নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আঃ হাকিম চাকলাদার

আঃ হাকিম চাকলাদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইসলামে ‘নারী-নেত্রীত্ব হারাম’ বলাটা ‘হারাম’ কেন ?

১৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ২:২০

লেখক-হাসান মাহমুদ

নিজস্ব ছাইট-http://www.hasanmahmud.com/2012/



প্রকাশক-আঃ হাকিম চাকলাদার (লেখকের অনুমোদনক্রমে)



ইসলামে ‘নারী-নেত্রীত্ব হারাম’ বলাটা ‘হারাম’ কেন ?



হাসান মাহমুদ: বাংলাদেশে-পাকিস্তানে-ইন্দোনেশিয়ায় প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, বেনজির ভুট্টো, ও সুকর্ণপুত্রী। এতে মনে হতে পারে নারী-নেত্রীত্ব নিয়ে ইসলামে যে বিতর্ক ছিল তার সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। গত ১৮ই জানুয়ারী (২০০৬) ভয়েস অব্ আমেরিকা রেডিওর আলোচনায় আমার বিপক্ষে বাংলাদেশ জামাতের সিনিয়র অ্যাসিস্টেণ্ট জেনারেল-সেক্রেটারী জনাব কামরুজ্জামান মিয়া অংশ নিয়েছিলেন।

বলা দরকার, জামাতে ইসলামি বাংলাদেশের প্রধান ধর্মীয়-রাজনৈতিক দল, বেগম জিয়ার সংসদে এ-দলের দু’জন মন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শারিয়া-মোতাবেক জামাত বহু বছর ধরে নারী-নেত্রীত্বের বিরোধী ছিল, তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্ব মেনে নিল কি করে? উনি জবাব দিয়েছিলেন, “পরিস্থিতির কারণে জামাত নারী নেত্রীত্ব মেনে নিয়েছে।” অর্থাৎ পরিস্থিতির কারণে যদি এতকালের হারামকে যাঁরা হালাল করেছেন, ভবিষ্যতে তাঁরা আবারও পরিস্থিতির কারণেই সে হালালকে হারাম করবেন। এবং সেই পরিস্থিতি কখন, কোথায়, কিভাবে হবে সেটাও তাঁরাই ঠিক করবেন। এ-এক মারাত্মক আত্মঘাতী প্রবণতা। এ-রকম ঘটনা ঘটেছেও।

মওলানা মওদুদি বহু আগে লিখেছেন, “কোরাণ-হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশকে কেউ বিন্দুমাত্র বদলাতে পারবে না, পৃথিবীর সব মুসলিম মিলেও না” (ইসলামিক ল’ অ্যাণ্ড কন্সটিটিউশন পৃষ্ঠা ১৪০)। কিন্তু নারী-নেত্রীত্বের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট হাদিসের পরেও সেই মওদুদিই ষাট দশকে ফাতিমা জিন্নাকে সমর্থন করেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট আইয়ুবের বিরুদ্ধে জাতীয় নির্বাচনে। আবার সেই মওদুদিপন্থী বাংলাদেশের জামাত একসময় বলেছে নারী-নেত্রীত্ব হারাম, এবং এখন বলছেন “পরিস্থিতির কারণে জামাত নারী-নেত্রীত্ব মেনে নিয়েছে !” ইসলাম নিয়ে এ কালখেলার অনেক মূল্য দিয়েছে বিশ্ব-মুসলিম, এখনো দিয়ে যাচ্ছে।

জাতির বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে তার ইতিহাসের ওপর। মুসলমানেরও তাই। সে ইতিহাসে আছে উন্নত মুসলিম-সভ্যতা, শত শত যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিদ্রোহ-বিপ্লব, রাজা-রাণী, মোল্লা-মওলানা। আছে মিশর, ইয়েমেন, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার সার্বভৌম রাণীরা। আছেন রত্ন-মাণিক-খচিত রাজ-পোশাকে অষ্টাদশী সুন্দরী সুলতানা রাজিয়া। মানুষের ইতিহাসের একমাত্র অবিবাহিতা সম্রাজ্ঞী তিনি। পুত্রদের হাতে না দিয়ে ১৮ বছরের কন্যার হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন রাজিয়ার পিতা বিশাল ভারতবর্ষের সম্রাট ইলতুৎমিস ১২৩৬ সালে।

তখনকার খলিফার সমর্থনও পেয়েছিলেন সুলতানা রাজিয়া, তাঁর সার্বভৌম রাজত্বকালে চালু মুদ্রায় খোদাই করা আছে, “সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা মালিকা ইলতুৎমিস, যিনি আমিরুল মু’মেনিনের সম্মান বাড়ান।” এ-মুদ্রা এখনও রাখা আছে কলকাতার মিউজিয়ামে। একই সময়ে ১২৫০ সালে মিশরের রাণী সাজারাত আল্ দু’র-এর নামেও মুদ্রা ছিল, মামলুক খেলাফতের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, মসজিদে তাঁর নামে খোৎবা পড়াতেন মওলানারা। রাজিয়ার সময়ের মওলানারাও নারী-নেত্রীত্বের প্রতিবাদ করেননি। (“দ্য ফরগটন কুইন্স্ অব্ ইসলাম” বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ফাতিমা মার্নিসি, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)।

এরই নাম ইতিহাস, বিন্দু-বিন্দু সত্যের রাজকন্যা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কণাগুলো একসাথে মিলিয়ে নিলে এত শতাব্দী পরেও অশ্রুসিক্ত চোখে ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে সে। ইতিহাসে সার্বভৌম মুসলিম রাণীদের অপরূপ কাহিনী শোনায়। আজকের বন্ধবোধের অন্ধকূপে বন্দি মুসলমানদের কিছু বলতে চায় বুঝি ! তাঁরা রাজদণ্ডধারী প্রবল রাজাদের অলঙ্কার-মার্কা মোমের পুতুল রাণী ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন রাজদণ্ডধারিণী শাসনক্ষমতার অধিকারিণী মুসলিম রাণী, নিজের নামে মুদ্রা ছিল তাঁদের কারো কারো, তাঁদের নামে মওলানারা দোয়া করতেন মসজিদে মসজিদে।উদাহরণ দিচ্ছি একই সূত্র থেকে:

১। ১২৩৬ সাল, দিল্লী। সুলতানা রাজিয়া।

ইরানের তুরকান অঞ্চলের রাণী তুরকান খাতুন, ১২৫৭ থেকে ১২৮২ পর্যন্ত একটানা ২৬ বছর। মসজিদে তাঁর নামে খোৎবা।

তুরকান খাতুনের কন্যা পাদিশা খাতুন। নামাঙ্কিত মুদ্রা।

ইরানের সিরাজ অঞ্চলে আব্শ খাতুন। ১২৫৩ থেকে ১২৮৭, একটানা ২৫ বছর। খোৎবা এবং নামাঙ্কিত মুদ্রা, দু’টোই।

ইরানের লুরিস্থান অঞ্চলের ১৩৩৯ সালের মুসলিম রাণী (নাম জানা নেই)।

রাণী তিন্দু, ১৪২২ থেকে ১৪১৯ পর্যন্ত, ৯ বছর। (জায়গা সম্বন্ধে মতভেদ আছে)।

৭, ৮, ৯।

মালদ্বীপের সুলতানারা: খাদীজা, মরিয়ম, ও ফাতিমা। ১৩৪৭ থেকে ১৩৮৮, একটানা ৪১ বছর। এক সময়ে ইবনে বতুতা সেখানকার সরকারি কাজী ছিলেন।

১১০, ১১ ইয়েমেনের সুলায়হি (শিয়া-খেলাফত?) বংশের দুই রাণী আসমা ও আরোয়া, প্রায় ৫০ বছর রাজত্ব করেছেন। আসমার নামে খোৎবা হত।

১২। ১২৫০ সালে মিশরের রাণী সাজারাত আল্ দু’র। তাঁর নামে মুদ্রাও ছিল, মামলুক খেলাফতের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি এবং মসজিদে তাঁর নামে খোৎবাও পড়াতেন মওলানারা।

১৩সুলতানা ফাতিমা, মধ্য এশিয়ায় কাসেমী খেলাফতের শেষ সার্বভৌম সুলতানা, শাসন করেছেন ১৬৭৯ থেকে ১৬৮১ দু’বছর।

১৪ ও ১৭ ইন্দোনেশিয়ায় ১৬৪১ থেকে ১৬৯৯ পর্যন্ত ৫৮ বছর ধরে একটানা শাসন করেছেন সুলতানা শাফিয়া, সুলতানা নূর নাকিয়া, সুলতানা জাকিয়া, ও সুলতানা কামালাত শাহ। ওখানকার মোল্লারা এর বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা নারী-নেত্রীত্বের বিরুদ্ধে মক্কা থেকে ফতোয়া এনে সুলতানাদের উৎখাত করার চেষ্টা করেও পারেননি। নিশ্চয়ই রাণীদের জনপ্রিয়তার জন্যই। বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পলো’র লেখা থেকেও আমরা এর কিছুটা বিবরণ পাই।

“১৫৯১ হইতে ১৯২৫, প্রায় তিনশ’ তিরিশ বছরে পুরুষ রাজারা দেশের রাস্তাঘাট দালানকোঠা মসজিদ-গম্বুজে যাহা উন্নতি করিয়াছিলেন, সম্রাজ্ঞী আসমা ও আরোয়া তাহা হইতে অনেক বেশি উন্নতি করিয়াছিলেন।” কত বছরে করিয়াছিলেন ? মাত্র ৫০ বছরে। অর্থাৎ রাণীরা শুধু মওলানাদের আর ইসলামি খলীফার সমর্থনই পাননি, শাসনও করেছেন যথেষ্ট সাফল্যের সাথে। এবারে আসা যাক সেই হাদিসে। সমস্ত সহি হাদিসে নারী-নেত্রীত্বের বিরুদ্ধে নাম-ধাম সহ সুস্পষ্ট হাদিস আছে মাত্র একটি, মাত্র একজন সাহাবীর বলা।

নবীজীর তায়েফ আক্রমণের সময় (৮ হিজরিতে) কিছুতেই তায়েফের দুর্গ ভাঙ্গা যাচ্ছিল না। তখন তিনি ঘোষণা করে দিলেন, দুর্গের ভেতর থেকে যে সব ক্রীতদাস পালিয়ে আসবে তারা সবাই মুক্ত হবে। শুনে অনেক ক্রীতদাস তায়েফ দুর্গ থেকে পালিয়ে আসে, ফলে দুর্গের পতন হয়। বালক আবু বাকরা (হজরত আবু বকর রাঃ নন) ছিলেন সেই ক্রীতদাসের একজন। তারপর দীর্ঘ চব্বিশ বছর চলে গেছে, নবীজী দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, সেই ক্রীতদাস বালক এখন বসরা নগরের গণ্যমান্য নাগরিক। তখন ঘটে গেল মুসলমানের ইতিহাসে প্রথম রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ, হজরত ওসমান খুন হবার পরে হজরত আলীর বিরুদ্ধে হজরত আয়েশা-তালহা-যুবায়ের দলের। উট শব্দটার আরবি হল “জামাল।” বিবি আয়েশা উটে চড়ে হজরত আলীর বিরুদ্ধে সৈন্য-পরিচালনা করেছিলেন বলে এ-যুদ্ধের নাম হয়েছে “জামাল-যুদ্ধ।” এধারে-ওধারে বারো হাজার সাহাবি খুন হয়েছেন এ-যুদ্ধে।

হজরত আলী ‘জামাল-যুদ্ধে’ জয়লাভ করে বিবি আয়েশাকে সসম্মানে মদীনায় পাঠিয়ে দেবার পর বসরায় প্রবেশ করে শহরের গণ্যমান্য লোকদের ডেকে পাঠান। আবু বাকরা তখন হজরত আলীকে এই হাদিস শোনান। নবীজীর সময় ৬২৯ থেকে ৬৩২ সাল পর্যন্ত রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আক্রমণে ইরানে খুব বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। তখন সেখানে দু’জন নেত্রীর আবির্ভাব হয়েছিল। সে-কথা শুনে নবীজী নাকি আবু বাকরাকে এ-হাদিস বলেছিলেন। হাদিসটা হল, “আবু বাকরা বলিয়াছেন, জামাল-যুদ্ধের সময় আমি সাহাবীদের সহিত যোগ দিয়া (বিবি আয়েশার পক্ষে) যুদ্ধে প্রায় নামিয়া পড়িয়াছিলাম, কিন্তু নবী (দঃ)-এর একটি কথায় আল্লাহ আমাকে বড়ই উপকৃত করিয়াছেন। যখন নবীজী (দঃ)-কে বলা হইল যে (পারস্য সম্রাট) খসরুর মৃত্যুর পরে পারস্যের লোকেরা তাহার কন্যার উপর নেত্রীত্ব অর্পণ করিয়াছে, তখন তিনি বলিলেন, ‘কখনও উন্নতি করিবে না সেই জাতি যে জাতি তাহাদের নেতৃত্ব অর্পণ করে নারীর উপরে” (সহি বোখারীর ইংরেজী অনুবাদ, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৭০৯)।

এটা বোখারীর যে কোন বাংলা অনুবাদে পেয়ে যাবেন, হাফেজ মোঃ আবদুল জলিলের ৯০ পৃষ্ঠার ২২২ নম্বরে তো পাবেনই, আজিজুল হক সাহেবের বোখারীর চতুর্থ খণ্ডের ২২৬ পৃষ্ঠাতেও পাবার কথা। অর্থাৎ আমরা পেলাম:

১।

এ হাদিস জানার পরেও তিনি বিবি আয়েশা (রাঃ)-র পক্ষে যুদ্ধে “প্রায় নেমে পড়ছিলেন,” পরে হঠাৎ মত পরিবর্তন করেন। অর্থাৎ হাদিসটা প্রথমে তাঁর মনে পড়েনি।

২।

এ হাদিস আবু বাকরা প্রকাশ করেছেন হজরত আয়েশা (রাঃ) পরাজিত হবার পরে, আগে নয়।

৩।

এ হাদিস অনুসারে তাঁর উচিত ছিল বিবি আয়েশা (রাঃ)-র বিপক্ষে হজরত আলী (রাঃ)-র পক্ষে যুদ্ধ করার। তা তিনি করেননি।

৪।

বলেছেন নবীজীর মৃত্যুর সুদীর্ঘ ২৪ বছর পর, তার আগে একবারও বলেননি।

৫।

এ হাদিসে তিনি বড়ই উপকৃত হয়েছেন বলে জানান।

৬।

তিনি হজরত আলী (রাঃ)-কে বলেছেন, অন্য কাউকে না জানালেও তিনি নাকি শুধু হজরত আয়েশা (রাঃ)-কে জামাল-যুদ্ধের আগে চিঠি লিখে এ-হাদিসের কথা জানিয়েছিলেন। (অর্থাৎ তাঁকে নেত্রীত্ব ছাড়তে বলেছিলেন)।

৭।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নবীজী বর্ণনা করেছেন অনেক সাহাবীকে, কিন্তু যে-হাদিসের সাথে বিশ্বের সমস্ত মুসলিম নারীদের সম্মান ও অধিকার কেয়ামত পর্যন্ত বাঁধা, সেই অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নবীজী বলেছেন শুধু তাঁকেই, আর কোন সাহাবীকেই নয়, বিদায় হজ্জ্বের খোৎবাতেও নয়।

এবার কিছু সহজ হিসেব করা যাক।

১।

আবু বাকরা বলেছেন “আমি বড়ই উপকৃত হইয়াছি।” কিভাবে ? তিনি কোন নেতা বা রাজা বাদশা ছিলেন না, কিভাবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বড়ই উপকৃত হলেন। প্রশ্নই ওঠে না। তিনি তো বিবি আয়েশার বিরুদ্ধে হজরত আলীর পক্ষে যুদ্ধও করেননি।

২।

জামাল-যুদ্ধে যদি আয়েশা (রাঃ) জিতে যেতেন, তবে কি তিনি এ-হাদিস প্রকাশ করতেন ? কে জানে!!

৩।

জামাল-যুদ্ধ যদি না হতো তবে তিনি এ-হাদিস বলতেন কি ? বোধ হয় না, কারণ তিনি সুদীর্ঘ ২৪ বছরে এ-হাদিস বলেননি।

এবারে প্রমাণ।

১।

চিঠিতে এ-হাদিস কথা জানাবার পরেও বিবি আয়েশা (রাঃ) নেত্রীত্ব ছেড়ে দেননি, যুদ্ধের নেত্রীত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি এ-হাদিস বিশ্বাস করেননি।

২।

মওলানারা এ-হাদিস জানতেন না, এটা হতে পারে না। যুগে যুগে বেশির ভাগ মুসলিম সুলতানাদের সময় মওলানারা বিরোধীতা করেননি। অর্থাৎ তাঁরা এ-হাদিস বিশ্বাস করেননি।

৩।

মুসলিম জাহানের খলিফাদের দরবারে কোরাণ-হাদিসের প্রচণ্ড চর্চা হত। এ-হাদিস নিশ্চয়ই তাঁরা জানতেন। মুসলিম জাহানের খলীফারাও এ-হাদিস বিশ্বাস করেননি। তাঁদের সমর্থন ছাড়া সুলতানাদের মুদ্রা ও খোৎবা সম্ভব হত না।

অর্থাৎ ইসলামের ইতিহাসে বেশির ভাগ লোক এ-হাদিস বিশ্বাস করেনি। আইয়ুবের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ফাতিমা জিন্নার সমর্থক মওলানা মওদুদিও বিশ্বাস করেনি। কেন ? কারণটা তাঁরা হয়ত জানতেন, এ-হাদিস জাল-হাদিস। মাত্র তিনটি সূত্র দিচ্ছি, আরও বহু জায়গায় পেয়ে যাবেন:-

সূত্র ১।

আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিবার অপরাধে আবু বাকরাকে শাস্তি দেওয়া হইয়াছিল (“দ্য ফরগটন কুইন্স্ অব্ ইসলাম” বিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ফাতিমা মার্নিসি)।

সূত্র ২।

এই হাদিসের অসত্যতা সুপ্রমাণিত শুধু ইতিহাসেই নয়, বরং ইহাও সত্য যে আবু বাকরা সম্বন্ধে মুসলমানের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিবার অপরাধে তাহাকে জনসমক্ষে শাস্তি দেয়া হইয়াছিল। উইমেন’স রাইট ইন ইসলাম শরীফ চৌধুরী।

সূত্র ৩।

ইহার বর্ণনাকারী আবু বাকরাকে নারী-ব্যাভিচারের মিথ্যা সাক্ষ্য দিবার অপরাধে হজরত ওমর শাস্তি দিয়াছিলেন। উইমেন অ্যাণ্ড পলিটিক্স ইন্ ইসলাম http://www.submission.org/women/politics.html

এইবার কোরাণ শরীফ খুলে সুরা ২৪-এর আয়াত ৪ দেখে নিন, “যাহারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর স্ব-পক্ষে চারজন পুরুষ-সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাহাদিগকে আশিটি বেত্রাঘাত করিবে এবং কখনও তাহাদের সাক্ষ্য কবুল করিবে না। ইহারাই না-ফরমান।”

এই না-ফারমান আবু বাকরা’র কথাতেই হানাফি-শাফি-মালিকি-হাম্বলি শারিয়া আইনে নারী-নেত্রীত্ব সরাসরি নিষেধ করা আছে। সময়ের সাথে সাথে সবাই উন্নতি করে। কিন্তু শারিয়ার বিবর্তন হচ্ছে শামুকের গতিতে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বাংলায় বিধিবদ্ধ আইন-এর ৩য় খণ্ডের ১৯৭ পৃষ্ঠায় ধারা ৯০০-তে “রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা” আইনে যে আটটা শর্ত আছে পুরুষ হওয়া তার অন্যতম। ব্যাখ্যায় আছে “রাষ্ট্রপ্রধানের পুরুষ হওয়াও অপরিহার্য শর্ত।” কিন্তু তার পরে পরেই “অপরিহার্য শর্ত”টা ততটা অপরিহার্য থাকেনি, বলা হয়েছে যদি “ইসলামি রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ ফকিরগণ কোন বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জাতির সার্বিক কল্যাণ বিবেচনা করিয়া উক্ত সর্বোচ্চ পদ নারীর জন্য অনুমোদন করিতে পারেন।” অর্থাৎ অনুমোদনের সার্টিফিকেট তাঁরা ছাড়বেন না। তাঁদেরকে কে অনুমোদন করে তার ঠিক নেই, অথচ তাঁদের অনুমোদন ছাড়া যোগ্য নারীও রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না। এভাবেই শারিয়া হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার।

খোদ কোরাণের নির্দেশটাই দেখি না কেন আমরা। পড়ে দেখুন সুরা নামল আয়াত ২৩ “আমি এক নারীকে সাবা-বাসীদের উপর রাজত্ব করতে দেখেছি।” সেই রাজত্ব করা রাণী যখন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হল তখন ? তখন কোরাণ বলেছে কি তাকে সিংহাসন থেকে তাড়িয়ে দেয়া হল? মোটেই নয়, মোটেই নয়, পড়ে দেখুন আয়াত ৪৪।

তাহলে ? দেখলেন ইসলামের নামে নারী-বিরোধী পুরুষতন্ত্রের কোরাণ-বিরোধী ষড়যন্ত্র ? কিন্তু সব ষড়যন্ত্রই দুর্বল হতে বাধ্য, ভেঙে চুরমার হতে বাধ্য যদি প্রতিরোধ করা যায়।

আমাদের নারীরা জীবনের বিষয়ে পুরুষের সমান কৃতিত্ব রাখছেন। কিন্তু তবু তাঁদের অবদানের প্রতিদান তো দূরের কথা, স্বীকৃতিটুকু দেয়া হয়নি। অথচ নিজেদেরই নারীদের এমন অপমান করে পঙ্গু করার পদক্ষেপ নিয়ে দুনিয়ার মুসলমানকে এক আত্মঘাতী ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হাদিসটার মূলে না গিয়ে কতভাবে কত-গবেষণায় ‘প্রমাণ’ করার চেষ্টা হয়েছে যে নারীরা নেত্রীত্বের যোগ্য নয়। খুলে দেখুন মওলানা মুহিউদ্দীনের বাংলা কোরাণ, পৃষ্ঠা ৯৯৩: “আলেমগণ এ-বিষয়ে একমত যে, কোন নারীকে শাসনকর্তৃত্ব, খেলাফত অথবা রাজত্ব সমর্পণ করা যায় না ; বরং নামাজের ইমামতের ন্যায় বৃহৎ ইমামতি অর্থাৎ শাসন-কর্তৃত্বও একমাত্র পুরুষের জন্যই উপযুক্ত।”

কে বা কারা এই আলেমগণ ? মুসলিম-নারীদের চিরকালের জন্য এ-ভাবে অপমান ও পঙ্গু করার অধিকার এঁরা কোত্থেকে পেলেন ? আরও দেখুন পৃষ্ঠা ১২২০, নবীজী নাকি বলেছেন, “যখন তোমাদের শাসকবর্গ তোমাদের মন্দ ব্যক্তি হইবে, তোমাদের বিত্তশালীরা কৃপণ হইবে এবং তোমাদের কাজকর্ম নারীদের হাতে ন্যস্ত হইবে। তারা যে-ভাবে ইচ্ছা কাজ করিবে, তখন তোমাদের বসবাসের জন্য ভূপৃষ্ঠ অপেক্ষা ভূগর্ভই শ্রেয়ঃ হইবে।” (রূহুল মা’আনি)।

লজ্জাটা কম নয়, কিন্তু সমস্যাটা তারও বড়। নারী-পুরুষের মিলিত অবদান ছাড়া সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই, কোন মহাপুরুষ তাঁর অনুসারী নারীদের চিরকালের জন্য এ-ভাবে অপমান ও পঙ্গু করে রাখতে পারেন না।

বিশ্ব-নবী তো ননই ॥

লেখক পরিচিতি: হাসান মাহমুদ

•উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, ওয়ার্লড মুসলিম কংগ্রেস

• গবেষক, দ্বীন রিসার্চ সেণ্টার, হল্যাণ্ড

• জেনারেল সেক্রেটারি, মুসলিমস ফেসিং টুমরো – ক্যানাডা

• কানাডা প্রতিনিধি, ফ্রী মুসলিমস্ কোয়ালিশন, আমেরিকা

• প্রাক্তন প্রেসিডেণ্ট ও ডিরেক্টর, শারিয়া আইন, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস

• প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশীপ কোয়ালিশন

• উপদেষ্টা, সম্মিলিত নারীশক্তি – খুলনা, বাংলাদেশ

(লেখকের “শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি”- বইয়ের একটি অধ্যায় থেকে)



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.