![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রিয় তুমি
(মহানবী-সা. সম্পর্কে ওমর খৈয়াম)
ওহে ঐ ব্যক্তি যে বিশ্বের অদ্বিতীয়
আমার মন, চক্ষু ও জীবনের চেয়েও প্রিয়
জীবনের চাইতে প্রিয় কোনো জিনিস নেই
অথচ আমার জীবন হতে শতগুণ বেশী প্রিয় তুমি।
-রাসুলের শানে লেখা খৈয়ামের একটি রুবাই (আবদুস সাত্তার অনূদিত)
আবার যখন মিলবে হেথায় শরাব সাকির আঞ্জামে,
হে বন্ধুদল, একটি ফোটা অশ্রু ফেলো মোর নামে।
চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন সাকীর পাশ,
পেয়ালা একটি উল্টে দিয়ো স্মরণ করে খৈয়ামে। (কবি নজরুল অনূদিত রুইবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম)
বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত দিতে বলা হলে বিশ্বসাহিত্য কিংবা ইতিহাসে যাদের নাম উপেক্ষা করা কঠিন ওমর খৈয়াম তাদের মধ্যে অন্যতম ও শীর্ষস্থানীয়। ইরানের প্রথম সারির কবিদের মধ্যে বিজ্ঞানী ও দার্শনিক কবি হাকিম ওমর খৈয়াম সারা বিশ্বেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে গত দুই শতকে তিনি পাশ্চাত্যে কবি হিসেবে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
ওমর খৈয়াম-এর নামে পাশ্চাত্যে গড়ে উঠেছে অনেক ফ্যান-ক্লাব এবং সভা-সমিতি। বেশ কয়েক বছর আগে ইরান সফরের সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খৈয়ামের কবিতার প্রতি তার গভীর অনুরাগের কথা জানিয়েছিলেন। ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ ও ইরান-বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড ব্রাউনের মতে ওমর খৈয়াম ফেরদৌসি, সা’দি ও হাফিজের পরই ইরানের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি।
ওমর খৈয়াম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টিয় ১০৪৮ সনের ১৮ মে তথা হিজরি পঞ্চম শতকের শেষের দিকে সালযুক যুগে। তার পুরো গিয়াসউদ্দিন আবুল ফাতুহ বিন ইব্রাহিম আল খাইয়াম। খাইয়াম বা খৈয়াম তার বংশগত উপাধি। আবার কেউ কেউ লিখেছেন তার পুরো নাম খাজা ইমাম ওমর খৈয়াম। তিনি ছিলেন মালিক শাহ সেলজুকের সমসাময়িক। বলা হয় তুর্কি সালজুক সুলতান আল্প আরসালান-এর ছেলে মালিক শাহ-এর প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মুলকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন ওমর।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছু আগে ওমর খৈয়াম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে উচ্চ পর্যায়ের দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, লেখক ও কবি। ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালী যুগে তথা এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে বীজগণিতের যেসব সূত্র বা উপপাদ্য এবং জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনও গণিতবিদ এবং মহাকাশ গবেষক বা জ্যোতির্বিদদের গবেষণায় যথাযথ সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আসলে খৈয়াম নিজ যুগে মূলতঃ গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসেবেই খ্যাত ছিলেন এবং তিনি নিজেও তাই মনে করতেন।
মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে ‘চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মণি-মুক্তা’ বলে অভিহিত করেছেন। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চার পঙক্তির কবিতাগুলো প্রথমবারের মত ইংরেজিতে অনূদিত হয় খৃষ্টীয় ১৮৫৯ সালে। এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের এই অনুবাদের সুবাদেই ওমর খৈয়াম বিশ্বব্যাপী কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। এ অনুবাদের মাধ্যমে ফিটজেরাল্ড নিজেও খ্যাতিমান হয়েছেন। তার এই অনুবাদ গ্রন্থ দশ বার ছাপা হয়েছে। ওমর খৈয়াম সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রবন্ধ ও বই লেখা হয়েছে।
ফার্সি কাব্য-জগতে ওমর খৈয়াম এক বিশেষ চিন্তাধারা ও বিশ্বদৃষ্টির পথিকৃৎ। তিনি এমন সব চিন্তাবিদ ও নিরব কবিদের মনের কথা বলেছেন যারা সেসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তা চেপে গেছেন। কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার নামে বা তার কবিতার অনুবাদের নামে নিজেদের কথাই প্রচার করেছেন। আবার কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার মধ্যে নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন।
অসাধারণ জ্ঞানী ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের অনেক কঠিন রহস্য বা প্রশ্নের সমাধান দিয়ে গেলেও অনেক অজানা বা রহস্যময় বিষয়গুলোর সমাধান জানতে না পারায় আক্ষেপ করে গেছেন। তাই তিনি জীবন এবং জগতের ও পারলৌকিক জীবনের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এসব প্রশ্ন শুধু তার মনেই নয়, যুগে যুগে জ্ঞান-তৃষ্ণার্ত বা অনুসন্ধানী মানুষের মনের প্রশান্ত সাগরেও তুলেছে অশান্ত ঝড়। দার্শনিকরা এ ধরনের প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন।
দর্শনের যুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব হলেও তারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। দর্শন বা বিজ্ঞান দিয়ে যে ভাব তুলে ধরা যায় না খৈয়াম তা কবিতার অবয়বে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর তাই যুক্তি ও আবেগের করুণ রসের প্রভাবে ওমর খৈয়ামের চার-লাইন বিশিষ্ট কবিতাগুলো কবিতা জগতে হয়ে উঠেছে অনন্য।
দার্শনিকরা একটি বই লিখেও যে ভাব পুরোপুরি হৃদয়গ্রাহী করতে পারেন না, গভীর অর্থবহ চার-লাইনের একটি কবিতার মধ্য দিয়ে ওমর খৈয়াম তা সহজেই তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,
اسرار ازل را نه تو دانی و نه من
وین حرف معما نه تو خوانی و نه من
هست از پس پرده گفتگوی من و تو
چون پرده بر افتد ، نه تو مانی و نه من
সৃষ্টির রহস্য জানো না তুমি, জানি না আমি
এ এমন এক জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি
পর্দার আড়ালে তোমায় ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ
পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন থাকবে না তুমি ও আমি।
অর্থাৎ সৃষ্টির রহস্যকে আমাদের কাছে রহস্যময় ও পর্দাবৃত মনে হয়। কিন্তু মনের চোখ বা আসল চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব হলে এ পর্দা থাকে না।
অন্য অনেক জ্ঞানী ও কবির মত ওমর খৈয়ামও তার যুগের চিন্তাধারার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না। তিনি এসব চিন্তাধারার ব্যাপারে নিজের মত বা প্রতিক্রিয়া কবিতায় তুলে ধরেছেন। তার কবিতায় যেসব বিষয় বার বার এসেছে বা প্রাধান্য পেয়েছে, সেসবের মধ্যে পার্থিব জীবনের অস্থায়িত্ব, পার্থিব জীবন ও বর্তমান সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, সন্দেহ ও বিভ্রান্তি, মৃত্যু ও পরকাল, উদাসীনতা প্রভৃতি বিষয় উল্লেখযোগ্য।
ওমর খৈয়াম যেসব কথা বলতে চেয়েছেন তার পরে ও তার আগে অনেকেই সেসব কথা বলেছেন। কিন্তু এসব চিন্তার পরিবেশনা ও রূপকের ব্যবহারের মধ্যেই রয়েছে তার বিশিষ্টতা। যেমন, ওমর খৈয়াম অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সংলাপ তুলে ধরেছেন তার অনেক চতুষ্পদী কবিতায়। জন্ম হওয়া বা সৃষ্টি, অতীতে বিরাজিত এবং মৃত্যু বোঝাতে তিনি মাটির কলসি বা পাত্র ও মাটিকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আল্লাহকে জানতে হলে আগে নিজেকে জানা প্রয়োজন এমন ইসলামী বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি লিখেছেনঃ
বিশ্ব-দেখা জামশেদিয়া পেয়ালা খুঁজি জীবন-ভর
ফিরনু বৃথাই সাগর গিরি কান্তার বন আকাশ-ক্রোড়।
জানলাম শেষ জিজ্ঞাসিয়া দরবেশ এক মুর্শিদে
জামশেদের সে জাম-বাটি এই আমার দেহ আত্মা মোর। (কবি নজরুলের অনুবাদ)
মহান আল্লাহর দয়া সম্পর্কে খৈয়াম প্রার্থনাসূচক রুবাইয়ে লিখেছেন:
দয়া যদি কৃপা তব সত্য যদি তুমি দয়াবান
কেন তবে তব স্বর্গে পাপী কভু নাহি পায় স্থান?
পাপীদেরই দয়া করা সেই তো দয়ার পরিচয়
পুণ্যফলে দয়া লাভ সে তো ঠিক দয়া তব নয়। (নরেন্দ্র দেবের অনুবাদ)
আমরা দেখি বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলও বলেছেন অনেকটা একই ধরনের কথাঃ
বিচার যদি করবে কেন রহমান নাম নিলে ?
ঐ নামের গুণে তরে যাব কেন এ জ্ঞান দিলে?
..রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না না বিচার।
অনেকে ওমর খৈয়ামকে নৈরাশ্যবাদী, নাস্তিক, জড়বাদী, অদৃষ্টবাদী এবং ভোগবাদী বলে ভুল ধারণা করে থাকেন। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন ওমর খৈয়ামের নামে প্রচলিত অনেক কবিতা আসলে তার কবিতা নয়। বরং এসব কবিতা বা রুবাইয়াত অন্য কারো লেখা। আর তাঁকে ও তাঁর কবিতার অর্থ ভুলভাবে বোঝার অন্য কারণটি হল তার কবিতার আক্ষরিক অর্থ বা অনুবাদ এবং তাঁর কবিতা সম্পর্কে খণ্ডিত দৃষ্টি। সৃষ্টি, অদৃশ্য জগত, পরকাল ও ভাগ্য বিষয়ের অনেক রহস্য যা মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে পুরোপুরি বোঝা বেশ কঠিন বা অসম্ভব সেসব বিষয়ে খৈয়াম কখনও কখনও প্রশ্ন তুলেছেন এবং কখনও কখনও নিজেই জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন তার কবিতায়। কেউ কেউ তাকে যুক্তিবাদী অর্থে মুতাজিলাও বলে থাকেন। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ইবনে সিনার অনুসারী।
ইবনে সিনার ডিভাইন ইউনিটি বা ঐশী একত্ব তত্ত্বের প্রতি খৈয়ামের সমর্থন ছিল। এরই আলোকে খৈয়ামের কবিতার আক্ষরিক অনুবাদ করাটাকে ‘অপরিপক্কতা’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক এবং ইসলামী ও ইরানি দর্শন বিশেষজ্ঞ সাইয়্যেদ হোসেইন নাস্র। [দ্রষ্টব্য: https://en.wikipedia.org/wiki/Omar_Khayyam: Seyyed Hossein Nasr argues that it is "reductive" to use a literal interpretation of his verses (many of which are of uncertain authenticity to begin with) to establish Omar Khayyam's philosophy. Instead, he adduces Khayyam's interpretive translation ofAvicenna's treatise Discourse on Unity (Al-Khutbat al-Tawhīd), where he expresses orthodox views on Divine Unity in agreement with the author. (S. H. Nasr, 2006, Islamic Philosophy from Its Origin to the Present, Chapter 9., pp. 165–183)]
খৈয়াম ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মের নামে ভণ্ডামির ঘোর বিরোধী ছিলেন ঠিক যেভাবে হাফিজসহ আরও অনেক ইরানি কবিও এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। খৈয়াম নাস্তিক, চরিত্রহীন ও ভোগবাদী হলে সে যুগে যারা ধর্মান্ধ ছিল বা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু ছিলেন তারা তা উল্লেখ করতে ও এরই ভিত্তিতে তাঁর নিন্দাবাদ ছড়িয়ে দিতে ভুল করতেন না বলে কবি নজরুল অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তাঁর বড় শত্রুরাও এমন কিছু লিখে যায়নি যে ওমর খৈয়াম মদ্যপ ও লম্পট ছিলেন বলে নজরুল উল্লেখ করেছেন! খৈয়ামের এইসব দোষের কথা তুলে ধরে বা সুলতানের দরবারে নালিশ ঠুকে তাঁর ফাঁসির ব্যবস্থা করতেও তারা পিছপা হতেন না! বরং খৈয়াম যে ধার্মিক ছিলেন এমন অনেক সাক্ষ্য প্রমাণও তুলে ধরা হয়েছে অতীতের গ্রন্থগুলোতে।
খৈয়ামের বহু কবিতায় মহান স্রস্টার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, কৃতজ্ঞতা এবং প্রশংসা দেখা যায়।
খৈয়াম লিখেছেন:
তোমারি সৃজনি শক্তি গড়িয়াছে আমারে এমন
তোমারি কৃপায় মোর দেহে আজ স্পন্দিছে জীবন
এই বোঝা-পড়া শুধু এতকাল করিতেছি আমি
আমার পাপের চেয়ে বড় কিনা দয়া তব স্বামী? (নরেন্দ্র দেবের অনুবাদ)
অথবা স্রস্টা ও সৃষ্টির অপূর্ণতার বেদনা তুলে ধরতে গিয়ে ওমর লিখেছেন:
ঢালিছে যে সুধা শাশ্বত সাকী নিখিল পাত্র ‘পরে
কোটি বুদ্ বুদ্ উঠিছে ফুটিয়া ফেনিল সে নির্ঝরে!
তোমার আমার মতো কত শত সেই স্রোতে সদা ভাসে
সাকীর পাত্র পূর্ণ সতত, কেউ যায়, কেউ আসে। (প্রাগুক্ত)
আকাশ যেদিন দীর্ণ হবে, আসবে যেদিন ভীম প্রলয়,
অন্ধকারে বিলীন হবে গ্রহ তারা জ্যোতির্ময়,
প্রভু আমার দামন ধরে বলব কেঁদে, “হে নিঠুর’
নিরপরাধ মোদের কেন জন্মে আবার মরতে হয়?” (কবি নজরুলের অনুবাদ)
এটাও মনে রাখা দরকার যে ফার্সি ক্লাসিক ধারার ও বিশেষ করে সুফি ধারার কবিরা সুরা বা মদ, সাকি, পানশালা, লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ এসব শব্দকে রূপক অর্থেই ব্যবহার করে থাকেন। এইসব শব্দ ছাড়া কবিতা লেখার কথা ভাবতেই পারতেন না ধ্রুপদি ধারার ইরানি কবিরা। যেমন, ‘মদ’ বলতে ধ্যান, সাধনা, প্রেম বা খোদা-প্রেম, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা- ইত্যাদি; সাকি বলতে স্রস্টা, কখনওবা পির-মুর্শিদ, গুরু ইত্যাদি; প্রেয়সীর চুল বলতে সৃষ্টিকর্তার গৌরব, স্ফূরণ ইত্যাদি; সৌন্দর্য বলতেও সৃষ্টিকর্তা; ‘পানশালা’ বলতে আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্র বা পিরের আস্তানা বা খানকাহ; ‘ঘুম’ বলতে সাধনার চরম পর্যায় বা সাফল্য ও এমনকি মৃত্যুকেও বোঝায়।
ওমর খৈয়াম আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর অস্তিত্বকেই নশ্বর বা অস্থায়ী বলতে চেয়েছেন। এভাবে তিনি মানুষকে স্থায়ী শক্তি বা সত্ত্বা হিসেবে আল্লাহমুখী হবার ওপরই জোর দিয়েছেন। অনেকেই মনে করেন ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বড় সুফি সাধক বা আরেফ। একটি সুফি-তাত্ত্বিক রুবাইয়ে তিনি লিখেছেন,
ধূলি মুছি ধরণীর আত্মা যদি ইচ্ছামত পারে
চলে যেতে শূন্য-পথে অবহেলে স্বর্গের দুয়ারে
নহে কিগো এটা তার দারুণ লজ্জার কথা তবে-
পড়ে থাকা এতকাল মাটির এ দেহ লয়ে ভবে?
যুগের অন্যতম সেরা জ্ঞানী হওয়া সত্বেও বিনয় বা নম্রতা ছিল ওমর খৈয়ামের অন্যতম প্রধান ভূষণ। তাইতো মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থাশীল ওমর বলেছেন,
একদা মোর ছিল যৌবনের অহংকার
ভেবেছিলাম গিঁঠ খুলেছি জীবনের সব সমস্যার ।
আজকে হয়ে বৃদ্ধ জ্ঞানী বুঝেছি ঢের বিলম্বে,
শূন্য হাতড়ে শূন্য পেলাম যে আঁধারকে সে আঁধার।
মৃত্যুর বিষয়ে মানুষ যে অসহায় তা তুলে ধরে খৈয়াম লিখেছেন:
ধরণীর কেন্দ্র হতে ছুটি
সুদূর গগণ হতে সপ্তর্ষির সিংহদ্বারে উঠি
বসেছিনু জ্যোতিষ্কের সমুজ্জ্বল রত্ন-সিংহাসনে;
দূর হল বিশ্ব-ভ্রমণে
জীবনের অনেক সংশয়;
কেবল গেলো না বোঝা, যে রহস্য বুঝিবার নয়,
দূর্জ্ঞেয় দূর্ভেদ্য চিরকাল-
মানুষের মৃত্যু আর ললাটের ভাগ্যলিপি জাল!
(নরেন্দ্র দেবের অনুবাদ)
ওমর খৈয়াম মারা যান খ্রিস্টিয় ১১২৩ বা মতান্তরে ১১৩১ সনের ৪ ডিসেম্বর। ইরানের বৃহত্তর খোরাসানের নিশাপুর শহরেই রয়েছে তার সমাধি সৌধ। বিশ্বের বহু ভাষায় খৈয়ামের রুবাইয়াতের অনুবাদ দেখা যায়। বাংলা ভাষায়ও খৈয়ামের রুবাইয়াত অনেকেই অনুবাদ করেছেন। যেমন, নরেন্দ্র দেব, কান্তি ঘোষ, সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, সিকান্দার আবু জাফর এবং আরো অনেকে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।
ওমর খৈয়ামের নামে ফার্সি ভাষায় প্রচলিত ছিল প্রায় এক হাজার রুবাই। কিন্তু কবি নজরুল মনে করতেন এর প্রায় তিন চতুর্থাংশই নকল। এসব রুবাই আসল ওমর খৈয়ামের তথা বিজ্ঞানী, কবি, জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ খৈয়ামের নয়। তাই তিনি ওমর খৈয়ামের নামে প্রচলিত ২০০ টি রুবাইয়েরও কিছু বেশি রুবাইয়ের অনুবাদ করেছেন। তাহলে ইরানিদের অনেকেই যেমন বলে থাকেন ওমর খৈয়াম ছাড়াও খৈয়াম নামের ভাঁড় প্রকৃতির ও ধর্ম-বিমুখ বা ধর্ম-বিদ্বেষী এবং অতি সাধারণ কবি প্রতিভার অধিকারী একজন ব্যক্তিও খুব সম্ভবত ছিলেন সেটাও হয়তবা অসত্য নয়! তার কবিতাগুলো বা কবিতার কথা ও ভাবগুলোও হয়ত ওমর খৈয়ামের কবিতার সঙ্গে কিছুটা মিশে গেছে বা মেশানোর পরিকল্পিত চেষ্টা হয়েছে।
কবি নজরুল লিখেছেন: ওমর সুফি ছিলেন কিনা জানিনে। কিন্তু ওই পথের পথিক যাঁরা, তারা ওমরকে সুফি এবং খুব উঁচু দরের তাপস বলে মনে করেন। ... সুফীরা জনপ্রিয়তার বা লোকের শ্রদ্ধার জুলুম এড়াবার জন্যই ঘোরতর পাপ পরিহার করেন। তাঁরা নিজেদের মদ্যপ লম্পট আখ্যা দিয়ে স্বেচ্ছানির্বাসন বরণ করে নিজেদের গুপ্ত সাধনায় মগ্ন থাকেন। তাছাড়া ইরানে কবির শরাবকে সকলে সত্যিকারের মদ বলে ধরে নেন না। .... #
©somewhere in net ltd.