নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এম এ হুসাইন

এম এ হুসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলীর অনন্য প্রজ্ঞা, কৃতিত্ব ও বীরত্ব

২০ শে মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৪

আজ ঐতিহাসিক ১৩ রজব তথা আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর জন্মদিন। এ দিনে তাঁর সম্পর্কে কিছু প্রামাণ্য মন্তব্য ও বক্তব্য তুলে ধরতে চাচ্ছি এই পবিত্র ও মহাখুশির দিনে।
আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র মহত ও সুন্দর ব্যক্তিত্ব এত বিশাল বিস্তৃত ও এত বিচিত্রময় যে একজন মানুষের পক্ষে তাঁর সব বৈশিষ্ট্য ও পরিধি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাও সম্ভব নয়। মানুষ কল্পনার ফানুস উড়াতে পারবে কিন্তু এর কিনারার নাগালও পাবে না।
মানুষের মনে উত্তেজনা ও প্রভাব সৃষ্টিতে আমিরুল মু' মিনিন আলী (আ.)'র সুবিশাল ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব ইতিহাসে দখল করে আছে অনন্য ও শীর্ষস্থানীয় অবস্থান। বিশ্বনবী (সা.)'র পর এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে তথা হিজরি সপ্তম শতকে মুহাম্মাদ ইবনে শাহরাসুব আল-মাজান্দারানি নামের একজন মুসলিম পণ্ডিত ছিলেন। তার লাইব্রেরিতে " মানাকিব" বা "মহত গুণাবলী' শীর্ষক এক হাজার বই ছিল। আর এসবগুলোই ছিল হযরত আলী (আ.)'র মহত গুণাবলী সম্পর্কে লিখা। এ থেকেই বোঝা যায় আলী (আ.)'র ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় কত অগণিত অসংখ্য মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে।
মহান আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ জন্য যে তিনি মানব জাতিকে হযরত আলী (আ.)'র মত একজন মহামানব উপহার দিয়েছেন।
ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট সূফী সাধক ও চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (র.) বলেছেন,সমুদ্রকে যেমন ঘটিতে ধারণ করা অসম্ভব তেমনি বর্ণনার মাধ্যমে আলী (আ.)'র গুণাবলী তুলে ধরাও অসম্ভব।
হযরত আলী (আ.)'র চরিত্রে আমরা দেখতে পাই একজন দার্শনিকের বৈশিষ্ট্য, একজন বিপ্লবী নেতার বৈশিষ্ট্য, একজন সূফী শায়খের বৈশিষ্ট্য এবং নবী-রাসূলদের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ থাকে তারও অনেক বৈশিষ্ট্য।
ইমাম বা খলিফা হওয়ার আগেও হযরত আলী (আ.) সবার সঙ্গে ন্যায় আচরণ করতেন। হযরত আলী (আ.) নিজে একজন সুশৃঙ্খল ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মনুষ্যত্বের প্রতিটি সদগুণের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। তাঁর মন ছিল গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তা ছিল করুণায় ভরপুর ও স্নেহরাশিতে টইটম্বুর। দৈহিক, আধ্যাত্মিক ও মানসিক সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন পূর্ণত্বের অধিকারী। রাতে যখন তিনি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতেন তখন আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকত না। আবার দিনে ছিলেন জনগণের মাঝে কর্মমুখর। দিনের বেলায় জনগণ তাঁর দয়া ও সততায় মুগ্ধ হতেন আর তাঁর উপদেশ, পরামর্শ ও জ্ঞানপূর্ণ কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। অন্যদিকে রাতে আকাশের তারকারাজি দেখত হযরত আলী (আ.) কিভাবে আল্লাহর ইবাদতে অশ্রু বিসর্জন করছেন আর আকাশ তাঁর প্রেমপূর্ণ মুনাজাত শুনত।
হযরত আলী (আ.) একাধারে একজন জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, রহস্যবাদী ব্যক্তি,সমাজের নেতা, আত্মসত্তা বিসর্জনকারী ব্যক্তি, মুজাহিদ, বিচারক, শ্রমিক,একজন বাগ্মী ও লেখক। তাঁর সব আকর্ষণীয় গুণ নিয়ে তিনি ছিলেন পূর্ণতার সব অর্থেই একজন পূর্ণাঙ্গ মানব।
বিশ্বনবী (সা.)'র একটি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আলী(আ.)-কে পুরোপুরি বা পরিপূর্ণভাবে চেনেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.) এবং আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.)-কে ভালভাবে চেনেন কেবল আলী (আ.)।

হযরত আলীর নামের শেষে আলাইহিস সালাম ব্যবহার প্রসঙ্গে

'আলাইহিস সালাম' যে কেবল নবী-রাসূলদের নামের শেষে ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু নয়। যেমন-আমরা হযরত লোকমান, হযরত মারিয়াম এবং ইমাম মাহদীর নামের শেষে 'আলাইহিস সালাম' ব্যবহার করি অথচ তারা কেউই নবী-রাসূল নন। শুধু তাই নয়, ফেরেশতাদের নামের সাথেও আমরা 'আলাইহিস সালাম' ব্যবহার করি।
আমরা আরেকটি প্রশ্ন তুলতে পারি যে, পবিত্র কোরআন বা হাদীসের কোথাও কি এমন বর্ণনা রয়েছে যে, কোনো মুসলমানের নামের পর "আলাইহিসসালাম" বা সংক্ষেপে (আ.) ব্যবহার করা যাবে না বা এ ধরনের ব্যবহার হারাম?
আমাদের জানামতে কোরআন-হাদীসের কোথাও এমন নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়নি কিংবা এ ধরনের ব্যবহার যে অপছন্দনীয় তাও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।
বরং পবিত্র কোরআনের নানা আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ মুমিনদের, পরহিজগারদের ও বেহেশতীদের সালাম দিয়েছেন। যেমন- সুরা ইয়াসিনের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
سَلَامٌ قَوْلًا مِنْ رَبٍّ رَحِيمٍ [٣٦:٥٨]
‘করুণাময় পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হবে সালাম।'
অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে সুরা ত্বাহার ৪৭ নম্বর আয়াতে এবং সুরা আরাফের ৪৬ নম্বর আয়াতে।
"আলাইহিসসালাম" শব্দের অর্থ তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। এটি এক বিশেষ প্রার্থনা। আমরা মুসলমানরা সবাই একে-অপরকে সালাম দিয়ে থাকি।
এবার আমরা বিশ্বনবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্যদের নামের পাশে "আলাইহিসসালাম" বা সংক্ষেপে (আ.) ব্যবহার যে বৈধ তার কিছু প্রমাণ তুলে ধরছি:
১-সুন্নি মাজহাবের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থ বুখারী শরীফের " কিতাবুল ফাজায়েলে সাহাবেহ" অধ্যায়ের (৩৭/৬২ নম্বর অধ্যায়) "বাবুল মানাক্বিবে ফাতিমাতু" শীর্ষক পর্বে (পর্ব নম্বর ৫৯/২৯) হযরত ফাতিমার নামের পর "আলাইহিসসালাম" ব্যবহার করা হয়েছে।
একই হাদীস গ্রন্থের অর্থাৎ বুখারী শরীফের " বাবুল মানাক্বিবি ক্বুরাবাত্বা রাসুলুল্লাহ ওয়া মানাক্বিবাতি ফাতিমাতা আলাইহিসসালাম বিনতি নাবী" শীর্ষক আলোচনায় (পর্ব নম্বর-৪১/১২) "আলাইহিসসালাম" ব্যবহার করা হয়েছে, যা এই শিরোনামের মধ্যেই লক্ষ্যনীয়।
২- একই ধরণের ব্যবহার রয়েছে সুন্নি মাজহাবের আরেকটি বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ তিরিমিজি শরীফের হাদীসে। যেমন, কিতাবুল মানাক্বিবিত তিরমিজি'র "ফাজলি ফাতিমাত্বা বিনতি মুহাম্মাদ সাল্লিল্লাহু আলাইহিমা ওয়া সাল্লাম" উপপর্বে। (৫০/৬১ নম্বর অধ্যায়, অর্থাৎ কিতাব নম্বর ৫০, বাব নম্বর ৬১ ) এখানেও শিরোনামের মধ্যেই "সাল্লিল্লাহু আলাইহিমা ওয়া সাল্লাম" শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
একই হাদীস গ্রন্থের "মানাক্বিব আল হাসান ওয়া আল হুসাইন আলাইহিমা ওয়া সাল্লাম" শীর্ষক আলোচনার শিরোনামেই এই শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়।
এটা স্পষ্ট যে বিশিষ্ট সাহাবীদের বর্ণিত এসব হাদীসে হযরত ফাতিমা (সা.) এবং হযরত ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.)'র নামের পর "আলাইহিসসালাম" ব্যবহার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলে সাহাবীরা তাঁদের বর্ণনায় কখনও এ শব্দ ব্যবহার করতেন না, বরং শুধু "রাজিয়াল্লাহু আনহু" বা এ জাতীয় অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করতেন। "রাজিয়াল্লাহু আনহু" শব্দের অর্থ আল্লাহ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হোক।
যাই হোক হযরত আলী (আ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হল হারুন (আ) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও।
আলী (আ.) এমন এক নাম যার নাম উচ্চারণ ও যার বরকতময় জীবনের আলোচনা মানুষের ঈমানকে তাজা করে দেয়। রাসূল (সা.) বলতেন, আলীর দিকে তাকানোও ইবাদত।
আমীরুল মুমিনীন আলী সম্পর্কে মাওলানা রুমী লিখেছেন,
“সাহসিকতায় তুমি ছিলে খোদার সিংহ তা জানি
পৌরুষত্বে আর বদান্যতায় কি তুমি তা জানেন শুধুই অন্তর্যামী।”
ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদ-পুরুষ হযরত আলী ছিলেন মহানবীর (সা) জামাতা ও আপন চাচাত ভাই। তিনি যেমন ছিলেন বীর যোদ্ধা তেমনি ছিলেন জ্ঞানী ও বিদ্বান। রাসূল (সা) তাঁকে ‘জ্ঞানের দরজা’ বলে অভিহিত করেন। শৌর্য-বীর্যের জন্য তিনি ‘আসাদুল্লাহ’ বা আল্লাহর সিংহ ও ‘ইয়াদুল্লাহ’ বা আল্লাহর হাত উপাধিতে ভূষিত হন। সুন্নি-হাদিস গ্রন্থগুলোতে তাঁর ৫৮৬টি হাদীস দেখা যায়। হযরত আলী তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয় লাভ করেন।
সাহাবীদের মধ্যে হযরত আলী ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও বিচারক এবং আরবী ভাষা ও সাহিত্যেও ছিলেন সুপণ্ডিত। অনন্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহর (সা) বিশেষ নৈকট্যে থেকে পবিত্র কুরআনের সূরাগুলো নাজিলের প্রেক্ষিতসহ আয়াতসমূহের অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ লাভ করেন তিনি। তিনি আল কুরআনের অন্যতম সংকলক ও তাফসিরের লেখক। হিজরত হতে মুসলিম সন গণনার পরামর্শ মহানবীর অন্যতম শশুর ওমর ইবনে খাত্তাবকে দেন তিনিই। ওমর ইবনে খাত্তাব বলেছেন, ‘আলী না হলে ওমর ধ্বংস হতো ।’
হযরত আলীর অসাধারণ বাগ্মিতা ও সাহসিকতার কাছে সকল প্রতিদ্বন্দ্বীই হার মানতো। তিনি ছিলেন সুকবি। তাঁর কবিতার বিভিন্ন সংকলন হয়েছে । ‘দীওয়ান-ই-আলী’ তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্য সংকলন। মুসলিম বিশ্বে তো বটেই, এর বাইরেও তাঁর কাব্য সমাদৃত হয়েছে। সার্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ বাণী ও শিল্প-সৌন্দর্যে এ গ্রন্থ কালজয়ী। তার অনন্য বাগ্মিতা ও অলংকারিক ভাষার সাক্ষ্য বহন করছে ‘নাহজুল বালাগ্বা’ নামক গ্রন্থ। এতে রয়েছে আলীর নানা ভাষণ, চিঠি-পত্র ও উপদেশ।
হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহু মানবিক সকল মহৎ গুণে ও কর্মে অত্যুজ্জ্বল এক মর্দে মুজাহিদ । তাঁর অসাধারণ বিচারবুদ্ধি প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার, ধৈর্য, বীরত্ব ও ত্যাগ-সাধনা অতুলনীয়। তিনি মানবতার মূর্ত প্রতীক।
হযরত আলীর মতো এত সব বড় বড় মহৎ গুণে উজ্জ্বল ব্যক্তি আর নেই। মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান মহানবীর (সা) জামাতা ও অন্যতম প্রধান সেনাপতি হয়েও মহানবীর মতই তাঁর পরিবারেরও দিনের পর দিন কেটে গেছে অনাহারে। বাগানে শ্রমিকের কাজ করে পরিবারের সদস্যদের অনাহার থেকে মুক্ত করতে হয়েছে তাঁকে।

হযরত আলীর নামাজ

হযরত আলী নামাজে এত গভীর মনোযোগী থাকতেন যে একবার যুদ্ধের সময় পায়ে বিদ্ধ-হওয়া একটি তির কেবল নামাজের সময়ই তার পা থেকে ছাড়ানো হয় হযরত হাসানের পরামর্শে। দেখা গেছে যে তিনি মোটেও টের পাননি। অথচ এর আগে তা ধরলেও তিনি মহা-যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। আবার নামাজরত অবস্থায় সাহায্য প্রার্থীর সাহায্যের আবেদন তিনি ঠিকই টের পেয়েছিলেন মহান আল্লাহর ইশারায়। ফলে তিনি রুকুতে থাকা অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্য প্রার্থীকে আঙ্গুলের আংটি নিতে ইঙ্গিত দেন। এর প্রশংসায় নাজিল হয়েছিল পবিত্র কুরআনের আয়াত। সুরা মায়েদার ৫৫ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: তোমাদের অভিভাবক তো হলেন একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এবং মু’মিনরা যারা নামাজ কায়েম করে ও জাকাত দেয় নত বা রুকু অবস্থায়।
হযরত আলী সত্যিকার অর্থেই আলী তথা সমুন্নত। এমন বিশাল মহৎ ব্যক্তির মহত্ত্ব ও কার্যাবলী যত বেশি আলোচনা করা যায়, যত বেশি প্রচার করা যায়, পাঠকরা তত বেশি অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হবেন।

হাদিসের আলোকে আলী

হযরত আলীর অসাধারণ প্রজ্ঞা, সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি, সাহসিকতা, বীরত্ব, ত্যাগ-সাধনা, ন্যায় বিচার ও মানবতাবোধের খ্যাতি ছড়িয়ে আছে মুসলিম-অমুসলিম সব মহলে। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘দীওয়ান-ই-আলীর কবিতার টুকরোগুলো মণি-মুক্তার মতো উজ্জ্বল ও মূল্যবান উপদেশপূর্ণ। হযরত আলী মুসলিম জাতির মর্যাদা ও গৌরব সমুন্নত করে রেখেছেন।
মহামানব আলী সম্পর্কে মহানবীর (সা) বাণীঃ
এক. আমি প্রজ্ঞার নগরী আর আলী তার তোরণ।
দুই. হে আলী, তোমার সাথে আমার বন্ধন, তুমি আমার ভাই এ জগতে এবং পরজগতে।
তিন. যে ব্যক্তি আমার বন্ধু সে আলীরও বন্ধু, আর যে আলীর বন্ধু সে আমারও বন্ধু ।
চার. আলী আমার একাংশ আর আমি আলীর একাংশ।
পাঁচ. আলীর তলোয়ারের এক আঘাত আসমান ও জমিনের সবার ইবাদতের চেয়ে শ্রেয়।
ছয়. হারুন যেমন মুসার প্রতিনিধি, আমার পক্ষ থেকে তুমিও সেরূপ প্রতিনিধি।

কেন হযরত আলী ইতিহাসে অনন্য?

হযরত আলী শৌর্যে-বীর্যে অনন্য দীপ্তিময় একটি নাম। বিশ্বের ইতিহাসে অনেক জ্ঞানী-গুণী, ধ্যানী সাধক, কবি-সাহিত্যিক, রাষ্ট্রনায়ক, সাহসী সেনানায়ক, বীর যোদ্ধা এবং আরও অনেক মহৎ গুণের অধিকারী ব্যক্তি রয়েছেন। কিন্তু কেবল মহানবীকে (সা) বাদ দিলে হযরত আলীর এর মতো এত সব বড় বড় মহৎ গুণের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আর নেই। তাই তিনি অতুলনীয়। আলী সত্যিকার অর্থেই-আলী। তিনি মুসলিম জাতির মর্যাদা এবং গৌরব সমুন্নত করে রেখেছেন ইতিহাসে।
মহানবীর (সা) নবুওত প্রাপ্তির দশ বছর আগে হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহু) জন্মগ্রহণ করেন। আলীর পিতা আবু তালিব মহানবীর আপন চাচা। সেই সূত্রে তিনি নবীজীর আপন চাচাতো ভাই। অন্যদিকে আলীর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ ছিলে নবীজীর ফুফু ।
হযরত আলীর জন্ম হয়েছিল কাবা ঘরে। এই পবিত্র পরশই ক্রমে তাঁর জীবনকে করেছে উজ্জ্বল ও মহান। তাঁর নানার নাম ছিল আসাদ। তাই তাঁর মাতা ফাতিমা ছেলের নাম রেখেছিলেন-আসাদ । ‘আসাদ’ অর্থ সিংহ। সিংহের মতোই তেজ আর শক্তি ছিল তাঁর।
বলা হয় ছেলের ‘আসাদ’ নামটি পিতা আবু তালিবের পছন্দ হয়নি। ভাবলেন, তাঁর ছেলের নাম হবে আরও সুন্দর, আরও মিষ্টি। কি দেয়া যায় নাম? সম্ভবত আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা) আলী নামটি রাখতে বলেন। আবু তালিব ছেলের নাম রাখলেন-আলী। আলী শব্দের অর্থ-সমুন্নত। তাঁর ছেলে হবেন সমস্ত ভয়ভীতি, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। হিংসা-ঘৃণা স্পর্শ করবে না তাঁর পা। ত্যাগে সাধনায় জ্ঞানে গুণে হবে অতুলনীয়।) বাস্তবেই আলী নামটি সার্থক করেছিলেন হযরত আলী। তার জন্ম হয়েছিল পবিত্র কাবা ঘরে এবং শাহাদত বরণ করেছিলেন মসজিদে সিজদারত অবস্থায় আততায়ীর আঘাত পাওয়ার কারণে!

হযরত আলীর বাবা মুসলমান ছিলেন?

মহানবীর চাচা আবু তালিব ও দাদা এবং বাবা ছিলেন একত্ববাদী ও হযরত ইব্রাহিমের ধর্মের অনুসারী। তবে আবু তালিব ভাতিজার ইসলামের দাওয়াতকে প্রকাশ্যে কবুল করেননি। তিনি বিষয়টি গোপন রাখতেন ঠিক যেভাবে ফেরাউনের দরবারের একজন কর্মকর্তা গোপনে মুসা নবীর সমর্থক ছিলেন যাতে ফেরাউনের দরবারের পদ ধরে রেখেই সময়মত হযরত মূসাকে নানাভাবে সহায়তা দেয়া যায়। উল্লেখ্য সব নবীর পিতা ও দাদা বা পূর্ববর্তী বংশধারার মূল সিঁড়ির সবাই ছিলেন একত্ববাদী ও খোদায়ী ধর্মের অনুসারী। কোনো কাফিরের পুত্র বা অপবিত্র রক্তধারায় যুক্ত ব্যক্তির বংশধর নবী হতে পারেন না। কারণ তাতে খোদাদ্রোহী জনগণ এ অজুহাত দেখাতে পারে যে যার বাবা বা বাপদাদারাই ঠিক ধর্মমতে ছিল না তার ছেলের কথা মানুষ কেনো শুনবে? তবে যে কোনো নবীর চাচা বা পূর্ববর্তী বংশধারার মূল সিঁড়ির বাইরের ব্যক্তিরা কফিরও হতে পারেন। যেমন, রাসুলের চাচা আবু লাহাব কাফের হন মহানবীকে অনুসরণ না করার কারণে। নবীরা নিজ বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করতেন যার বর্ণনা পবিত্র কুরআনের আয়াতে রয়েছে। অনেকে ইব্রাহিম নবীর চাচা আজরকে তার পিতা বলে ভুল করেন। আরবিতে চাচাকেও অনেক সময় বাবা বলা হয়। কিন্তু কুরআনে নবীদের পিতার জন্য দোয়ার ক্ষেত্রে আবু/ আবি শব্দের পরিবর্তে ওয়ালিদ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন,সুরা ইব্রাহিম,৪১ নম্বর আয়াত رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ

আলীর প্রতি মহানবীর (সা) ভালবাসা

মহানবী (সা) আলীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একবার আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস তার বাবা আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেন, মহানবীর (সা) পুত্ররা সবাই বাল্যকালে মারা গেছেন। কোন্‌ পুত্রকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন? হযরত আব্বাস (রা) জবাব দেন-আলীকে। আব্দুল্লাহ আবার বলেন, আব্বা, আমি তো তাঁর পুত্রদের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছি? হযরত আব্বাস বলেন, মহানবী (সা) তাঁর পুত্রদের চেয়ে আলীকেই বেশি ভালবাসতেন। তিনি বাইরে না গেলে আলীকে আমি অতি অল্প সময়ের জন্যেও তাঁর কাছ-ছাড়া হতে দেখিনি। আলী মহানবীর প্রতি যেরূপ অনুরক্ত ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কোনো পুত্রকেও আমি পিতার প্রতি তত অনুরক্ত ও ভক্তি-পরায়ণ দেখিনি।
হযরত আলী দশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। নারী ও পুরুষের মধ্যে হযরত খাদিজা সবার আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আর তার পরপরই বা প্রায় একই সময়ে পুরুষ জাতির মধ্যে মহানবীর (সা) ইসলামের দাওয়াত প্রথম গ্রহণ করেন আলী। পঁচিশ বছর বয়সে হযরত আলী রাসূলের (সা) আদুরে কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে করেন। ফাতিমার বয়স তখন পনের কি ষোল।
হযরত আলী আপন সত্তাকে আল্লাহর নবী মুহাম্মদের (সা) সত্তার মধ্যে বিলীন করে দিয়েছিলেন। তাঁর জীবন ছিল এক দর্পণ স্বরূপ। এই দর্পণের মধ্যে রাসূল (সা) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত হতো। আল্লাহর রাসূলের সমগ্র রূপটি যদি কোনো মানুষের মধ্যে দেখার ইচ্ছে হয়, তবে হযরত আলীর চরিত্র এবং জীবন যাত্রার দিকে তাকাতে হবে।
অপত্য স্নেহ আদর ও সন্তান-তুল্য ভালবাসায় নবী (সা) আলীকে লালন পালন করেন। তাঁরই শিক্ষায় আলীর চরিত্র মহামানবীয় গুণে মাধুর্য-মণ্ডিত হয়ে ওঠে।
হযরত আলী খলিফা ছিলেন, সেনানায়ক ছিলেন, পণ্ডিত ছিলেন, কবি ছিলেন, বাগ্মী ছিলেন। মানব গুণের চরম ও পরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল তাঁর মধ্যে।
নবী মুহাম্মাদের (সা) জীবনের অপর এক সাফল্য আলীর মানস গঠন। তাঁরই যত্ন-পরিশ্রম, হাতের ছোঁয়া এবং সাধনার ফসল আলী মানবতার গৌরব। সাধনার পথে অগ্রসর হতে হতে মানুষ এমন স্তরে উন্নীত হয় যখন হয়তো স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে অন্তরাল থাকে না। স্রষ্টা আপন সৃষ্টিতে গর্ববোধ করেন।

রোম সম্রাটের প্রশ্নের জবাব:

মহানবীর শশুর ওমর ইবনে খাত্তাব যখন মদীনা-কেন্দ্রীক রাষ্ট্রের প্রধান তখন রোম সম্রাট কয়েকটি জটিল প্রশ্ন দূতের মাধ্যমে তার কাছে পাঠান। রাষ্ট্রপ্রধান ওমর প্রশ্নগুলো পাঠ করে বুঝতে পারলেন এর জবাব দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কে জবাব দিবেন? জবাব তো দিতেই হবে। তিনি সোজা চলে গেলেন হযরত আলীর কাছে। তাঁকে দেখালেন প্রশ্নগুলো। হযরত আলী প্রশ্নগুলো পাঠ করে তখনই খুব দ্রুত কাগজে জবাব লিখে ওমরের হাতে তুলে দেন। তিনি কাগজগুলো ভাঁজ করে দূতের হাতে দেন। দূত জিজ্ঞেস করেন, জবাবদাতা কে?
ওমর বলেন, আলী। ইনি রাসূলুল্লাহর (সা) পিতৃব্যপুত্র, জামাতা এবং বন্ধু।

মুক্তি পেয়ে গেল কয়েদী:

ভাষা আল্লাহর এক অপরিসীম নিয়ামত। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে অন্যতম পার্থক্য ভাষা। একই ভাষার একই শব্দের রয়েছে নানা রকম অর্থ ও মর্ম। কখনো ব্যবহার হয় মূল অর্থে। আবার কখনো ব্যবহার হয় রূপক অর্থে। বক্তার ভাষার অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে ঘটে বিপদ। ভাষার মারপ্যাঁচ বুঝতে না পালে শ্রোতার যেমন লজ্জা পেতে হয়, বক্তার ভাগ্যে ঘটে যায় জেল-হাজত বাস। এমনি এক ঘটনা ঘটেছিল ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় রাষ্ট্র-প্রধান ও মহানবীর শশুর ওমর ইবনে খাত্তাবের সময়ে। এক ব্যক্তি উপস্থিত হলো তার দরবারে। সে নির্ভীক চিত্তে ওমরকে বলল, নিশ্চয়ই আমি ফিতনাকে ভালোবাসি, হককে অপছন্দ করি এবং যা দেখিনি, তার সাক্ষ্য প্রদান করি। কি সাংঘাতিক কথা! সে আর যায় কোথায়! এত বড় দুঃসাহস রাষ্ট্র-প্রধান ওমরের সামনে! তাঁর সামনে থেকে কি এই ব্যক্তি রেহাই পেতে পারে? সে নিজেই তিনটি অন্যায়ের স্বীকৃতি প্রদান করছে! প্রথম কথা, যে ফিতনাকে ভালোবাসে, যে ভালোবাসার কোনো প্রশ্নই ওঠতে পারে না। দ্বিতীয় কথা, যে হক অপছন্দ করে, অথচ হককে পছন্দ করাই স্বাভাবিক। তৃতীয় কথা, যে না দেখে সাক্ষ্য প্রদান করে, যা গুরুতর অন্যায়। তাই রাষ্ট্রপ্রধান ওমর তখনই তাকে বন্দী করে পাঠালেন কয়েদখানায় ।
লোকটি তার বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করল না। আবার ওমরও স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন বিধায় কোনো রকম সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন মনে করা হলো না। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো সংবাদটা। সাধারণ মানুষ তথা আম-জনতা ভাবল এমন নির্ভয় স্বীকারোক্তি করে লোকটা শুধু অন্যায়ই করেনি, এর জন্য শুধু জেল নয়, আরও কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার। জনগণ তার সে কঠিন শাস্তির দিন গুনছিল।
মহাজ্ঞানী রহস্য উন্মোচনকারী ও সুক্ষ্মদর্শী হযরত আলী শুনতে পেলেন ঘটনাটা। তিনি সাথে সাথেই বুঝতে পারলেন লোকটির কথার মর্ম। তিনি সোজা চলে গেলেন হযরত ওমরের দরবারে। শুরু করলেন কথাবার্তা ।
হযরত আলী ওমরকে বললেন: আপনি অন্যায়ভাবে লোকটিকে বন্দী করেছেন।
ওমর : কেন? সে নিজ মুখে স্বীকার করেছে, একটি নয়, তিনটি অপরাধ করেছে।
হযরত আলী: লোকটি বলেছে, আমি ফিতনাকে ভালোবাসি। এর দ্বারা সে বুঝাতে চাচ্ছে যে, সে সম্পদ ও সন্তানকে ভালোবাসে। কেননা, আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের সম্পদরাজি ও সন্তানাদি হচ্ছে ফিতনা। লোকটি আরও বলেছে যে, সে হককে অপছন্দ করে। এ কথার দ্বারা সে বুঝাচ্ছে যে, সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে। যা অবশ্যই হক ও চিরসত্য। কেন না, আল্লাহ বলেছেন, মৃত্যু যন্ত্রণা অবশ্যই আসবে। তৃতীয় কথা, লোকটি বলেছে, আমি যা দেখিনি, তা সাক্ষ্য দিই। একথার অর্থ হলো, সে এ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ আছেন এবং এক, অথচ সে তাঁকে দেখেনি।
হযরত আলীর এই ব্যাখ্যা শুনে রাষ্ট্রপ্রধান ওমর লোকটির কথার মর্ম বুঝতে পারলেন এবং তখনি চিৎকার দিয়ে বলে ওঠলেন, ‘হায়! যদি না হতো আলী, তাহলে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেতো ওমর।’ এরপর কি আর লোকটি হাজতে থাকতে পারে? সাথে সাথেই সে মুক্তি পেল। লোকমুখে চারদিকে প্রচারিত হতে লাগলো হযরত আলীরে তত্ত্বজ্ঞান আর অসাধারণ বিচার ক্ষমতার কথা।

বেশি খেলেন কে?

মহানবী (সা) তখন মদীনায়। একবার হাদিয়া হিসেবে কিছু খেজুর পেলেন। সামনে উপস্থিত ছিলেন আলী। তাই মহানবী (সা) আলীকে নিয়ে সেই খেজুর খাওয়া শুরু করলেন। উভয়ে সম্পর্কে চাচাত ভাই হলেও একজন ছিলেন নবী আরেকজন উম্মত। বয়সেও ছিল বিস্তর তফাত। অন্য দিকে একজন ছিলেন শ্বশুর আর অন্যজন জামাতা ।
তাই ছোট ভাই ও জামাতা হযরত আলী খুব লাজুকের মতো খেজুর খাচ্ছিলেন নবীজীর (সা) পাশে বসে। কোনো দিকে খেয়াল নেই তাঁর। খেয়েই চলেছেন একটি একটি করে। আর বীচি রাখছেন সামনে ।
প্রিয় নবী (সা) খেজুর খাচ্ছিলেন আর দেখছিলেন আলীর অবস্থা। যেন নিরামিষ খেজুর ভোজন অনুষ্ঠান। তাই নবী (সা) একটু কৌতুক ও হাসিখুশি করতে চাইলেন আলীর সাথে। এ জন্য তিনি নিজের খাওয়া খেজুরের বীচিগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে রাখতে লাগলেন আলীর সামনে। সমাপ্ত হলো খেজুর ভোজন পর্ব ।
নবীজীর (সা) সামনে বীচি নেই। অথচ আলীর সামনে বীচির স্তূপ। হযরত আলী কিন্তু এদিকে খেয়াল করেননি। তাঁর চোখে ধরা পড়েনি বিষয়টি। শুরু হলো কৌতুক।
প্রিয় নবী (সা) : যার সামনে খেজুরের বীচি বেশি, সেই খেয়েছে বেশি ।
প্রিয় নবীর একথা শুনে খেয়াল হলো আলীর।
তিনি চেয়ে দেখলেন যে, কোনো বীচি মহানবীর (সা) সামনে নেই। সব বীচি জমা হয়ে আছে তাঁর সামনে। তিনি বুঝতে পারলেন রহস্য। একনজর দেখে নিয়েই তৎক্ষণাৎ তিনি জবাব দিলেন, যা ছিল বাস্তবভিত্তিক ও সূক্ষ্ম-জ্ঞানের পরিচায়ক ও রসে-ভরা মধুময়। কৌতুক হলেও নবীজীর (সা)আদব রক্ষা করে উম্মতের কিভাবে কথা বলা উচিত, তাও কিন্তু আলী ভুলে যাননি।
আমরা হলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে বলে ফেলতাম, আপনি বীচি রেখেছেন আমার সামনে, আবার আমাকে বলছেন, আমি বেশি খেয়েছি! বা বলতাম, কেন আমার সামনে বীচি রেখেছেন? যা নবীজীর (সা)মর্যাদার পরিপন্থী হয়ে যেতো। হযরত আলী এসব কোনো জবাব না দিয়ে নবীজী (সা) যেমন সম্বোধনহীন প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, তেমনি তিনিও সম্বোধনহীন পরোক্ষ জবাব দিলেন অত্যন্ত ভদ্র ও বিনায়বনত কণ্ঠে: যার সামনে বীচি নেই, তিনি বীচিসহই খেজুর খেয়েছেন।
ভেবে দেখার বিষয়, প্রশ্ন ছিল বেশি খাওয়া নিয়ে আর উত্তর হলো বীচিসহ খাওয়া নিয়ে। কে রাখল বীচি বা নবীজীর (সা) খাওয়া বীচি কোথায় গেল, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না আলী। অথচ কৌতুকের জবাব কৌতুকসুলভই হলো। ওদিকে নবুওতী মর্যাদার খেলাফও হলো না।
আলীর এমন সুসংহত জবাবে তিনি আলীর দিকে চেয়ে হাসতে লাগলেন স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি।

মহানবীর জুলফিকার পেলেন উপহার

বদরের যুদ্ধ! মুসলমান আর কাফিরদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ। মুসলমানদের সংখ্যা খুব কম। আনসার আর মুহাজির মিলে সাকুল্যে ৩১৩ জন। শত্রুপক্ষের শক্তি অনেক। তিনশ’ ঘোড়সওয়ার আর উষ্ট্রারোহী মিলে সাতশ জন। উভয় পক্ষ মুখোমুখি। স্থান বদর প্রান্তর।
সেকালে আরবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে দু’পক্ষের শ্রেষ্ঠ বীরদের মধ্যে থেকে প্রথমে মল্ল-যুদ্ধ হতো।
কুরায়েশদের পক্ষ থেকে তিন বীর- উৎবা, শায়বা ও ওলিদ মাঠে নামলো।
মুসলমানদের পক্ষ থেকে এগিয়ে এলেন হামযা, উবায়দা ও হযরত আলী।
বীরে বীরে শুরু হলো যুদ্ধ। দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ভীষণ রকম অবস্থা।
আলীর হাতে নিহত হলো ওলিদ। হামযা হত্যা করলেন উৎবাকে। প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেও শায়বার হাতে শহীদ হলেন উবায়দা (রাঃ)। এবার আলীর রক্ত টগবগিয়ে উঠলো। তিনি আল্লাহ আকবার বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মল্লযুদ্ধ শুরু হলো শায়বার সাথে। কিন্তু মহাবীর আলীর সাথে শায়বার তুলনা? অল্পক্ষণের মধ্যে শায়বার ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেললেন মহাবীর আলী। এবার যুদ্ধের মোড়টাই ঘুরে গেল। আবু জেহেল এতক্ষণ যুদ্ধের দৃশ্য দেখছিল। এবার সে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুসলিম বাহিনী সংখ্যায় অল্প হলেও হযরত আলীর বিক্রম ও কৌশলে আয়ত্তে এসে গেল যুদ্ধ। জয়ী হলো মুসলিম বাহিনী। কাফের বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয় এ যুদ্ধে। আর তাদের ৩৬ জনকে খতম করেন মহাবীর আলী একাই। অন্য কথায় এ জয়ের পেছনে যার বীরত্ব ভূমিকা অনন্য তিনি শের-এ-খোদা হযরত আলী। যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করার কারণে রাসূলে করীম (সা) হযরত আলীকে তাঁর ‘জুলফিকার’ তরবারিটি উপহার দেন। রাসূল (সা) এর নিকট থেকে তরবারি উপহার পাওয়া মানে অতুলনীয় সম্মান ও উৎসাহ পাওয়া।
ওহুদ প্রান্তরে
বদরের যুদ্ধে পরাজিত কুরায়েশদের চোখে ঘুম নেই। তাদের গায়ে জ্বালা ধরে গেছে। পরাজয়ের অপমানে তারা অধীর অস্থির। কিভাবে প্রতিশোধ নেয়া যায়, কিভাবে মুসলমানদের দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা যায়, সে চিন্তায় তাদের চোখে ঘুম নেই। আবু সুফিয়ান সৈন্য আর অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শেষমেশ তারা তিন হাজার সৈন্যের এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে অগ্রসর হলো।
মহানবীর (সা) তত্ত্বাবধানে মুসলিম বাহিনীও সংঘবদ্ধ হলো। প্রথমে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার খানেক। কিন্তু যুদ্ধ-যাত্রার এক পর্যায়ে প্রায় আড়াই’শ জন মুনাফিক দল ত্যাগ করে। ফলে মুজাহিদদের সংখ্যা হয় মাত্র সাতশ। ওহুদ নামক স্থানে শত্রুর সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। শুরু হলো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। বিখ্যাত যোদ্ধা তালহা কুরায়েশদের পক্ষে। আর মুসলমানদের মহাবীর আলী ।
কিন্তু আলী তো একাই একশ’। তাঁর সামনে তালহা তো একটা খড় কুটো। আলীর বিক্রমে অবাক হয়ে যায় সবাই।পরাজয় হলো তালহার। এবার কুরায়েশরা সদলবলে পড়লো ঝাঁপিয়ে মুসলিমদের ওপর। প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। শত্রুর আঘাতে আলীর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। তবু অপরাজেয়। এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে। হিসেবে একটা বড় ভুল করেছিল একদল মুসলমান যোদ্ধা। মুসলিম বাহিনীর ঠিক পিছনে ছিল ওহুদ পাহাড়। সেই পাহাড়ের একটা গিরিপথ ছিল এই বিপদের কারণ। যুদ্ধের শুরুতেই মহানবী (সা) সেখানে মোতায়েন করলেন একদল তীরন্দাজ। হুকুম দিলেন পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেনো কিছুতেই তা এ স্থান থেকে না সরে। প্রচণ্ড যুদ্ধে যখন কুরায়েশ বাহিনী পিঠ দেখিয়ে পালাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই সেই তীরন্দাজ বাহিনী জয় নিশ্চিত ভেবে গনিমত কুড়ানোর জন্যে নেমে পড়লো ময়দানে। তিরন্দাজদের দল-নেতা বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা রাসুলের নির্দেশকে করে উপেক্ষা। আর যাবে কোথায়? কাফের বাহিনীর বীর মহা-চতুর খালিদ, ছোট একটা বাহিনী নিয়ে সেই গিরিপথ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসলমানদের ওপর।
এ সময়ে শয়তান খবর রটালো রাসূল (সা) আর নেই। মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারলো ছুটতে শুরু করলো। এ সময়ে কয়েকজন মাত্র সাহাবী নিজেদের জীবন বাজি রেখে মহানবীর (সা) চারদিক ঘিরে শত্রুপক্ষের আঘাত হজম করে নবীজীকে হেফাজত করছিলেন। হযরত আলী ছিলেন তাদের একজন। তাঁর বাহুবলে শত্রুরা পালাতে শুরু করলো। তাঁর সেদিনের সেই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ দেখে উভয় পক্ষ অবাক হয়ে গিয়েছিল।শুধু বদর আর ওহুদে নয়, তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয় লাভ করেন মহাবীর আলী।

লৌহ-কপাট হলো ঢাল

খায়বর যুদ্ধ চলছে। ইসলামের বড় দুশমন ইহুদিদের সঙ্গে। কঠিন যুদ্ধ। শত্রুদের অবস্থান মজবুত খাঁটিতে দুর্গের ভিতরে। দুর্গের দরজার লৌহ-কপাট মজবুত আর ভীষণ ভারী। কেউ না খুলতে পারছে না পারছে ভাঙতে। রাসূল (সা) প্রথম মুসলিম বাহিনীর পতাকা দিয়ে ছিলেন ওমরের হাতে। তিনি একদল সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন। কিন্তু বিজয় অর্জন করতে পারলেন না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। তারপর আবু বকরের নেতৃত্বে মুজাহিদদের পাঠালেন। তিনিও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। এরপর আবারও ওমর সৈন্য সামন্ত নিয়ে গেলেন। কিন্তু এবারও দুর্গ অজেয় রয়ে গেল।
রাসূল (সা) এ সংবাদ শুনে বললেন, ‘আগামীকাল আমি এমন একজন বীরের হাতে পতাকা দেবো, যে ঘুরে ঘুরে শত্রুর ওপর হামলা চালায় এবং পলায়ন করে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাঁকে ভালোবাসেন এবং সেও আল্লাহ ও রাসূলকে (সা) ভালোবাসে। আল্লাহ তাঁকে বিজয় না দেয়া পর্যন্ত সে ফিরে আসবে না।’
মহানবীর শশুর আবু বকর ও ওমরের বাসনা ছিল যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সেই বিশেষ প্রিয়তম ব্যক্তিটি তাঁদের একজন হবেন। সাহাবি সাদ বিনীতভাবে এসে রাসূলের সামনে দাঁড়ালেন যাতে রাসূলের (সা) দৃষ্টি তাঁর ওপর পড়ে। মুমিনের কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) প্রিয় হওয়ার চেয়ে লোভনীয় আর কি আছে? যে কাজটি করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) ভালোবাসেন সে কাজটি করতে কে এগিয়ে যেতে না চায়? সাহাবীদের অনেকেই সেদিন ওই নেতৃত্ব পাওয়ার লোভ করেছিলেন। কারণ তারা রাসূলের (সা) মুখ থেকে শুনেছিলেন, যে ব্যক্তি পতাকা হাতে নিবে, সে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এর প্রিয়। বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ফিরে আসবে না!
একি চাট্টিখানি খুশি আর গৌরবের কথা! এ তো পরম আর চরম আনন্দের সংবাদ। পরিপূর্ণ সফলতার ঘোষণা। সবাই দারুণ আগ্রহ আর উত্তেজনায় রাত কাটালেন। সবার মন উচাটন। টান টান অবস্থা। সকালে রাসূল (সা) কার হাতে যে পতাকা দেন!
রাত পোহালো। ফজরের পর। রাসূল করীম (সা) না ডাকলেন হযরত আবু বকরকে, না ডাকলেন হযরত ওমরকে। সাদকেও ডাকলেন না। ডাকলেন হযরত আলীকে। হযরত আলী তখন চক্ষুরোগে আক্রান্ত ছিলেন। প্রিয় নবী (সা) তাঁর চোখে মুখে থুথু দিলেন। তখনই তাঁর চোখ রোগমুক্ত হলো। এরপর সারা জীবনে আর কখনো তাঁর চোখে রোগ ও ব্যথা বেদনা হয়নি তাঁর।
এরপর তিনি আলীর হাতে পতাকা তুলে দিলেন। নিজের লৌহ বর্ম তাঁকে পরিয়ে দিলেন এবং ‘জুলফিকার তরবারি হাতে ধরিয়ে দিয়ে দোআ করলেন : হে আল্লাহ, শৈত্য ও উত্তাপ তোমার নিয়ন্ত্রণে। আজ উভয়টি যেনো অনুকূলে থাকে’। হযরত বলেন, সেদিন থেকে আমার ওপর উত্তাপ ও শৈত্যের কোনো প্রভাব পড়েনি। আমি গ্রীষ্মকালেও গরম কাপড় পড়েছি এবং শীতকালেও পাতলা কাপড় পরে বাইরে ঘুরাফেরা করেছি।
এরপর হযরত আলী দ্রুত খায়বর দুর্গের দিকে অগ্রসর হলেন। মুজাহিদ বাহিনীর শেষাংশ পৌঁছার আগেই তিনি সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি দুর্গে পৌঁছার সাথে সাথে ইহুদিরা তাঁকে আক্রমণ করে। আগের চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে তারা ভীষণভাবে মুসলিম বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক সময় আলীর হাতের ঢাল মাটিতে পড়ে যায়। তিনি মাটি থেকে ঢাল আর হাতে তুলে নিলেন না। দুর্গের কপাট ধরে এক হেঁচকা টান মেরে তা খুলে ফেললেন এবং সেই কপাট হাতে ধরে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। এরপর এক পর্যায়ে সেই ভারী লৌহ কপাট পিঠের ওপর রেখে মুসলিম বাহিনীর দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করার সিঁড়ি পথ তৈরি করে দিলেন। মুসলিম বাহিনী সেই সিঁড়ি পথে দ্রুত দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করলেন।
খায়বর দুর্গের পতন ঘটল। দুর্গের ভিতরে ইহুদিদের পতাকার পরিবর্তে মুসলিম বাহিনীর কালেমা খচিত পাতাকা পতপত করে উড়তে লাগলো।
হযরত রাফে বর্ণনা করেন, যুদ্ধের কাজ সেরে হযরত আলী দুর্গের সেই ভারী লৌহকপাট অনেক দূরে ছুঁড়ে মারেন। আমরা সাত ব্যক্তি অনেক চেষ্টা করেও সেই লৌহ কপাটটি একটুও নাড়াতে পারিনি। এই ঘটনা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য-ভাষায় মূর্ত হয়েছে এভাবে :
খয়বরজয়ী আলী হায়দার, জাগো জাগো আর বার ।
দাও দুশমন দুর্গ বিদারী দু’ধারী জুলফিকার॥
এসো শেরে-খোদা ফিরিয়া আরবে ডাকে মুসলিম ‘ইয়া আলী’ রবে
হায়দরী-হাঁকে তন্দ্রা-মগনে করো করো হুঁশিয়ার॥
আল বোর্জের চূড়া গুঁড়া করা গোর্জ আবার হানো,
বেহেশতী সাকী,মৃত এ জাতিরে আবে কওসার দানো॥
আজি বিশ্ববিজয়ী জাতি যে বেহোঁশ, দাও তারে নব কুয়ত ও জোশ, এসো নিরাশার মরুধূলি উড়ায়ে দুলদুল আসওয়ার॥

বাচ্চা ও ডিম প্রসবকারী প্রাণী

এক দুষ্ট লোক হযরত আলীর (কাররামাল্লাহু ওয়াজহু) অগাধ জ্ঞানের জন্য খুব হিংসা করত। এত হিংসা যে, তা নিয়ে সে দিনে কোনো কাজ করতে পারত না এবং রাতে ঘুমাতে পারত না। তার মাথায় এক চিন্তা কিভাবে আলীকে ঠেকানো যায়। সে নানা রকম ফন্দি আঁটত। কিন্তু কোনো কিছুতে তার সঙ্গে পেরে উঠত না।
সে অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটি প্রশ্ন তৈরি করল। প্রশ্নটি হলো, ‘কোন্ কোন্ত‌ প্রাণী বাচ্চা দেয়, আর কোন্‌ কোন্‌ প্রাণী ডিম দেয়।’ছোট্ট প্রশ্ন । কিন্তু জবাবটা অত সহজ নয়। দুনিয়ার কত দেশে কত প্রাণী আছে তার ইয়ত্তা নেই। সব প্রাণী সম্পর্কে জ্ঞান থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। আর বাচ্চা প্রসবকারী ও ডিম প্রসবকারী প্রাণীর শ্রেণী ভাগ করতে হলে অনেক সময় গবেষণার প্রয়োজন। দু’চারদিন বা দু’চার মাসের কাজ নয়। কয় বৎসর লাগবে কে জানে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও প্রাণী-তত্ত্ববিদরা দুনিয়ার সব প্রাণী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি। আজও সমুদ্রগর্ভে, দুর্ভেদ্য পাহাড় জঙ্গলে এবং মাটির নিচে অনেক অজানা প্রাণী আছে। দুষ্ট লোকটা জানতো যে হযরত আলী কোনো প্রার্থীকে তার প্রার্থনা পূর্ণ না করে কোনো কাজে যান না। সে জ্ঞান-প্রার্থী হোক, আর ধনপ্রার্থী হোক।
তাই লোকটা উক্ত প্রশ্ন আলীর কাছে জিজ্ঞেস করার জন্য একটা সময়ও বেছে নিলো। আসরের নামাযের পূর্ব মুহূর্ত। ঐ সময়ে প্রশ্ন করলে অত অল্প সময়ে উত্তর দিতে পারবে না। আর উত্তর দিতে না পারলে নামাযও পড়তে পারবে না। নামায হবে কাযা ।
একদিন হযরত আলী আসরের নামায পড়ার জন্য তাহরিমা বাঁধতে কানের কাছে হাত উঠিয়েছেন, ঠিক তখনই লোকটা তাঁকে প্রশ্ন করে বসলো : আচ্ছা বলুন তো, কোন্‌ কোন্‌ প্রাণী ডিম দেয় আর কোন কোন প্রাণী প্রসব করে বাচ্চা?
লোকটার বিশ্বাস, আলী শুধু ধর্মের কথা জানেন, জিহাদের কৌশল ও খিলাফত পরিচালনার জ্ঞান রাখেন। দুনিয়ার এত সব প্রাণীর খোঁজ খবর রাখবেন কি করে? আর যদিও কোনক্রমে জবাব দেনই, তবে হাজার হাজার প্রাণীর শ্রেণীমত সাজিয়ে তাদের নাম বলতে বলতে আলীর নামায কাযা হয়ে যাবে নিশ্চয়। নামায কাযা হলে তিনি মনে খুব কষ্ট পাবেন। তাঁর মনে এতটুকু কষ্ট লাগানো কম কথা নাকি?
প্রশ্নকারী অপেক্ষা করতে যাওয়ার আগেই আলী সেই সদাহাস্য মুখে লোকটির দিকে একনজর তাকালেন। কানের কাছে যে হাত দুটি তুলেছিলেন সে হাত তেমনি রেখে মুখে বললেন: ‘যে সব প্রাণীর শরীর থেকে কান বেরিয়ে পড়া তারা দেয় বাচ্চা, আর যে সব প্রাণীর কান শরীরের ভেতরে প্রবিষ্ট তারা দেয় ডিম, ‘আল্লাহু আকবর’ বলেই নামায আরম্ভ করলেন।
জবাবটি আরবী ভাষায় এতো সংক্ষিপ্ত ছিল যে কুচক্রী লোকটির কূটকৌশল একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় সে মুখ কালো করে চলে গেল। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, আমি হলাম জ্ঞানের শহর আর আলী তার দরজা।

অগ্নি-পূজারি হলো লা-জবাব

একবার রাষ্ট্রপ্রধান ওমরের দরবারে উপস্থিত হলো এক অগ্নিপূজক। সে ওমরের কাছে প্রশ্ন করলো, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন সত্য কি না? ওমর বললেন, হ্যাঁ, সত্য। অগ্নিপূজক বলল-তোমাদের ধর্মগ্রন্থে আছে কাফেরদের কবরে সকাল সন্ধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়।’এরপর সেই লোকটি তার পকেট থেকে বের করলো মাথার দুটি খুলি। খুলি দু’টি দেখিয়ে সে বলল, এটি আমার পিতার মাথার খুলি আর এটি আমার ভাইয়ের মাথার খুলি। যদি তোমাদের ধর্মগ্রন্থের কথা ঠিক অর্থাৎ সত্য হয়, তবে আমার পিতা ও ভাইয়ের মাথার খুলি আগুনের তাপে গরম থাকার কথা। অথচ এ খুলি দু’টি শীতল কেন?
হযরত ওমর অগ্নি-পূজারির প্রশ্ন ও কথা শুনে লোক পাঠালেন হযরত আলীর কাছে তাঁকে ডেকে আনার জন্য। হযরত আলী এসে উপস্থিত হলেন দরবারে। ওমর তখন তাকে অনুরোধ করলেন অগ্নি-পূজারির প্রশ্নের জবাব দিতে। কথা শুনে আলী বুঝতে পারলেন মূল বিষয়। হযরত আলী তৎক্ষণাৎ একটি হাতুড়ি ও একখণ্ড লৌহ এনে অগ্নিপূজকের সামনে রেখে বললেন, এই লোহার উপর হাত রাখুন। অগ্নিপূজক লোহার উপর হাত রাখল। হযরত আলী এবার প্রশ্ন করলেন, কি মনে হচ্ছে? লোহা গরম না ঠাণ্ডা? -একেবারে ঠাণ্ডা। এরপর হযরত আলী হাতুড়ি দিয়ে লোহা-খণ্ডের উপর কয়েকবার খুব জোরে আঘাত করলেন। হাতুড়ির আঘাতে লোহার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো এবার আলী অগ্নি-পূজারিকে বললেন, লোহাতে হাত রাখুন।সে লোহাতে হাত রাখল। আলী জিজ্ঞেস করলেন, এবার কি মনে হচ্ছে? লোহা ঠাণ্ডা না কি গরম?- ভীষণ গরম।
- এই লোহা খণ্ড পূর্বে ছিল ঠাণ্ডা, এখন এতে আগুন এলো কোথা থেকে?
প্রশ্ন শুনে অগ্নিপূজক লা জবাব। একদম বোকা হয়ে গেল সে। কোনো জবাবই দিতে পারলো না। এবার হযরত আলী জবাব দেয়া শুরু করলেন। এ লোহার মধ্যে যে স্রষ্টা অগ্নি রেখেছেন, যদিও আমরা বুঝতে পারি না, সেইরূপ স্রষ্টা তাঁর অসীম কুদরতে এই দু’জনের মাথার খুলিতে অগ্নি রেখে দিয়েছেন, অগ্নি জ্বালিয়ে রেখেছেন এবং সেই অগ্নি সর্বদা জ্বলছে আর জ্বলছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে, যদিও আমরা তা অনুভব করতে পারছি না।
এই জ্ঞানগর্ভ উদাহরণ ও উত্তর শুনে তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করলো অগ্নিপূজক এবং বাধ্য হলো মেনে নিতে-আল কুরআন হচ্ছে অবশ্যই সত্য। এখানে রাষ্ট্রপ্রধান হযরত ওমরের একটি দোয়া বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য: ‘আমাদের এখানে কোনো কঠিন মাসআলা এস গেল, অথচ আলী সেখানে নেই, এমন যেনো আল্লাহ না করেন।’

হযরত আলীর শাহাদাত : এক মহাবীরের ট্র্যাজিক উপাখ্যান

৪০ হিজরির একুশে রমজান। সব-হারানোর বেদনায় গোটা বিশ্ব জগত যেন ব্যথিত, প্রকৃতি যেন নির্জীব, অচল, স্পন্দনহীন। ইয়াতিম, বঞ্চিত আর মজলুমের মর্মভেদী কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত! যে অবিস্মরণীয় নিষ্পাপ-ফুলেল সত্তা হিজরি-পূর্ব ২৩ সনের ১৩ই রজব পবিত্র কাবা ঘরে জন্ম নিয়ে তাঁর বহুমুখী সৌরভে ও অতুলনীয় সব গুণের ছোঁয়ায় বারে বারে ইসলামকে দিয়েছে নব-জীবন এবং টিকিয়ে রেখেছিল ইসলামের প্রকৃত প্রাণ ও চেতনা সেই পবিত্র ব্যক্তিত্বের শাহাদত শোক-সাহারায় তুলেছে অনন্ত মাতম! প্রায় ১৪০০ বছর ধরে মু’মিনের চোখে রক্ত-অশ্রু-ঝরাচ্ছে এই রাত! কিন্তু সে রাতে বিশ্বনবী (সা)’র পর হেদায়াতের উজ্জ্বলতম প্রদীপ অসময়ে চিরতরে নির্বাপিত হলেও মানুষের অন্তরে তিনি আজো অমর, অক্ষয় এবং ঈমানের অফুরন্ত শক্তির উৎস !
একুশে রমজান পৃথিবী হারিয়েছিল বিশ্বনবী-(সা)’র শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ও শ্রেষ্ঠ অনুসারীকে, হারিয়েছিল বিশ্বনবী (সা)’র জ্ঞান-নগরীর মহা-তোরণকে, হারিয়েছিল রাসূল (সা)’র পর সবচেয়ে দয়ালু ও উদার আত্মার অধিকারী মানুষ এবং হেদায়াতের উজ্জ্বলতম প্রদীপকে। সেদিন মুসলিম বিশ্ব তার অত্যন্ত দুঃসময়ে হারিয়েছিল সাধনা ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার সর্বোত্তম আদর্শকে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা)’র নিজ হাতে গড়ে তোলা ইসলামের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সবচেয়ে আপোষহীন নেতাকে। কিন্তু অকাল-মৃত্যু সত্ত্বে আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলীর শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের স্বর্গীয় আলোকোজ্জ্বল প্রভা যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পরতে পরতে আদর্শ মুমিনের কর্মতৎপরতার গভীরে অতুলনীয় ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। আলী ছিলেন যুবকদের জন্য বীরত্ব ও সাহসিকতার আদর্শ, সরকার-প্রধানদের জন্য ন্যায়বিচারের আদর্শ, ইবাদত, খোদা-প্রেম ও ভারসাম্যপূর্ণ অনাড়ম্বর জীবনের জন্য সব মুমিন মুসলমানেরই আদর্শ। তাঁর মুক্তিকামিতা বিশ্বের সব মুক্তিকামীর আদর্শ এবং প্রজ্ঞাময় বক্তব্য ও চিরস্মরণীয় উপদেশগুলো আলেম, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের জন্য আদর্শ।
আলী (আ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব নদী-দখলকারী শত্রুরা যার বাহিনীর জন্য নদীর পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে সেই শত্রুদের পরাজিত করার পরও তিনি ওই নদীর পানি কোনো শত্রুর জন্য নিষিদ্ধ করেননি। জালিমদের বিরুদ্ধে আলী (আ) সবচেয়ে কঠোর হলেও তিনি ব্যক্তিগত ক্রোধের বশে নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাদের ওপর আঘাত হানতেন।
সিফফিনের যুদ্ধের প্রাক্কালে উভয়পক্ষের লোকক্ষয় এড়ানো ও বিদ্রোহীদের সুপথে আনার জন্য তিনি এত বেশী অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছিলেন যে, সে সময় শত্রুরা এ প্রচারণা চালিয়েছিল যে মহাবীর আলী মৃত্যুকে ভয় পান! অথচ শাহাদত ছিল তাঁর কাছে এতটা প্রিয় যতটা প্রিয় শিশুর কাছে মাতৃস্তন । তিনি খিলাফত লাভের পর সব সাহাবির জন্য সরকার-প্রদত্ত ভাতা সমান করে দিয়ে রাসূল (সা) সুন্নাত পুন:প্রবর্তন করেছিলেন। আলী সর্বত্র প্রকৃত ইসলাম ও ন্যায়-বিচার কায়েমের তথা সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই সুবিধাবাদী, মুনাফিক এবং স্বল্প-জ্ঞানী ধর্মান্ধ ও বিভ্রান্ত শ্রেণীগুলো তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়। সত্যের পথে অবিচল থাকলে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও নেতা তাঁকে ত্যাগ করবেন বলে তিনি জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ন্যায়-বিচারের পথ ত্যাগ করেননি। ফলে শাহাদতের উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন হযরত আলী।
একদল সরলমনা ও ধর্মান্ধ ব্যক্তি দুনিয়া-পূজারি ও ক্ষমতালোভীদের প্রতারণার শিকার হয়ে হযরত আলীর মতো নিষ্পাপ মুমিনকেও কাফের বলে ঘোষণা দেয়! ইতিহাসে এই শ্রেণী খারেজী বলে খ্যাত ।এই খারেজীদেরই অন্ধ অনুসারী ইবনে মুলজেম আল আশআসসহ আলী’র চরম বিদ্বেষী কয়েক ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে শরীক হয়। ইবনে মুলজেম ১৯ শে রমজানের ফজরের নামাজের সময় সিজদারত অবস্থায় হযরত আলীর শির মোবারকে বিষাক্ত তরবারির আঘাত হানে। এ আঘাতে আহত আমীরুল মুমিনীন ২১শে রমজানের রাতে শাহাদত বরণ করেন এবং শেষ হয়ে যায় চার বছর ও নয় মাসের খেলাফত। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ ।
হযরত আলী ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হল হারুন নবী ছিলেন, তুমি নবী নও।
রাসূল (সা) বলেছেন, “আমি জ্ঞানের নগরী, আলী তার দরজা, যে কেউ আমার জ্ঞানের মহানগরীতে প্রবেশ করতে চায় তাকে এ দরজা দিয়েই আসতে হবে”।
মহানবী (সা) আরও বলেছেন, হে আম্মার! যদি দেখ সমস্ত মানুষ একদিকে চলে গেছে, কিন্তু আলী চলে গেছে অন্য দিকে, তবুও আলীকে অনুসরণ কর, কারণ, সে তোমাকে ধ্বংসের দিকে নেবে না।
বিশ্বনবী (সা) আরও বলেছেন, আমি আলী থেকে, আর আলী আমার থেকে, যা কিছু আলীকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা কিছু আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকে কষ্ট দেয়।
হে আলী! ঈমানদার কখনও তোমার শত্রু হবে না এবং মোনাফেকরা কখনও তোমাকে ভালবাসবে না।-অনেক সাহাবী এ হাদিসের ভিত্তিতেই মোনাফেকদের সনাক্ত করতেন ।
রাসূলে পাক (সা)’র স্ত্রী আয়শা বিনতে আবুবকর হযরত আলীর শাহাদতের খবর শুনে বলেছিলেন,
“হে রাসূল! তোমার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র শাহাদত বরণ করেছেন। আজ এমন এক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন যিনি ছিলেন রাসূল (সা)’র পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। (সূত্র: মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা: লেখক ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ)
“আর এইসব বাণী থেকে এটা স্পষ্ট যে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব।
হযরত আলী (রা)’র আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব ও মহত্ত্বে অমুসলিম পণ্ডিতরাও অভিভূত ও হতবাক হয়েছেন। আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, আলী (আ.) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ‍ব্যক্তি।
ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, “সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলীর ছিল মহৎ সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রীক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।”
ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সা)’র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী।
শাহাদত-প্রেমিক আলী যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তাঁর সঙ্গীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সবাই কাঁদছে, চারিদিকে ক্রন্দনের শব্দ, কিন্তু আলীর মুখ তখনও হাস্যোজ্জ্বল। তিনি বলছেন, “আল্লাহর শপথ! আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে, ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ হব?”
ঘাতকের প্রাণঘাতী আঘাতে ধরাশায়ী আমিরুল মু’মিনিন এ ঘটনা নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা অবিচার না করার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “ হে আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা! তোমরা এমন যেন না কর, যখন আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেব তখন মানুষের উপর হামলা করবে এ অজুহাতে যে, আমীরুল মু’মিনীনকে শহীদ করা হয়েছে। অমুকের এটার পেছনে হাত ছিল, অমুক এ কাজে উৎসাহিত করেছে। এসব কথা বলে বেড়াবে না, বরং আমার হত্যাকারী হল এই ব্যক্তি।”
আলী (আ) ইমাম হাসানকে বলেছিলেন, “বাবা হাসান! আমার মৃত্যুর পর যদি চাও আমার হত্যাকারীকে মুক্তি দেবে তাহলে মুক্তি দিও, যদি চাও কিসাস গ্রহণ করবে তাহলে লক্ষ্য রাখবে, সে তোমার পিতাকে একটি আঘাত করেছে, তাকেও একটি আঘাত করবে। যদি তাতে মৃত্যুবরণ করে তো করল, নতুবা ছেড়ে দেবে।”
হযরত আলী নিজেকে সব সময় জনগণের সেবক বলে মনে করতেন এবং সব সময় অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। দ্বিতীয় রাষ্ট্রপ্রধান ওমর ইবনে খাত্তাব বলেছেন, আলী ইবনে আবি তালিবের মতো আরেকজনকে জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নারীকূলের কারো নেই, আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত।
হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, আলীর চারটি গুণ ছিল যা অন্য কারো ছিল না। আরব ও অনারবের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলের সাথে সালাত আদায় করেছেন। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক জিহাদেই তাঁর হাতে ঝাণ্ডা থাকতো। তৃতীয়তঃ লোকেরা যখন রাসূলের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেত তখনও আলী তাঁর পাশেই থাকতো। চতুর্থতঃ আলীই রাসূল (সা)কে শেষ গোসল দিয়েছিলেন এবং তাঁকে কবরে দাফন করেছিলেন।
জীরার ইবনে হামজা তাঁর প্রিয় নেতা আলী সম্পর্কে আমির মুয়াবিয়ার কাছে বলেছিলেন, “আলীর ব্যক্তিত্ব ছিল সীমাহীন, তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দোর্দণ্ড, তাঁর বক্তব্য ছিল সিদ্ধান্তমূলক, তাঁর বিচার ছিল ন্যায়ভিত্তিক, সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল, তাঁর প্রতিটি আচরণে প্রজ্ঞা প্রকাশিত হত। তিনি মোটা বা সাদামাটা খাদ্য পছন্দ করতেন এবং অল্প দামের পোশাক পছন্দ করতেন। আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের একজন হিসেবে আমাদের মাঝে ছিলেন, আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, আমাদের সকল অনুরোধ রক্ষা করতেন। তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সম্বোধন করে কিছু বলতে ও প্রথমে কথা বলতে আমরা ভয় পেতাম না। তাঁর হাসিতে মুক্তা ছড়িয়ে পড়তো। তিনি ধার্মিকদের খুব সম্মান করতেন। অভাবগ্রস্তের প্রতি খুবই দয়ালু ছিলেন। এতিম, নিকট আত্মীয় ও অন্নহীনকে খাওয়াতেন। তিনি বস্ত্রহীনে বস্ত্র দিতেন ও অক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করতেন। তিনি দুনিয়া ও এর চাকচিক্যকে ঘৃণা করতেন। আমি আলী ইবনে আবি তালিবকে গভীর রাতে বহুবার এ অবস্থায় মসজিদে দেখেছি যে তিনি নিজ দাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আর্তনাদ করতেন যেন সাপে কামড় খাওয়া মানুষ এবং শোকাহত লোকের মতো রোদন করে বলতেন, হে দুনিয়া, ওহে দুনিয়া, আমার কাছ থেকে দূর হও! আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না!” … এরপর জীরার বলেন, আলীর অনুপস্থিতিতে আমি সেই মহিলার মতো শোকাহত যার সন্তানকে তার কোলে রেখে কেটে ফেলা হয়েছে। বলা হয় জিরারের কথা শুনে আলীর জাত-শত্রু ও পরোক্ষ-ঘাতক মুয়াবিয়ার চোখেও পানি চলে আসে। (আল্লাহই ভালো জানেন)
সবশেষে হযরত আলীর (আঃ)’র কয়েকটি অমর ও অমূল্য বাণী তুলে ধরছিঃ
-‘নিশ্চয় আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে অনন্তর বলতে শুনেছি যে, কোন উম্মতই সম্মান ও মর্যাদার পবিত্র স্থানে পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের ক্ষমতাশীলদের হাত থেকে দুর্বলদের অধিকার আদায় করবে কোন দ্বিধা ও শঙ্কা ছাড়াই। ’ (নাহজুল বালাগাহ্, পত্র নং ৫৩)
-প্রকৃত জীবন হচ্ছে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে জয়ী হওয়া। আর প্রকৃত মৃত্যু হলো বেঁচে থেকেও নিকৃষ্ট ব্যক্তির অধীনে থাকা।
- জেনে রাখ, নিশ্চয়ই দারিদ্র্য একটি বড় বিপদ এবং দারিদ্র্য হতে মন্দ শারীরিক অসুস্থতা আর শারীরিক অসুস্থতা হতে খারাপ ও কঠিন হলো অন্তরের অসুস্থতা।”
- প্রত্যেক বক্তব্য বা কথা যাতে আল্লাহর স্মরণ নেই তা হল অর্থহীনতা বা অন্তঃসারশূন্যতা, আর যে নীরবতার মধ্যে আল্লাহ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই তা হচ্ছে উদাসীনতা বা মনোযোগহীনতা এবং যে চিন্তার মধ্যে আল্লাহর প্রতি দৃষ্টি নেই তা হচ্ছে অনর্থক সময় নষ্ট করা।
*বাহ্যিক অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্য হল-জ্ঞান ও সভ্যতা। যার পিতা-মাতা মারা গেছে সে এতীম নয়, প্রকৃত এতীম সে যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক নেই।
*সত্যকে আঁকড়ে ধর, যদি তাতে তোমার ক্ষতিও হয় এবং মিথ্যাকে বর্জন কর যদি মিথ্যা দিয়ে তোমার লাভও হয়। আর এটাই হল ঈমান।
আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর জন্মদিনে সবাইকে জানাচ্ছি আবারও অভিনন্দন। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ মহামানবের অনুরাগী ও অনুসারী হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন। #

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.