নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পদ্মাপাড়ের ছেলে। বাড়ি বিক্রমপুর। ছোট গল্প লেখার আনন্দে ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করি!

এ এস রিপন

ছোটগল্প লেখার আনন্দে ছোটগল্প লিখে যাওয়া........

এ এস রিপন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নদী (ছোট গল্প)

১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৮

সকাল থেকেই মতি মিয়া খক খক করে কাশছে। অন্যদিনের চেয়ে আজ কাশির তোড়টা বেশি। কাশের ফাঁকে ফাঁকে তার একমাত্র ছেলেকে ডাকছে।
মধু......ও মধু.....
মধু কোন সাড়াশব্দ করল না। বিছানায় ঝিম মেরে পরে রইল।
খেয়াঘাটে যা বাজান। সূর্য উঠছে। লোকজন আইব।
আসুক। আমি খেয়া বাইতে পারুম না।
মধু কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাশফিরে শুইল।
সাত পুরুষের পেশা। এইটা ছাড়া কী করবি?
মধু কাঁথার ভেতর থেকেই বলল, আমি অন্য কাজ করুম।
যখন পাবি, তখন করিস। এখন উঠ বাজান। লোকজন পারাপার করা ছোয়াবের কাজ।
মধু গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইল। তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। সকালবেলা তার ঘুমটা গাঢ় হয়। এই সময়ে একটু আরাম করে ঘুমাবে! না, সকাল হলেই বৈঠা নিয়ে দৌড়াও। সে সারাদিন খাটতে রাজি। কিন্তু সকালবেলা তার ঘুম চাই।
মা হোসনে আরা বেগম এসে ছেলের ঘরে ঢুকলেন। তীক্ষ্ম কন্ঠে ডাকলেন, মধু...মধু...
মা ডাকাডাকি কইরো না তো! এখন উঠতে পারুম না।
অ্যা, উঠতে পারুম না। নবাবজাদা! উঠ তাড়াতাড়ি। সংসারে দ্ইুডা পয়সা আইবো সেই চিন্তা নাই!
মধু উঠে পড়ল। আর শুয়ে থাকা যায় না। মা কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকব।
কিছুক্ষনের মধ্যে সে বৈঠা হাতে খেয়া ঘাটের দিকে রওনা হল। নদীর কাছাকাছি আসতেই মিষ্টি হাওয়া গায়ে লাগল। তার মন থেকে বিরক্তিভাব উধাও হয়ে গেল। ভাটা চলছে। পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। তাদের ছোট নৌকাটা ডাঙ্গায় উঠে আছে। সে কাঁদা ঠেলে ওটা পানিতে নামাল। তারপর উঠে বসল।
শীত আসি আসি করছে। এই সময় নদীতে পানি থাকে কম। নৌকা চালাতে কোন কষ্ট হয় না। তীরে লগি দিয়ে জোরে একটা থাক্কা দিলেই হল। এক ধাক্কায় ওপাড়। ওপাড় মানে পাশের গ্রাম। নাম সূবর্ণগ্রাম। ধনীলোকজনের বসবাস। তাই জিনিসপত্রের দামও চড়া। সূবর্ণগ্রামের ব্যবসায়ীরা তাদের গ্রামে আসে। সস্তায় ধান,পাট,কলা, শাকশব্জি কিনে। ওপাড়ে নিয়ে বেশিদামে বেঁচে। কাকডাকা ভোরেই লোকজন আসা শুরু করে। সবার আগে আসে হারুন ব্যাপারী। সূবর্ণগ্রামের বাজারে তার তিনটা দোকান। নৌকায় উঠে তিনি হাক দেন,
কিরে মতির পোয়া, খবর কী তোর?
জি চাচা ভালো।
মতি মিয়ার শরীর এখন কেমুন? যক্ষা কমছে?
জি-না। একদিন ভালো থাকলে আরেকদিন খারাপ থাকে। হোমিওপ্যাথি চলতাছে...
হোমিওপ্যাথি-টোমিওপ্যাথিতে কাজ হইবো না। ঢাকায় নিয়া ভালো ডাক্তার দেখা।
কয়েকবারই তো দেখাইছি। কাজ হয় না।
ডাক্তার এনামুল হককে একবার দেখা। তাকে দেখলে রোগ অর্ধেক পালায়। বাকী অর্ধেক পালায় ওষুধে।

মধু নৌকার মাঝখানের বসার গদিটা ঠিকঠাক করল। সূবর্ণগ্রামের বিশিষ্ট লোকজন পারাপারের সময় এই গদিতে বসে। বসে বসে নানা বিষয়ে গল্প করে।
কার ছেলে পানিতে ডুবে মরল, কার মেয়ে কোন ছেলের সাথে ভেগে গেল, কার বউ গোপনে কোন লোকের সাথে দেখা করে, কোন ব্যাপারী এইবার ব্যবসায় ধরা খেল, চেয়াম্যান সাহেব এইবার সব গম বিতরণ করেছে, না করে নাই কিংবা নতুন পুল বানাতে এইবার কত টাকা মারল, হাজী সাহেব ছেলেকে বিয়ে করাতে গিয়ে নিজে বিয়ে করে এলেন- কত কাহিনী! তার বয়স এখন আঠার। গত দুই বছর ধরে সে খেয়া পারাপার করছে।এই দু’বছরে সে কত মানুষের কাহিনী যে শুনেছে! হয়তো মানুষটিকে চোখেও দেখেনি কিন্তু তার গল্প জানে। বর্ষাকালে চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। পার হতে সময় লাগে। গল্পও জমে উঠে।

মধু নৌকা নিয়ে সূবর্ণগ্রামে পৌঁছল। তীরে মৌলানা ইদরিস আলী দাড়িয়ে আছেন। তিনি তাদের গ্রামে এসে স্কুলে পড়ান। মধুর ধারণা-তিনি সূবর্ণগ্রামে কোনো সুবিধা করতে পারেননি বলে তাদের গ্রামে এসে পড়ান। ইদরিস আলী নৌকায় উঠে ভ্রু-কুঁচকে গদির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মধু গদির কাভার ধোস না কতদিন?
হুজুর গত জুম্মায় ধুইছি।
প্রতিদিন ধুবি। এই গদিতে বসলে জামা-কাপড়ের ইজ্জত থাকব? একদিনেই কুচকুচে কালো। দুই টাকার খেয়া পার হতে গিয়ে পরে দশ টাকার সাবান খরচ!
মৌলানা তার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী কোমড় পর্যন্ত উঠিয়ে আলগোছে বসলেন। মধু বৈঠা হাতে বসে রইল। আরও যাত্রী না এলে নৌকা ছাড়া যাবে না। যাত্রী আসছে না কেন-কে জানে! সূর্য উঠছে অনেক আগেই । দেখতে দেখতে আরও দু’জন যাত্রী চলে এলো। গরীব কিসিমের যাত্রী। এরা গদিতে বসে না। নৌকার দু’পাশে রেলিংয়ের উপর বসে।
মৌলানা সাহেব উঁচু গলায় বললেন, মধু নৌকা ছাড়।
মধু নৌকা ছাড়তে যাবে-এমন সময় চৌদ্দ-পনের বছরের এক মেয়ে ঝুড়ি নিয়ে দৌড়ে নৌকায় উঠল। কালো চেহারা। বেশ কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করেছে মেয়েটি সূবর্ণগ্রাম থেকে এসে তাদের গ্রামে গোবর কুড়ায়। বিকেলের দিকে ফিরে যায়।
মধু নৌকা ছেড়ে দিল। মৌলানা সাহেব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। আশেপাশে বিশিষ্টি লোকজন না থাকলে বা মহিলা যাত্রী না থাকলে তিনি খুব একটা কথা বলেন না। একবার আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকালেন। মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মৌলানা সাহেব গলাখাকারী দিয়ে বললেন, এই মেয়ে তোর বাড়ি কোথায়?
সূবর্ণগ্রাম।
সূবর্ণগ্রাম তো বুজলাম। কার মেয়ে?
বশির খাঁর।
কোন বশির খাঁ? ঢাকায় ট্রাক চালাতে গিয়ে যে মরেছে-
জে।
ঐ গ্রামে কি?
গোবর কুড়াতে যাই।
সূবর্ণ গ্রামে গোবর নাই?
আছে, তয় কম।
এত গোবর দিয়ে করিস কি?
লাকড়ি বানাই।
বেঁচার জন্য?
মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
বাড়িতে আর কে কে আছে?
মা।
ভাই-বোন নাই?
না।
মৌলানা সাহেব আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন পাড়ের দিকে। তাদের গ্রামের পাড়ে কয়েকটি মেয়ে এসে দাড়িয়েছে। প্রত্যেকে ফুটফুটে সুন্দরী। হাতে বই-খাতা। এরা সূবর্ণগ্রামের কলেজে পড়ে।

নৌকা থামতেই মৌলানা সাহেব সবার আগে নেমে পড়লেন। ভ্রু কুঁচকে মেয়েদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। মধু লক্ষ্য করেছে-মৌলানা সাহেব কলেজের মেয়েগুলোকে দুর থেকেই মনোযোগ দিয়ে দেখেন। কাছ দিয়ে যাবার সময় ফিরেও তাকান না।

সবার শেষে নামল কালো মেয়েটি। কালো হলেও মেয়েটির মধ্যে অন্যরকম ঝিলিক আছে। মধু তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি গ্রামে ঢুকল না। নদীর পাড় ধরে হাটছে। নদীর পাড়ে প্রচুর গরু চড়ে। হয়তো সেখানে গোবর বেশি। মেয়েটি গোবর কুড়ায়। মধু নৌকা চালাতে চালাতে ওর গোবর কুড়ানো দেখে।

রোজ রোজ। ঝড়-বৃষ্টি, রোদ কোন কিছুই মেয়েটিকে আটকে রাখতে পারে না। ঠিক ঠিক চলে আসে। কখনো কখনো মেয়েটি হাসতে হাসতে নদীর ধার দিয়ে ছুটে। পেছনে পেছনে ছুটে আসে কোনো রাখাল ছেলে। হয়তো তারা হাসি-তামাশা করছে। যেহেতু গোবর কুড়ায়, তাই হয়তো ও রাখালদের সাথে সদভাব রেখে চলে। তার সাথেও সদভাব হয়েছে। প্রতিদিন খেয়াপাড়ের কারণেই হয়েছে। নৌকায় উঠলেই সে মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করে-
কিরে আজ কোন দিকে কুড়াবি? উত্তরপাড় না দক্ষিনপাড়?
মেয়েটি বিরক্ত মুখে বলে-একদিকে কুড়ালেই হইল। প্রতিদিন আপনের কাছে কৈইফত দিতে হইব?
হইব না? গেরামের সব গোবর নিয়ে সাফা করতাসছ। গেরাম তো শশ্মান বানায় ফেলবি।
ইস্ কত দরদ! আপনাগো গেরাম এমনেই শশ্মান।
তোর কারনে হইতাছে। ক্ষেত খামার অনুর্বর হইতাছে।
আপনে ক্ষেত-খামারে গোবর দেন? চালান তো নৌকা...
নৌকা চালাই বইলা তুই আসতে পারস।
আমি সাঁতার দিয়াও আসতে পারি। আপনের নৌকা লাগব না।
সাঁতার দিয়া আসা কি দরকার? আমাগো গ্রামে একটা বিয়া করে থাইক্কা যা।
দুর মাঝির বাচ্চা মাঝি!
দুর গোবরওয়ালী!

মেয়েটি রেগে গেলে তাকে ‘মাঝির বাচ্চা মাঝি’ বলে। সেও মেয়েটিকে রাগানোর জন্য ‘গোবরওয়ালী’ বলে। তার আসল নাম আকাশি। দিন দিন আকাশি তার মনটাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলল, খেয়াঘাটে এলেই মনে হতো মেয়েটি তার আশে-পাশে আছে। তার নৌকা চালানো দেখছে। ভোর না হতেই সে এখন খেয়াঘাটে চলে আসে। দেরি হলে অস্থির অস্থির লাগে। নৌকা চালাতে চালাতে আকাশির ছোটাছুটি দেখে। প্রখর রোদে তার ঘর্মাক্তমুখ চিক চিক করে। তার দেখতে বড় ভালো লাগে। আকাশি ঝুড়ি ভর্তি গোবর নিয়ে যখন ফিরে, তখন দুপুর গড়িয়ে যায়। এই সময়ে যাত্রী থাকে না।। মধু উৎফুল্ল গলায় কথা বলে।

কিরে শুধু গোবর কুড়ালে হইব?
কি করমু?
লাকড়ি বেঁচে কত পাস?
পাই ভালোই।
আমার কাছে লাকড়ি বেঁচবি?
আপনে লাকড়ি দিয়া কি করতেন?
আমাগো গেরামে বেঁচমু।
আকাশি ফিক করে হাসে।
আপনাগো গেরামে কেউ লাকড়ি কিনব? শুকনা পাতা দিয়া রাইন্ধা কুল পায় না!
আমাগো গেরামরে এত ছোট ভাবিস ক্যা? আমাগো গেরামের মানুষ ভালো।
হ, কত ভালো বুঝতাছি! গোবর পইড়া থাইক্কা শুকায় যায়। কুড়াতে গেলে টেকা চায়।
কে চায়?
রাখালরা।
তোর সাথে মস্করা করে।
আকাশি মুখ কালো করে ফোঁস করে বলে- হ, সবাই আমার সাথে মস্করা করে!
আকাশির রাগী মুখ দেখতে তার ভালো লাগে। ও হাসলেও ভালো লাগে। সাদা দাঁত চকচক করে। মুখ কালো বলে দাঁতগুলো বেশি সাদা দেখায়।
মধু বলল, গোবর কুড়ানো বাদ দে। আমার সাথে বইসা খেয়া পার কর।
আমার লাভ? আপনে আমারে টেকা দিবেন?
সব টেকাই তোরে দিমু। শুধু আমার বউ হ।
আকাশি লজ্জায় লাল হয়ে বলল, দুর মাঝির বাচ্চা মাঝি!

মধু আনন্দে হাসে। চঞ্চল তেজি একটা মেয়ে! কী যে আকর্ষন ওর মধ্যে! গোবর কুড়ায় বলে শরীরে এখানে-সেখানে গোবর লেগে থাকে। কিন্তু ও যখন ক্লান্ত হয়ে নৌকায় উঠে, মনে হয়-গোবরের মধ্যে তাজা একটি পদ্মফুল ফুটে আছে।

দুই

সকাল থেকে মধু খেয়াপার করছে। কিন্তু মনটা বিষন্ন। আকাশি আজ আসে নেই। নৌকায় কত মানুষ! তবুও নিজেকে একা একা লাগছে। দুপুরের দিকে খেয়াপার হতে একদল বরযাত্রী এলো। রাখালপাড়ার এক রাখাল বর সেজে সূবর্ণগ্রামে যাচ্ছে। বিয়ে করবে। মধু তেমন আগ্রহ দেখাল না। এরকম প্রায়ই যায়। বিকেলের দিকে বরযাত্রী ফিরে এলো। সাথে নববধু।
নৌকায় উঠতেই তীব্র বাতাস শুরু হল। হয়তো ঝড় আসবে। এই ঝড়ই শীত নামাবে। মধু নৌকা ছেড়ে দিল। মাঝ নদীতে আসতেই হঠাৎ এক দমকা হাওয়া নববধুর ঘোমটা উড়িয়ে নিল। মুহুর্তে মধুর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল! ঘোমটা পড়ে বসে আছে-গোবরওয়ালী!! মধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল! তার হাত থেকে বৈঠা পড়ে গেছে।

তিন

প্রকৃতির নিয়মে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যায়। ভোরে উঠে আবার জ্বলজ্বল করতে থাকে। কিন্তু মানুষ সূর্যের মতো না। তীব্র থাক্কা সামলে সেও উঠে দাড়ায়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কাজ করে। কিন্তু সূর্যের মতো আর জ্বলজ্বল করতে পারে না। তার সমস্ত উজ্জ্বলতা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

মধু প্রতিদিন ভোরে উঠে। নদীতে গিয়ে খেয়াপার করে। নদীর উথাল-পাতাল হাওয়ায় তার চুল উড়ে। তবুও তার দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। ভর দুপুরে নদীর পাড়ের বালু চিকমিক করে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ জ্বলসে উঠে। হঠাৎ মনে হয় বালুর উপর দিয়ে গোবরওয়ালী ছুটছে। তার মুখ হাসি হাসি। ঘামে চিক চিক করছে।

মধু ভাবে-মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে বলে সে এই দৃশ্য দেখে। সে আর মাঠের দিকে তাকাবে না। পানির দিকে তাকিয়ে থাকবে। পানির দিকে তাকিয়ে সে একটানা বৈঠা বায়। আবার সে চমকে উঠে। পানির মধ্যে গোবরওয়ালীর মুখটা ধীরে ধীরে কাঁপছে। মনে হচ্ছে সে খিল খিল হাসিতে ফেটে পড়ছে। কালো মূর্তির মতো কমনীয় মুখ। তার বুক হাহাকার করে!

ঐ তো রাখালপাড়া! এক দৌড়ে সে গোবরওয়ালীকে দেখে আসতে পারে। কিন্তু সে যায় না। গিয়ে আর কী হবে? না পাওয়ার হাহাকার কী কমবে?
তার হাহাকার প্রকৃতির কাছে পৌঁছল কিনা কে জানে? বিয়ের ছ’মাসের মাথায় খবর এলো-রাখালকে সাপে কেটেছে। গরু চড়াতে গিয়ে সাপের ছোবল খায়। সদর হাসপাতালে নিতে নিতে মৃত্যু।

গোবরওয়ালী একদিন আবার তার নৌকায় উঠল। থমথমে পাথরের মতো মুখ। ছোট নদী পাড়ি দিয়ে সে তাদের গ্রামে এসেছিল। এখন ফিরে যাচ্ছে একা! সামনে বিশাল পথ। একা একা কিভাবে পাড়ি দিবে?
বেশ কিছুদিন পর মধু একদিন আকাশির বাড়িতে গেল। ওদের মাটির ঘর। উঠানে বসে আকাশি আনমনে গোবরমাখানো কাঠিগুলো শুকাচ্ছে। ছোট কোমল মুখটা কী শক্তই না হয়ে আছে! পুরো বাড়ি ভুতুড়ে ভুতুড়ে! লোকালয় থেকে দুরে হওয়ার কারনে এরকম মনে হতে পারে।
মধুকে দেখে আকাশি তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। পরক্ষনেই চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইল।
মধু বলল, আকাশি ভালো আছিস?
আকাশি কোন উত্তর দিল না। মধু বলল, তোর কথা শুইনা আমার খুব খারাপ লেগেছে। ভাগ্যকে মাইন্না নে। আল্লাহ যা করেন...
আকাশি ফোঁস করে উঠল।
আপনে আমার দূর্দশা দেইখা মস্করা করতে আসছেন?
আমি তোরে নিয়ে কোন কালেই মস্করা করি নাই। এখন তো আরও না।
তয় কি জন্য আসছেন?
মধু ইতস্ততঃ করে বলল, নতুন কইরা আবার চিন্তা-ভাবনা কর। জীবন মাত্র শুরু ....
আকাশি রাগী গলায় বলল, আমার মনে এত রঙ নাই! আপনে যান।

মধু চলে এল। যে রাখালকে সে বিয়ে করেছিল-তাকে ভালোবেসেই করেছিল। হঠাৎ মানুষটি চলে গেল! এই শোক কী সহজে ভুলা যায়?

মধু আগের মতোই আকাশিকে নিয়ে ভাবে।

‘মধ্য দুপুর। মাঝ নদীতে তার নৌকা একটু একটু দুলছে। নৌকায় কেউ নেই। শুধু সে আর আকাশী। কিছু গাং চিল চক্রাকারে তাদের মাথার উপর উড়ছে।
আকাশী গাং চিলগুলো কি বলছে জানস?
কি?
মধুর আকাশে কে আছে? আকাশী! আকাশী!
দূর বোকা মাঝি!

একদিন আকাশি বলল, আপনে আমার পেছনে ঘুরঘুর করেন ক্যান? আমার সব কথা জানলে আপনে আমারে থু দিয়ে চইলা যাবেন।
তোর সব কথা আমি জানি। আমি চইলা যাব না।
কী করবেন? আমারে বিয়ে করবেন? মাইনষে নানা কথা বলব।
বলুক। মাইনষের কথায় আমি ভয় পাই না।
আপনি এখন যান।
খালি বলে যান যান। তোর আপত্তি কেন?
আমি একলা থাকতে চাই।
একা থাকা যায় না। একজন সঙ্গী লাগে।
আমি একা না। আমার সঙ্গী আসতাছে...
মধু কিছু না বুঝে হা করে তাকিয়ে রইল। আকাশি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।

মধু এই কথার অর্থ পরে বুঝেছিল। আকাশি অন্তঃসত্ত্বা। তাতে ওর প্রতি মধুর আগ্রহ তো কমল না, বরং বাড়ল। অন্তর দিয়ে কোন মেয়েকে চাইলে তা মেয়েটি বুঝতে পারে। আকাশিও হয়তো বুঝল।

একদিন কোমল গলায় বলল, আপনে একজন ভালো মানুষ। আপনেরে পাওয়া আমার ভাগ্য! কিন্তু...
কিন্তু কি?
এখন তো বিয়ে করা যাইব না। বাবু আসছে...

সিদ্ধান্ত হল বাবু আসার পর বিয়ে হবে। মধু আবার ফুরফুরে হয়ে উঠল। নদী, খেয়া, বাতাস, যাত্রীদের কোলাহল, গাছপালা-সবকিছুই যেন ঝলমল করছে। আহ, চারদিকে কী আনন্দ! আনন্দে সে নিজের অজান্তে গান গেয়ে উঠে-

‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে
আমি আর বৈতে পারলাম না।
সারা জীবন উজান বাইলাম,
ভাটির নাগাল পাইলাম না’।

একদিন তার ডাক এল। আকাশির অবস্থা খুব খারাপ। সে খেয়া ফেলেই দৌড় দিল। উঠান ভর্তি মানুষ। মধু কারও অনুমতি না নিয়ে আকাশির ঘরে ঢুকে পড়ল। সে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। তার কন্যা সন্তানটি চিৎকার করছে। হয়তো পৃথিবীকে তার আগমন বার্তা জানাচ্ছে। আকাশির পাশে তার মা এবং দাইমা হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। সে ঢুকতেই তারা উঠে গেল। আকাশি ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকাল। মধু ওর মাথার কাছে গিয়ে বসল।
এখন কেমুন লাগছে?
আকাশি ম্লান হেসে বলল, আমার মেয়েটিরে দেখ। ওর একটা নাম ঠিক করেছি- নদী। আমি না থাকলে তুমি ওকে দেখবা।

আকাশি এই প্রথম তাকে তুমি করে বলল।

মধু হড়বড় করে বলল, তোর কিচ্ছু হবে না। আমি রাসু কবিরাজকে নিয়ে আসতেছি। সে ছুটে গেল। যখন ফিরে এল তখন সব শেষ! উঠান ভর্তি লোকজন একেক কথা বলছে-
অল্প বয়সে বিয়া!
অল্প বয়সে মা হইছে!
অল্প বয়সে সোয়ামী মরল!
ছোট্র শইলে এত যন্ত্রনা সহ্য হয়?

মধুর মনে কোন যুক্তি-তর্ক এল না। সে চোখে শুধু একটা দৃশ্যই দেখছে- তীব্র বাতাসে নদীর পাড় ধরে তার গোবরওয়ালী ছুটছে! ক্ষনে ক্ষনে তার ঘমাক্ত মুখ ঝিলিক দিয়ে উঠছে!














মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: শেষটা দারুন ঝটকা দিল|
নদীর পারের জীবন সম্পর্কে ধারনা ছিল না আমার| গত কয়েকমাস আগে ব্রহ্মপুত্রের এক চরে কাটিয়েছি কয়েক সপ্তাহ| দেখেছি তাদের জীবন| নদী যে কতটা জড়িত জীবনের সাথে জানা যায় না ওদের সাথে না থাকলে| ওখানে থাকাকালীন প্রতিদিন সকালবিকাল নদী পার হতাম| খেয়ায়| কখনও ইন্জিনচালিত নৌকায়| সেসব কথা মনে পরে গেল|
গল্প ভাল লেগেছে

২| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:১৪

এ এস রিপন বলেছেন: নদী আসলেই গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনে একান্তভাবে জড়িত! পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.