নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পদ্মাপাড়ের ছেলে। বাড়ি বিক্রমপুর। ছোট গল্প লেখার আনন্দে ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করি!

এ এস রিপন

ছোটগল্প লেখার আনন্দে ছোটগল্প লিখে যাওয়া........

এ এস রিপন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনুভূতি শূন্যতা (ছোট গল্প)

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:১৯

পল্টনের মোড়ে দাঁড়িয়ে তারেক বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকক্ষণ হল বাস আসছে না। সে যাবে মিরপুর দশ নম্বর গোল চক্কর। সব রুটের বাস আসছে, মিরপুরের বাস আসছে না। সে লক্ষ্য করেছে, সে যখন যেই রুটের বাসের জন্য অপেক্ষা করে, সেই বাস সহজে আসে না। ব্যাপারটা কি শুধু তার বেলায় ঘটে? তার সামনে একটা সি.এন.জি ড্রাইভার মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। তার পরনে নীল ড্রেস। পুলিশ, ডাক্তার এবং উকিলদের মত ড্রাইভাররাও আজকাল ড্রেস পরে। ভাল! সব ধরনের পেশাজীবীদের ড্রেস থাকা ভাল। শুধু পেশাজীবী না, দুনিয়ার সমস্ত মানুষের যদি ড্রেস থাকত! রিক্সাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, ছাত্র, শিক্ষক, বেকার, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সবার আলাদা আলাদা ড্রেস। বাইরে বের হলে সবাই নিজ নিজ ড্রেস পরে বের হবে।
সব মানুষের ভিতরের কলকব্জা এক হলেও সোসাইটি কাউকে আকাশে উঠিয়ে রাখে। কাউকে পাতালে ফেলে রাখে। একই সোসাইটির একজন মন্ত্রীর অবস্থান আকাশে। একজন রিক্সাওয়ালার অবস্থান পাতালে। শিক্ষা, অর্থ এবং প্রভাব বিস্তারেরের ক্ষমতা দ্বারা এই অবস্থান নির্ধারিত হয়ে আসছে। এখন ড্রেস দ্বারা হোক। সেটা হবে আরও প্রত্যক্ষ। ফার্স্ট সোসাইটি তো সবকিছু প্রত্যক্ষ চায়। যাকে বলে স্ট্রেটকাট। ঘুষখোর অফিসারদের জন্যও থাকবে এক ধরনের ড্রেস। কেউ ঘুষ খেয়ে ধরা পড়লে তাকে সেই ড্রেস পরে এক বছর অফিসে আসতে হবে। ঘুষ যত বেশী হবে, ড্রেস পরার মেয়াদও তত বেশী হবে।
একটা বড় বাস মোড়ে এসে থামল। হেল্পার মিরপুর মিরপুর বলে চেঁচাতেই তারেক প্রায় লফিয়ে বাসে উঠল।
ভিতরে একটা সীটও খালি নেই। দাঁড়ানো যাত্রীরা গেটের সামনে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে পুরো ফাঁকা। তবুও কেউ পিছনে যাচ্ছে না। পিছনে না যাওয়ার কারণ কি? নামতে দেরি হবে নাকি নামতে কষ্ট হবে? এখন যে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে, এই কষ্ট তাদের গায়ে লাগছে না?
মিরপুর আসতে অনেক দেরি। তারেক একদম পিছনে চলে এল। পিছনের দিকে কোন সীট খালি হলে সে টুপ করে বসে পড়বে। ইদানিং তার পিছনে বসতে ভাল লাগে। আগে সব সময় সামনে বসত।
একবার চাকরির জন্য কি একটা পরীক্ষা দিতে তাকে তাড়াহুড়া করে চিটাগাং যেতে হল। বাসে নাইট-জার্নি। সামনে সীট খালি নাই। পিছনে বসতে হল। গাড়ি চলতেই ঝাকুনি শুরু হল। এক একটা গর্তে পড়ে, তার মনে হয় হাড়ের জয়েন্টগুলো খুলে খুলে আসছে।
ঘুম তো দূরের কথা সে ঠিক মতো বসে থাকতেই পারছে না। পরের দিন কি পরীক্ষা দিবে? দেখা যাবে লিখতে লিখতে টেবিলের উপরই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রায় এক ঘণ্টা পর তারেক টের পেল, সে চোখ খোলা রাখতে পারছে না। আরামদায়ক অদ্ভুত এক ঝিমুনীতে তার চোখ বুজে আসছে। সেদিন গাড়িতে তার যে ঘুম হয়েছিল, বহুদিন বাড়িতেও সে এভাবে ঘুমাতে পারেনি।
এরপর যতবার সে লং জার্নিতে গেছে- বেছে বেছে পিছনের সীটে বসেছে। সাথে সাথে ঘুম ঘুম ঝিমুনী। এ যেন এক অদ্ভুত নেশা!
আজ পিছনে বসলেও কি ঝিমুনী আসবে? আসলেও ঝিমানো যাবে না। লং জার্নিতে যা স্বাভাবিক, ঢাকা শহরে বাসে বসে ঝিমানো নিশ্চয়ই স্বাভাবিক না। পাশের যাত্রী আড়চোখে তাকাবে। তাকে ভাববে অসচেতন। নিজেকে ভাববে সচেতন।
বেশী সচেতন মানুষের সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। কাচুমাচু ভাব চলে আসে।
বাসের মাঝামাঝি সীটে দুটো ছেলে বসে উঁচু গলায় কথা বলছে। তাদের পাশে একজন বুড়ো মানুষ জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন। কন্ট্রাক্টর ভাড়া তুলছে। ওদের কাছে আসতেই একটা ছেলে বলল,
শাহবাগ কত?
দশ টেকা।
কি কস? পাঁচ টেকার ভাড়া দশ টেকা চাস্?
ভাই, গ্যাসের দাম বাড়ছে।
গ্যাসের দাম কমলেও তো ভাড়া কমাস না।
দেন ভাই, আরও ভাড়া তুলতে হইবো।
ছেলেটা চাপ্পি মারা দুটো পাঁচ টাকার নোট দিল। কন্ট্রাক্টর টাকাটা নিয়ে ভ্রু কুঁচকে দেখল। তারপর দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে বলল,
আরও দশ টেকা দেন ভাই।
ছেলেটা খড়খড়ে গলায় বলল,
যা এখন। আর দিতে পারমু না। ভাড়া পাঁচ টেকা কইরাই।
সবাই দশ টেকা কইরা দিতাছে।
পাশের ছেলেটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে জিন্সের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। তারপর পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে কন্টাক্টারের চোখের সামনে ধরে বলল, তোর কাছে পাঁচশ টাকার ভাংতি আছে?
কন্টাক্টরও দমে যাওয়ার পাত্র নয়।
সে বলল, দেন, ভাংতি দিতাছি।
আগে দে। পরে তুই ভু্ইলা যাবি। তোগো তো আবার খাইছত খারাপ।
কন্টাক্টর আর কথা বাড়াল না। সে অন্যান্য যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারেকের কাছে আসতেই সে ভাড়া দিয়ে দিল।
বাসে উঠে সে একটা ব্যাপারে বরাবরই অবাক হয়। বাসে উঠলে টাকার প্রতি মানুষের মমতা হঠাৎ করে যেন বেড়ে যায়। যেই লোক ফাস্টফুডের দোকানে গিয়ে আশি টাকা দিয়ে একটা বার্গার খেতে কৃপণতা করে না, সেই লোকই বাসভাড়া ‘এক টাকা’ বাড়ছে শুনলে এমন চেঁচামেচি শুরু করে! ড্রাইভার পর্যন্ত চলন্ত বাস থামিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়।
শাহবাগ আসতেই ছেলে দুটো গেটের দিকে এগিয়ে গেল। গেটের কাছে কি নিয়ে যেন আবার কন্টাক্টরের সাথে লেগে গেল। সম্ভবতঃ কন্ট্রাক্টর ‘বিশ টেকার জন্য পাঁচশ টেকার নোট দেন’-এই জাতীয় কিছু একটা বলেছে। তাতেই ক্ষেপে গিয়ে ছেলেদুটো কন্টাক্টরের নাকে-মুখে সমানে ঘুষি চালাচ্ছে। বেচারা কোন রকম আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। বাসভর্তি মানুষ সীটে বসে মজা দেখছে!
ওরা নামতেই ড্রাইভার দ্রুত বাস ছেড়ে দিল। ফার্মগেট আসতেই কিছু নতুন যাত্রী উঠল। তাদের ভাড়া নিতে কন্ট্রাক্টর আবার পিছনে এল।
একজন ভাড়া দিতে গিয়ে বলল, কি ও মিয়া, তোমার কানে কী হইছে?
তারেক লক্ষ্য করল কন্টাক্টরের কানের ভেতর চাপ চাপ রক্ত। কিছুক্ষণ আগেও তা ছিল না।
কন্টাক্টর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ও কিছু না। আগেরই।
তারেকের খুব ইচ্ছা করছিল বলে, অবহেলা করো না। ডাক্তার দেখিও। কিন্তু বলতে পারল না।
সে মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল। জানালা দিয়ে হু-হু করে বাতাস ঢুকছে। বহুদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল।
তখন গ্রামে থাকত। কলেজ থেকে রিক্সায় করে বাড়ি ফিরছে। কড়া রোদ। রিক্সাওয়ালা দরদর করে ঘামছে।
বড় রাস্তায় আসতেই রিক্সাওয়ালা হঠাৎ রিক্সা থেকে নেমে বসে পড়ল। সে হরহর করে বমি করছে। তারেক লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নামল।
আপনার শরীর খারাপ?
রিক্সাওয়ালার চোখ রক্তবর্ণ। সে গো...গো.... করছে। তারেকের দিকে তাকিয়ে যেন লজ্জা পেল।
বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, জ্বর আছিলো ভাইজান।
জ্বর নিয়ে বের হয়েছেন কেন?
আইজ শরীলডা ভাল লাগছিল। ভাবলাম বাইর হই। চাক্কা না ঘুরাইলে তো সংসারের চুলা জ্বলবো না।
তারেক মানিব্যাগ বের করে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিল।
থাক, আপনাকে আর যেতে হবে না। আপনি বাড়ি চলে যান। বিশ্রাম নেন।
রিক্সাওয়ালা মাথা কাত করে সায় দিল। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে বমি আটকানোর চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় তাকে ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার।
মিনিট দশেক পরে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল!
একটা রিক্সা পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে আরেকটা রিক্সাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পিছনের রিক্সায় তারেক রিক্সাওয়ালাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে। তারা যাচ্ছে সদর হাসপাতালের দিকে।
তারেক একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। তখন তার বয়স কত ছিল? বড়জোর সতের-আঠার। তারপর দশ-বছর কেটে গেছে। এই দশ বছরে ধরে সে ঢাকায় আছে। ঢাকা শহরের ইট-পাথর আর কংক্রীট কি তাকে বদলে দিয়েছে? দুনিয়ার কঠিন নিয়মের একটি ‘নির্লিপ্ত থাকা’।
নিজের অজান্তেই কি সে এই নিয়ম শিখে গেছে?
তারেক বড় করে নিঃশ্বাস নিল। তার মনে হল-ঢাকা শহরের ধুলোমাখা বায়ু ফুসফুসে ঢোকার সাথে সাথে তার মনেও কিছুটা ধুলোর আস্তরণ পড়ল।
কন্ট্রাক্টর ভাড়া তুলে যাচ্ছে। তার চোখ ভাবলেশহীন। সেখানে কোন ক্ষোভ নেই! কোন অভিযোগ নেই! কোন অভিমান নেই! কেমন শূন্য একটা দৃষ্টি নিয়ে যাত্রীদের বলছে-
‘দেহি ভাই, ভাড়াটা দ্যান তো। চালু করেন’।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৮

অভ্রনীল হৃদয় বলেছেন: বাস্তবতা, দীর্ঘশ্বাস আর অনুধাবনের দূর্দান্ত প্রকাশ।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১১

এ এস রিপন বলেছেন: ভাই পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

২| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ২:৫৭

ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: কিছু কিছু ছেলেপেলে যেন মারার জন্যই বাসে উঠে। এক দুই টাকার জন্য মারামারি শুরু করে, খুব বাজে লাগে এই জিনিসটা।

সব মানুষের ভিতরের কলকব্জা এক হলেও সোসাইটি কাউকে আকাশে উঠিয়ে রাখে। কাউকে পাতালে ফেলে রাখে। একই সোসাইটির একজন মন্ত্রীর অবস্থান আকাশে। একজন রিক্সাওয়ালার অবস্থান পাতালে। শিক্ষা, অর্থ এবং প্রভাব বিস্তারেরের ক্ষমতা দ্বারা এই অবস্থান নির্ধারিত হয়ে আসছে। এখন ড্রেস দ্বারা হোক। সেটা হবে আরও প্রত্যক্ষ। ফার্স্ট সোসাইটি তো সবকিছু প্রত্যক্ষ চায়। যাকে বলে স্ট্রেটকাট। ঘুষখোর অফিসারদের জন্যও থাকবে এক ধরনের ড্রেস। কেউ ঘুষ খেয়ে ধরা পড়লে তাকে সেই ড্রেস পরে এক বছর অফিসে আসতে হবে। ঘুষ যত বেশী হবে, ড্রেস পরার মেয়াদও তত বেশী হবে।

হা হা হা ভাল বলেছেন।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১১

এ এস রিপন বলেছেন: ভাই পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.