মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে নবগঙ্গা নদীর তীরে সমবেত হন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.