![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লেখার আনন্দে ছোটগল্প লিখে যাওয়া........
আজ লালুর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা! ইসহাক মিয়া পরম যত্মে লালুর শরীরে তেল মাখাচ্ছে। কৌতুহলী লোকজন তার বাড়ির উঠানে ভিড় করেছে। সবাই মুগ্ধচোখে লালুর প্রস্তুতি দেখছে। লালু রাজকীয় ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। ইসহাক মিয়া প্রথমে লালুকে ভালো করে গোসল করাল। তারপর খড়, ভূষি খাওয়াল। এরপর কাচের বোতল ভেঙ্গে ভাঙ্গা কাচ দিয়ে লালুর শিং চেছে ধারাল করল। সবশেষে শিংয়ের মাথায় কাচামরিচ ভেঙ্গে ডলে দিল।
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন চেচিয়ে বলল, ইসহাক মিয়া, তোমার ষাড়কে বাংলা মদ খাইয়ে দাও। দেখবে-সে মরা পর্যন্ত লড়াই করবে।
ইসহাক মিয়া মনে মনে আঘাত পেল। সে উঁচু গলায় বলল, লালুর মদ লাগে না। সে এমনিতেই জিতবে। আজ পর্যন্ত কোনো লড়াইয়ে সে হারেনি। ইনশাআল্লাহ আজও হারবে না।
লালু গো করে একটা শব্দ করল। হয়তো সে তার মনিবের গর্ব বুঝতে পারছে। গত সাত বছর ধরে সে লড়াই করছে। একবারও হারেনি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে সে যখন রক্তাক্ত শরীরে উঠে দাড়ায়, ইছাপুর গ্রামবাসী আনন্দে চিৎকার করতে থাকে- লালু! লালু!! লালু!!!
ইসহাক মিয়ার বুক গর্বে ভরে উঠে। সেই দিনের বাছুর। আজ দুর্দান্ত ফাইটার। আজ ফাইট দিবে খালেক ব্যাপারীর কালা পাহাড়ের সাথে।
বিকেল চারটা বাজার আগেই স্কুলমাঠ লোকে কানায় কানায় ভরে গেল। তারপরও দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসছে। মাঠের একপাশে সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে। গ্রামের বিশিষ্ঠ লোকজন বসবে। ইতোমধ্যে চাঁন মিয়া মেম্বার, ইছাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, হোসেন ডাক্তার, আলম সওদাগর চলে এসেছেন এবং প্রথম সারিতে বসেছেন।
একজন ঘোষক মাইকের সামনে দাড়িয়ে বলছে- হ্যালো, হ্যালো, মাইক্রোফোন টেষ্টিং। ওয়ান, টু, থ্রী...
প্রিয় গ্রামবাসী, কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে- আপনাদের প্রানপ্রিয় খেলা ষাড়ের লড়াই। কালা পাহাড় বনাম লালু।
এই সময়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে তার দলবল নিয়ে আসতে দেখা গেল।
ঘোষক চিৎকার করে বলতে শুরু করল- আমাদের মাঝে এখন এসে উপস্থিত হয়েছেন অত্র গ্রামের মহামান্য চেয়ারম্যান, গ্রামবাসীর অকৃত্রিম বন্ধু, জনদরদী-আমাদের প্রানপ্রিয় নেতা জনাব আমির আলী।
চেয়ারম্যান সাহেব হাসিমুখে সামিয়ানার নিচে ঢুকলেন। শুরু হল-হ্যান্ডশেকের পালা। সবাই চুপ হয়ে বসতেই চেয়ারম্যান সাহেবকে খেলা উদ্বোধন করতে বলা হল।
চেয়ারম্যান সাহেব মাইকের সামনে এসে দাড়ালেন।
প্রিয় গ্রামবাসী, আসসালামালাইকুম।
ইছাপুরগ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী খেলা ষাড়ের লড়াই। বাংলাদেশের গ্রামগুলো যখন রাজনৈতিক হানাহানিতে মত্ত, রাতের আধারে একপক্ষ আরেক পক্ষের ধান কেটে নিচ্ছে, পুকুরে বিষ প্রয়োগে নিরীহ মাছ হত্যা করছে আমরা বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গ্রামে এইসব হানাহানি বন্ধ করেছি। ধরে রেখেছি নির্মল বিনোদন- ষাড়ের লড়াই। আপনারা উপভোগ করুন আজকের ষাড়ের লড়াই।
তুমুল করতালি শুরু হল। ইসহাক মিয়া লালুকে নিয়ে মাঠে ঢুকল। মাঠভর্তি লোকজন লালুকে দেখছে। এক একজন একেক প্রশ্ন করছে।
ইসহাক মিয়া, তোমার লালু পারব তো। খালেক ব্যাপারী এইবার একখান জিনিস কিনছে। হাঁটলে মনে হয়-জীবন্ত পাহাড় হাঁটতাছে...
ইসহাক মিয়া কোন জবাব দিল না। লড়াইয়ের মাঠে ঢুকলে সে উত্তেজনায় কথা বলতে পারে না। লালু নির্বিকার। ওর নির্বিকার ভঙ্গি দেখলে সে ভরসা পায়।
ঘোষক উৎফুল্ল গলায় বলছে- আজকের লড়াইয়ে যে জিতবে, তার মালিক পাবেন, হ্যা ভাই অনুমান করেন তো কত টাকা? দশ হাজার, বিশ হাজার। না...না...। পাঁচ দশে পন-পন-পঞ্চাশ হাজার টাকা...
চারদিক হাত তালিতে ফেটে পড়ল।
ইসহাক মিয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এই পুরস্কারের ভিতর কিন্তু আছে। এটা আসলে পুরস্কার না। বাজি। সে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিয়েছে। খালেক ব্যাপারী দিয়েছে পঞ্চাশ। লালু জিতলে পাবে একলক্ষ টাকা। হারলে এক পয়সাও পাবে না। সে শব্দ করে থু থু ফেলল।
মাঠের অপরপ্রান্ত দিয়ে খালেক ব্যাপারী ঢুকল। তার পেছনে পেছনে বিশাল কালো এক ষাড়। কয়েকজন কামলা ওটাকে সামলাচ্ছে।
গ্রামবাসীর একট অংশ চিৎকার করে উঠল- কালা পাহাড়! কালা পাহাড়!! কালা পাহাড়!!!
খালেক ব্যাপারী মাঠে ঢুকে চোখ-মুখ বিকৃত করে লালুর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে সে নিজেই লালুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। গত লড়াইয়ে তার ষাড় লালুর কাছে হেরে গিয়েছিল। বাজি ছিল-বিশ হাজার টাকার। রাগে-অপমানে সে পরদিনই হাঁটে গিয়ে ষাড়টাকে বেঁচে দেয়। কিনে আনে কুচকুচে কালো এই বিশাল ষাড়টাকে।
ঘোষকের ঘোষনার মধ্য দিয়ে লড়াই শুরু হল। পুরো মাঠে দুটো পক্ষ। লালু পক্ষ, কালা পাহাড় পক্ষ।
লালু আক্রমন করলে তার পক্ষ চিৎকার করে উঠে- মার গুতা। মার। জন্মের মতো শোয়াইয়া দে।
কালা পাহাড় আক্রমন করলে তার পক্ষ চিৎকার করে- দে শিং দিয়া ফুটা করে। রক্ত বাইর কর! রক্ত বাইর কর!!
লড়াই বেশ জমে উঠেছে। লালু চোরা মারে ওস্তাদ। প্রকান্ড দেহ নিয়েও কালা পাহাড় তেমন সুবিধা করতে পারছিল না।
ইসহাক মিয়া শান্ত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। সে নিশ্চত তার লালু জিতবে। দীর্ঘদিন সে লালুকে প্রশিক্ষন দিয়েছে- কিভাবে লড়াই করতে হয়। কিভাবে চোরাগুপ্তা হামলা করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হয়। তাছাড়া লড়াইয়ে তার অভিজ্ঞতাও অনেক।
একঘন্টা পার হয়েছে। তবু লড়াই চলছে। হঠাৎ কী হল কে জানে। লালু হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এই সুযোগে কালা পাহাড় তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিং দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকল। লালু কোন রকম মাটি থেকে উঠে প্রান বাঁচাতে দৌড় দিল।
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চারদিকে চিৎকার উঠল- কালা পাহাড়! কালা পাহাড়!! কালা পাহাড়!!!
দুই
লালু নির্জিব ভঙ্গিতে উঠানে দাড়িয়ে আছে। তার সারা শরীর ঘামে ভেজা। চামড়া ফেটে জায়গায় জায়গায় রক্ত ঝরছে। ইসহাক মিয়া ক্লান্তভাবে বারান্দায় বসে আছে। কিছুক্ষন পরপর সে তীব্র ঘৃনার দৃষ্টিতে লালুর দিকে তাকাচ্ছে। তার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
আহ, পঞ্চাশ হাজার টাকা!
পাড়া প্রতিবেশী কৌতুক কৌতুক মুখে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। হঠাৎ তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে হিংস্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠল। একটা বাশ নিয়ে লালুকে পেটাতে শুরু করল।
হারামখোর! হারামখোরের বাচ্চা হারামখোর!!
তার চিৎকার শুনে স্ত্রী ছুটে এলেন। সাথে তার একমাত্র মেয়ে আয়েশা।
লালু একটুও নড়াচড়া করছে না। দাড়িয়ে দাড়িয়ে মার খাচ্ছে।
ইসহাক মিয়া মুখে হিসহিস শব্দ করছে আর বদ্ধ পাগলের মতো সমানে পেটাচ্ছে।
আয়েশা কাঁদো কাঁদো গলায় চিৎকার করে উঠল- বাবা!
ইসহাক মিয়া চোখ তুলে তাকালেন। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে।
এই হারামখোররে একটা দানা-পানিও খেতে দিবি না।
সে সজোরে বাশটা ছুড়ে বের হয়ে গেল।
লালু ধীরে ধীরে পা ভেঙ্গে বসে পড়ল। তার বড় বড় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
আয়েশা লালুর কাছে ছুটে গেল। আলতো করে তার মাথায় হাত রাখল। লালু অসহায়ভাবে ‘গো’ ‘গো’ করে এক ধরনের শব্দ করছে। আয়েশার বুকটা ধক করে উঠল। সাত বছর আগে সে এইভাবে ডাকত। লড়াকু হবার পর থেকে সে লালুর এই ডাক আর শুনেনি।
সে তখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ে। একদিন সন্ধ্যায় বাবা একটা ছোট বাছুর নিয়ে এল।
দেখ তো আয়েশা। এটাকে তাজা করতে পারিস কিনা। সস্তায় দিল। নিয়ে এলাম।
বাছুরটার গায়ের রঙ ছিল টকটকে লাল। আয়েশা এর নাম দিল লালু। এরপর লালুই হয়ে উঠল তার খেলার সাথী।
সে নাদিয়াদের বাড়িতে যাচ্ছে। গোল্লাছুট খেলবে। পেছনে পেছনে লালু আসছে। সে ধমক দিয়ে বলছে-
বাড়িতে যা লালু। পেছনে পেছনে আসবি না।
লালু থমকে দাড়ায়। কিছুক্ষন পর আবার তার পিছু পিছু আসে।
কোন মধ্যদুপুরে সে হয়তো তাদের পুরনো বাগানের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। একটা গাছের ডাল ধরে নিচু করতেই লালু লাফিয়ে সামনে চলে আসে। ডালের পাতা চাবিয়ে চাবিয়ে খায়। আর ক্ষনে ক্ষনে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়।
আবার কখনো কখনো সে লালুকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। হঠাৎ সে বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ত। তাকে খুঁজে না পেয়ে সে দিশেহারা হয়ে ‘গো’ ‘গো’ করে ডাকত। সেই ডাকে কেমন যেন কান্না মেশানো থাকত। আয়েশা আর লুকিয়ে থাকতে পারত না।
অনেকদিন পর সে লালুর এই ডাক শুনল। লালু আধমরা হয়ে পড়ে আছে। সে ধীর পায়ে উঠে এল।
তিন
রাত প্রায় দুটো। আয়েশা বাবার রুমে ঢুকল। বাবাকে স্পর্শ করতেই সে পাশ ফিরে শুইল।
বাবা লালু যেন কেমন করছে!
মেয়ের ডাকে এমন কিছু ছিল ইসহাক মিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসল।
বাবা লালু এমন শব্দ করছে কেন?
ইসহাক মিয়া বিরক্তস্বরে বলল, করুক।
বাবা লালু তো একবার হেরেছে।
হারব ক্যান?
তুমি কখনও হারোনি?
ইসহাক মিয়া জবাব দিল না।
আয়েশা একটা ছোট্র নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ইস, লালু যদি মানুষ হত! কালা পাহাড়ের সাথে লড়তে হত না। না খেয়েও থাকতে হত না। আচ্ছা বাবা, আমি যদি কখনও হেরে যাই আমাকেও না খাইয়ে রাখবে?
ইসহাক মিয়া তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষন মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বিছানা ছেড়ে বারান্দ্রায় এসে দাড়াল।
যা মা, একটা হারিকেন নিয়ে আয়।
হারিকেনের আলোতে তারা দেখল-লালু তখনো মাটিতে শুয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে।
ইসহাক মিয়া ডাকল, লালু।
লালু অনেক কষ্টে মাথাটা মাটি থেকে তুলল। তার গলা দিয়ে অদ্ভুত একধরনের শব্দ বের হচ্ছে। ইসহাক মিয়া অস্থির হয়ে পড়ল। দৌড়ে গিয়ে এক বালতি পানি নিয়ে এল।
লালু অনেক কষ্টে সামান্য পানি খেল। তারপরই চোখ বন্ধ করে ফেলল।
আয়েশা লালুর মাথায় হাত রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। লালু চোখ বন্ধ করতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। সে চিৎকার করে উঠল- লালু!
আজ লালুর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা! ইসহাক মিয়া পরম যত্মে লালুর শরীরে তেল মাখাচ্ছে। কৌতুহলী লোকজন তার বাড়ির উঠানে ভিড় করেছে। সবাই মুগ্ধচোখে লালুর প্রস্তুতি দেখছে। লালু রাজকীয় ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। ইসহাক মিয়া প্রথমে লালুকে ভালো করে গোসল করাল। তারপর খড়, ভূষি খাওয়াল। এরপর কাচের বোতল ভেঙ্গে ভাঙ্গা কাচ দিয়ে লালুর শিং চেছে ধারাল করল। সবশেষে শিংয়ের মাথায় কাচামরিচ ভেঙ্গে ডলে দিল।
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন চেচিয়ে বলল, ইসহাক মিয়া, তোমার ষাড়কে বাংলা মদ খাইয়ে দাও। দেখবে-সে মরা পর্যন্ত লড়াই করবে।
ইসহাক মিয়া মনে মনে আঘাত পেল। সে উঁচু গলায় বলল, লালুর মদ লাগে না। সে এমনিতেই জিতবে। আজ পর্যন্ত কোনো লড়াইয়ে সে হারেনি। ইনশাআল্লাহ আজও হারবে না।
লালু গো করে একটা শব্দ করল। হয়তো সে তার মনিবের গর্ব বুঝতে পারছে। গত সাত বছর ধরে সে লড়াই করছে। একবারও হারেনি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে সে যখন রক্তাক্ত শরীরে উঠে দাড়ায়, ইছাপুর গ্রামবাসী আনন্দে চিৎকার করতে থাকে- লালু! লালু!! লালু!!!
ইসহাক মিয়ার বুক গর্বে ভরে উঠে। সেই দিনের বাছুর। আজ দুর্দান্ত ফাইটার। আজ ফাইট দিবে খালেক ব্যাপারীর কালা পাহাড়ের সাথে।
বিকেল চারটা বাজার আগেই স্কুলমাঠ লোকে কানায় কানায় ভরে গেল। তারপরও দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসছে। মাঠের একপাশে সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে। গ্রামের বিশিষ্ঠ লোকজন বসবে। ইতোমধ্যে চাঁন মিয়া মেম্বার, ইছাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, হোসেন ডাক্তার, আলম সওদাগর চলে এসেছেন এবং প্রথম সারিতে বসেছেন।
একজন ঘোষক মাইকের সামনে দাড়িয়ে বলছে- হ্যালো, হ্যালো, মাইক্রোফোন টেষ্টিং। ওয়ান, টু, থ্রী...
প্রিয় গ্রামবাসী, কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে- আপনাদের প্রানপ্রিয় খেলা ষাড়ের লড়াই। কালা পাহাড় বনাম লালু।
এই সময়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে তার দলবল নিয়ে আসতে দেখা গেল।
ঘোষক চিৎকার করে বলতে শুরু করল- আমাদের মাঝে এখন এসে উপস্থিত হয়েছেন অত্র গ্রামের মহামান্য চেয়ারম্যান, গ্রামবাসীর অকৃত্রিম বন্ধু, জনদরদী-আমাদের প্রানপ্রিয় নেতা জনাব আমির আলী।
চেয়ারম্যান সাহেব হাসিমুখে সামিয়ানার নিচে ঢুকলেন। শুরু হল-হ্যান্ডশেকের পালা। সবাই চুপ হয়ে বসতেই চেয়ারম্যান সাহেবকে খেলা উদ্বোধন করতে বলা হল।
চেয়ারম্যান সাহেব মাইকের সামনে এসে দাড়ালেন।
প্রিয় গ্রামবাসী, আসসালামালাইকুম।
ইছাপুরগ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী খেলা ষাড়ের লড়াই। বাংলাদেশের গ্রামগুলো যখন রাজনৈতিক হানাহানিতে মত্ত, রাতের আধারে একপক্ষ আরেক পক্ষের ধান কেটে নিচ্ছে, পুকুরে বিষ প্রয়োগে নিরীহ মাছ হত্যা করছে আমরা বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গ্রামে এইসব হানাহানি বন্ধ করেছি। ধরে রেখেছি নির্মল বিনোদন- ষাড়ের লড়াই। আপনারা উপভোগ করুন আজকের ষাড়ের লড়াই।
তুমুল করতালি শুরু হল। ইসহাক মিয়া লালুকে নিয়ে মাঠে ঢুকল। মাঠভর্তি লোকজন লালুকে দেখছে। এক একজন একেক প্রশ্ন করছে।
ইসহাক মিয়া, তোমার লালু পারব তো। খালেক ব্যাপারী এইবার একখান জিনিস কিনছে। হাঁটলে মনে হয়-জীবন্ত পাহাড় হাঁটতাছে...
ইসহাক মিয়া কোন জবাব দিল না। লড়াইয়ের মাঠে ঢুকলে সে উত্তেজনায় কথা বলতে পারে না। লালু নির্বিকার। ওর নির্বিকার ভঙ্গি দেখলে সে ভরসা পায়।
ঘোষক উৎফুল্ল গলায় বলছে- আজকের লড়াইয়ে যে জিতবে, তার মালিক পাবেন, হ্যা ভাই অনুমান করেন তো কত টাকা? দশ হাজার, বিশ হাজার। না...না...। পাঁচ দশে পন-পন-পঞ্চাশ হাজার টাকা...
চারদিক হাত তালিতে ফেটে পড়ল।
ইসহাক মিয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এই পুরস্কারের ভিতর কিন্তু আছে। এটা আসলে পুরস্কার না। বাজি। সে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিয়েছে। খালেক ব্যাপারী দিয়েছে পঞ্চাশ। লালু জিতলে পাবে একলক্ষ টাকা। হারলে এক পয়সাও পাবে না। সে শব্দ করে থু থু ফেলল।
মাঠের অপরপ্রান্ত দিয়ে খালেক ব্যাপারী ঢুকল। তার পেছনে পেছনে বিশাল কালো এক ষাড়। কয়েকজন কামলা ওটাকে সামলাচ্ছে।
গ্রামবাসীর একট অংশ চিৎকার করে উঠল- কালা পাহাড়! কালা পাহাড়!! কালা পাহাড়!!!
খালেক ব্যাপারী মাঠে ঢুকে চোখ-মুখ বিকৃত করে লালুর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে সে নিজেই লালুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। গত লড়াইয়ে তার ষাড় লালুর কাছে হেরে গিয়েছিল। বাজি ছিল-বিশ হাজার টাকার। রাগে-অপমানে সে পরদিনই হাঁটে গিয়ে ষাড়টাকে বেঁচে দেয়। কিনে আনে কুচকুচে কালো এই বিশাল ষাড়টাকে।
ঘোষকের ঘোষনার মধ্য দিয়ে লড়াই শুরু হল। পুরো মাঠে দুটো পক্ষ। লালু পক্ষ, কালা পাহাড় পক্ষ।
লালু আক্রমন করলে তার পক্ষ চিৎকার করে উঠে- মার গুতা। মার। জন্মের মতো শোয়াইয়া দে।
কালা পাহাড় আক্রমন করলে তার পক্ষ চিৎকার করে- দে শিং দিয়া ফুটা করে। রক্ত বাইর কর! রক্ত বাইর কর!!
লড়াই বেশ জমে উঠেছে। লালু চোরা মারে ওস্তাদ। প্রকান্ড দেহ নিয়েও কালা পাহাড় তেমন সুবিধা করতে পারছিল না।
ইসহাক মিয়া শান্ত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। সে নিশ্চত তার লালু জিতবে। দীর্ঘদিন সে লালুকে প্রশিক্ষন দিয়েছে- কিভাবে লড়াই করতে হয়। কিভাবে চোরাগুপ্তা হামলা করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হয়। তাছাড়া লড়াইয়ে তার অভিজ্ঞতাও অনেক।
একঘন্টা পার হয়েছে। তবু লড়াই চলছে। হঠাৎ কী হল কে জানে। লালু হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এই সুযোগে কালা পাহাড় তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিং দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকল। লালু কোন রকম মাটি থেকে উঠে প্রান বাঁচাতে দৌড় দিল।
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চারদিকে চিৎকার উঠল- কালা পাহাড়! কালা পাহাড়!! কালা পাহাড়!!!
দুই
লালু নির্জিব ভঙ্গিতে উঠানে দাড়িয়ে আছে। তার সারা শরীর ঘামে ভেজা। চামড়া ফেটে জায়গায় জায়গায় রক্ত ঝরছে। ইসহাক মিয়া ক্লান্তভাবে বারান্দায় বসে আছে। কিছুক্ষন পরপর সে তীব্র ঘৃনার দৃষ্টিতে লালুর দিকে তাকাচ্ছে। তার বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
আহ, পঞ্চাশ হাজার টাকা!
পাড়া প্রতিবেশী কৌতুক কৌতুক মুখে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। হঠাৎ তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে হিংস্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠল। একটা বাশ নিয়ে লালুকে পেটাতে শুরু করল।
হারামখোর! হারামখোরের বাচ্চা হারামখোর!!
তার চিৎকার শুনে স্ত্রী ছুটে এলেন। সাথে তার একমাত্র মেয়ে আয়েশা।
লালু একটুও নড়াচড়া করছে না। দাড়িয়ে দাড়িয়ে মার খাচ্ছে।
ইসহাক মিয়া মুখে হিসহিস শব্দ করছে আর বদ্ধ পাগলের মতো সমানে পেটাচ্ছে।
আয়েশা কাঁদো কাঁদো গলায় চিৎকার করে উঠল- বাবা!
ইসহাক মিয়া চোখ তুলে তাকালেন। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে।
এই হারামখোররে একটা দানা-পানিও খেতে দিবি না।
সে সজোরে বাশটা ছুড়ে বের হয়ে গেল।
লালু ধীরে ধীরে পা ভেঙ্গে বসে পড়ল। তার বড় বড় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
আয়েশা লালুর কাছে ছুটে গেল। আলতো করে তার মাথায় হাত রাখল। লালু অসহায়ভাবে ‘গো’ ‘গো’ করে এক ধরনের শব্দ করছে। আয়েশার বুকটা ধক করে উঠল। সাত বছর আগে সে এইভাবে ডাকত। লড়াকু হবার পর থেকে সে লালুর এই ডাক আর শুনেনি।
সে তখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ে। একদিন সন্ধ্যায় বাবা একটা ছোট বাছুর নিয়ে এল।
দেখ তো আয়েশা। এটাকে তাজা করতে পারিস কিনা। সস্তায় দিল। নিয়ে এলাম।
বাছুরটার গায়ের রঙ ছিল টকটকে লাল। আয়েশা এর নাম দিল লালু। এরপর লালুই হয়ে উঠল তার খেলার সাথী।
সে নাদিয়াদের বাড়িতে যাচ্ছে। গোল্লাছুট খেলবে। পেছনে পেছনে লালু আসছে। সে ধমক দিয়ে বলছে-
বাড়িতে যা লালু। পেছনে পেছনে আসবি না।
লালু থমকে দাড়ায়। কিছুক্ষন পর আবার তার পিছু পিছু আসে।
কোন মধ্যদুপুরে সে হয়তো তাদের পুরনো বাগানের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। একটা গাছের ডাল ধরে নিচু করতেই লালু লাফিয়ে সামনে চলে আসে। ডালের পাতা চাবিয়ে চাবিয়ে খায়। আর ক্ষনে ক্ষনে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়।
আবার কখনো কখনো সে লালুকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। হঠাৎ সে বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ত। তাকে খুঁজে না পেয়ে সে দিশেহারা হয়ে ‘গো’ ‘গো’ করে ডাকত। সেই ডাকে কেমন যেন কান্না মেশানো থাকত। আয়েশা আর লুকিয়ে থাকতে পারত না।
অনেকদিন পর সে লালুর এই ডাক শুনল। লালু আধমরা হয়ে পড়ে আছে। সে ধীর পায়ে উঠে এল।
তিন
রাত প্রায় দুটো। আয়েশা বাবার রুমে ঢুকল। বাবাকে স্পর্শ করতেই সে পাশ ফিরে শুইল।
বাবা লালু যেন কেমন করছে!
মেয়ের ডাকে এমন কিছু ছিল ইসহাক মিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসল।
বাবা লালু এমন শব্দ করছে কেন?
ইসহাক মিয়া বিরক্তস্বরে বলল, করুক।
বাবা লালু তো একবার হেরেছে।
হারব ক্যান?
তুমি কখনও হারোনি?
ইসহাক মিয়া জবাব দিল না।
আয়েশা একটা ছোট্র নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ইস, লালু যদি মানুষ হত! কালা পাহাড়ের সাথে লড়তে হত না। না খেয়েও থাকতে হত না। আচ্ছা বাবা, আমি যদি কখনও হেরে যাই আমাকেও না খাইয়ে রাখবে?
ইসহাক মিয়া তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষন মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বিছানা ছেড়ে বারান্দ্রায় এসে দাড়াল।
যা মা, একটা হারিকেন নিয়ে আয়।
হারিকেনের আলোতে তারা দেখল-লালু তখনো মাটিতে শুয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে।
ইসহাক মিয়া ডাকল, লালু।
লালু অনেক কষ্টে মাথাটা মাটি থেকে তুলল। তার গলা দিয়ে অদ্ভুত একধরনের শব্দ বের হচ্ছে। ইসহাক মিয়া অস্থির হয়ে পড়ল। দৌড়ে গিয়ে এক বালতি পানি নিয়ে এল।
লালু অনেক কষ্টে সামান্য পানি খেল। তারপরই চোখ বন্ধ করে ফেলল।
আয়েশা লালুর মাথায় হাত রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। লালু চোখ বন্ধ করতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। সে চিৎকার করে উঠল- লালু!
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৮
এ এস রিপন বলেছেন: পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
২| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৪
জ্ঞানহীন মহাপুরুষ বলেছেন: বেশ সাজিয়ে লিখেছেন। ভাল্লাগসে
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০২
এ এস রিপন বলেছেন: পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
৩| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৮
অভ্রনীল হৃদয় বলেছেন: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালই লাগল।
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০২
এ এস রিপন বলেছেন: পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
৪| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০৩
আরণ্যক রাখাল বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছেন| জমাট লেখায় খাদ নেই| সুপাঠ্য| পড়তে পাঠককে কোথাও বাঁধা পেতে হয়নি
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০১
এ এস রিপন বলেছেন: আপনিও তো লেখেন। আপনার ভালো লেগেছে- এটা আমার বড় পাওনা। ধন্যবাদ ভাই পড়ার জন্য।
৫| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২৩
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: লালুর প্রতি অায়েশার মমত্ববোধ, কিংবা লালুর মৃত্যু বিবেককে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো; জানিয়ে দিলো, অামরা বিজয়ীর বন্দনা করি অার বিজিতকে ছুঁড়ে ফেলে দেই । বড় নিষ্ঠুর মানব জাতি!
৬| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৭
এ এস রিপন বলেছেন: আপনার কমেন্ট এর সাথে আমি সম্পুর্ন একমত। আপনার কমেন্ট ভালো লাগল। পড়ার ন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
৭| ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৮
দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: লালুর মৃত্যু মনে নাড়া দিয়ে গেল সেই সংগে লালুর প্রতি আয়েশার মমত্ববোধও। সুন্দর একটি লেখা দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন নিরন্তর।
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১৪
এ এস রিপন বলেছেন: লালু পরাজয়কে স্বাভাবিকভা নিয়েছে। অথচ মানুষটি নিতে পবরেনি। তাই মৃত্যু!
ভাই পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
৮| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:৫৩
লবিব বলেছেন: Click This Link
এই লিঙ্কে আপ্নারা ষাড়ের লড়াই দেখতে পারবেন
আপনার লেখা সব গুলা ঠিক না!!! ষাড়ের মালিকরা একটি ষাড়কে কি ভাবে লালন পালন করে আপনি নিজ চুখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না !!! একটি ষাড়ের পিছনে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয় !!!ষাড় হেরে গেলে ষাড়কে পিঠায় আপনাকে কে বলছে????
আর লাল ষাড়ের যে ফোট দিছেন অইটা এখন ও আছে অইটা সিলেট এর টপ একটি ষাড়ের নাম লাল বারুত
আর ঊপ রে যে ষাড় গুলা লড়াই করছে অইগুলা খুলনা অথবা চিটাগাং এর হবে
৯| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৩২
এ এস রিপন বলেছেন: সবাই পিটায় না। কেউ কেউ পেটায়। আর গল্পকে আপনি বাস্তব ভাবছেন কেন? এই গল্পটির উদ্দেশ্য-করুন রস সৃষ্টি করে এই ধরনের বাজি এবং অমানবিক খেলা বন্ধ করা।
ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে নেয়া।
ধন্যবাদ ষাড়ের অনেক বিষয় আপনি জানেন।
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫২
আমি মিন্টু বলেছেন: ভালো লেখছেন ভালো লাগলো