![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল,
তারাই এখন চড়বে ঘোড়া চড়বে ঘোড়া!
ঠাট ঠমকে চালাক চতুর
সভ্য হবে থোড়া থোড়া!!
আর কি এরা এমন কোরে,
সাঁজ সেঁজুতির ব্রত নেবে?
আর কি এরা আদর কোরে,
পিঁড়ি পেতে অন্ন দেবে?
... এরা এ বি পোড়ে বিবি সেজে,
বিলিতী বোল কবেই কবে!
এরা পর্দা তুলে ঘোমটা খুলে,
সেজে গুজে সভায় যাবে!
ড্যাম হিন্দুয়ানী বোলে
বিন্দু বিন্দু ব্রান্ডি খাবে!
আর কিছুদিন থাকলে বে’চে
সবাই দেখতে পাবেই পাবে!
ভাষা কিভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে সে সম্পর্কে অন্তত দেড়শ বছর আগে হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছিলেন কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। হয়ত একই কারণে ভারতবর্ষের রক্ষণশীল মুসলিম আলেমদের অনেকেই ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজদের শিক্ষা-ব্যবস্থা বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন।
অপসংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে ব্যঙ্গ করে লেখা নজরুলের ১১ বছর বয়সের স্মরণীয় ছড়া (গান) দেখুন:
রব না কৈলাসপুরে
আই এ্যাম ক্যালকাটা গোইং
যতসব ইংলিশ ফ্যাশন
আহ মরি! কি লাইটনিং !
ইংলিশ ফ্যাশন সবই তার
মরি কি সুন্দর বাহার
দেখলে বন্ধু দেয় চেয়ার
কাম অন ডিয়ার গুড মর্নিং।
বন্ধু আসিলে পরে হাসিয়া হ্যান্ডশেক করে
বসায় তারে রেসপেক্ট করে
হোল্ডিং আউট এ মিটিং ।
তারপর বন্ধু মিলে
ড্রিংকিং হয় কৌতূহলে,
খেয়েছে সব জাতিকুলে
নজরুল ইসলাম ইজ টেলিং।।
ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত নানা কারণে রবি ঠাকুর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্রিটিশ ইংরেজদের প্রশংসা করতে অভ্যস্ত হলেও পশ্চিমা সভ্যতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তার ৮০ তম জন্মদিনে ‘সভ্যতার সংকট’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘...সমস্ত য়ুরোপে বর্বরতা কি রকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে। ...’
এইসব কবিতা ও বক্তব্য তুলে ধরার কারণ হল আমাদের নিজস্ব ও স্থানীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির গুরুত্ব ভুলে গিয়ে পাশ্চাত্যের ভাষা-বাহিত সংস্কৃতি ও লাইফ-স্টাইলের অবাধ লালন ও অন্ধ অনুকরণ করার পরিণতি সম্পর্কে আমাদের অতীত জ্ঞানী-গুণীদের হুঁশিয়ারীর কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়া। কারণ, উপনিবেশবাদীদের রেখে-যাওয়া শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রভাবে উচ্চ-শিক্ষিত ও কথিত বুদ্বিজীবীদের অনেকেই পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে বলে থাকেন: জাপান যখন নিজেদের সব কিছু বাদ দিয়ে ও ত্যাগ করে পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলনে, চিন্তা-ভাবনায় এবং ধ্যান-ধারণায় পুরোদমে পাশ্চাত্যকে অনুসরণ ও অনুকরণ শুরু করে তখন থেকেই জাপান নাকি উন্নত দেশে পরিণত হয়। অন্য কথায় জাপান যখনই নিজের প্রাচীন পুরনো সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস ও সংস্কার বাদ দিয়ে ও ত্যাগ করে পশ্চিমা ভাবধারা, সংস্কৃতি ও আধুনিকতা গ্রহণ করে ঠিক তখন থেকেই উন্নত হতে থাকে এবং অবশেষে এক উন্নত ও অগ্রসর দেশে পরিণত হয়! তাই আমাদের মতো জাতির উন্নতি করতে হলে জাপানের পদাঙ্ক অনুকরণ ও অনুসরণের কোন বিকল্প নেই!
গত বিংশ শতকের শুরুতে পাশ্চাত্যপন্থী অনেক বুদ্ধিজীবী সার্বিক উন্নয়নের মডেল তুলে ধরতে গিয়ে বলতেন: আমাদেরকে আপাদমস্তক পাশ্চাত্যের অনুসারী হতে হবে। তাই মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোপুরি ওয়েস্টার্ন বা পশ্চিমা হতে হবে। এর জবাবে বলতে হয়: ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন এবং আচার-আচরণ হুবহু পাশ্চাত্যের মত বা পশ্চিম ইউরোপের মতো বা অন্তত: স্পেন পর্তুগালের মতো। একমাত্র পর্তুগিজ ভাষাভাষী ব্রাজিল ছাড়া বাদবাকি ল্যাটিন আমেরিকান দেশ হচ্ছে স্প্যানিশ ভাষাভাষী এবং ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ অধিবাসী ইউরোপীয় বা ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত। কই তারা তো জাপানের মতো উন্নত হতে পারেনি। বরং এসব দেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত বলেই বিবেচিত হয়।
আসলে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক ও চালচলন গ্রহণের জন্য নয় বরং জাপানীরা কঠোর অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও চেষ্টা - সাধনার কারণেই উন্নত হতে পেরেছে। তাছাড়া জাপানীরা নিজ মাতৃভাষাকে বাদ দেয়নি।
প্রধানত: মুসলিম ও আরবি ভাষাভাষী উত্তর আফ্রিকা ছাড়া বাদবাকি আফ্রিকা তথা ব্ল্যাক-আফ্রিকা হয় ইংরেজিতে না হয় ফরাসি ভাষায় কথা বলে। কারণ এসব অঞ্চল হয় ব্রিটিশ অথবা ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন-কবলিত ছিল। অত্র অঞ্চলে অর্থাৎ ব্ল্যাক আফ্রিকায় এই দুই ভাষার প্রভাব এত বেশি যে ঐ সব দেশের রাস্তা-ঘাট হাট-বাজারে সর্বত্র মাতৃভাষার মতো সাধারণ লোকেরা তথা শিক্ষিত- অশিক্ষিত সবাই ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলে এমনকি ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েও এর ব্যতিক্রম নয়। ভারত , বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের সর্বস্তরে এমন অনর্গল ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার চর্চা কল্পনা করাই যায় না।
অর্থাৎ পাক-ভারত উপমহাদেশে অনেকেই খুব ভালো ইংরেজি জানলেও এবং বলতে পারলেও আপামর জনগণ অনর্গল বলা তো দূরে থাক তেমন একটা ভালো ইংরেজি বলতে ও বুঝতে পারে না! তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে ঐ সব ইংরেজি বা ফরাসি ভাষাভাষী আফ্রিকীয় দেশ ইংরেজি বা ফরাসি ভাষা, খ্রিষ্ট ধর্ম এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়েও উন্নত হতে পারে নি। বরং ঐ সব দেশ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশ। কই ইংরেজি বা ফরাসি ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পরও কেন ঐ সব আফ্রিকীয় দেশ উন্নত হতে পারল না? বর্তমানে এসব ইংরেজি বা ফরাসি ভাষাভাষী আফ্রিকীয় দেশ ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, গোলযোগ, কুশাসন, স্বৈরশাসন ইত্যাদিতে জর্জরিত। অতএব জাগতিক ও বৈষয়িক উন্নতি করতে হলে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা অথবা স্প্যানিশ, জার্মান, রুশ ইত্যাদির মত কোনও একটি প্রসিদ্ধ ইউরোপীয় ভাষা শেখা ছাড়া উপায় নেই বলে বিপুল সংখ্যক জনগণের মধ্যে যে কথা প্রচলিত আছে তা মারাত্মক ভুল ও অলীক কল্পনা মাত্র।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে যাবেঃ
যেমন, দক্ষিণ সুদান এবং উত্তর সুদান প্রসঙ্গ:
দক্ষিণ সুদান পাশ্চাত্যের মদদে ৩০ বছরেরও বেশি সময়ের সশস্ত্র সংগ্রামের পর এখন থেকে প্রায় ৮ বছর আগে (২০১১ সনের ৯ জুলাই) বৃহত্তর সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়। দেশটি অত্যন্ত তেল-সমৃদ্ধ এবং এখানেই রয়েছে নীল নদের উৎস। আর এ কারণে দেশটি খুবই সবুজ বা সুজলা সুফলা এবং কৃষিকাজের উপযুক্ত। আর মরুময় উত্তর-সুদানের তুলনায় এ দেশ পানি-সম্পদসহ প্রাকৃতিক সম্পদে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। অথচ এদেশ এখনও উত্তর সুদান হতে অনেক দরিদ্র ও অনুন্নত।
পাশ্চাত্যের মদদে দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময়ের সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সেখানে চলছে ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ। অথচ এই দক্ষিণ সুদানের অধিবাসীরা অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। ইংরেজি জেনে এবং খনিজ তেলসহ প্রাকৃতিক নানা সম্পদের অধিকারী ও সুজলা সুফলা হয়েও তারা তথা মূলত: খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদান প্রধানত: আরবি-ভাষাভাষী মুসলিম প্রধান মরুময় উত্তর সুদানের চেয়ে উন্নত ও ধনী হতে পারছে না! স্বাধীনতা লাভ করার পরও মারামারি, দাঙ্গা, হানাহানি, গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, হত্যা, রোগ-ব্যাধি ও মৃত্যু এখন দক্ষিণ সুদানের অধিবাসীদের নিত্য-সঙ্গী।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত দক্ষিণ সুদানের অধিবাসীরা আরবি ভাষা প্রত্যাখ্যান ও বর্জন করে এবং ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করে বৃহত্তর সুদান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য পাশ্চাত্যের মদদে দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় সশস্ত্র বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে। এমনকি মূল সুদানের সাথে একত্রে থাকাকালীন সময়ও দক্ষিণ সুদানে আরবি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় সরকারী কাজকর্ম সম্পন্ন হত এবং স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান করা হত। তাই দক্ষিণ সুদানে ইংরেজি ভাষার পদচারণা সেই সুদূর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই ছিল।
মালি প্রসঙ্গ:
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন-কবলিত হওয়ার আগে মালি পশ্চিম-আফ্রিকায় এক বিশাল সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী সাম্রাজ্য তথা সালতানাৎ স্থাপন করেছিল এবং পশ্চিম আফ্রিকায় ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসারে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এর উৎকর্ষের সোনালী যুগে তথা খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে মালি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, সাহিত্য ও শিল্পকলায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছিল। মালির উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা দেশ-দেশান্তরে ছড়িয় গিয়েছিল। এমনকি মালির খ্যাতি ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল যা নব্য সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদী ইউরোপকে মালিতে হানা দেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ মালিকে করায়ত্ত ও দখল করে ফরাসী সুদানের আওতাধীন করে। ফলে সে দেশে নেমে আসে ভয়ঙ্কর কুশাসনের অমানিশা এবং এরপরের ইতিহাস বঞ্চনা-গঞ্জনা, দারিদ্র্য, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, দুর্ভিক্ষ, লুট-তরাজ, হত্যা, পশ্চাদপদতা, অজ্ঞতা, অনগ্রসরতা, রোগ-বালাই আর মহামারী, মৃত্যু ও সর্বস্ব হারানোর ইতিহাস।
মালি সবকিছু হারিয়ে একটা জিনিস লাভ করেছে। আর তা হল ফরাসি ভাষা। ফরাসি ভাষা এখন দেশটির রাষ্ট্র-ভাষা এবং তা এখন মালির অধিবাসীদের প্রায় মাতৃভাষায় পরিণত হয়েছে। মালির ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে-মেয়েও ফ্রান্সের অধিবাসীদের মত অনর্গল ফরাসি বলতে ও বুঝতে পারে। কই ফরাসি ভাষা জানা ও এ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারার কারণে কি মালির অধিবাসীদের হারানো গৌরব, সমৃদ্ধি ও উন্নতি ফিরে এসেছে যা ইসলাম ও আরবি ভাষা তাদেরকে দিয়েছিল? না, মোটেও তা হয় নি। ফরাসি ভাষা লাভ করেও মালি এখন বিশ্বর সবচেয়ে দরিদ্র দশ দেশের অন্যতম এবং গুরুতর ঋণভারে জর্জরিত দরিদ্র ৩৭ দেশের একটি। বিভিন্ন বৈদেশিক উৎস থেকে বিপুল বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে থাকে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশ তথা মালি।
তাই এটা স্পষ্ট যে পশ্চিমা তথা ইউরোপীয় ভাষাগুলো শেখার সঙ্গে কোনও দেশের বা জাতির উন্নত হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই বরং পশ্চিম ভাষা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুরাগ ও অনুকরণ বিশ্বের বহু জাতি ও বহু দেশের অসংখ্য নাগরিকের জন্য অনুন্নত হওয়ার মাধ্যমই হয়েছে।
সূত্র : এ পোস্টের বেশিরভাগ তথ্য ও বক্তব্যই সমাজ-সংস্কারকামী বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খানের প্রবন্ধ ‘ভাষা সংক্রান্ত কিছু বিভ্রান্তির অপনোদন’ থেকে নেয়া হয়েছে।
©somewhere in net ltd.