![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইসলামের ইতিহাস নিয়ে যারা নিরপেক্ষ-অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়েছেন ও সত্যকে জানার জন্য গবেষণা করেছেন বা করছেন তারা এর নিষ্পাপ মহানায়কদের জীবনীর মধ্যে বেশ কিছু অসঙ্গতি দেখতে পান! আসলে এসব অসঙ্গতির রহস্য বা উৎস হল জাল বা ভুয়া হাদিস।
স্বয়ং বিশ্বনবীর (সা) নামে প্রচার হয়েছে অনেক জাল হাদিস। বোখারি শরিফের মত হাদিস গ্রন্থে এমন হাদিস স্থান পেয়েছে যে মহানবী শৈশবে এক বিশেষ মূর্তির পূজা করেছিলেন এবং এ জন্য ওই মূর্তি বা কথিত দেবতার উদ্দেশ্যে ভেড়া উৎসর্গ করেছিলেন। তাই পশ্চিমা ঐতিহাসিক পি. কে হিট্টির মত লেখক লিখেছেন যে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ এক সময় মূর্তি-পূজারি ছিলেন!!!।
অনেকেই মনে করেন সুপরিকল্পিতভাবে এমন অনেক হাদিস প্রচার করা হয়েছে বিশেষ বিশেষ সাহাবিদের নামে যা ওই সাহাবিদের মর্যাদাকে রাসুলের (সা) চেয়েও অনেক ওপরে উঠিয়ে দেয়! আর বিশ্বনবী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের অনেকের নামেই এমন সব জঘন্য অপবাদমূলক হাদিস প্রচার করা হয়েছে এ হীন উদ্দেশ্যে যে তাতে যেন তাঁদের মর্যাদা নেমে আসে সাধারণ মানুষ বা ইন্দ্রিয়পরায়ণ পাপী মানুষের পর্যায়ে!
এসব জঘন্য কাজ করেছে ইহুদিবাদী চক্রের দোষর মুসলিম নামধারী একদল মুনাফিক যারা উমাইয়া রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামের ওপর চরম আঘাত হেনে ইসলামের প্রকৃত চেতনা ও নেতৃত্বকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছে। হযরত আলী ও ইমাম হুসাইনের সংগ্রাম তাদের সেইসব ষড়যন্ত্র অনেকাংশে বানচাল করলেও আব্বাসিয় সুবিধাবাদী চক্রসহ মহানবীর (সা) আহলে বাইতের বিদ্বেষী প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও মহলের কারসাজিতে যুগে যুগে সেসব মিথ্যা প্রচারণার এক বিপুল অংশ বিষাক্ত প্রভাবসহ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। ওয়াহাবি মতবাদের মধ্যযুগীয় পথিকৃৎ ইবনে তাইমিয়াও সেইসব মিথ্যাচার ও প্রচারণার ধারাকে তীব্র মাত্রায় বেগবান করেছিলেন। ফলে আজও দেখা যায় একদল নাস্তিক ও মুরতাদ বা ইসলাম-বিদ্বেষী ব্যক্তি ওইসব জাল-হাদিসকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সরলমনা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করছে। আধুনিক যুগে সালমান রুশদির নাম এইসব নাপাক ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থানীয়।
সম্প্রতি ইন্টারনেটে ইসলাম-বিদ্বেষীদের এইসব প্রচারণার প্রভাব দেখে খুবই মর্মাহত হলাম যখন দেখলাম যে বেহেশতি যুবকদের অন্যতম সর্দার নামে খ্যাত মহামানব তথা মহানবীর প্রথম নাতি হযরত ইমাম হাসানকে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক বাঙ্গালি লেখক ' ইসলামের প্রাথমিক যুগের প্লে-বয়' (নাউজুবিল্লাহ) বলে উল্লেখ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তাই আজ এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যামূলক প্রামাণ্য প্রবন্ধ তুলে ধরছি। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যের পথে চলার তৌফিক দিন। ( বিনীত- এম এ হুসাইন):
'ইমাম হাসানের বিরুদ্ধে অসংখ্য স্ত্রী গ্রহণের অপবাদ ও তার জবাব'
আলোক আরিফ
ইসলামের শত্রু বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাস মহানবীর পবিত্র আহলে বাইত বিশেষত ইমাম হাসানের চরিত্র হরণের উদ্দেশে তাঁর ওপর বিভিন্নরূপ অপবাদ আরোপ করেছে। তাদের শাসনকালে যে সকল ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থ সঙ্কলিত হয়েছে তাতে এমনকিছু আপত্তিকর ও সত্যের অপলাপ বিষয় বর্ণিত হয়েছে যার কোন ভিত্তি নেই। এরূপ একটি বিষয় হল ইমাম হাসানের পুনঃপুনঃ নতুন স্ত্রী গ্রহণ ও তালাক দানের বিষয়। যেমন, ঐতিহাসিক বালাজুরি উল্লেখ করেছে: আবু সালেহ বর্ণনা করেছে যে, হযরত আলী বলেছেন: হাসান এত বেশি বিয়ে করে ও তালাক দেয় যে, আমি ভয় পাচ্ছি এটা আমাদের সাথে অন্যদের সাথে শত্রুতার কারণ হবে। (অনসাবুল আশরাফ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫)
তেমনি সুয়ুতি আলী থেকে বর্ণনা করেছে: হাসান এত বেশি বিয়ে করে ও তালাক দেয় যে, আমি ভয় পাচ্ছি এর ফলে বিভিন্ন গোত্র ও বংশের লোকদের পক্ষ থেকে আমাদের সাথে শত্রুতা বৃদ্ধি পাবে। (তারিখুল খোলাফা, পৃ.১৯১) ইবনে হাজার বর্ণনা করেছে হাসানের ৯০জন স্ত্রী ছিল। (আসসাওয়ায়েকুল মুহরিকা, পৃ.১৩৯) আবু তালেব মাক্কি তাঁর ৩০০জন স্ত্রী ছিল বলে উল্লেখ করেছে।(মানাকিবু আলে আবি তালিব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩০) আবুল হাসান মাদায়েনী তাঁর স্ত্রীদের সংখ্যা ৭০জন ছিল বলেছে।
এ বর্ণনাগুলো ইমাম হাসানের মহান মর্যাদার সাথে অসামঞ্জস্যশীল
পবিত্র কোরআন, সুন্নাত, ইমাম হাসানের জীবনচরিত এবং তাঁর বিষয়ে হযরত আলী ও ইমাম হোসাইনের বক্তব্য ও আচরণ থেকে তাঁর যে মহান চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তা তাঁর নামে যা প্রচারিত হয়েছে তাকে সর্বৈবভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। নিম্নে আমরা নমুনাস্বরূপ এরূপ কিছু বর্ণনা উল্লেখ করছি:
১. পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৩৩নং আয়াতের এ অংশটি- আল্লাহ কেবল চান যে, হে আহলে বাইত! তোমাদের হতে সর্ব প্রকারের কলুষ দূরে রাখতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে- ইমাম হাসানসহ মহানবীর (সা.) আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।(তাফসীরে দুররুল মানসূর, ৫ম খ-, পৃ. ১৯৬; আসসাওয়ায়েকুল মুহরিকা, পৃ.১৪৩; সুনানে বায়হাকি, ২য় খ-, পৃ.১৪৯) এ আয়াত থেকে ইমাম হাসানের মহান ও পুতপবিত্র চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। আর কেনই তা তিনি এমন হবেন না যখন তিনি পবিত্র কোরানের ঘোষণায় মহান চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি (সূরা কালাম:৪) অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলের সন্তান ও তাঁর দ্বারা প্রশিক্ষিত।
২. সূরা শূরার ২৩নং আয়াতেরও তিনি অন্তর্ভুক্ত যেখানে মহান আল্লাহ তাঁর নবীর আহলে বাইতের সদস্যদের -অর্থাৎ হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইন- প্রতি ভালবাসা পোষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীরে দুররুল মানসূর, ৭ম খ-, পৃ. ৭) নিঃসন্দেহে উত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়ার কারণেই আল্লাহ ইমাম হাসানকে ভালবাসার নির্দেশ দিয়েছেন।
৩. রাসূল (সা.) বলেছেন: «أَلْحَسَنُ وَ اْلْحُسَيْنُ سَيِّدا شَبَابِ أَهْلِ اْلْجَنَّةِ» “হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা।” (আহমাদ ইবনে হাম্বাল, মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খ-, পৃ.২; হাকিম নিশাবুরি, আলমুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন, ৩য় খ-, পৃ,১৬৭; সুয়ুতী, তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৮৯) নিঃসন্দেহে ইমাম হাসানের বিয়ে ও তালাকের ব্যাপারে যে বড় এক সংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে তা স্বয়ং পাঠকের মনে এ প্রশ্নের সৃষ্টি করে যে, তবে কি তালাক মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কর্ম বলে বিবেচিত নয় যা আল্লাহর আরশকে প্রকম্পিত করে। এরূপ এক অপছন্দনীয় কর্ম কিভাবে বেহেশতের যুবকদের নেতা থেকে বারবার ঘটতে পারে। তবে কী তিনি আল্লাহর আরশ প্রকম্পিত হওয়ার কোন পরওয়াই করতেন না। তিনি যদি এমন চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকেন তবে কিভাবে তিনি বেহেশতের যুবকদের নেতা হলেন?
৪. মহানবী (সা.) ইমাম হাসানকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি তাকে কাঁধে নিয়ে দোয়া করে বলতেন: “হে প্রভু, আমি তাকে ভালবাসি। তুমিও তাকে ভালবাস।” (তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৮৮)
৫. ইবনে কাছির বলেছেন: হযরত আলী তাঁর সন্তান হাসানকে খুবই সম্মান করতেন। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খ-, পৃ.৩৭)
৬. ইমাম হোসাইন তাঁর ভাই ইমাম হাসানের প্রতি এতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, তাঁর উপস্থিতিতে কখনও কথা বলতেন না। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খ-, পৃ.৩৭)
৭. ইমাম হাসান মদীনায় এতটা সম্মানিত ছিলেন যে, তিনি শাহাদাত বরণ করলে তাঁর জানাযায় মদিনা ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ মদিনায় সমবেত হন। (ইবনে আসাকির, ৮ম খ-, পৃ. ২২৮) তাঁর জানাযায় এত অধিক লোক আসে যে, জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে সুই ফেললেও তা মাটিতে পড়ত না। (আলইছাবাহ ফি মারিফাতিস সাহাবাহ, ১ম খ-, পৃ. ৩৩০।
৮. ইমাম হাসান পদব্রজে আবার কখনো নগ্নপদে পঁচিশ বার আল্লাহর ঘর যিয়ারত (হজ) করেন। (তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৯০)
৯. মারওয়ান বিন হাকাম, যে ব্যক্তি ইমামকে বিরক্ত ও কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে কোন কিছুই বাকী রাখেনি ইমাম হাসান (আ.)-এর ইন্তেকালের সময় তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করে। হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন: আমার ভাইয়ের জীবদ্দশায় তাঁর সাথে আপনি যা মন চেয়েছে তাই করেছেন আর এখন তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেছেন এবং কাঁদছেন? মারওয়ান উত্তর দেয়, “যা কিছু করেছি তা এমন এক মহান ব্যক্তির সঙ্গে করেছি যার সহনশীলতা এই পাহাড়ের (মদীনার পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে) চেয়েও অনেক বেশি ছিল।”(তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৯১)
১০. আবু তালেব মাক্কি যে ইমাম হাসানের স্ত্রীর সংখ্যা ২৫০জন বলেছেন এবং আবুল হাসান মাদায়েনী ও মুহাম্মাদ ইবনে উমর ওয়াকেদি ৭০জনের কথা বলেছেন, তারা কেন শুধু তাঁর ৮জন স্ত্রীর নাম উল্লেখ করেছেন। তারা তাঁর সন্তানের সংখ্যাও ৭জন থেকে ৩১জন হতে পারে বলেছেন। তবে কি তাঁর এত সংখ্যক স্ত্রীর অধিকাংশই বন্ধ্যা ছিলেন? নাকি তিনি তাদের ব্যয় বহন করা থেকে বিরত থাকতেন বিধায় তাঁরা সন্তান গ্রহণে অনাগ্রহী ছিলেন?
বর্ণনাগুলির পর্যালোচনা
বর্ণনাগুলোর সনদ ও সূত্রগত পর্যালোচনা
১. অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ বর্ণনাগুলো কোন সনদ ও বর্ণনাকারীদের ধারার উল্লেখ ছাড়াই বিচ্ছিন্ন-সূত্রে বর্ণনা করেছে। যেমন, ইবনে আসাকির বর্ণনাকারীদের ধারার উল্লেখ ছাড়াই সরাসরি বলেছেন: মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন এরূপ বর্ণনা করেছেন, এ সম্পর্কে মিরখান্দ শাফেয়ী লিখেছেন: এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, হাসান ইবনে আলী…(রওজাতুস সাফা, ৩য় খণ্ড, পৃ.২০) সূয়ুতী কোনরূপ সূত্র উল্লেখ ছাড়াই বলেছেন: হাসান ইবনে আলী বারবার বিয়ে করতেন (তারিখুল খোলাফা, পৃ. ১৯১); আবু তালেব মাক্কিও বলেছেন: হাসান পুনঃপুনঃ বিয়ে করতেন…; সিবতে ইবনে জাওযি বলেছেন: এক বর্ণনায় এসেছে হাসান…(তাযকিরাতুল খাওয়াছ, পৃ.১২১); আবুল হাসান মাদায়েনী এভাবে বলেছেন: হাসান অধিক বিয়ে করতেন।
এ বর্ণনাগুলো থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, তারা সকলে কোনরূপ সূত্র উল্লেখ ছাড়াই বিষয়টিকে মুরসাল বা বিচ্ছিন্ন ও কর্তিতরূপে তাদের গ্রন্থ এনেছেন। তাই এ বর্ণনাগুলো মূল্যহীন বলে গণ্য।
২. উপরিউক্ত বর্ণনাগুলো ও এসম্পর্কিত অন্য সকল বর্ণনা মূলত তিনজন ঐতিহাসিকের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আর তারা হল আবুল হাসান মাদায়েনী, আবু তালেব মাক্কি ও মুহাম্মাদ ইবনে উমর ওয়াকেদি এবং তারাও এ বিষয়টি সনদ ও সূত্র ছাড়াই উল্লেখ করেছেন। রিজালশাস্ত্রবিদরা বর্ণনার ক্ষেত্রে এ তিন ঐতিহাসিকের দুর্বল হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। যাহাবি (মিযানুল ইতিদাল, ৩য় খণ্ড, পৃ.১০৭), ইবনে হাজার আসকালানী (লিসানুল মিযান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৮৬), ইবনুল জাওযী(আলমুন্তাযাম, ৭ম খণ্ড, পৃ.১৮৯), ঈমাদ হাম্বালী(শাযারাতুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, পৃ.১২০); রাযি(আলজারহ ওয়াত তা’দিল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১); ইবনুল আছির জাযারী(আল কামিল ফিত তারিখ, ৯ম খণ্ড, পৃ.৪৪), যারকুলি (আলআ’লাম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬০) প্রমুখ রিজাল ও হাদিসশাস্ত্রবিদরা ঐ তিন ঐতিহাসিককে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন।
৩. ঐ তিন ঐতিহাসিকও যে ব্যক্তিদের থেকে বর্ণনা করেছেন তারা হয় বনি উমাইয়ার গোঁড়া সমর্থক অথবা দুর্বল, অজ্ঞাত ও অপ্রসিদ্ধ। যেমন, ঐতিহাসিক মাদায়েনী তার গ্রন্থে ইমাম হাসানের বিয়ের বিষয়টি আওয়ানাহ থেকে বর্ণনা করেছে যে বনি উমাইয়ার পক্ষে হাদিস জাল করত। (লিসানুল মিযান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৮৬) এ হাদিসের অন্যান্য বর্ণনাকারী যেমন জাফর ইবনে হেলাল, আসেম ইবনে সুলায়মান আহওয়াল ও ইবনে উসমানকে যাহাবি দুর্বল বা অপরিচিত রাবি বলেছেন((মিযানুল ইতিদাল, ১ম খণ্ড, পৃ.৪৩০; ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৫০; ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৯৮)
রিজালশাস্ত্রবিদ ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন, মাদানিদের থেকে বর্ণিত ওয়াকেদির সকল বর্ণনাতেই অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীদের উপস্থিতি রয়েছে বলেছেন।(তাযকিরাতুল হুফফায, ১ম খণ্ড, পৃ.৩৮৪)
হাশেম মারূফ আলহাসানী লিখেছেন:ঐতিহাসিক মাদানী বনি আব্বাসের সমসাময়িক এবং সে মিথ্যাবাদী ও হাদিস জালকারী। যাহাবি তার মিযানুল ইতিদাল গ্রন্থ-এ বলেছেন: মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ তার সহীহ (মুসলিম) গ্রন্থে মাদায়েনী থেকে হাদিস গ্রহণ করেননি,ইবনে আদী তাকে দুর্বল বলেছেন। ইবনু হাজার আসকালানী বলেছে,‘সে (মাদায়েনী) উমাইয়া বংশের আবদুর রহমান ইবনে সামারাহ ইবনে হাবিবের দাসদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার অধিকাংশ বর্ণনা সূত্রহীন অথবা বর্ণনাকারীদের ধারায় বিচ্ছিন্নতার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।’ এ ত্রুটিগুলো প্রমাণ করে যে, ইমাম হাসানের বহুসংখ্যক স্ত্রী থাকার বর্ণনাগুলো তাঁর শত্রুদের দ্বারা জালকৃত। আর তাই কোনক্রমেই তা সঠিক হতে পারে না।
হাদিস জালকরণ ইসলামের ইতিহাসের এক ধ্বংসাত্মক চরম বাস্তবতা
দুঃখজনকভাবে ইসলামের ইতিহাসের এক ধ্বংসাত্মক চরম বাস্তবতা হল এর ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থগুলোতে জাল ও বানোয়াট বর্ণনা ও হাদিসের অনুপ্রবেশ। কোন কোন ক্ষেত্রে এ গ্রন্থগুলোর সঙ্কলক ও রচয়িতারা শাসকগোষ্ঠীর ভয়ে অসংখ্য সহীহ হাদিস বর্ণনা করতে অথবা গোপন করতে বাধ্য হয়েছে। আবার অনেক সময় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রছায়ায় ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থসমূহ রচিত হওয়ায় তাদের ফজিলত ও মর্যাদায় এবং তাদের প্রতিপক্ষের অবমাননায় জাল হাদিস রচিত হয়েছে। ইমাম হাসানও বনি উমাইয়া শাসক গোষ্ঠী বিশেষত মুয়াবিয়ার রোষানলে পড়ে অপবাদের শিকার হন এবং তাঁর সম্মান হানি করে তার বিরুদ্ধে অনেক জাল হাদিস রচনা করা হয়।
ইমাম মুহাম্মদ আবদুহ বলেন: বনি উমাইয়ার শাসনামলে মানুষের ওপর সাধারণভাবে যে বিপদ নেমে এসেছিল তা হল ব্যাপক আকারে মিথ্যার প্রচলন। ফলে যদিও বর্ণনাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যবাদীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। প্রসিদ্ধ সাহাবাদের অনেকেই তাদের থেকে শ্রুত হাদীস বিকৃত হওয়ার আশংকায় হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন এবং সীমিত কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছেই কেবল হাদীস বর্ণনা করতেন।
আব্বাসীয় খলীফারাও শরীয়তকে পদদলিত করার ক্ষেত্রে বনি উমাইয়াদের তুলনায় কম ছিলেন না। তারাও তাদের শাসন ক্ষমতা এবং প্রশাসনের স্বার্থে শরীয়তকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতো। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর, মালিক ইবনে আনাসের কাছে তার মনোপূত বর্ণনার সুন্নাত (সংকলিত হাদীস সমগ্র) কামনা করে এবং জনমতকে তার ওপর ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নেয়। মানসুর ইমাম আবু হানিফাকে ইমাম সাদিক (আ.) এর সাথে শরীয়তের বিভিন্ন বিধান নিয়ে বিতর্ক করতে বলে। আর তিনি তাঁর জন্য (তার দৃষ্টিতে) বেশ কিছু কঠিন প্রশ্নের অবতারণা করেন যেন ইমাম সাদিক (আ) তার উত্তর দানে সক্ষম না হন।
মিশরীয় অধ্যাপক আহমাদ আমিন বলেন: আশ্চর্যের বিষয় হল যদি আমরা হাদীস বর্ণনা ও সংকলনের সংখ্যার উপাত্ত একটি গ্রাফের দ্বারা চিত্রিত করি তবে দেখতে পাব তা একটি পিরামিডের আকৃতি লাভ করেছে। আল্লাহর রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় তা এর সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছায় তার পর যতই সময় অতিক্রান্ত হয় এ রেখা নিচের দিকে যেতে থাকে এবং এক সময় তা নিচের অক্ষে গিয়ে পৌঁছায়। আর এটা আল্লাহর রাসূলের সময়ের অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। অথচ এর বিপরীত হওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। যেহেতু আল্লাহর রাসূলের সাহাবারা হাদীসের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জানতেন সেহেতু তাদের জীবদ্দশায় হাদীসের বর্ণনা সর্বাধিক হওয়ার কথা। আর যখন তাদের কারো মৃত্যু হবে (ও তাদের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকলে) এবং তাদের থেকে কেউ বর্ণনা না করবে তখন হাদীসের পরিমাণ কমে যাবে।
কিন্তু আমরা দেখি (রাসূলের মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর) বনি উমাইয়ার সময় বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় বর্ণিত হাদীসের থেকে অনেক বেশী। আবার বনি আব্বাসের শাসনামলে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা বনি উমাইয়ার শাসনের সময় বর্ণিত হাদীস থেকে আরো অধিক।
অতঃপর আহমাদ আমিন এর কারণকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, যেহেতু বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসের সময় হাদীস সংকলনের জন্য বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত শুরু হয় এবং ইহুদী ও খ্রিস্টানরা শরীয়তের মধ্যে বিকৃত ও পরিবর্তনের চেষ্টায় রত হয় সেহেতু এ সময় হাদীসের প্রাচুর্য দেখা যায়।
মুয়াবিয়া, বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাস কর্তৃক হাদিস জালকরণ
মুয়াবিয়া কল্পকাহিনী রচয়িতা, গল্পকথক ও তার নৈকট্যকামী (দুনিয়ালোভী) হাদীস বর্ণনাকারীদের ভূমিকাকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা হাতে নেয় এবং তাদেরকে তার মতের সমর্থক ও তার বিরোধীদের মর্যাদাকে ক্ষুন্নকারী হাদীস জালের জন্য ব্যবহার করে। সে তার শাসন ক্ষমতার ভিত্তিকে দৃঢ় করার জন্য প্রথম দুই খলিফা ও উসমানের ফজিলত বর্ণনা করে হাদীস রচনার ওপর গুরুত্বারোপ করে।
যেমন মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান কা’বুল আহবারকে** নির্দেশ দিয়েছিল মসজিদে বসে (নবীদের সম্পর্কে) বিভিন্ন কাহিনী ও ঘটনা বর্ণনা করার। এভাবে সে কা’বকে হাদীস জাল করার সুযোগ করে দেয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কা’ব তার অপছন্দনীয় হাদীসসমূহের বিপরীত অসংখ্য হাদীস তৈরি করে এবং রাসূলুল্লাহর নামে তা প্রচার করতে থাকে।** কা’বুল আহবার একজন ইহুদী পণ্ডিত। সে ইয়েমেনের অধিবাসী ছিল এবং খলিফা আবু বকর অথবা উমরের সময় ইসলাম গ্রহণ করে। সে দ্বিতীয় খলিফার একজন প্রিয়ভাজন ব্যক্তি ছিল। সেই দ্বিতীয় খলিফাকে ‘ফারুক’ উপাধি দান করে। ইবনে সাদ, আত তাবাকাতুল কুবরা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।
এখানে আমরা ইবনে আসাকির থেকে অপর একটি বর্ণনা করছি। তিনি উল্লেখ করেছেন : মুয়াবিয়া একদিন দামেস্কের মিম্বারে বক্তব্য দানকালে বলছিল : তোমাদের আমি আল্লাহর রাসূলের হাদীস বর্ণনা করা থেকে নিষেধ করছি তবে ঐ হাদীসগুলো ব্যতীত যা উমর ইবনে খাত্তাবের সময়ে বর্ণিত ও প্রচারিত হয়েছে। তারিখে দামেস্ক, ২৯তম খ-, পৃ. ২৭৪।
ইবনে আসাকির রাজা ইবনে হাইয়া সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : মুয়াবিয়া হাদীস বর্ণনা করা হতে নিষেধ করত এবং সে বলত : রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে কোন হাদীস বর্ণনা কর না।***তারিখে দামেস্ক, ৫৯তম খ-, পৃ. ১৬৭।
ইবনে আদি, ইসমাঈল ইবনে উবাইদুল্লাহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন : মুয়াবিয়া রাসূলুল্লাহ্ থেকে সকল প্রকার হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করে; শুধু ঐ হাদীসগুলি ব্যতীত যা উমরের সময়ে বর্ণিত হতো এবং উমর তা মেনে নিয়েছেন।****আল কামিল, ইবনে আদি, ১ম খ-, পৃ. ১৯, ১৪তম অধ্যায়।
মুসলিম ও বায়হাকী উল্লেখ করেছেন : মুয়াবিয়ার নিকট একটি হাদিস বর্ণনার খবর পৌঁছালে সে খুতবা দিতে দাঁড়িয়ে বলল : এ লোকগুলোর কি হয়েছে তারা রাসূল (সা.) থেকে এমন সব হাদীস বর্ণনা করে যা আমরা তাঁর থেকে শুনিনি অথচ আমরা তার সঙ্গে ছিলাম ও তাঁর হাদীসের সাক্ষ্য ছিলাম?! অতঃপর উবাদা ইবনে সামেত দাঁড়িয়ে ঘঁনাটি বর্ণনা করলেন এবং বললেন : আমরা রাসূলুল্লাহ্ থেকে যা শুনেছি অবশ্যই তা বর্ণনা করব যদিও এতে মুয়াবিয়া অসন্তুষ্ট হয় অথবা তিনি বলেন : যদিও এতে মুয়াবিয়া লাঞ্ছিত হয়। আমি তার তোয়াক্কা করি না। আমি অন্ধকার রাতে কখনই তার সৈন্য দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার সঙ্গী হব না।*
*সহীহ মুসলিম, ৩য় খ-, পৃ. ১২১০, বাবু হাযারি বাইয়িল বুর বিল বুর ওয়াশ শায়ির বিশ শায়ির ওয়া ... ইল্লা সিভা বিসিভা আইনান বি আইনি, হাদীস নং ১৫৮৭, হাদীসটি এখান থেকে গৃহীত; সুনানুল কুবরা, বায়হাকী, ৫ম খ-, পৃ. ২৭৭, হাদীস নং ১০২৬০।
মুয়াবিয়া, সামারাত ইবনে জুন্দাবকে চার লক্ষ দিরহাম দিয়ে বলেছিল যে, যেন সে একটি হাদীস জাল করে বলে: পবিত্র কোরআনের ‘মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি রয়েছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের জীবনকে বিক্রয় করে’ -এ আয়াতটি ইমাম আলী (আ.) এর হত্যাকারী ইবনে মুলজিম সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আর সামারাত লোভের বশবর্তী হয়ে তা জাল করেছিল। শাওয়াহেদুত তানজীল, ১ম খ-, পৃ. ১৩২
হযরত আলী ও ইবনে আব্বাসের প্রতি মুয়াবিয়ার বিদ্বেষ এত বেশি ছিল যে, সে তাঁদেরকে লানত করার নির্দেশ দেয়।**কিতাবুস সুন্নাহ, আমর ইবনে আসেম, ২য় খ-, পৃ. ৬০২, হাদীস নং ১৩৫০; তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খ-, পৃ. ২২৩; শারহে নাহজুল বালাগা, ইবনে আবিল হাদীদ, ৪র্থ খ-, পৃ. ৫৬; জাওয়াহিরুল মাতালিব, ২য় খ-, পৃ. ২২৭।
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সাকাফী, সাহল ইবনে সাদ, আস সায়েদীসহ অন্যান্য হাদীস লেখকদের ঘাড়ে মোহর অঙ্কিত করে দেয়। ইতিহাসে এ বিষয়টি প্রমাণিত সত্য যে, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ যখন মদীনায় প্রবেশ করে তখন রাসূলুল্লাহর সাহাবাদের হীন ও লাঞ্ছিত করে। সে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারীর হাতে এবং আনাস ইবনে মালিক ও সাহল ইবনে সাদের ঘাড়ে সীসা দিয়ে মোহর মেরে দেয় তাদেরকে অপমানিত করার উদ্দেশ্যে। দ্রষ্টব্য : তারিখে তাবারী, ৩য় খ-, পৃ. ৫৪৩, ৭৪ হিজরীর ঘটনাসমূহের বর্ণনা; আল ইসতিয়াব, ২য় খ-, পৃ. ৬৬৪, আত তারজুমাহ (জীবনী নং) ১০৮৯, সাহল ইবনে সাদ আস সায়েদীর জীবনী পর্ব; উসদুল গাবাহ, ২য় খ-, পৃ. ৩৬৬, তাহযীবুল কামাল, ১২তম খ-, পৃ. ১৮৯।
বনি আব্বাসও আহলে বাইতের প্রতি চরম বিদ্বেষী ছিল। তাই আব্বাসীয় খলিফা মানসূর দাওয়ানিকী, মালিক ইবনে আনাসকে বলে : আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের মতকে গ্রহণ কর যদিও তা আলী ও ইবনে আব্বাসের মতের পরিপন্থী হয়।**তাবাকাতুল কুবরা, ৪র্থ খ-, পৃ. ১৪৭
©somewhere in net ltd.
১|
১৩ ই আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:৫৮
জিয়াউর রহমান ফয়সাল বলেছেন: বুঝলাম আপ্নিও শিয়া সম্প্রহায়ের অন্তর্ভুক্ত, ভাগ্যিস আপনি কোনো খলিফা দের কে গালি দেন নাই।