নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আরিফুজ্জামান১৯৮৭

আরিফুজ্জামান১৯৮৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের ৬ষ্ঠ পর্ব

২২ শে জুন, ২০২০ ভোর ৬:৩৩

এর আগে ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের পাঁচটি পর্ব দিয়েছি। আজ দিচ্ছি ষষ্ঠ পর্বঃ
.
এই বিস্ফোরণটা দুর্গের মাঝ দিয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল। ক্রিস্টাল-নির্মিত ঝাড়বাতিটি কেঁপে উঠল, টুংটাং শব্দ করে বাজছে। মনসুর তখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছিল। বাড়ির জানালায় থাকা সকল খড়খড়ি টেনে নামিয়ে রাখা হয়েছে, এবং দুপুরের উত্তাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য দরজাগুলোকেও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সুর্যালোকের রশ্মি জানালার খড়খড়ির মাঝ দিয়ে লেজারের মতো নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, ওই রশ্মিতে বাতাসের মাঝ দিয়ে ধুলোর ঘূর্ণি দেখা যাচ্ছে। ভারতবর্ষে ধুলো একটা বড় সমস্যা। চাকর বাকরেরা যতই ঘর ঝাড়ু দিক বা পানি দিয়ে মুছুক, এই দেশে এই জিনিসের হাত থেকে তুমি কোনোভাবেই পুরোপুরি নিস্তার পাবে না।
"ভেরিটি?" মনসুর ডাক দিল। "কন্সট্যান্স? থিও?"
সিঁড়ি দিয়ে সে যতই ওপরে উঠছিল, পরিবারের লোকদের কথা চিন্তা করে তার মন ততই আরও বেশি করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল। যদিও সে বারবার নিজেকে বুঝাচ্ছিল যে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ওরা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। ওরা তো সবসময়ই দিনের এই সময়টায় ঘুমায়। এবং দুর্গের ভেতরের এই বাড়িটিকে মনসুর খুব সতর্কতার সাথে বেছে নিয়েছে... পশ্চিমের দেয়াল এবং ফরাসি সৈন্যদের কামান থেকে অনেক দূরে এই বাড়িটি।
মনসুর কন্সট্যান্সের শয়নকক্ষের দরজা খুলল। ওখানে কেউ নেই। বিছানার চাদরেও কোনও ভাঁজ দেখা যাচ্ছে না, বুঝাই যাচ্ছে ওটা কেউ স্পর্শই করেনি। মনসুর অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে এরপরে থিওর শয়নকক্ষটাও দেখল। ওখানেও একই অবস্থা। মনসুর নিজেকে প্রবোধ দিল, হয়তো ওরা ওদের মায়ের সাথে আছে।
ভেরিটি তখন শরীর টানটান করে বিছানায় শুয়ে আছে। তার পরনে সুতির কাপড়ের খাটো জামা। সে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এমনকি এখনও, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি চলে যাওয়ার পরেও, এই মেয়েটি এখনও পর্যন্ত মনসুরের দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী। মনসুর প্রতিদিন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়। কারণ, ঈশ্বর ওদের দুজনকে একত্রে বসবাস করার সুযোগটা দিয়েছেন।
কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটোর ব্যাপারে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার কারণে মনসুরের মন থেকে এই চিন্তাগুলো দূরে সরে গেল।
"কন্সট্যান্স, থিও... ওরা কোথায়?" মনসুর জিজ্ঞেস করল, ভেরিটিকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জেগে তুলছে।
হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে তোলায় ভেরিটি ওর চোখ ঘষতে লাগল। "কেন? ওরা কি ওদের রুমে নেই?"
মনসুর না বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। এবার মনসুরের দুশ্চিন্তা ভেরিটির মাঝেও সংক্রমিত হল। বাড়ির মাঝে জরুরী ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করতে লাগল ওরা, সন্তানদেরকে খুঁজে পেতে চাইছে। ঝাড়া দিয়ে দরজা খুলছে, ছেলে-মেয়ের নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকছে। কিন্তু মিনিট-খানেক পরেই ওরা বুঝতে পারল কন্সট্যান্স আর থিও বাসায় নেই।
"ওরা গেল কোথায়?" ভেরিটি চিন্তায় পড়ে গেছে। "ওদেরকে বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না।"
ধারে কাছে কোথাও আরেকটা কামানের গোলা পড়ল। খুব জোরালো আওয়াজ হল এতে। বাড়িটা কেঁপে উঠেছে। অন্যদিকে, ইংরেজ গোলন্দাজেরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা এবার ফিরতি গুলি ছুঁড়বে।
"ওই দেয়াল," মনসুর বুঝতে পারল, ওর কণ্ঠে ভয়ের আভাস। "তুমি জানো থিও কেমন টাইপের ছেলে... সবসময় এডভেঞ্চারের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকে। সে নিশ্চয়ই যুদ্ধ দেখতে গিয়েছে।"
"আর কন্সট্যান্স?"
"সে নিশ্চয়ই ওর বোনকেও নিজের সাথে করে নিয়ে গেছে।" মনসুর ইতোমধ্যে দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছে।
ভেরিটি তাড়াহুড়ো করে স্বামীর পিছু নিল। "ওরা তো ফরাসিদের কামানের মুখে পড়ে যাবে।" এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই সে ভয়ে কেঁপে উঠল।
ইঞ্জিনিয়ারের দেয়া সেই সতর্কবার্তাটির কথা মনে আসতেই মনসুর আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। "ওরা যেই দেয়ালের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ফরাসিদের কামানের চেয়ে ওটা আরও বেশি বিপজ্জনক।"
মনসুর তার স্ত্রীকে নিয়ে গভর্নরের প্রাসাদের সামনে থাকা প্যারেড গ্রাউন্ড ধরে দৌড়াতে লাগল। গির্জা এবং পানির কুয়াটা পেরিয়ে গেল ওরা। শুকনা মরিচ, চা পাতা এবং মশলার গন্ধে গুদামঘরের চারপাশটা ম ম করছে, কিন্তু মনসুরের তখন ওদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় নেই।
কামান থেকে আবারও গোলা ছোঁড়া হল। কয়েকটা গোলা এত কাছাকাছি পতিত হল যে ওরা আরেকটু হলেই মাটিতে আছড়ে পড়ত। ফরাসিরা তাদের আক্রমণের ধার বাড়িয়ে দিয়েছে। এবং ইংরেজ সৈনিকরাও ওদের আক্রমণের বিপরীতে হালকা পাতলা জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে।
ওহ, ঈশ্বর! আমাদের যেন খুব বেশি দেরি হয়ে না যায়, মনসুর ভাবল।
ওরা দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় পৌঁছাল। সিঁড়ির গোড়ায় থাকা একজন সিপাহী ওদেরকে থামাতে চাইল, কিন্তু ওদের দুজনকে চিনতে পেরে আর আটকাল না। মনসুর ঝড়ের বেগে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যেতে লাগল।
সিঁড়ির শীর্ষভাগে, একজন ইংরেজ লেফট্যানেন্ট মনসুর এবং ভেরিটির পথের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল। সৈনিকেরা হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোমরের ওপরে তাদের পরনে আর কিছু নেই, শরীর থেকে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তারা চেহারায় বিস্ময় মেখে নবাগত দুজনের দিকে চেয়ে রইল।
"এই? তোমরা এখানে কী করছ?" লেফট্যানেন্ট খেঁকিয়ে উঠল। "এটা মোটেও সিভিলিয়ানদের জায়গা না। আমরা এখানে একটা যুদ্ধ লড়ছি।" কিন্তু দেয়াল বরাবর তাকাতেই, মনসুর যা খুঁজছিল তার দেখা পেয়ে গেল। সে ধাক্কা দিয়ে ওই লেফট্যানেন্টকে একপাশে সরিয়ে দিল... যতটা চেয়েছিল ধাক্কাটা তার চেয়েও কিছুটা জোরালো হয়ে গেল। অফিসারটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কামানের উত্তপ্ত ব্যারেলের সাথে তার শরীর স্পর্শ করতেই সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। ততক্ষণে মনসুর ওকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে। মনসুরের সাথে সাথে ভেরিটিও। বিস্মিত গোলন্দাজদের মুখের ওপর দিয়ে ভেরিটির স্কার্ট বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল।
মনসুর দুর্গের দেয়াল ধরে দৌড় দিল, এবড়ো খেবড়ো পাথরের ওপরে ওর পা-জোড়া দ্রুতগতিতে ছুটছে। "থিও!" সে চিৎকার করল। "কন্সট্যান্স! এই মুহুর্তে ওই দেয়াল থেকে নেমে আসো। এখনই! এটা তোমাদের জন্য নিরাপদ না।"
ফরাসিদের পাশ থেকে, কামানটা আরও একবারের মতো গর্জে উঠল।
***
থিও এবং কন্সট্যান্স প্রথমে বাবার চিৎকার শুনতে পায়নি। ওদের চোখ ছিল ফরাসিদের ওপরে এবং কামানের আওয়াজের কারণে ওদের শ্রবণশক্তি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। এরপরে থিও ওর চোখের কোনায় কিছু একটার নাড়াচাড়া লক্ষ করল। এতক্ষণ যাবত ও যেই উদ্বেগ-বোধ করছিল সেটা এবার রুপ নিল আতংকে।
সে কন্সট্যান্সের জামা ধরে টান দিল। "ওরা আমাদেরকে দেখে ফেলেছে। আমরা এবার খুব বড় রকমের বিপদে পড়ে যাব।"
বোমাবর্ষনের কারণে সৃষ্ট ধোঁয়া উড়তে উড়তে দেয়াল বরাবর চলে এল। থিওর দিকে যেই মানবমূর্তিগুলো দৌড়ে দৌড়ে আসছিল, তাদের চেহারা এই কুয়াশার মাঝে কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেল। কিন্তু ওরা যতই কাছাকাছি এগিয়ে আসছিল ততই থিওর চোখে ওরা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। থিও অনুভব করল এরা ওর চেনা মানুষ। এবং ওদেরকে চিনতে পেরেই সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল।
"বাবা?" এরপরে ওর দৃষ্টি স্থির হল পেছনে থাকা আরেকটি মানবমূর্তির ওপরে। "মা?"
থিওর মনে হল সে দারুণ অপরাধ করে ফেলেছে। বাবা-মা ওকে নিশ্চয়ই এবার মারাত্মক কোনো শাস্তি দেবে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই ওর সকল বোধ-বুদ্ধি হারিয়ে গেল। সে শরীর ঘুরিয়ে ভীষণ জোরে একটা দৌড় দিল। এখন আর সে মোটেও কোনও জোয়ান পুরুষ না, সে স্রেফ একজন বালক যে কিনা তার বাবা-মার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চায়। সে শুনতে পেল ওর বাবা ওকে চিৎকার করে বলছে থামার জন্য, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে কিছু একটা বলছে, কিন্তু সে ওর কানে হাত চাপা দিয়ে ওদের চিৎকারকে ব্লক করে ফেলতে চাইল। সে কামানের গোলার আওয়াজ শুনতে পেল না, অথবা আরও জোরালো আওয়াজ যেটা ওর পেছনে বজ্রধ্বনির মতো উচ্চনাদ করল।
কিন্তু ওর মায়ের চিৎকারের আওয়াজ এর সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। হয় থিও এটা শুনতে পেয়েছে, নয়তো সে স্রেফ অনুভব করল এটা যেন ওর হাড়ের ভেতরে কম্পন তুলেছে। সে প্রবৃত্তির বশে থেমে গেল। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল সে।
ওর পেছনে থাকা দেয়ালটা ততক্ষণে উধাও। এক সেকেন্ড আগেও যেই দুর্গ-প্রাচীরের ওপরে সে দাঁড়িয়েছিল সেটা একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। দেয়ালটা নিজেই নিজের ওপরে আছড়ে পড়েছে। দেয়ালটা যেখানে ছিল সেখানে একটা গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ইটগুলো জলপ্রপাতের পানির মতো করে নিচে আছড়ে পড়ছে, যেন একটা বাঁধকে খুলে দেয়া হয়েছে যাতে পানি বেরিয়ে যেতে পারে। ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে ধুলার একটা মেঘ জেগে উঠছিল। এবং এই মেঘটা চারপাশের এলাকাকে গ্রাস করে ফেলছিল।
থিও এবার পেছন দিকে দৌড় দিল, ধুলা যাতে নাকে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য জামার হাতাকে মুখের কাছে ধরে রেখেছে। গর্তের প্রান্তের কাছাকাছি গিয়ে সে থেমে গেল। আলগা ইটগুলো হড়কাতে হড়কাতে নিচে পড়ছিল এবং ওর পায়ের নিচে থাকা ইটগুলো টলোমলো করছিল। থিও বুঝতে পারছিল না, কিভাবে জাস্ট একটা কামানের গোলা এই পরিমাণ ক্ষতিসাধন করতে পারল?
"পিছিয়ে যাও।"
কিন্তু এই কণ্ঠস্বরটা এতই দুর্বল ছিল যে, থিও দেয়ালের ওপরে দাঁড়িয়ে এটা সেভাবে শুনতেই পেল না। সে বুঝতে পারছিল না এই আওয়াজটা এল কোথা থেকে। আওয়াজের উৎস খুঁজে পাওয়ার জন্য নিচে তাকাল থিও।
ওর বাবা ছিল ওর ঠিক নিচে, দেয়ালের একটা অংশকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। দেয়ালের ওই অংশটা কিভাবে যেন নিজেকে এখনও খাড়া করে রেখেছে। বাবার থেকে আরও নিচে, গর্তের তলায়, সাদা কাপড় পরিহিত একটা নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে। ভাঙ্গা পাথরকুঁচি সেই দেহটিকে চাপা দিয়ে রেখেছে, যেন একটা বাতিল খেলনা পুতুল। ওটা ছিল ভেরিটির দেহ।
"পিছিয়ে যাও," মনসুর হিসহিসিয়ে উঠল। পতনশীল ইটগুলোর কারণে ওর কয়েকটা দাঁত খসে পড়েছে এবং ইটের আঘাতে ওর মুখটা রক্তাক্ত হয়ে বিকৃত রুপ ধারণ করেছে। চেহারাটা সাদা ধুলায় আবৃত হয়ে আছে, খুবই ভৌতিক লাগছিল দেখতে। "নিজেকে বাঁচাও।"
"আমি তোমার কাছে পৌঁছাতে পারব," থিও গোঁয়ারের মতো বলল। সে দেয়ালের ওপরে বুকের ওপরে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ল এবং যতটা পারে বাবার উদ্দেশ্যে নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে দিল। মনসুর চেষ্টা করল ছেলের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরার জন্য, কিন্তু তার সামান্যতম নাড়াচাড়াতেও ইটের পিলারটি দুলে উঠছিল।
ওদের মাঝখানের ওই শূন্যস্থান দেখে প্রথমে যা মনে হয়েছিল, এটা আসলে তার চেয়েও চওড়া। এমনকি হাতটিকে পুরোপুরি প্রসারিত করে দেয়ার পরেও, থিওর আঙ্গুলের ডগা তার লক্ষ্য স্পর্শ করতে পারল না। সে নিজের শরীরকে আরেকটু সামনে ঠেলে দিয়ে বাবার কাছাকাছি হতে চাইল। ওর নিচ থেকে আলগা ইটগুলো পতিত হল। সে তখন ওর বাবার হাত থেকে ইঞ্চিখানেক দূরত্বে। কিন্তু সে অনুভব করতে পারছিল ওর শরীরের তলায় ধীরে ধীরে একটা শুন্যগর্ভ উন্মুক্ত হচ্ছে। ও যদি শরীরটা আরেকটু নাড়ায়, তাহলেই পুরো দেয়ালটা চরম শক্তি নিয়ে নিচের দিকে আছড়ে পড়বে।
"পিছিয়ে যাও," মনসুর কর্কশ কণ্ঠে বলল। সে দেয়ালের যেই ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়েছিল, তা বিপজ্জনক ভঙ্গিতে টলোমলো করছিল।
"আমি তোমাকে বাঁচাতে পারব," থিও জোর দিয়ে বলল। সে ওর হাতটা আরও সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল। ওর আঙ্গুলগুলো মনসুরের দেহকে স্পর্শ করল, কিন্তু সে ওকে আঁকড়ে ধরার মতো কোনও সুযোগ খুঁজে পেল না।
দুর্গ-প্রাচীরটি তখন মুহুর্মুহু কেঁপে কেঁপে উঠছে। থিও, শুয়ে আছে বুকের ওপরে ভর দিয়ে। অনুভব করছে যে ওর মাথার খুলির ভেতরে কম্পন উঠছে, যেন মাথার ভেতরে কেউ ঘণ্টা বাজাচ্ছে। অন্যদিকে ফরাসি সৈনিকেরাও তখন অলস বসে নেই। ওদের কামান যেই ক্ষতিসাধন করেছে সেটা ওদের চোখে পড়েছে। এবার ওরা ওদের সবকয়টা কামানের মুখ ওই দুর্গ-প্রাচীরের ওপরে তাক করল। আরেকটা কামানের গোলা ওই দেয়াল বরাবর জোরালোভাবে নিক্ষিপ্ত হল। আরও বেশ কিছু ইট অস্থির ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেয়ালের কাঠামো থেকে আলগা হয়ে গেল এবং সেই নড়বড়ে দেয়াল যেটা মনসুর শক্ত করে ধরে রেখেছিল নিজেকে বাঁচানোর জন্য, সেটাতে ফাটল ধরে ধ্বসে পড়তে শুরু করল।
সকল বিচার-বুদ্ধি এবং নিজের নিরাপত্তার চিন্তা ভুলে গিয়ে থিও সম্মুখদিকে ঝাঁপ দিল। কিন্তু ততক্ষণে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। মনসুর ইতোমধ্যে দেয়াল থেকে পড়ে গিয়েছে। থিওর কাছ থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যাচ্ছে সে। থিও ওর হাতটিকে আরও সামনের দিকে বাড়িয়ে দিতে চাইল, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হল না। মনসুর ওর মুখ দিয়ে কিছু একটা উচ্চারণ করল, যদিও থিও সেটা বুঝতে পারল না। ওর কাছে মনে হল বাবা হয়তোবা "কন্সট্যান্স" কথাটা উচ্চারণ করেছে।
থিও ওর আঙ্গুলের ডগায় বাবার আঙ্গুলের সামান্য স্পর্শ অনুভব করল... কিন্তু এরপরে আর কিছুই না। মনসুর পতিত হল ধুলা এবং ধোঁয়ার মেঘের ভেতরে। এরপরে ওই ধুলা এবং ধোঁয়ার মেঘের মাঝে হারিয়ে গেল।
থিওর তখন আর কিছুই করার ছিল না। কিভাবে সে বাবাকে অনুসরণ করবে। কামানের গোলার কারণে দুর্গ-প্রাচীরটি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, যেটার ওপরে এতক্ষণ সে বুকে ভর দিয়ে শুয়েছিল। এবং একটু আগে যে সে সম্মুখ দিকে ঝাঁপ দিয়েছিল, সেটা ওকে খুব বিপজ্জনক একটা পজিশনে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও থিও বিপদের কোনও পরোয়া করছিল না। সে এমন দুজন মানুষকে হারিয়েছে যাদেরকে সে এই দুনিয়ার মধ্যে সবচে বেশি ভালবাসত। এখন এই দুনিয়ায় ওর জন্য আর কিছুই বাকি নেই। ওর স্বরণে এল শেষ শব্দটা যা ওর বাবার রক্তাক্ত ঠোঁটে ধ্বনিত হয়েছিল। কন্সট্যান্স। যদি সে এখনই মারা যায়, তাহলে ওই মেয়েটা এই দুনিয়ায় একদম একলা হয়ে যাবে। ওর বাবার মৃত্যুকালীন চাওয়া ছিল কন্সট্যান্সকে রক্ষা করা। থিও ওর বাবার শেষ ইচ্ছাটিকে যেভাবেই হোক রক্ষা করবে।
মনের মাঝে থাকা ওর চিন্তাগুলো ওকে ক্রমাগত জ্বলাতন করতে লাগল। অপরাধবোধ এবং প্রবল হতাশা গ্রাস করে ফেলল ওকে।
থিও দেখল, হঠাৎ করেই ওর পতন থেমে গেছে। এক সেকেন্ডের জন্য, ওর কাছে মনে হল ও যেন মাঝ-আকাশে ঝুলছে।
সে চারপাশে তাকাল, দেখল লালচে-চেহারার একজন সার্জেন্ট স্থির চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে, তার একটা হাত দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে থিওর বেল্টটিকে।
ওই সার্জেন্ট থিওর বেল্ট ধরে ওকে তুলে দুর্গ-প্রাচীরের ওপরে শুইয়ে দিল। থিওর কাছে তখন ওর শরীরের তলায় থাকা ভূমিটিকে খুব ভারী এবং শক্ত বলে মনে হচ্ছিল। সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই, কন্সট্যান্স দৌড়ে ওর কাছে এল এবং থিওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। থিওর মাথাটাকে নিজের বুকের কাছে এনে আশ্রয় দিল সে। "আমি ভেবেছিলাম তুই বুঝি হারিয়ে গেছিস," মেয়েটি বলল। "আমি ভেবেছিলাম আমরা বুঝি হারিয়ে গেছি।"
আরও বেশকিছু সৈনিক ঘটনাস্থলে পৌঁছাল। সার্জেন্ট চিৎকার করতে থাকল, সবাইকে বলছে যে ওদের অবশ্যই নিরাপদ কোথাও সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু এই চিৎকার-চেঁচামেচি থিও এবং কন্সট্যান্সকে স্পর্শ করল না। ওরা যেন তখন তীব্র শোকে পরিপূর্ন আলাদা একটা জগতে বিরাজ করছে। থিও কান্না করছিল। থিওর কাছে মনে হল, এমন মেয়েলি আচরণ করা ওর উচিত হচ্ছে না। কিন্তু ওর বাবা-মা ওকে ছেড়ে দুনিয়া থেকে চলে গেছে। সে এত প্রবলভাবে হতাশা অনুভব করছিল যে এটা ওর হৃদয়কে চূর্ন-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল।
যখন সে কন্সট্যান্সকে বলল যে কী ঘটেছিল, মেয়েটি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। ওকে স্বান্তনা দেয়া থিওর পক্ষে অসম্ভব। থিও ওকে শক্ত করে ধরে রাখল, এমনভাবে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে ওকে ঠাণ্ডা করতে চাইছিল যেন ও একটা শিশু। ওদের দুনিয়াটা হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয়ে গেছে। একদম এক মুহুর্তের মধ্যে একটা সাজানো গোছানো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আশা এবং স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ, ভালোবাসার মানুষেরা ইটের তলায় নিষ্পিষ্ট। এটাই হচ্ছে যুদ্ধের নিষ্ঠুর, নির্মম বাস্তবতা। থিও বুঝতে পারল ওদের জীবনটা এবার অনিশ্চিত হয়ে গেছে। কিভাবে সে নিজের জীবনকে পুনর্নির্মাণ করবে।
"এটা আমার ভুলের কারণে হয়েছে," কন্সট্যান্স ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। "আমাদের উচিত ছিল বাসাতেই থাকা। আমি যদি তোকে নিয়ে এখানে না আসতাম..."
থিও ওর বোনের কব্জিটা শক্ত করে ধরল। "ওই কথা বলবি না। আমরা দুজনেই এখানে এসেছিলাম। আমরা দুজনেই সমানভাবে দোষী। আমি তোকে এই দোষ একলা নিজের ঘাড়ে নিতে দেব না।"
কন্সট্যান্স ওর চোখের ওপরে আছড়ে পড়া এক গোছা চুল সরিয়ে দিয়ে নিজের গাল থেকে কান্নার জল মুছল। "ধন্যবাদ। এখন থেকে আমাদের উচিত একজন আরেকজনকে দেখে রাখা।" এই কথা বলেই কন্সট্যান্স আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতে শুরু করল।
ওরা দুজনেই বুঝতে পারছিল, বাবা-মা ওদেরকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় ওরা দুজনেই গভীর একটা গর্তে পতিত হয়েছে, এখন থেকে ওদেরকে একত্রে থাকতে হবে। "আমাকে প্রমিজ কর, কনি। প্রমিজ কর, যা-ই ঘটুক না কেন, তুই কখনই আমাকে ছেড়ে যাবি না।"
"আমি প্রমিজ করলাম।"
"কখনও যাবি না?"
"কখনও যাব না। আমি প্রমিজ করলাম।"
নিচে, সিপাহীদের একটা দল ততক্ষণে তাদের উদ্ধার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তারা ধ্বংসস্তূপের মাঝে পড়ে থাকা মনসুর এবং ভেরিটির প্রাণহীন দেহ পুনরুদ্ধার করছে।

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের প্রথম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/photo.php?fbid=2985829594796406&id=100001081832019&set=a.422627021116689&source=56

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের তৃতীয় পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3211705148875515&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3211705148875515:top_level_post_id.3211705148875515:tl_objid.3211705148875515:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3211705148875515:photo_id.3211705005542196:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:5167009495212656913&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের চতুর্থ পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3213814051997958&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3213814051997958:top_level_post_id.3213814051997958:tl_objid.3213814051997958:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3213814051997958:photo_id.3213813895331307:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:2041402156577410201&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের পঞ্চম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3220982584614438&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3220982584614438:top_level_post_id.3220982584614438:tl_objid.3220982584614438:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3220982584614438:photo_id.3220982351281128:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:-6887371295566324405&__tn__=*s-R

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১২:০৬

রাজীব নুর বলেছেন: ১ম পর্ব থেকেই আমি সাথে আছি।
এপর্বে বেশ কিছু বানান এডিট করে ঠিক করে নিবেন।

২| ২২ শে জুন, ২০২০ দুপুর ২:৩৭

নেওয়াজ আলি বলেছেন: সুলিখিত ,সুবচন লেখা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.