নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পদ্মাপাড়ের ছেলে। বাড়ি বিক্রমপুর। ছোট গল্প লেখার আনন্দে ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করি!

এ এস রিপন

ছোটগল্প লেখার আনন্দে ছোটগল্প লিখে যাওয়া........

এ এস রিপন › বিস্তারিত পোস্টঃ

রহস্য (ছোট গল্প)

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৩

আতিক দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। রাত দশটা। বিরক্তিতে তার ভ্রু কুচকে গেল। পাকা দু’ঘণ্টা ধরে পড়ছে। এখনও রচনাটা মুখস্ত হচ্ছে না। সে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিল। তার পরীক্ষার সময় একটা না একটা ঝামেলা আসবেই। সারা বছর তাদের বাড়িতেই টু শব্দ নাই, তার ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষার রুটিন দিল, অমনি বাড়িতে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেল। আতিকের বড় বোন শিলার বিয়ে। অনেকদিন থেকে পাত্র খোঁজা হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আর্মি পারসন এমনকি আমেরিকান প্রবাসী পাত্রও শিলাকে দেখানো হয়েছে। যেই দেখেছে- প্রথম দেখাতেই শিলাকে পছন্দ করেছে। শিলা একটা না একটা খুঁত বের করে সবাইকে আউট করে দিয়েছে।
আতিকের মা আয়েশা বেগম একদিন বিরক্ত মুখে বললেন, তোর পছন্দের কেউ আছে?
নাহ।
তাহলে?
তাহলে কি?
আমরা কষ্ট করে এক একজন যোগ্য পাত্র খুঁজে আনছি। তুই ফিরিয়ে দিচ্ছিস।
কষ্ট করে তোমাদের খুঁজতে কে বলেছে?
যোগ্য পাত্র কি আপনা আপনি আসবে? কেরানী টাইপ পাত্র খুঁজতে হয় না, যোগ্যপাত্র খুঁজতে হয়।
যোগ্য পাত্র বলতে তুমি কি বোঝ?
তুই কি বুঝিস, তাই বল।
শিলা হাই তুলতে তুলতে বলল, যোগ্য-অযোগ্য নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। তাই কিছু বুঝিও না।
তা বুঝবি কেন? শিখেছিস তো শুধু বাঁকা তর্ক করতে। আমেরিকার ছেলেটা কোন অংশে কম ছিল?
আমেরিকার ছেলে?
সাদেকের কথা বলছি। যেমন দেখতে শুনতে, তেমন ভদ্র। সারাজীবন আমেরিকার থাকতে পারতি।
আমেরিকায় থাকলে কি হতো? সারাদিন ড্রেন পরিষ্কার করে সাদেক না ফাদেক ঘরে ফিরতো। আমি গরম পানি দিয়ে তার পা ধুইয়ে, পায়ে সেন্ট মেখে বাবুর পা টিপতে বসে যেতাম। এই তো।
আয়েশা বেগম ঝংকার দিয়ে উঠলেন, ড্রেন পরিষ্কার করতে যাবে কেন? ফ্লোরিডায় ছেলের নিজস্ব ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে।
শিলা মুখ বাঁকিয়ে বলল, দেশে কি পাত্রের অভাব? আমেরিকা থেকে আমদানী করতে হবে?
দেশী পাত্রও তো তুই পাত্তা দিচ্ছিস না? ডাক্তার ছেলেটাকে না করে দিলি কেন?
ডাক্তার আমার পছন্দ না।
ডাক্তারে সমস্যা কি? ডাক্তাররা তো ডাক্তারকেই বিয়ে করে।
শিলা রাগী গলায় বলল, করুক আমি করবো না। সংবিধানে এমন কোন ‘ল’ নেই, ডাক্তার হয়েছি বলে ডাক্তারকেই বিয়ে করতে হবে।
বিয়ের ব্যাপারে শিলার এই খুঁতখুঁতানির জন্য বাড়ির কর্তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বিশেষ করে আয়েশা বেগম। শিলা পাশ দিয়ে গেলে তিনি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
মেয়েটা ডাক্তারী বিদ্যা শিখেছে। কিন্তু এক কণাও বাস্তব বুদ্ধি হয় নাই। কবে যে হবে!
শিলার ভাবী রুমা শাশুড়ি আম্মার দুশ্চিন্তাকে হেসে উড়িয়ে দেন।
আম্মা আপনি শিলার ব্যাপারে শুধু শুধু চিন্তা করেন। শিলা তো আর সাধারণ মেয়ে না। আমরা তো ওর জন্য তেমনভাবে পাত্র দেখা শুরুই করিনি। আগে ইন্টারনিটা শেষ হোক। দেখবেন, ছেলে, ছেলের বাবা-মা, গোষ্ঠীশুদ্ধ লাইন পড়ে গেছে।
আয়েশা বেগম নিরস মুখে বলেন, আমার অত বাছাবাছি ভাল লাগে না। ইন্টারনি অবস্থায়ই তো ডাক্তাররা বিয়ে করে। ওর বান্ধবী তানিয়া করল না?
ভাল ছাত্র-ছাত্রীরা পড়া অবস্থায় বিয়ে করে না। যাদের ভবিষ্যৎ ভাল না, তারাই আগেভাগে বিয়ে করে। পাত্রপক্ষকে ইনডাইরেক্টে জানায়, পাত্রী অসীম সম্ভাবনাময়। ইন্টারনি শেষ হলেই সে বিশাল মাপের একজন ডাক্তার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিলার ইমেজ শো করার কোন দরকার নেই। আগে কোর্স শেষ হোক, তারপর যেখানে দাঁড়াবে সেখানেই চাকরি হয়ে যাবে।
রুমা ভাবীর উৎসাহ টাইপ কথাবার্তায়ও আয়েশা বেগমের মন থেকে শঙ্কা দূর হয় না। তিনি বিষণœ গলায় বলেন, কি জানি কি হবে!!
শিলাকে নিয়ে তার অনেক গর্ব। আশাও বড়। সেই আশা যদি ভেঙ্গে যায়! আশা ভঙ্গের যন্ত্রণা তো কম না। তার অন্য ছেলে দুটো নিয়ে তিনি এত বেশী আশা করতে পারেন না। আতিক সেবার অল্পের জন্য এস.এস.সি তে স্টার পেল না।
আয়েশা বেগম মার্কশীট দেখে তিক্ত গলায় বললেন,
তোরা দুই ভাই মিলে আমার শিলার সমান হসনি। বড়টা যেমন গাধা, তুইও গাধা! তিনজন মাস্টার দিয়ে পড়েও স্টার পেলি না। শিলার কয়জন মাস্টার লেগেছে, অ্যা? ও তো হেসেখেলে ম্যাট্রিক ইন্টারে স্টার পেল। ওর পা ধুয়ে তোকে পানি খাওয়ানো উচিত।
এস.এস.সি রেজাল্টের কথা মনে হতেই আতিক আবার পড়ায় মন দিল। ইংরেজীতে সে বরাবরই দুর্বল। রচনা মুখস্ত না করে সে লিখতে পারে না। সে মনে মনে নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হল। স্মরণশক্তি সব গেছে। সামান্য একটা রচনা। তাও মুখস্ত করতে এত সময় লাগছে। সে পানির বোতলটা মুখে নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেল। মনে মনে ভাবল, মুখস্থ হবে কিভাবে? এত গ্যাদারিং-এর মধ্যে পড়া যায়? হঠাৎ করে শিলার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হওয়ায় বাসায় অতিথি গিজগিজ করছে। শিলা যে হুট করে বিয়েতে রাজী হবে সে ভাবতে পারেনি।
একদিন শুক্রবার বিকেলে মোটা করে এক ভদ্রমহিলা তার মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে নিয়ে শিলাকে দেখতে এলেন। সাথে আরও সাঙ্গপাঙ্গ।
খুব সাদামাটাভাবে আর দশজন অতিথিকে যেভাবে আপ্যায়ন করা হয়, তাদেরকেও সেইভাবে আপ্যায়ন করা হল। আতিকের বাবা-মা ধরেই নিলেন, এটা একটা ব্যর্থ বৈঠক। অযথা বড় আয়োজনের মানে হয় না।
কেক, মিষ্টি খাওয়া খাওয়ির পর শিলাকে ডাকা হল। শিলা তার পড়ার রুম থেকে ঘরোয়া ড্রেসে সোজা চলে এল। সোফায় বসে স্বাভাবিকভাবে প্লেট থেকে এক টুকরা কেক তুলে নিল। আয়েশা বেগম কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। শিলা মার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চুলগুলো পিছনে সরিয়ে বলল, কেকটা বাসি।
সদ্য গোসল করায় তার চুলগুলো চিকচিক করছে। ভদ্রমহিলা সম্মোহিত হয়ে শিলার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি একটা প্রশ্নও করলেন না।
শিলা ভিতরে চলে যাওয়ার পর তিনি অস্ফুটস্বরে বললেন, এতদিন ধরে আমি এমন একখানা মুখ আমার ছেলের জন্য খুজছি।
মেরিন ছেলেটা মার সরাসরি কথায় লজ্জা পেল। সে টেবিলের উপর পত্রিকাটা টেনে নিল।
ভদ্রমহিলা ইতঃস্তত করে বললেন, আপা, আমার কোন মেয়ে নেই। আপনার মেয়েকে আমার মেয়ে করে নিয়ে যাবো। আপনি অমত করবেন না।
আয়েশা বেগম ম্লান হেসে বললেন, আমার তো অমত নেই! মেয়ে কি বলে আগে শুনি।
তা তো অবশ্যই!! এখনকার সময়ে ছেলেমেয়েদের মতামতটাই আসল। আমরা কে? আমরা শুধু খুঁজে দিতে পারি।
দুদিন পরের ঘটনা। শিলা তার রুমে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। আয়েশা বেগম চা হাতে শিলার রুমে ঢুকলেন। পড়ার সময় ঘন ঘন চা খাওয়া শিলার অভ্যাস। মার দিকে না তাকিয়েই শিলা হাত বাড়িয়ে কাপটা নিল। আয়েশা বেগম কিছুক্ষণ মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। ওর খাটের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো চাদরটা টান-টান করলেন। বিছানায় পড়ে থাকা চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর তুলে রাখলেন। তারপর খাটে আলতো করে বসে শিলার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। শিলা বই বন্ধ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,
মা, কিছু বলবে?
নাহ, কি আর বলবো?
যা বলার দ্রুত বলে ফেল। নিউরোলজির উপর একটা ইন্টারেসটিং বই পড়ছি।
সেই দিনের ছেলেটাকে তোর কেমন লাগলো?
কোন ছেলে?
ঐ যে মেরিন না কিসে পড়ে বললো। ভদ্রমহিলাকে আমার বেশ লেগেছে।
ভাল।
কেমন ভাল?
কেমন ভাল আবার কি? তুমি মাঝে মাঝে এমন বোকার মত প্রশ্ন করো না!
আমরা আগাবো?
তোমাদের ইচ্ছা।
তোর কোন ইচ্ছা নেই?
আমার ইচ্ছা তো আজীবন বিয়ে না করা।
তাতে তোর লাভ?
লাভ লোকসান বুঝি না। পরের বাড়িতে আমার যেতে ইচ্ছা করে না।
আগে বিয়ে হোক, পরের বাড়ি আর পরের বাড়ি মনে হবে না। তখন হেলিকাপ্টার পাঠিয়েও আনা যাবে না।
না আনা গেলে বিমান পাঠাবা। বাসার সামনে রানওয়ে থাকবে। আমি বিমান থেকে নামব। তোমরা লাল গালিচা সংবর্ধনা দিবা।
হাসিস না। তোর ভাগ্য ভাল, তুই আমাদের সময় জন্মাসনি।
জন্মালে কি হতো?
বিয়ের নিরানব্বই পারসেন্ট আয়োজনের শেষে তুই জানতে পারতি তোর বিয়ে ফাইন্যাল হয়েছে।
এক পারসেন্ট বাদ থাকতো কেন?
বিয়ের আসরে কবুল বলার জন্য।
যদি কবুল না বলতাম।
না বলার সুযোগ নাই। একটু হুঁ হ্যাঁ করলে আরেকজন চিৎকার করে উঠত কবুল বলেছে, কবুল বলেছে।
আমি যদি চিৎকার করে বলতাম, আমি রাজি না। তাহলে?
তাহলে আর কি? তোর জন্য সংসারে হাবিয়া দোজখ নেমে আসত।
মারতো?
মার খাওয়া তখনকার সময়ে তেমন ব্যাপার ছিল না। সারাক্ষণ শুনতে হতো এই রকম নির্লজ্জ মেয়ে ঘরে রাখার দরকার নেই। কেটে দু’টুকরো করে গাঙে ভাসিয়ে দেওয়া উচিত।
শিলা কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, আমিও বলতাম, আমাকে কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমি এক মুহূর্ত এই সংসারে থাকবো না।
আয়েশা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মেয়েটা এত অবুঝ কেন?
শিলা হাই তুলে বলল, আচ্ছা তোমরা আগাও।
ভাল করে ভেবেচিন্তে বল। পরে পিছিয়ে গেলে হবে না।
বললাম তো। এখন যাও তো। পড়ার সময় এই সব প্যাঁচাল ভাল লাগে না।
আয়েশা বেগম দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। খুশিতে তার বুক টিপ টিপ করছে। মেয়েটা রাজি হয়েছে! অনেকদিন পর তিনি সত্যিকারের আনন্দবোধ করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সারা বাড়ি জেনে গেল- শিলা মেরিন ছেলেটাকে পছন্দ করছে।
সেদিন রাতেই ঘুমানোর সময় আয়েশা বেগম উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে শিলার বাবাকে বললেন, তুমি একটা সুদিন দেখে দ্রুত দিন-তারিখ ঠিক করে ফেল।
শিলার বাবা ফয়েজ আহমেদ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, এত তাড়াহুড়ার কি আছে। ‘ইন্টারনিটা’ শেষ হোক।
আয়েশা বেগম রাগী গলায় বললেন, মেয়ের বিয়ে কখন দিতে হবে, আমার চেয়ে তুমি ভাল বোঝ? তুমি আছ তোমার ব্যবসা নিয়ে। দিন-তারিখ ঠিক করো, বাকীটা আমি দেখবো। ফয়েজ আহমেদ ‘আচ্ছা’ বলে পাশ ফিরে শুইলেন।
আতিক শুনে বিরক্ত মুখে বলল, সামনে আমার পরীক্ষা, পরীক্ষার পর ডেট দিও।
আয়েশা বেগম তীক্ষè গলায় বললেন, কবে তোর পরীক্ষা?
মে মাসে।
এখনও তিন মাস বাকী। বিয়ে তোর পড়া ধরে রাখবে না। তোর কাজ তুই পড়বি।
আতিক হতাশ ভঙ্গিতে বলল, আমার পরীক্ষার সময় যত ঝামেলা সামনে আসে। পরে রেজাল্ট খারাপ হলে ক্যাট ক্যাট করতে পারবে না।
আয়েশা বেগম থমথমে গলায় বললেন, বড় বোনের বিয়ে হবে, সেটা তোর কাছে ঝামেলা?
আতিক লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল।
আর রেজাল্ট খারাপ হবে কেন? সারা বছর কি পড়লি?
সারা বছর যাই পড়ি, রিভিশন দিতে হবে না?
রুমা ভাবী এতক্ষণ চুপচাপ মা-ছেলের কথা শুনছিলেন। তিনি শান্ত গলায় বললেন, আতিক তিন মাস পর তোর পরীক্ষা?
হ্যাঁ।
এই তিন মাসে ইচ্ছা করলে পি.এইচ.ডি. করে ফেলা যায়, তুই জানিস?
আপনি করেন না, বসে আছেন কেন?
সময় হলে ঠিকই করবো। আমি যখন ছাত্রী ছিলাম, তোর মত ইংরেজীতে বছরের পর বছর ডাব্বা মারতাম না। কিছু না পড়েও পাস করে যেতাম। এখন বল, বিয়ে আগে হলে তোর সমস্যা কোথায়?
আয়েশা বেগম বললেন, অনুষ্ঠান তো মাত্র দুইদিন। এই দুইদিন না পড়ে রেস্ট নিলি।
আতিক বলল, বিয়েতে আত্মীয়-স্বজন আসবে না? তারা এসে থাকবে কোথায়? তখন তো আমাকেই রুম ছাড়তে হবে। তখন পড়বো কোথায়?
রুমা ভাবী বললেন, তোর রুমের সমস্যা? আমার রুমে এসে পড়বি। তোকে কেউ ডিস্টার্ব করবে না। নিরিবিলিতে পড়তে পারবি। আমি শিলার সাথে থাকবো।
সেই থেকে আতিক রুমা ভাবীর রুমে আশ্রয় নিয়েছে! রুমা ভাবী একা থাকেন। আতিকের বড় ভাই মারুফ দিনাজপুরে চাকরি করেন। এক সপ্তাহ পরপর আসেন। তাই রুমা ভাবী সহজে রুমটি ছেড়ে দিলেন।
রুমা ভাবীর রুমটি বেশ বড়সর। রুমে বেলজিয়ামের আয়নাযুক্ত বিশাল এক ড্রেসিং টেবিল। আয়নাটা এত বড় রুমের যে কোন প্রান্ত থেকে চেহারা দেখা যায়। রুমা ভাবীর বিয়েতে বাপের বাড়ী থেকে এই ড্রেসিং টেবিল এসেছে। ড্রেসিং টেবিলের পাশে খালি জায়গাটুকুতে আতিক তার পড়ার চেয়ার টেবিল ফিট করেছে।
বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ বাকী!! প্রতিদিন কিছু না কিছু অতিথি আসছে। আতিকের রুমটিতে পুরুষ অতিথিদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। মহিলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে ভিতরে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে আড্ডা, গল্প গুজব। এক সময় সবাই মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে পড়ে। দেখে মনে হয় রেল-স্টেশনের রাতের দৃশ্য।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আতিক ঘুমায় না। বই নিয়ে পড়তে বসে। পড়া তেমন এগোয় না। কিছু মুখস্থ করতে গেলে রাজ্যের যত কথা মনে পড়ে। কে কি বলছে মাথায় ঘুরঘুর করে। কিন্তু ‘ম্যাথ’ করতে গেলে সে দুনিয়া ভুলে যায়। তাই সে পড়তে বসার আগে কিছুক্ষণ ‘ম্যাথ’ করে নেয়। আজ করা হয়নি। ‘ম্যাথ’ বইটি এই ঘরে নেই!! ওর পড়ার ঘরে রয়েছে। অতিথি ডিঙ্গিয়ে পড়ার ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। রুমা ভাবীর রুমে পড়তেও তার অস্বস্তি লাগে। পুরো রুমটিতে হালকা মিষ্টি গন্ধ। ফুল স্পীডে ফ্যান চালিয়েও সে এই গন্ধ দূর করতে পারেনি। বিশাল আয়নাটায় চোখ পড়লেও বিরক্তি লাগে। মনে হয় রুমে আরেকজন আছে। আয়নাটার আকর্ষণ ক্ষমতাও প্রচন্ড। যতবার সে বই থেকে মুখ তুলেছে, ততবার আয়নায় চোখ পড়েছে। বড় আয়নার কি আলাদা আকর্ষণ ক্ষমতা আছে? সে আগে এই রুমটাতে তেমন ঢোকেনি। আয়নাটাকে এত গভীর ভাবে লক্ষ্যও করেনি। আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়, জগতে যা কিছু বিশাল, তার আকর্ষণ ক্ষমতাও বিশাল। বিশাল পিরামিড, বিশাল পাহাড়, সমুদ্রের বিশাল ঢেউ, বিশাল প্রাসাদ। পরক্ষণেই মনে হয়, হীরা-মুক্ত তো ছোট। তাদের আকর্ষণ ক্ষমতা কি কম? সে আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
কি সব উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসছে! পড়ার চাপের কারণে হয়তো এ রকম হচ্ছে! মানসিক চাপ কি মাথা এলোমেলো করে দেয়? রুমা ভাবী প্রথম প্রথম এ বাড়িতে এসে যে সব আজগুবি গল্প করতেন, সেকি মানসিক চাপের কারণে?
আতিক যখন ক্লাস টেনে উঠে, তখন রুমা ভাবী এ বাড়িতে বউ হয়ে আসেন। এসেই তিনি একদিন আপন মনে বিড়বিড় করে বললেন, এই বাড়িতে অশুভ কিছু একটা আছে।
শিলা শুনতে পেয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল, সেই অশুভটা কে ভাবী, তুমি?
শিলার কথায় কান না দিয়ে রুমা ভাবী অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, সারাক্ষণ মনে হয় কে যেন আমাকে দেখছে।
শিলা হাসতে হাসতে বলল, কে দেখছে ভাবী? আগে তোমার কেউ ছিল নাকি? তোমাকে না পেয়ে আত্মহত্যা করে ভূত হয়ে এসেছে!
যা, তোর সব সময় রসিকতা।
বলা তো যায় না। ইডেনের মেয়েরা যা ডিয়ারিং।
আমি ইডেনে পড়লেও ডেয়ারিং হতে পারেনি।
শিলা বলল, তবুও পরিবেশের একটা ব্যাপার আছে না।
রুমা ভাবী একটু হেসে বললেন, পরিবেশ! শোন সুন্দরবনের সবাই বাঘ না, ভীতু হরিণও আছে!!
এরপর বিয়ের একমাস যেতে না যেতেই রুমা ভাবীর ঝলমল চেহারাটা মলিন হতে থাকে! রুমা ভাবী ঢাকার এক ধনী পরিবারের মেয়ে। ছোটকাল থেকে ঢাকায় বড় হয়েছেন। রুমা ভাবীর মনমরা ভাব দেখে সবাই ভাবলেন, হঠাৎ রংপুরের মত একটা মফস্বল শহরে আসায় তিনি ঠিক এডজাস্ট করতে পারছেন না। কিছুদিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিন দিন রুমা ভাবী নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তাকে বেশ অস্থির দেখাত। সামান্য শব্দে আৎকে উঠতেন।
তার অবস্থা লক্ষ্য করে একদিন আয়েশা বেগম বললেন, বৌমা, তুমি মারুফের ওখানে যেয়ে কিছুদিন থেকে এসো না? ছেলেটা একা থাকে।
কিন্তু মা---
রুমাভাবী চুপ করে গেলেন। আয়েশা বেগম পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।
রুমা ভাবী মাথা নিচু করে বললেন, আমার একা থাকতে ভয় লাগে।
একা থাকবে কেন? মারুফ আছে না?
সে তো সারাদিন অফিসে থাকবে। আমি একা একা কি করবো? আমি এখানেই ভাল আছি। সবার সাথে আছি। আপনাদের যদি কোন সমস্যা না হয়।
ছিঃ এ কোন ধরনের কথা। আমাদের সমস্যা হবে কেন? আমার কাছে শিলাও যা, তুমিও তা। তোমার যেখানে খুশী থাক, কিন্তু মনমরা থাকবে না। মনমরা ভাব দেখতে আমার ভাল লাগে না।
রুমা ভাবী মাথা কাত করে সায় দিলেন। এরপর-রুমা ভাবীকে বেশ কিছুদিন হাসিখুশী প্রাণবন্ত দেখাল। কিন্তু একদিন রাতে রুমা ভাবী ভর্তা না যেন কি একটা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর বিকট চিৎকার দিয়ে ছুটে এলেন। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। বাড়ির যে যেখানে ছিল, চিৎকার শুনে দৌড়ে চলে এল। রুমা ভাবী যা বললেন, তার মর্মার্থ হলঃ
তিনি মার জন্য কলা ভর্তা করছিলেন। হঠাৎ মাটিতে ভারী কিছু পতনের শব্দ হল। তিনি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেন, উঠানের মাঝখানের আমগাছটা থেকে একলোক নেমে আসছে। তার পরনে সাদা ধবধবে শার্ট-প্যান্ট। লোকটা জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে চাপা স্বরে ডাকছে, রুমা! রুমা!
পরদিন রুমা ভাবী কাপুনি দিয়ে জ্বরে পড়লেন। শিলা গম্ভীর মুখে প্রেসার মাপলো। প্রেসার খুব হাই। শিলা পরপর দুটো নাপা খাওয়ালো। জ্বর যেন আর ছাড়ে না। এক সময় জ্বরের ঘোরে তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করলেন। কখনো কখনো ঘুমের ঘোরে খিল খিল করে হেসে উঠছেন। স্পেশালিস্ট ডাক্তার ডাকা হল। মারুফকে খবর দেয়া হল। বাড়ির সবার মুখ থমথমে। নানাজনে নানা কথা বলছে। এমনকি বাড়ির ঝি পর্যন্ত তার মতামত দিয়ে যাচ্ছে।
আম্মা, আমরা পুরান কালের মানুষ। মুখ দেইখ্যা ব্যারাম কইতে পারি। ভাবী জানরে বদজ্বীনে আছর করছে!! নয়া বউ, তার উপর চুল খোলা রাইখ্যা ঘুরে।
আয়েশা বেগম ধমক দিয়ে বললেন, তুমি চুপ কর। তুমি তোমার কাজ কর।
আম্মা গরীবের কথা কেউ কানে নেয় না। জীবন ভর দ্যাখছি, বাড়িতে সোন্দর মাইয়া থাকলে বদজ্বীন ঘুরঘুর করে। সুযোগ পাইলে কথা কইতে চায়!!
আবার বকবক করছো? বউমার জ্বর হয়েছে। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। সেরে যাবে।
বদজ্বীনে ধরলে ডাক্তার-কবিরাজ বাইট্টা খাওয়াইলেও কিছু হইবো না গো আম্মা। আমার চিনা এক ওঝা আছে। মন্তাজ ওঝা। এমুন মন্তর জানে, বদজ্বীন বাপ বাপ কইরা এই গেলাম ছাইড়া পালাইবো। হেরে খবর দিমু?
নিয়মিত মহিলা তাবলীগ করেন এমন এক প্রতিবেশী খালা এসে একদিন বললেন, বাড়িতে একটা মিলাদ দেন। বালামুসিবত সব দূর হয়ে যাবে। আয়-বরকতও ভাল হবে।
কেউ কেউ বললেন, আমগাছটার মধ্যে দোষ আছে। আমগাছটা কেটে ফেলেন।
কিন্তু আমগাছটা বাড়ির সবার প্রিয়।
আয়েশা বেগমের মা বেঁচে থাকতে প্রায়ই বলতেন, ফলবান বৃক্ষ মায়ের মত। এদের কাটতে নেই। কাটলে বাড়ির অমঙ্গল হয়।
অমঙ্গলের ভয়ে হোক বা আমের লোভেই হোক, আমগাছটা আর কাটা হয়নি। নতুন বাড়ি তোলার সময় সাবধানে আমগাছটা বাঁচিয়ে বাড়ি তোলা হয়েছে। এই গাছ এখন কাটতে হবে?
পরে সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, গাছ কাটা হবে না। বাড়িতে মিলাদ পড়ানো হবে।
হুজুর ডাকা হল। তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় মিলাদ পড়ালেন। মিলাদ শেষে এক গ্লাস পানি হাতে আমগাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। বিড় বিড় করে কি যেন পড়লেন। তাকে ঘিরে ছোটখাটো জটলা। সবাই পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। হুজুর পানিতে পরপর তিনবার ফু দিলেন। তারপর সেই পানি গাছের গোড়ায় ছিটিয়ে দিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, কোরআন শরীফে আল্লাহ পাক স্বয়ং বলিয়াছেন, আমি মানুষ এবং জ্বীন সৃষ্টি করিয়াছি আমার ইবাদতের জন্য। তবে মানুষের মইধ্যে যেমন বদ মানুষ আছে, জ্বীনদের মধ্যেও তেমন বদজ্বীন আছে। এরা মানুষের উপর ভর কইরা মানুষকে কু পথে চালাইতে চায়। বিশেষ করে শিশু এবং মহিলাদের উপর এনাদের লোভ বেশী। এমুন পানি পড়া দিছি, কোন বদজ্বীন যদি আমগাছের একশ গজের মইধ্যে আসে পুইড়া ছাই হইয়া যাইবো!
আতিক সন্দেহের স্বরে বলল, জ্বীন তো এমনিতেই আগুনের তৈরি! জ্বীন আবার ছাই হবে কিভাবে?
হুজুর দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে মুখ হাসি হাসি করে বললেন, মোমের আগুনও আগুন, জাহান্নামের আগুনও আগুন। কিন্তু জাহান্নামের আগুনের তেজ সত্তর হাজার গুণ বেশী।
যেমন হুট করে রুমা ভাবী জ্বরে পড়ছিলেন, তেমনি হুট করে তিনি জ্বর ছেড়ে উঠে বসলেন। উঠেই বললেন, আম্মা, পোলাউ খেতে ইচ্ছা করছে। জাউ ভাত খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে।
সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মারুফ ভাই ঝুঁকে রুমা ভাবীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এক্ষুণি বিরিয়ানী নিয়ে আসছি।
বাবা ধমক দিয়ে বললেন, বাইরের বিরিয়ানী কি খাবে? যতসব আজেবাজে তেল মশলা দিয়ে রান্না। আমি বাজারে যাচ্ছি। বাড়িতে পোলাউ-মাংস রান্না হবে।
দুপুরে সবাই উৎসাহ নিয়ে খেতে বসল। রুমা ভাবী বসেছেন সবার মাঝে। তিনি দু’এক লোকমা মুখে দিয়ে থালা হাতে বসে রইলেন।
মা বললেন, কি হল বউমা, খাও!
খেতে ইচ্ছা করছে না আম্মা।
সে-কি!! রান্না ভাল হয়নি?
না না, রান্না ভাল হয়েছে। পেট ভরা ভরা লাগছে!
তুমি তো কিছুই খেলে না, পেট ভরা লাগবে কেন? দেখি থালাটা একটু। ঝোল নাও। জ্বর থেকে উঠেছো। এখন ঝাল খেতে ভাল লাগবে।
শিলা রান চিবুতে চিবুতে বলল, দিনাজপুরে যাওয়ার কথা শুনে ভাবীর খুশীতে পেট ভরে গেছে!
রুমা ভাবী মুখ বাঁকিয়ে বললেন, খুশি না ছাই! আমি দিনাজপুরে যাবো না।
আয়েশা বেগম বললেন, কেন? ঘুরে আসো কিছুদিন। ভাল লাগবে। এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে এমনিতেই মন খারাপ লাগে।
শিলা বলল, মা, বিয়ের পর রংপুর ছাড়া তুমি আর কোথায় কোথায় গেছো?
আমার কথা আলাদা। আমরা আগেকার দিনের মানুষরা এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করি!!
হু! আগেকার মানুষরাও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বায়ু পরিবর্তনে যেতো!
সে তো অসুখ-বিসুখ হলে বা স্বামী চাকরিজীবী হলে। কিন্তু তোর আব্বা তো ছোটকাল থেকে এখানেই ব্যবসা করে। এই ভিটেমাটি ছেড়ে কোথায় যাবো!
মারুফ ভাই বললেন, আম্মা, দিনাজপুরে চলেন। সবাই মিলে ঘুরে আসবেন। দিনাজপুর দেখার অনেক কিছু আছে। রামসাগর আছে, কান্তজির মন্দির আছে।
এই বুড়ো বয়সে আর মন্দির-টন্দির দেখার ইচ্ছা নেই।
শিলা রাগী গলায় বলল, মা, কথায় কথায় বুড়ো বয়স বুড়ো বয়স বলবে না তো। তোমার এমন কি বয়স হয়েছে?
না বাবা, তোরা যা। বউমাকে দেখে রাখিস। একি বউমা, তুমি হাত ধুয়ে উঠে যাচ্ছো?
ভাবী বললেন, আর খাবো না, আম্মা।
কিছুই তো খেলে না!
মারুফ ভাই বললেন, থাক পরে খাবো। জ্বর থেকে উঠেছে। মুখে হয়তো রুচি নেই।
শিলা বলল, আমগাছের ভূত দেখে ভাবীর রুচি কমে গেছে। আমার রুচি কিন্তু বেড়েছে। ভাবী প্রতিদিন যদি একটা করে ভূত দেখতো, আমরা মজা করে বিরিয়ানী খেতে পারতাম!
সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।
আয়েশা বেগম বললেন, ভূত দেখার দরকার নেই। তোরা খেতে চাইলে আমিই রেঁধে দিবো। খাস তো না। এই বয়সে কত বাছবিচার! তেলের জিনিস খাবো না। আলু খাবো না। মোটা হয়ে যাবো। আমি খাচ্ছি না? আমি মোটা হচ্ছি?
রুমা ভাবী বললেন, এখন খায় না। শ্বশুরবাড়ি গেলে সব খাবে।
হু, শ্বশুরবাড়ি গেলে ও খাবে! বিয়ের পর মোটা হওয়ার ভয়ে ও পানি খাওয়াও ছেড়ে দিবে!
কিছুদিনের মধ্যে রুমা ভাবী বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন। মারুফ ভাইয়েরও ছুটি শেষ হয়ে এল। তিনি ভাবীকে নিয়ে দিনাজপুরে চলে গেলেন।
বাসা থেকে একজন মানুষ চলে গেলে বাসাটা খালি খালি লাগে। ভাবী চলে যাওয়ায় বাসাটাও নির্জীব হয়ে গেল।
মাঝরাতে আতিক যখন পড়া শেষ করে হিশি করতে উঠানে নামে, নিজের অজান্তে আমগাছটার দিকে চোখ পড়ে! অজানা কারণে গা ছমছম করে। মনে হয় এই বুঝি আমগাছের সেই সাদা শার্ট প্যান্ট পরা ভদ্রলোক নেমে এসে বলবে- তোমাদের রুমা ভাবী কোথায়? রুমা?
আতিক দ্রুত উঠান থেকে উঠে আসে।
দিনের বেলা আমগাছটার দিকে তাকালে তার হাসি পায়। কি নিরিহ ভঙ্গিতে গাছটা দাঁড়িয়ে আছে! সূর্যের আলো পড়ে পাতাগুলো চকচক করছে অথচ রাতের বেলা গাছটার দিকে তাকালে তার গা ছমছম করে।
কেন? রুমা ভাবীর গল্প কি নিজের অজান্তে তার মনে এফেক্ট করেছে?
সে মনে মনে ভাবে, ধুর এসব কিছু না। কত নাশকতামূলক কাণ্ড ঘটে আজকাল। বোমা ফাটে, গ্রেনেড ফাটে, পা উড়িয়ে নিয়ে গাছের সাথে লটকে রাখে। সে সবের সামনে ভৌতিক কর্মকাণ্ড আজকের যুগে হাস্যকর। সবই তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। ভূত-পেতœী বলতে কিছুই নেই।
কিন্তু ভাবী এ ধরনের অবাস্তব কথা বললেন? তিনি কি বানিয়ে বলেছেন? ভাবী তো বানিয়ে কথা বলেন না। বানিয়ে বলে তার লাভ কি?
আতিকের কলেজে একজন পাতানো বড় ভাই আছে। নাম সাঈদ সবাই তাকে সমীহ করে। তিনি সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবী পরে থাকেন। বাম রাজনীতি করেন। তার পড়া-শোনা প্রচুর। আতিক মাঝে মাঝে তার কাছ থেকে বই ধার নিয়ে আসে।
একদিন বই আনতে গেলে সাঈদ ভাই বললেন, আতিক, সেদিন তোমাদের বাড়িতে খুব ভীড় দেখলাম। কোন ফাংশন ছিল নাকি? আতিক বলল, ফাংশন না। মিলাদ ছিল।
মিলাদ? কি উপলক্ষ্যে?
আতিক রুমা ভাবীর ভয় পাওয়ার ঘটনাটা খুলে বলল। সব শুনে সাঈদ ভাই মুচকি হেসে বললেন, তোমাদের তো মুক্তমনা মানুষ হিসেবে জানতাম। তোমরা এইসব কুসংস্কারে কান দাও কেন?
আতিক চুপ করে রইল। সাঈদ ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, শোন, তোমার ভাবী সেই সময় এক ধরনের মানসিক চাপে ছিলেন।
আতিক বলল, মানসিক চাপে ছিলেন কেন?
আরে বোকা! মানসিক চাপে থাকবে না? একটা মেয়ে বিয়ের পর সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে একটা নতুন ফ্যামিলিতে আসে। এটা যে কত বড় ব্যাপার তুমি আমি বুঝবো না। তারপর মেয়েটিকে নতুন বাড়ি, নতুন লোক এবং নানা কাজের সাথে খাপ খাওয়াতে হয়। এই সময় অনেক মেয়েই ‘মানসিক চাপে’ থাকে। তোমার ভাবিও ছিলেন। ফলে হ্যালুসিনেশন দেখতেন।
আতিক বলল, হ্যালুসিনেশন কি?
হ্যালুসিনেশন হল দৃষ্টি বিভ্রাট। তুমি হঠাৎ হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখবে কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই!
আতিক সাঈদ ভাইয়ের যুক্তি সম্পূর্ণভাবে মেনে নিল। এজন্য সাঈদ ভাইকে তার ভাল লাগে। লোকটা জ্ঞান রাখে।
একমাস পর রুমা ভাবী দিনাজপুর থেকে ফিরে এলেন। আগের চেয়ে ঝকঝকে তকতকে চেহারা। টানা তিনদিন ধরে তিনি দিনাজপুরের দর্শনীয় স্থানের গল্প করলেন। বাসায় যেন প্রাণ ফিরে এল।
একদিন বিকালে রুমাভাবীকে একা চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আতিক বলল, ভাবী, আপনি এখনও আমগাছের ঐ লোকটাকে দেখতে পান?
রুমাভাবী ফ্যাকাশে হেসে বললেন, লোকটা এখন আমার সাথে থাকে। আমার সাথে গল্প করে।
ওহ! লোকটা তাহলে এখনও মাথা থেকে যায়নি। আমি ভেবেছিলাম, দিনাজপুরে যেয়ে লোকটার কথা ভুলে গেছেন।
ভাবী বললেন, সে আমার সাথে দিনাজপুরেও গিয়েছিল।
ও, তাই! কিভাবে গিয়েছিল? বাসে চড়ে, না আপনার কাঁধে চড়ে?
খুব ফাজিল হয়েছিস। ওদের বাসে চড়তে হয় না।
তাহলে কিভাবে গেল?
ওরা যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে।
ভাবী, এই সুপারসনিক যুগে আপনার কাহিনী যে কি হাস্যকর তা বুঝতে পারছেন?
হ্যাঁ পারছি, তুই যা আমার সামনে থেকে।
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। দেখতে দেখতে শিলার বিয়ের সময় ঘনিয়ে এল। আমগাছের ভদ্র লোককে নিয়ে আতিক আর ভাবীর সাথে কথা বলেনি। তিনি আছেন তার মত। ইদানিং শিলার বিয়ে নিয়ে তিনি মহাব্যস্ত। ঐ তো তার বিছানা। কি পরিপাটি করে সাজানো।
আতিক ঘড়ি দেখলো। রাত প্রায় একটা। আজ আর পড়া হবে না। শুয়ে পড়তে হবে। সে রচনাটা না দেখে লেখার চেষ্টা করছে। লেখা শেষ হলেই শুধু পড়বে।
আতিক তুই এখনও জেগে আছিস?
আতিক চমকে পিছনে ফিরে তাকাল। ভাবী দাঁড়িয়ে আছেন।
পরীক্ষার আগে এত রাত জেগে পড়লে শরীর খারাপ করবে। শুয়ে পড়। আমি মশারী টানিয়ে দিচ্ছি।
আতিক বলল, আমি টানাতে পারবো। আপনি যান।
তুই পারবি না। এই খাটে মশারী টানানোর বিশেষ কায়দা আছে।
ভাবী দ্রুত হাতে মশারী টাঙ্গালেন। তোষকের চারদিকে মশারী গুঁজে দিলেন। তারপর বিছানার এক পাশে আলগোছে বসলেন। একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন।
আতিক বলল, ভাবি, গল্পের আসর শেষ? আজকে প্রধান বক্তা কে ছিল? আপনি?
ভাবি বললেন, আমি গল্প বলি না, গল্প শুনি।
কি নিয়ে এত গল্প করেন?
তা শুনে তোমার কাজ নাই। যখন বিয়ে করবে তখন মেয়েদের গল্প শুনো।
আতিক মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এই সময় আয়নায় তার চোখ পড়ল। সাথে সাথে রক্ত হিম হয়ে গেল!!
এ কি দেখছে? আয়নাতে সে যাকে দেখছে তিনি তো ভাবী নন! বীভৎস চেহারার সাদা প্যান্ট শার্ট পড়া একলোক বসে আছে! লোকটার চোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। তীব্র ভয়ে সে অবশ হয়ে গেল। তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি পিছন থেকে কেউ তার গলা টিপে ধরবে। সে ভয়ে ভয়ে ভাবীর দিকে তাকাল।
ঐ তো ভাবী। শান্তভাবে বসে আছেন। হাতে ম্যাগাজিন। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক চেহারা। কিন্তু আয়নাতে এমন দেখাচ্ছে কেন? ভয়ে ভয়ে সে আবার আয়নার দিকে তাকাল।
ভাবীর চেহারার সাথে তার প্রতিবিম্বের কোন মিলই নেই! একই জায়গায় যেন দুটি ভিন্ন মানুষ বসা। আয়নাতে কোন সমস্যা আছে? তারেক নড়েচড়ে আয়নার বিভিন্ন স্থান থেকে ভাবীকে দেখার চেষ্টা করলো। কোন পরিবর্তনই দেখলো না! একজন মানুষের প্রতিবিম্ব আরেক ধরনের হয় কি করে?!
তার মাথা কাজ করছে না। সারা শরীর দরদর করে ঘামছে।
ভাবী বললেন, কিরে পড়া শেষ? আর রাত জাগিস না। ঘুমিয়ে পড়। ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিস। তুই তো আবার ছিটকিনি না লাগিয়েই ঘুমিয়ে পড়িস। কবে চোর এসে সবকিছু নিয়ে চম্পট দিবে টেরও পাবি না।
এই বলে ভাবী চলে গেলেন। আতিক নিথর হয়ে বসে রইল! একবার ভাবল, দীর্ঘসময় পড়ার কারণে হ্যালুসিনেশন দেখছে না তো!!

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৫

আজমান আন্দালিব বলেছেন: ভালোই ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.