নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আরিফুজ্জামান১৯৮৭

আরিফুজ্জামান১৯৮৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের ৫ম পর্ব

১৯ শে জুন, ২০২০ সকাল ৭:৪৫

এর আগে ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের চারটি পর্ব দিয়েছি। আজ দিচ্ছি পঞ্চম পর্বঃ
.
মনসুর দীর্ঘ সময় ধরে চুপ করে রইল। এই প্রসঙ্গ নিয়ে ওরা এর আগেও বহুবার তর্ক করেছে। এবং মনসুর কখনই হার স্বীকার করেনি। কিন্তু এখন যেই আবেগগুলোকে সে বহু বছর ধরে চাপা দিয়ে রেখেছিল সেগুলো মনের মাঝে ঘূর্ণিত হতে শুরু করল। এখন পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক, বিপদ এড়ানোর জন্য পরিবারকে নিয়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই অবস্থায় সেসব অনুভূতিগুলো আবারও ফিরে আসছে যেগুলো শান্তিকালীন সময়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে। পরিবারের চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ আর কী আছে?
ভেরিটির পাশেই রাখা আছে হার্পশিকর্ড নামক একটি বাদ্যযন্ত্র। তার পাশের টেবিলে ড্যাগারটা রেখে দিল মনসুর। এই রকমের একটা হার্পশিকর্ড রাখা আছে অন্য আরেকটা বাড়িতে। এবং বহু বছর আগে আরেকটা লড়াই হয়েছিল, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা তাড়া করেছিল ওদেরকে। এটা সেই সময়ের কথা, যখন সে আর জিম ছিল পরস্পরের প্রাণের বন্ধু।
"প্রিয়তম, সবসময়কার মতো, তোমার কথাই ঠিক। এই ঋতুটা চলে যাক। এরপরে বর্ষা মৌসুমের বাতাস যখন দিক পালটে আমাদের অনুকূলে বইতে শুরু করবে, আমি আফ্রিকার উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা করব। জিমকে সাথে নিয়ে আবারও মাছ ধরতে বের হতে পারলে আমার কাছে ভালোই লাগবে। এবং থিও আর কন্সট্যান্স একজন অচেনা কাজিনকে খুঁজে পেয়ে অবাক হয়ে যাবে, যার ব্যাপারে ওদের কোনও স্মৃতিই নেই।"
***
"আমার কাছে খুব বোরিং লাগছে," কন্সট্যান্স বলল। "কে কল্পনা করেছিল যে যুদ্ধ জিনিসটা এত বিরক্তিকর একটা ব্যাপার?"
মেয়েটির পরনে সাদা রঙের সুতি শাড়ি। বসে আছে একটা চেয়ারের ওপরে। সে নিজের হাতে একটা আয়না ধরে রেখেছে এবং আয়নার ওপরে পড়া নিজের প্রতিফলনটাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। সে প্র‍্যাকটিস করছে নিজের চেহারায় বিভিন্ন রকমের ভাব ফুটিয়ে তুলতে। সে বুঝতে চাইছে বিভিন্ন রকমের অঙ্গ-ভঙ্গিমা অন্যের মনের ওপরে কেমন কেমন প্রভাব ফেলতে পারে। ওর বিনুনি করা চুল নিচের দিকে ঝুলছে। ঘামের কারণে ওর গালটা আর্দ্র হয়ে আছে। ওর ফরাসি ভাষা শেখার ব্যাকরণ বই পড়ে আছে সাইড-টেবিলে, কন্সট্যান্স ওটা ছুয়েও দেখছে না।
কন্সট্যান্স চেহারায় বিরক্তি ফুটিয়ে থিওর দিকে তাকাল। “তুই তো ইচ্ছে করলেই এখান থেকে পালিয়ে আর্মিতে যোগ দিতে পারিস।”
থিও ওর বই থেকে মুখ তুলে তাকাল। "পালিয়ে যাওয়ার কথা যে ভাবিনি তা কিন্তু না। তোর মতোই আমার নিজের কাছেও এই পরিস্থিতিটা অসহ্য লাগছে। কিন্তু বাবা আমাকে খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে ফেলবে। আমি তাই বাড়ি ছাড়তে পারছি না। তোর আর আমার এখন একই অবস্থা।"
ওরা প্রায় এক মাস যাবত এই দুর্গ-এলাকার ভেতরে আবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। যেই বাড়িতে ওরা এখন আছে সেটার মালিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন ব্যবসায়ী। সে এখন বঙ্গ প্রদেশে আছে ব্যবসার কাজে। ওই ব্যবসায়ীর এজেন্ট ওকে খুশিমনেই এখানে থাকতে দিয়েছে। কারণ, মনসুর একবার ওই ব্যবসায়ীর একটা উপকার করে দিয়েছিল।
প্রথম দুই সপ্তাহ থিও এবং কন্সট্যান্স বাবা-মায়ের কাছে ক্রমাগত অসন্তোষ প্রকাশ করছিল। সামান্য একটা গুজবের কারণে ওদেরকে বাড়ি ছাড়তে হল কেন? ওরা এটা মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু এরপরে ফরাসি সৈন্যরা এখানে এসে পৌঁছাল। ওরা গ্রেট প্যাগোডার কাছাকাছি ক্যাম্প বসায়। এবং শহরের চারপাশে কামানের গোলা নিক্ষেপ করার মতো অস্ত্র স্থাপন করে। মনসুর যেমনটা আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কোর্টনি পরিবারের ড্রয়িং রুমে এখন দুটো নয় পাউন্ড ওজনের ফিল্ড-গান বসানো হয়েছে।
একটা চাপা বুম-বুম আওয়াজ শহরের মাঝে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল। এই অবস্থা গত কয়েকদিন ধরেই চলছে, যদিও এটার আওয়াজে থিও এখনও প্রতিবার চমকে ওঠে।
ফরাসিরা এখানে অবরোধ জারি করেছে। তবে এই অবরোধ চলাকালীন সময়ে ওরা খুব বেশি শক্তি খরচ করছে না। এক ঘণ্টায় খুব বেশি হলে তিনটা কি চারটা গুলি ছুঁড়ছে।
"আমি বুঝলাম না মা কিভাবে এই অবস্থার মাঝেও ঘুমাচ্ছে," থিও বলল। ভেরিটি তখন ওপরতলায়, ভারতীয় স্টাইলে দুপুরের খাওয়ার পরের ভাতঘুম দিচ্ছে।
"আমার ধারণা, সমুদ্র পথে উনি যে এতগুলো যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, সেই কারণে এসব গোলাগুলির আওয়াজ এখন আর তার ওপরে তেমন প্রভাব ফেলে না," কন্সট্যান্স বলল। "আমার জীবনটা কী বোরিং। অন্ততপক্ষে মা তার জীবনে কিছুটা উত্তেজনা নিতে পেরেছিলেন।"
"বাবা বলেছেন আমাদেরকে এমনভাবে আচরণ করতে হবে, যেন কোনো কিছুই ঘটেনি।" থিও ওর হাতে ধরা বইটার দিকে মুখ ফেরাল। এটা ড্যানিয়েল ডিফোর লেখা একটি বই। এর নাম দ্য লাইফ, এডভেঞ্চারস এন্ড পাইরেসিস অফ ফেমাস ক্যাপ্টেন সিংগেলটন। এটা থিওর খুব প্রিয় একটা বই। এই বইতে লেখা আছে, ডাকাতগুলো কিভাবে আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ করেছে। বইয়ে লেখা এই সব অদ্ভুত অদ্ভুত কাহিনি পড়ে থিওর মনেও এখন দারুণ সাধ জাগছে অমন কোনো এডভেঞ্চারে যুক্ত হতে এবং বিদেশের ওইসব প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে। ওর বাবা ওই রহস্যময় মহাদেশে তার বালক বয়সের করা প্রচুর এডভেঞ্চারের গল্প ওকে শুনিয়েছে। যেটা কিনা থিওর লাগামহীন কল্পনার জগতে আরও বারুদ সরবরাহ করেছে। কিন্তু গল্পে লেখা ওইসব কাল্পনিক ডাকাতদের ওপরে মনোযোগ নিবদ্ধ করাটা এখন কঠিন। কারণ সত্যিকারের ফরাসি বন্দুকধারীরা ওদের বাসগৃহকে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে চাইছে।
"কিন্তু আমার কাছে মল ফ্ল্যান্ডার্স সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে," কন্সট্যান্স বলল। "সে বারো বছর ছিল বেশ্যা। পাঁচবার বিয়ে বসেছে। একবার তো নিজের ভাইয়ের সাথেই ওর বিয়ে হয়েছিল, ওকে আমেরিকায় নিয়ে নির্বাসন দেয়া হয়, কিন্তু তারপরেও ওই মেয়ে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয় এবং আরামের সাথে মারা যায়। এই ধরনের এডভেঞ্চারই তো আমার চাই।"
"মা বলে যে এটা খুবই অশ্লীল একটা শব্দ," থিও বলল। ওর বোন যখন "বেশ্যার" মত শব্দ উচ্চারণ করে তখন ওর কাছে সেটা শুনতে ভালো লাগে না।
কন্সট্যান্স আয়নার গায়ে প্রতিফলিত ওর চেহারাটা আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। "হয়তো কোনও একদিন আমি হব একটা গৃহপালিত টাইপের মহিলা এবং বিয়ে করব মাথা নষ্ট করা বিশাল এমাউন্টের টাকার জন্য, কে জানে!"
"এরচেয়ে হাস্যকর আইডিয়া আর কী হতে পারে? ফালতু! আমি এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাই যাকে আমি মনে-প্রাণে ভালোবাসব, যেমন আমার মা এবং বাবা।"
কন্সট্যান্স কিছু বলল না। আচমকা, সে ওর হাতের আয়নাটা টেবিলের ওপরে রেখে উঠে দাঁড়াল। "যথেষ্ট হয়েছে। কেন আমরা বইয়ে লেখা ওইসব এডভেঞ্চার নিয়ে কথা বলছি, যেখানে আমাদের দরজার কাছেই সত্যিকার এডভেঞ্চার ঘটে চলছে? আমি বাইরে বেড়িয়ে অবস্থাটা দেখে আসতে চাই।"
থিও ওর বইটা বন্ধ করল। "হারজিন্দর আমাদেরকে কিছুতেই বাইরে বের হতে দেবে না।" মনসুর ওই প্রহরীকে বাড়ির সদর দরজায় বসিয়ে দিয়েছে। এবং বাবা তাকে আদেশ দিয়ে রেখেছে যে তার অনুমতি ছাড়া তার পরিবারের কেউ যাতে বাড়ির বাইরে বেরুতে না পারে।
"নিঃসন্দেহে, আমরা ওই পথ দিয়ে বাইরে বের হচ্ছি না।"
থিওর দৃষ্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানালার দিকে চলে গেল। কন্সট্যান্স ওর ওই দৃষ্টিকে অনুসরণ করল।
"মা কী বলবে, যদি তিনি জেগে উঠে আমাদেরকে দেখতে না পান?" থিও বলল।
"তিনি জেগে ওঠার আগেই আমরা বাড়িতে ফিরে আসব। উনি আমাদের অভিযানের ব্যাপারে কিছুই টের পাবেন না। অথবা তুই নিজেই মাকে সবকিছু জানিয়ে দিতে পারিস, যদি আমার সাথে আসতে তোর ভীষণ ভয় করে আরকি।"
"আমার কোনো ভয় নেই।" সে চাইছে না ওর বোন একলা একলা বিপদের মুখে চলে যাক। সে ওর বইটা নামিয়ে রাখল এবং ভেজা মাদুরটা তুলল যেটা জানালার ওপরে ঝুলছিল বাতাসকে শীতল রাখার জন্য। কন্সট্যান্স ওর কৃশকায় পা-জোড়া গোবরাটের ওপরে তুলল, এরপরে আলতো করে বাইরের মাটিতে পা রাখল। থিও ওর বোনকে অনুসরণ করল।
দুপুরের এই সময়টায় শহর একদম চুপচাপ। এখানে থাকা বেশির ভাগ ব্রিটিশই এখন ঘুমে অচেতন হয়ে আছে।
"আমরা কোথায় যাব?" থিও জিজ্ঞেস করল।
"দেয়ালের ওপরে উঠব। ওখানে উঠলেই যুদ্ধের সবচেয়ে ভালো ভিউ পাওয়া যাবে।"
"কিন্তু ওখানে তো গার্ডেরা পাহারা দিচ্ছে," থিও প্রতিবাদ জানাল।
কন্সট্যান্স ওর দিকে তাকিয়ে জিহ্বা দিয়ে ভেংচি কাটল। "আমি একটা পথের কথা জানি।"
"কিভাবে যাব?"
"আমাকে অনুসরণ করতে থাক।"
মেয়েটি থিওকে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে প্রশস্থ, বালুময় রাস্তা ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। নিজেদেরকে যতটা পারা যায় বাড়ি এবং কোম্পানির গুদামঘরের আড়ালে আড়ালে রাখল। বিল্ডিংগুলো হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। চোখের সামনে ধরা দিল সারি সারি খুপরিঘর এবং দোকানঘর। ওগুলো পরস্পরের সাথে এত ঠাসাঠাসি করে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে এটা বুঝতে থিওর এক মুহুর্ত সময় বেশি লেগে গেল যে ওই ইটের দেয়ালের পেছন দিকটা আসলে দুর্গের বহিঃস্থ দেয়াল।
"আমাকে ওপরে তোল," কন্সট্যান্স থিওকে হুকুম দিল।
থিও ওর দুই হাতের তালু উপুর করে ধরল যাতে কন্সট্যান্স ওটার ওপরে পা রেখে উঠে যেতে পারে। থিও কন্সট্যান্সকে ধারেকাছে থাকা সবচেয়ে নিচু ছাদের ওপরে তুলে দিল। এরপরে বোনের পিছু পিছু সে নিজেও ছাদে উঠে এল। দেয়ালের বাইরের দিকে যেই বাড়িগুলো আছে, সেগুলোকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। ওরা নিজেদের শরীরকে ঠেলাঠেলি করে কষ্টেসৃষ্টে কেল্লার প্রাচীরের ওপরে উঠে এল। ওদের শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল, কাপড়ে ধুলো লেগে গেছে।
থিও দেয়ালটিকে আড়ালে রেখে মাথা নিচু করে রইল। কিন্তু কন্সট্যান্স ভয়ডরহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। সে সামনের দিকে ঝুঁকে বাইরের দিকে মুখটা বাড়িয়ে রাখল।
"নিচু হ, কন্সট্যান্স," থিও হিসহিসিয়ে উঠল। "তোকে যদি কেউ দেখে ফেলে তখন কী হবে?"
"কে দেখবে?" কন্সট্যান্স থিওকে পাত্তা দিল না। "বাবা বলেছেন ওদের সৈন্যসংখ্যা এত কম যে ওরা শুধু মেইন টাওয়ারেই লোক রাখতে পারবে। আর কোনও সৈন্য যদি আমাদের সামনে এসেই পড়ে, আমি স্রেফ ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দেব, আর তাতেই সে আমার রূপ দেখে পটে যাবে। আমি এরপরে ওই সৈনিকের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরব। ওরা বুঝবে যে এটা ছিল জাস্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি।"
"তুই কি ফরাসিদের কথা বলছিস?"
"আমি নিশ্চিত ওরা এত বর্বর না যে একজন লেডির ওপরে গুলি চালাবে।"
ঠিক সেই মুহুর্তে ওরা দেখল, আগুনে ধোঁয়ার একটা উদগিরণ ফরাসি সৈন্যবাহিনির ওখান থেকে প্রস্ফুটিত হয়েছে। এক মুহুর্ত পরেই ওদের কানে এল "বুম" আওয়াজ। ওরা অনুভব করল, শকওয়েভের কারণে ওদের পায়ের নিচের দেয়ালের মেঝেটা কাঁপছে। কামানের গোলাটা কারও কোনও ক্ষতি না করে ধারেকাছে পতিত হল, নিচের সমভূমিতে ধুলোর মেঘ সৃষ্টি হল এতে।
"তুই দেখেছিস?" কন্সট্যান্স উল্লসিত ভঙ্গিতে বলল। "আমাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই, পিচ্চি ভাই আমার।"
"আমাকে ওই রকম করে ডাকবি না।"
থিও উঠে দাঁড়াল, সাবধানতার সাথে বাইরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে। সেন্ট জর্জ দুর্গ এবং মাদ্রাজ শহরটা দাঁড়িয়ে আছে হুগলি নদীর বালুতটের ওপরে। বিস্তৃত একটা ভূমি উপকূলের পাশ দিয়ে চলে গেছে। ওটা মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়েছে জোয়ারের ফলে সৃষ্ট একটা লেগুনের কারণে। তীরভূমির অপর প্রান্তে, লেগুনের পেছনে, সে দেখতে পাচ্ছিল ফরাসিদের সেনাশিবির পাম গাছের মাঝে বিন্দু বিন্দু হয়ে ছড়িয়ে আছে, গ্রেট প্যাগোডার চারপাশে অবস্থান নিয়েছে ওরা। থিও দেখতে পাচ্ছিল ওখানে আছে সারি সারি তাঁবু, মালপত্র বোঝাই ওয়াগন এবং ভাঁড়ার-ঘর। একটা এলাকা সাফসুতরো করে অস্থায়ী প্যারেড গ্রাউন্ড বানানো হয়েছে, সেখানে একদল বন্দুকধারী সৈনিক কুচকাওয়াজ করছে। ওদের সামনে, নেটিভ শ্রমিকেরা সারি সারি পরিখা খনন করেছে। ওই পরিখায় আধ ডজন কামান বলতে গেলে অলস অবস্থায় পড়ে আছে। থিও দেখতে পাচ্ছিল, কামান সামলানোর কাজে নিয়োজিত একজন সেনা আলস্যভরে একটা কামানকে স্পঞ্জ দিয়ে মুছছে। ওটা দিয়ে মাত্র কিছুক্ষণ আগে গোলা ছোঁড়া হয়েছে। তবে, দুর্গের ভেতরে থাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজেরা ফরাসিদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
"বাবা যদি এখানকার ব্রিটিশ সৈনিকদেরকে নেতৃত্ব দিতেন, ওই ফরাসীরা একবার রিলোড করার আগেই তিনি চারটা কামান থেকে একযোগে ফায়ার করতেন," থিও বলল, পারিবারিক গর্বে ওর বুকটা সামান্য ফুলে উঠেছে। মনসুর প্রায়ই ওদেরকে বলে যে তিনি কিভাবে ওদের মা ভেরিটিকে তার দুশ্চরিত্র বাবার হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন, কিভাবে তিনি হুকুম দিচ্ছিলেন তার নিজের এক মাস্তুলওয়ালা ছোট ডিঙ্গি নৌকাকে এবং ব্যস্ত রেখেছিলেন গাই কোর্টনির যুদ্ধজাহাজকে, পালাচ্ছিলেন ঠিক ওই যুদ্ধজাহাজে থাকা কামানের তলা দিয়ে। বাবার হাঁটুর ওপরে বসে বসে থিও যখন থেকেই এই গল্প শুনেছে, সে তখন থেকেই আকাঙ্ক্ষা করে আসছে যুদ্ধের রোমাঞ্চকর উত্তেজনা নেয়ার জন্য। কিন্তু এখন, বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। যেখানে কামানগুলো ওর দিকেই তাক করে ধরে রাখা। ড্যানিয়েল ডিফো তার গল্পের বইয়ে যেমনটা লিখেছিলেন, এটাকে এখন তার চেয়েও জটিল একটা পরিস্থিতি বলে মনে হচ্ছে।
"নিচু হ," থিও কন্সট্যান্সকে বলল। "আমরা শুধু শুধু নিজেদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। এটা মোটেও উচিত হচ্ছে না।"
"তুই দেখেছিস, সর্বশেষ গোলাটা এই দেয়ালের পঞ্চাশ গজের মধ্যেও আসেনি।" কন্সট্যান্স বলল, ওর চোখজোড়া তখন উত্তেজনায় চকচক করছে। "আমরা ওদের নাগালের বাইরে।"
"তুই দেখছি এই অবস্থাটা উপভোগ করছিস!" থিও অবাক হয়ে গিয়েছে।
মেয়েটি তার ভাইয়ের দিকে ঘুরল, এক হাত বুকের ওপরে ধরে ভাঁজ করে রাখা। "অবশ্যই, এটা তো দারুণ রোমাঞ্চকর একটা অভিজ্ঞতা, তাই না?"
কামানটা থেকে আবারও গোলা ছুঁড়ে মারা হল।
***
এই বিস্ফোরণটা দুর্গের মাঝ দিয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল। ক্রিস্টাল-নির্মিত ঝাড়বাতিটি কেঁপে উঠল, টুংটাং শব্দ করে বাজছে। মনসুর তখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছিল। বাড়ির জানালায় থাকা সকল খড়খড়ি টেনে নামিয়ে রাখা হয়েছে, এবং দুপুরের উত্তাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য দরজাগুলোকেও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সুর্যালোকের রশ্মি জানালার খড়খড়ির মাঝ দিয়ে লেজারের মতো নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, ওই রশ্মিতে বাতাসের মাঝ দিয়ে ধুলোর ঘূর্ণি দেখা যাচ্ছে। ভারতবর্ষে ধুলো একটা বড় সমস্যা। চাকর বাকরেরা যতই ঘর ঝাড়ু দিক বা পানি দিয়ে মুছুক, এই দেশে এই জিনিসের হাত থেকে তুমি কোনোভাবেই পুরোপুরি নিস্তার পাবে না।
"ভেরিটি?" মনসুর ডাক দিল। "কন্সট্যান্স? থিও?"
সিঁড়ি দিয়ে সে যতই ওপরে উঠছিল, পরিবারের লোকদের কথা চিন্তা করে তার মন ততই আরও বেশি করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল। যদিও সে বারবার নিজেকে বুঝাচ্ছিল যে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ওরা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। ওরা তো সবসময়ই দিনের এই সময়টায় ঘুমায়। এবং দুর্গের ভেতরের এই বাড়িটিকে মনসুর খুব সতর্কতার সাথে বেছে নিয়েছে... পশ্চিমের দেয়াল এবং ফরাসি সৈন্যদের কামান থেকে অনেক দূরে এই বাড়িটি।
মনসুর কন্সট্যান্সের শয়নকক্ষের দরজা খুলল। ওখানে কেউ নেই। বিছানার চাদরেও কোনও ভাঁজ দেখা যাচ্ছে না, বুঝাই যাচ্ছে ওটা কেউ স্পর্শই করেনি। মনসুর অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে এরপরে থিওর শয়নকক্ষটাও দেখল। ওখানেও একই অবস্থা। মনসুর নিজেকে প্রবোধ দিল, হয়তো ওরা ওদের মায়ের সাথে আছে।
ভেরিটি তখন শরীর টানটান করে বিছানায় শুয়ে আছে। তার পরনে সুতির কাপড়ের খাটো জামা। সে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এমনকি এখনও, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি চলে যাওয়ার পরেও, এই মেয়েটি এখনও পর্যন্ত মনসুরের দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী। মনসুর প্রতিদিন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়। কারণ, ঈশ্বর ওদের দুজনকে একত্রে বসবাস করার সুযোগটা দিয়েছেন।
কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটোর ব্যাপারে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার কারণে মনসুরের মন থেকে এই চিন্তাগুলো দূরে সরে গেল।
"কন্সট্যান্স, থিও... ওরা কোথায়?" মনসুর জিজ্ঞেস করল, ভেরিটিকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জেগে তুলছে।
হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে তোলায় ভেরিটি ওর চোখ ঘষতে লাগল। "কেন? ওরা কি ওদের রুমে নেই?"
মনসুর না বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। এবার মনসুরের দুশ্চিন্তা ভেরিটির মাঝেও সংক্রমিত হল। বাড়ির মাঝে জরুরী ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করতে লাগল ওরা, সন্তানদেরকে খুঁজে পেতে চাইছে। ঝাড়া দিয়ে দরজা খুলছে, ছেলে-মেয়ের নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকছে। কিন্তু মিনিট-খানেক পরেই ওরা বুঝতে পারল কন্সট্যান্স আর থিও বাসায় নেই।
"ওরা গেল কোথায়?" ভেরিটি চিন্তায় পড়ে গেছে। "ওদেরকে বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না।"
ধারে কাছে কোথাও আরেকটা কামানের গোলা পড়ল। খুব জোরালো আওয়াজ হল এতে। বাড়িটা কেঁপে উঠেছে। অন্যদিকে, ইংরেজ গোলন্দাজেরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা এবার ফিরতি গুলি ছুঁড়বে।
"ওই দেয়াল," মনসুর বুঝতে পারল, ওর কণ্ঠে ভয়ের আভাস। "তুমি জানো থিও কেমন টাইপের ছেলে... সবসময় এডভেঞ্চারের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকে। সে নিশ্চয়ই যুদ্ধ দেখতে গিয়েছে।"
"আর কন্সট্যান্স?"
"সে নিশ্চয়ই ওর বোনকেও নিজের সাথে করে নিয়ে গেছে।" মনসুর ইতোমধ্যে দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছে।
ভেরিটি তাড়াহুড়ো করে স্বামীর পিছু নিল। "ওরা তো ফরাসিদের কামানের মুখে পড়ে যাবে।" এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই সে ভয়ে কেঁপে উঠল।
ইঞ্জিনিয়ারের দেয়া সেই সতর্কবার্তাটির কথা মনে আসতেই মনসুর আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। "ওরা যেই দেয়ালের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ফরাসিদের কামানের চেয়ে ওটা আরও বেশি বিপজ্জনক।"
মনসুর তার স্ত্রীকে নিয়ে গভর্নরের প্রাসাদের সামনে থাকা প্যারেড গ্রাউন্ড ধরে দৌড়াতে লাগল। গির্জা এবং পানির কুয়াটা পেরিয়ে গেল ওরা। শুকনা মরিচ, চা পাতা এবং মশলার গন্ধে গুদামঘরের চারপাশটা ম ম করছে, কিন্তু মনসুরের তখন ওদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় নেই।
কামান থেকে আবারও গোলা ছোঁড়া হল। কয়েকটা গোলা এত কাছাকাছি পতিত হল যে ওরা আরেকটু হলেই মাটিতে আছড়ে পড়ত। ফরাসিরা তাদের আক্রমণের ধার বাড়িয়ে দিয়েছে। এবং ইংরেজ সৈনিকরাও ওদের আক্রমণের বিপরীতে হালকা পাতলা জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে।
ওহ, ঈশ্বর! আমাদের যেন খুব বেশি দেরি হয়ে না যায়, মনসুর ভাবল।
ওরা দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় পৌঁছাল। সিঁড়ির গোড়ায় থাকা একজন সিপাহী ওদেরকে থামাতে চাইল, কিন্তু ওদের দুজনকে চিনতে পেরে আর আটকাল না। মনসুর ঝড়ের বেগে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যেতে লাগল। (চলবে)

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের প্রথম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/photo.php?fbid=2985829594796406&id=100001081832019&set=a.422627021116689&source=56

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের তৃতীয় পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3211705148875515&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3211705148875515:top_level_post_id.3211705148875515:tl_objid.3211705148875515:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3211705148875515:photo_id.3211705005542196:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:5167009495212656913&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের চতুর্থ পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3213814051997958&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3213814051997958:top_level_post_id.3213814051997958:tl_objid.3213814051997958:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3213814051997958:photo_id.3213813895331307:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:2041402156577410201&__tn__=*s-R

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জুন, ২০২০ সকাল ৮:৪৮

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন: সুন্দর হয়েছে।

২১ শে জুন, ২০২০ সকাল ৭:৫৭

আরিফুজ্জামান১৯৮৭ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার প্রশংসার জন্য।

২| ১৯ শে জুন, ২০২০ সকাল ১০:৪১

রাজীব নুর বলেছেন: সহজ ভাষা। সুন্দর হয়েছে।

২১ শে জুন, ২০২০ সকাল ৭:৫৬

আরিফুজ্জামান১৯৮৭ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার প্রশংসার জন্য।

৩| ১৯ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১২:৫৩

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অসাধারণ উপস্থাপন ।

২১ শে জুন, ২০২০ সকাল ৭:৫৬

আরিফুজ্জামান১৯৮৭ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার প্রশংসার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.