![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লেখার আনন্দে ছোটগল্প লিখে যাওয়া........
এ.এস.আই হামিদুর ডিউটি সেরে সন্ধ্যার দিকে থানায় ফিরলেন। তার শরীর প্রচণ্ড ক্লান্ত। ইচ্ছা করছে একটা বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েন। তিনি মাথার ক্যাপ খুলে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। কড়া এক কাপ চা খেতে পারলে ক্লান্তি কিছুটা দূর হতো। কিন্তু থানার যেই চা, ফাঁসির আসামীকেও এক কাপ দিলে সে থু থু করে ফেলে দিবে।
ম্যাসেঞ্জার এসে বলল,
বড় স্যার আপনেরে ডাকে।
তিনি ক্যাপ পরে দ্রুত পায়ে ওসির রুমে ঢুকলেন। ওসি সাহেব টেবিলের উপর ঝুঁকে একটা ম্যাপ দেখছিলেন। তাকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন।
ডিউটি থেকে ফিরলেন?
জ্বি স্যার।
শহরে আর কোন গণ্ডগোল হয়নি তো?
না স্যার।
আজ রাতটা আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে। নিমতলায় যেতে হবে।
কোন সমস্যা স্যার?
ওসি সাহেব থমথমে মুখে বললেন,
কিছুক্ষণ আগে থানায় খবর এসেছে, নিমতলার এক হিন্দু বাড়ির বউ জঙ্গলে গাছের ডালে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আজ রাতটা ঐ লাশ পাহাড়া দিতে হবে। কাল সকালে সুরতহাল লিখবেন। তারপর লাশ থানায় নিয়ে আসবেন। কনস্টেবল রফিককে সাথে নিয়ে যান।
আচ্ছা, স্যার।
হামিদুর মুখে ‘আচ্ছা স্যার’ বললেও নির্দেশ শুনে তার মনটা দমে গেছে। সারাদিন ডিউটি করে এখন জঙ্গলে যেয়ে লাশ পাহারা দিতে হবে?
দুনিয়ার সব চাকরিতে টাইম টেবিল আছে, অথচ পুলিশের চাকরিতে? যখনই ডাক, তখনই বান্দা হাজির। তিনি বিরক্তমুখে চেয়ারে এসে বসলেন। বড় কর্তার হুকুম, মানতেই হবে। সামনে তার প্রমোশনের সময়। এই সময় চাকুরীর প্রতি ডেডিকেটেড ভাব না দেখালে প্রমোশনে ঝামেলা হবে। তিনি রফিকের খোঁজে বের হলেন। ছেলেটা পুলিশে নতুন জয়েন করেছে। সব কাজেই উৎসাহ। পাবলিকের সামনে বেশ গম্ভীরভাবে অকারণে রাইফেল হাত বদল করে। তার হাসি পায়। ছেলেটা ক্ষমতা উপভোগ করছে। কিন্তু ক্ষমতার আড়ালে যে যন্ত্রণা, তা এখনও টের পায়নি। কিছুদিন যাক, হাড্ডিতে দাগ লাগলে বুঝতে পারবে পুলিশের চাকুরী কাকে বলে।
রাত ন’টার দিকে তিনি রওনা হলেন। সাথে রফিক। অস্ত্র বলতে দুটো রাইফেল, একটা তিন ব্যাটারীর টর্চ।
নিমতলা জঙ্গলের কাছাকাছি এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। গভীর জঙ্গল। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। তার উপর ডিসেম্বর মাসের ঘন কুয়াশা। তিনি রফিকের দিকে তাকালেন। রফিকের মুখ শুকিয়ে গেছে। সে কয়েকবার ঢোক গিলল। ইতঃস্তত করে বলল,
স্যার, এখনই জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে হবে? সকালে ঢুকলে হয় না?
হামিদুর গম্ভীর মুখে বললেন,
না। লাশ গায়েব হলে সমস্যা আছে। আগে লাশের অবস্থান দেখি।
তিনি মনে মনে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লেন। তার পিছনে পিছনে রফিক। কত ভিতরে ঢুকতে হবে কে জানে? কুয়াশায় টর্চের আলো বেশী দূর যাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর তিনি লাশের সন্ধান পেলেন।
মেয়েমানুষের লাশ। একটা তেঁতুল গাছের ডাল থেকে ঝুলছে। গলায় পরনের কাপড় দিয়ে ফাঁস লাগানো।
হামিদুর লাশের মুখে টর্চের আলো ফেললেন। তার দেহ কাঁটা দিয়ে উঠল। কালচে লাল টুকটুকে জিহ্বা বেরিয়ে আছে। মনে হয় একটু আগে রক্ত পড়েছে। মাছি ভনভন করছে। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যন্ত্রণায় সারামুখ বিকৃত।
হামিদুর তাড়াতাড়ি টর্চের আলো সরিয়ে ফেললেন। ঝোপ থেকে কি যেন একটা দৌড়ে পালাল। হয়তো শিয়াল। পুলিশের চাকুরীর সুবাদে তিনি জীবনে বহু লাশ দেখেছেন কিন্তু এমন বীভৎস লাশ আর দেখেননি।
এই শীতের রাতে এই লাশের পাশে থাকতে হবে! তার মন বিষিয়ে উঠল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
শালার চাকুরী! এর চেয়ে ক্ষেত খামারে কামলাগিরি করাও ভাল ছিল।
তিনি লাশ থেকে দূরে একটা বটগাছের নিচে যেয়ে দাঁড়ালেন। ক্লান্তিতে তার পা ভেঙ্গে আসছে। তিনি গাছের গুড়িতে বসে পড়লেন। জংলী মশা তাকে জেঁকে ধরল। মোটা পোশাকের ভেতরও তিনি হুল টের পাচ্ছেন।
হঠাৎ তার হাসি পেল। লোকে বলে পুলিশের হাত অনেক লম্বা। তারা ইচ্ছা করলে মাটি খুড়েও আসামী বের করতে পারে। এখন মনে হচ্ছে মশার হুলও কম লম্বা না। এরাও মোটা পোশাক ভেদ করে পুলিশের দেহ স্পর্শ করতে পারে। মশা তাড়ানোর কাজ পেয়ে লাশের চিন্তা তার মাথা থেকে খানিকটা দূর হল।
রাত এগারটার দিকে রফিক হাই তুলতে তুলতে বলল,
স্যার, শীতে জমে যাচ্ছি। চা না খেলে আমরাই জমে লাশ হয়ে যাবো। যাই, নিমতলা বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি। দেখি চা-টা পাওয়া যায় কিনা। আপনার জন্য আনবো স্যার?
হামিদুর মাথা কাত করে সায় দিলেন।
রফিক গলায় মাফলার পেচিয়ে টর্চ লাইটটা নিয়ে হনহন করে চলে গেল।
হামিদুর অন্ধকার গাছের গুড়িতে ঠায় বসে রইলেন। টর্চ না থাকায় তিনি মাঝে মাঝে আলো ফেলতে পারছেন না। জমাট অন্ধকার। নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে তিনি কবরের ভেতর বসে আছেন।
ধীরে ধীরে তার চোখ অন্ধকার সয়ে এল। তিনি ঝুলন্ত লাশের সাদা কাপড়টা দেখতে পাচ্ছেন। মুখটা দেখতে পাচ্ছেন না।
কে এই গৃহবধূ? কি যন্ত্রণা পেয়ে এমন গহীন জঙ্গলে এসে জীবন শেষ করলো? নাকি এটা কোন হত্যা? গাছে ঝুলিয়ে কেউ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে? পোস্টমর্টেম করলে সব বেরিয়ে আসবে।
তবে হত্যা বা আত্মহত্যা যাই হোক, এর পিছনে যে দায়ী তাকে এই মুহূর্তে হামিদুরের গুলি করে মারতে ইচ্ছা করছে। শালার জন্য এই কষ্ট!
হঠাৎ তার মনে হল পুরো জঙ্গলটা কেমন থম মেরে আছে। এতক্ষণ ঝিঁঝিঁ ডাকছিল। তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি পিঠ টান টান করে বসলেন। তার ঝিমুনী ভাব কেটে গেছে। মনে হচ্ছে কে যেন বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন। রাইফেলটা শক্ত হাতে ধরলেন। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অসম্ভব সচেতন হয়ে উঠেছে। তিনি আগেও লক্ষ্য করেছেন বিপদের আঁচ পেলে তার এ রকম অনুভূতি হয়।
একবার খুলনায় থাকতে বনদস্যু ধাওয়া করতে যেয়ে তাকে সুন্দরবনে ঢুকতে হয়। দস্যুদের চারপাশ দিয়ে তারা ঘিরে ফেলেন। তিনি গুলি করতে যাবেন, হঠাৎ সূক্ষ্ম শব্দে তার সারা দেহের লোম খাড়া হয়ে গেল। তিনি চট করে ঘুরে দাঁড়ালেন। বিশাল একটা সাপ গাছের ডালের সাথে পেঁচিয়ে ফণা তুলে আছে। আর এক হাত নাগালের মধ্যে আসলেই তিনি ছোবল খেতেন। সেদিন সৃষ্টিকর্তার দেয়া শক্তিশালী ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের গুণে তিনি রক্ষা পেয়েছেন।
দূরে একটা পেঁচা ডেকে উঠল। হামিদুর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তিনি ঘামতে শুরু করেছেন। টর্চটা এই মুহূর্তে ভীষণ দরকার ছিল। কেন টর্চটা হাতছাড়া করলেন? অবশ্য না দিয়ে উপায় ছিল না। রফিক পথ খুঁজে আসতে পারতো না।
হঠাৎ তিনি স্পষ্ট শুনলেন লাশটি হিঃ হিঃ করে হাসছে এবং দুলছে।
তার সমস্ত শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। গহীন জঙ্গলে সেই হাসি গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন তাকে ব্যঙ্গ করছে।
তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি টলতে টলতে পড়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর রফিক চা নিয়ে এসে দেখল, হামিদুর স্যার গাছের নিচে পড়ে আছেন। সে ভাবল হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সে নিচু গলায় ডাকল,
স্যার, ও স্যার। চা নিয়ে এসেছি, উঠেন।
এমন সময় লাশটি আবার হিঃ হিঃ করে হেসে দুলতে লাগল।
রফিক চমকে উঠল। তার হাত থেকে চায়ের মগ পড়ে গেল। প্রচণ্ড ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডটা কাটা মুরগীর মতো লাফাচ্ছে। আবার সেই রক্ত হিম করা হাসি। তার চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
অনেকক্ষণ পর হামিদুরের জ্ঞান ফিরল। তিনি চোখ পিট পিট করে আশে-পাশে তাকালেন। প্রচণ্ড অন্ধকার! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ তিনি নারীকণ্ঠ শুনতে পেলেন।
কি পুলিশ দাদারা....ভয় পাইছো? চা খাবা না?....আমারেও দিও।... হিঃ.... হিঃ......হিঃ.....
হামিদুর ধরফর করে রফিককে ডাকলেন। তার হুঁশ ফিরতেই বললেন, বাঁচতে চাইলে তাড়াতাড়ি চল। দৌড়াই।
রফিক ঝটপট উঠে দাঁড়াল। তারা দৌঁড় দিতে যাবে, এমন সময় হামিদুর বললেন, লাশের মুখের উপর একবার টর্চটা মারো দেখি। আমি একটা গুলি করে পালাবো।
রফিক কাঁপা কাঁপা হাতে টর্চের আলো লাশের উপর ফেলল। তারা দু’জনেই চমকে উঠল। লাশের উপর একটা নারীমূর্তি বসা। হামিদুর প্রায়ই ট্রিগার চাপতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ লক্ষ্য করলেন এ যে বাজারের পাঁচী পাগলী। ডালের উপর বসে হিহি করে হাসছে। তার হাসির ঠেলায় ডালটা থর থর করে কাঁপছে। সেই সাথে লাশটাও দুলছে।
রফিক দ্রুত গাছে উঠে পাগলীকে নামিয়ে আনল। তাকে আর কি বলবে- পাগল মানুষ! শেষতক সারারাত পাগলীর গান শুনে তারা লাশ পাহাড়া দিতে লাগল।
এ.এস.আই হামিদুর ডিউটি সেরে সন্ধ্যার দিকে থানায় ফিরলেন। তার শরীর প্রচণ্ড ক্লান্ত। ইচ্ছা করছে একটা বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েন। তিনি মাথার ক্যাপ খুলে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। কড়া এক কাপ চা খেতে পারলে ক্লান্তি কিছুটা দূর হতো। কিন্তু থানার যেই চা, ফাঁসির আসামীকেও এক কাপ দিলে সে থু থু করে ফেলে দিবে।
ম্যাসেঞ্জার এসে বলল,
বড় স্যার আপনেরে ডাকে।
তিনি ক্যাপ পরে দ্রুত পায়ে ওসির রুমে ঢুকলেন। ওসি সাহেব টেবিলের উপর ঝুঁকে একটা ম্যাপ দেখছিলেন। তাকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন।
ডিউটি থেকে ফিরলেন?
জ্বি স্যার।
শহরে আর কোন গণ্ডগোল হয়নি তো?
না স্যার।
আজ রাতটা আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে। নিমতলায় যেতে হবে।
কোন সমস্যা স্যার?
ওসি সাহেব থমথমে মুখে বললেন,
কিছুক্ষণ আগে থানায় খবর এসেছে, নিমতলার এক হিন্দু বাড়ির বউ জঙ্গলে গাছের ডালে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আজ রাতটা ঐ লাশ পাহাড়া দিতে হবে। কাল সকালে সুরতহাল লিখবেন। তারপর লাশ থানায় নিয়ে আসবেন। কনস্টেবল রফিককে সাথে নিয়ে যান।
আচ্ছা, স্যার।
হামিদুর মুখে ‘আচ্ছা স্যার’ বললেও নির্দেশ শুনে তার মনটা দমে গেছে। সারাদিন ডিউটি করে এখন জঙ্গলে যেয়ে লাশ পাহারা দিতে হবে?
দুনিয়ার সব চাকরিতে টাইম টেবিল আছে, অথচ পুলিশের চাকরিতে? যখনই ডাক, তখনই বান্দা হাজির। তিনি বিরক্তমুখে চেয়ারে এসে বসলেন। বড় কর্তার হুকুম, মানতেই হবে। সামনে তার প্রমোশনের সময়। এই সময় চাকুরীর প্রতি ডেডিকেটেড ভাব না দেখালে প্রমোশনে ঝামেলা হবে। তিনি রফিকের খোঁজে বের হলেন। ছেলেটা পুলিশে নতুন জয়েন করেছে। সব কাজেই উৎসাহ। পাবলিকের সামনে বেশ গম্ভীরভাবে অকারণে রাইফেল হাত বদল করে। তার হাসি পায়। ছেলেটা ক্ষমতা উপভোগ করছে। কিন্তু ক্ষমতার আড়ালে যে যন্ত্রণা, তা এখনও টের পায়নি। কিছুদিন যাক, হাড্ডিতে দাগ লাগলে বুঝতে পারবে পুলিশের চাকুরী কাকে বলে।
রাত ন’টার দিকে তিনি রওনা হলেন। সাথে রফিক। অস্ত্র বলতে দুটো রাইফেল, একটা তিন ব্যাটারীর টর্চ।
নিমতলা জঙ্গলের কাছাকাছি এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। গভীর জঙ্গল। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। তার উপর ডিসেম্বর মাসের ঘন কুয়াশা। তিনি রফিকের দিকে তাকালেন। রফিকের মুখ শুকিয়ে গেছে। সে কয়েকবার ঢোক গিলল। ইতঃস্তত করে বলল,
স্যার, এখনই জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে হবে? সকালে ঢুকলে হয় না?
হামিদুর গম্ভীর মুখে বললেন,
না। লাশ গায়েব হলে সমস্যা আছে। আগে লাশের অবস্থান দেখি।
তিনি মনে মনে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লেন। তার পিছনে পিছনে রফিক। কত ভিতরে ঢুকতে হবে কে জানে? কুয়াশায় টর্চের আলো বেশী দূর যাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর তিনি লাশের সন্ধান পেলেন।
মেয়েমানুষের লাশ। একটা তেঁতুল গাছের ডাল থেকে ঝুলছে। গলায় পরনের কাপড় দিয়ে ফাঁস লাগানো।
হামিদুর লাশের মুখে টর্চের আলো ফেললেন। তার দেহ কাঁটা দিয়ে উঠল। কালচে লাল টুকটুকে জিহ্বা বেরিয়ে আছে। মনে হয় একটু আগে রক্ত পড়েছে। মাছি ভনভন করছে। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যন্ত্রণায় সারামুখ বিকৃত।
হামিদুর তাড়াতাড়ি টর্চের আলো সরিয়ে ফেললেন। ঝোপ থেকে কি যেন একটা দৌড়ে পালাল। হয়তো শিয়াল। পুলিশের চাকুরীর সুবাদে তিনি জীবনে বহু লাশ দেখেছেন কিন্তু এমন বীভৎস লাশ আর দেখেননি।
এই শীতের রাতে এই লাশের পাশে থাকতে হবে! তার মন বিষিয়ে উঠল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
শালার চাকুরী! এর চেয়ে ক্ষেত খামারে কামলাগিরি করাও ভাল ছিল।
তিনি লাশ থেকে দূরে একটা বটগাছের নিচে যেয়ে দাঁড়ালেন। ক্লান্তিতে তার পা ভেঙ্গে আসছে। তিনি গাছের গুড়িতে বসে পড়লেন। জংলী মশা তাকে জেঁকে ধরল। মোটা পোশাকের ভেতরও তিনি হুল টের পাচ্ছেন।
হঠাৎ তার হাসি পেল। লোকে বলে পুলিশের হাত অনেক লম্বা। তারা ইচ্ছা করলে মাটি খুড়েও আসামী বের করতে পারে। এখন মনে হচ্ছে মশার হুলও কম লম্বা না। এরাও মোটা পোশাক ভেদ করে পুলিশের দেহ স্পর্শ করতে পারে। মশা তাড়ানোর কাজ পেয়ে লাশের চিন্তা তার মাথা থেকে খানিকটা দূর হল।
রাত এগারটার দিকে রফিক হাই তুলতে তুলতে বলল,
স্যার, শীতে জমে যাচ্ছি। চা না খেলে আমরাই জমে লাশ হয়ে যাবো। যাই, নিমতলা বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি। দেখি চা-টা পাওয়া যায় কিনা। আপনার জন্য আনবো স্যার?
হামিদুর মাথা কাত করে সায় দিলেন।
রফিক গলায় মাফলার পেচিয়ে টর্চ লাইটটা নিয়ে হনহন করে চলে গেল।
হামিদুর অন্ধকার গাছের গুড়িতে ঠায় বসে রইলেন। টর্চ না থাকায় তিনি মাঝে মাঝে আলো ফেলতে পারছেন না। জমাট অন্ধকার। নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে তিনি কবরের ভেতর বসে আছেন।
ধীরে ধীরে তার চোখ অন্ধকার সয়ে এল। তিনি ঝুলন্ত লাশের সাদা কাপড়টা দেখতে পাচ্ছেন। মুখটা দেখতে পাচ্ছেন না।
কে এই গৃহবধূ? কি যন্ত্রণা পেয়ে এমন গহীন জঙ্গলে এসে জীবন শেষ করলো? নাকি এটা কোন হত্যা? গাছে ঝুলিয়ে কেউ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে? পোস্টমর্টেম করলে সব বেরিয়ে আসবে।
তবে হত্যা বা আত্মহত্যা যাই হোক, এর পিছনে যে দায়ী তাকে এই মুহূর্তে হামিদুরের গুলি করে মারতে ইচ্ছা করছে। শালার জন্য এই কষ্ট!
হঠাৎ তার মনে হল পুরো জঙ্গলটা কেমন থম মেরে আছে। এতক্ষণ ঝিঁঝিঁ ডাকছিল। তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি পিঠ টান টান করে বসলেন। তার ঝিমুনী ভাব কেটে গেছে। মনে হচ্ছে কে যেন বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন। রাইফেলটা শক্ত হাতে ধরলেন। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অসম্ভব সচেতন হয়ে উঠেছে। তিনি আগেও লক্ষ্য করেছেন বিপদের আঁচ পেলে তার এ রকম অনুভূতি হয়।
একবার খুলনায় থাকতে বনদস্যু ধাওয়া করতে যেয়ে তাকে সুন্দরবনে ঢুকতে হয়। দস্যুদের চারপাশ দিয়ে তারা ঘিরে ফেলেন। তিনি গুলি করতে যাবেন, হঠাৎ সূক্ষ্ম শব্দে তার সারা দেহের লোম খাড়া হয়ে গেল। তিনি চট করে ঘুরে দাঁড়ালেন। বিশাল একটা সাপ গাছের ডালের সাথে পেঁচিয়ে ফণা তুলে আছে। আর এক হাত নাগালের মধ্যে আসলেই তিনি ছোবল খেতেন। সেদিন সৃষ্টিকর্তার দেয়া শক্তিশালী ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের গুণে তিনি রক্ষা পেয়েছেন।
দূরে একটা পেঁচা ডেকে উঠল। হামিদুর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তিনি ঘামতে শুরু করেছেন। টর্চটা এই মুহূর্তে ভীষণ দরকার ছিল। কেন টর্চটা হাতছাড়া করলেন? অবশ্য না দিয়ে উপায় ছিল না। রফিক পথ খুঁজে আসতে পারতো না।
হঠাৎ তিনি স্পষ্ট শুনলেন লাশটি হিঃ হিঃ করে হাসছে এবং দুলছে।
তার সমস্ত শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। গহীন জঙ্গলে সেই হাসি গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন তাকে ব্যঙ্গ করছে।
তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি টলতে টলতে পড়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর রফিক চা নিয়ে এসে দেখল, হামিদুর স্যার গাছের নিচে পড়ে আছেন। সে ভাবল হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সে নিচু গলায় ডাকল,
স্যার, ও স্যার। চা নিয়ে এসেছি, উঠেন।
এমন সময় লাশটি আবার হিঃ হিঃ করে হেসে দুলতে লাগল।
রফিক চমকে উঠল। তার হাত থেকে চায়ের মগ পড়ে গেল। প্রচণ্ড ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডটা কাটা মুরগীর মতো লাফাচ্ছে। আবার সেই রক্ত হিম করা হাসি। তার চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
অনেকক্ষণ পর হামিদুরের জ্ঞান ফিরল। তিনি চোখ পিট পিট করে আশে-পাশে তাকালেন। প্রচণ্ড অন্ধকার! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ তিনি নারীকণ্ঠ শুনতে পেলেন।
কি পুলিশ দাদারা....ভয় পাইছো? চা খাবা না?....আমারেও দিও।... হিঃ.... হিঃ......হিঃ.....
হামিদুর ধরফর করে রফিককে ডাকলেন। তার হুঁশ ফিরতেই বললেন, বাঁচতে চাইলে তাড়াতাড়ি চল। দৌড়াই।
রফিক ঝটপট উঠে দাঁড়াল। তারা দৌঁড় দিতে যাবে, এমন সময় হামিদুর বললেন, লাশের মুখের উপর একবার টর্চটা মারো দেখি। আমি একটা গুলি করে পালাবো।
রফিক কাঁপা কাঁপা হাতে টর্চের আলো লাশের উপর ফেলল। তারা দু’জনেই চমকে উঠল। লাশের উপর একটা নারীমূর্তি বসা। হামিদুর প্রায়ই ট্রিগার চাপতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ লক্ষ্য করলেন এ যে বাজারের পাঁচী পাগলী। ডালের উপর বসে হিহি করে হাসছে। তার হাসির ঠেলায় ডালটা থর থর করে কাঁপছে। সেই সাথে লাশটাও দুলছে।
রফিক দ্রুত গাছে উঠে পাগলীকে নামিয়ে আনল। তাকে আর কি বলবে- পাগল মানুষ! শেষতক সারারাত পাগলীর গান শুনে তারা লাশ পাহাড়া দিতে লাগল।
২| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১২
মুদ্দাকির বলেছেন: নাইস!! মনে হইল নাটক দেখলাম !!
৩| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩
অভ্রনীল হৃদয় বলেছেন: ভালো লেগেছে গল্প।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১৯
মাকড়সাঁ বলেছেন: Darun ses line a vul vaglo protom vabcelam bhoot er golpo
