নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর - "দ্যা ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট" / ভারতীয় শিল্পকলায় পশ্চিমা আধুনিকতা আনায়নের প্রাণপুরুষ
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬৭ - ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ) ছবি নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে তিনি যে সময়ে বেড়ে উঠেছেন শিল্পী হিসেবে - সে সময়কার পারিবারিক, স্থানিক, ও বৈশ্বিক প্রতিবেশ। গগন ঠাকুর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংসারে, রবীন্দ্রনাথের জন্মের ছ' বছর পর। তিনি দেহত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথের তিন বছর পূর্বে। মধ্যিখানে তার যে একষট্টি বছরের আয়ুষ্কাল, তারমধ্যেই তিনি বাংলার চিত্রকলায় এমন কিছু অবদান রেখে গেছেন - যার ফলে তাকে ডিঙ্গিয়ে বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে আমাদের মন খচখচ করে। ইন্ডিয়ান স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট এর গঠনকালীন সময়ের তিন মৌলিক প্রতিভা, যারা ঠিক অ্যাকাডেমিক রীতিতে চিত্রকলা চর্চা করেন নি, অথচ স্বমহিমায় ভাস্বর - গগনেন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম একজন। বাকি দু'জন, বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং যামিনী রায়।
কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি এমন একটি জায়গা, যেখানে উনিশ শতকের হিন্দুপ্রধান বাংলা সমাজে প্রথাভাঙ্গা অনেক বিপ্লবের নীরব - সরব সূচনা হয়েছে। ব্রাহ্ম আন্দোলন, প্রথাবিরোধী জমিদারীর প্রচলন (রবীন্দ্রনাথের আমলে), বাংলা সাহিত্য - সংস্কৃতির নতুন দিগন্তের সূচনাসহ সুক্ষ / মোটাদাগের আরও অনেক ভূমিকাই এই পরিবারটির আছে, উনবিংশ - বিংশ শতকের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ও বাঙ্গালীর জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন আনায়। সৃজনশীলতার বিন্দুমাত্র স্ফুলিঙ্গ কারো মনের মধ্যে থাকলে তাকে প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করবার মত হাওয়া ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে বারোমাস দিবা-রাত্রিতে প্রবাহিত হত। তারই ফলশ্রুতিতে দেবেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন , ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট, আরও কতো কি।
কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যে সময়টা ছিল ব্রিটিশ শাসনের। সময়টা ছিল লুটপাট, এবং দাসত্বের। সময়টা ছিল - "হোয়াইট ম্যান'স বার্ডেন" -এর উসিলায় অশিক্ষিত বর্বর ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার নামে ঔপনিবেশিকতাকে আইনসিদ্ধ করে তোলার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর, মানবতার অপরিসীম বিপর্যয়ে, ট্রেঞ্চ যুদ্ধের নামে প্রায় চারকোটি মানুষের মৃত্যুর বিভীষিকা অবলোকন করার পর - পৃথিবী আর আগের মত থাকে নি।
আমাদের আজকের আলোচ্য শিল্পী, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেড়ে উঠেছেন এইসকল ঐতিহাসিক ঘটন-অঘটনের ঘাত-প্রতিঘাতে।
শিল্পীমানস সৃজনের প্রাথমিক দিনলিপিঃ
চিত্রঃ প্রতিমা বিসর্জন ( ১৯১৫ - ১৯২০ এর মধ্যে অঙ্কিত)
প্রথাগত শিল্পচর্চায় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহ জন্মে অনেক পরিণত বয়সে। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯০৫ সাল থেকে গগন ঠাকুরকে নিয়মিত চিত্ররচনায় ব্যপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, এবং বিলেতি কায়দায় জলরঙের কাজ তিনি শিখেছিলেন হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। ওকাকুরা কাকুজো'র বিজুইৎসেন স্কুল অফ আর্টের কেতায়, স্বয়ং জাপান থেকে আগত শিল্পীদের কাছ থেকেই জাপানী কালি - তুলির কাজ , এবং ওয়াশ টেকনিকে প্রতিকৃতি, নিসর্গ চিত্র , এবং ঐতিহাসিক বিবিধ বিষয়ে ছবি আঁকা তিনি শিখেছেন, এবং এঁকেছেন। কিন্তু আমাদের আগ্রহের মূল জায়গাটি হচ্ছে, তার পৃথিবী দেখার টেকনিক্যাল বা কৃতকৌশলী দৃষ্টিভঙ্গীটি গড়ে উঠেছে কীভাবে।
চিত্রঃ জাপানী অনুপ্রেরণায় গগন ঠাকুরের অঙ্কিত একটি ছবি (রচনাসন অজ্ঞাত)
অশোক ভট্টাচার্যের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, যুবাবয়সে তার আগ্রহ ছিল ফটোগ্রাফিতে। ফটোগ্রাফি চর্চা তখন সারা পৃথিবী জুড়েই ততটা সুলভ নয়, ভারতে তো আরও নয়। তবুও, ঠাকুর বাড়ির সন্তান হিসেবে একখানি ক্যামেরা জোগাড় করে নেয়া তার জন্য কষ্টদায়ক ছিল না, এবং ছবি তুলে বাড়ির মধ্যে একটি ডার্করুম বানিয়ে নিয়ে তাতে বিস্তর সময় তিনি কাটিয়েছেন আলোছায়ার দ্বন্দ্বের পর্যবেক্ষণে। ডার্করুম ছাড়াও ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলের আঙ্গিক এবং তাতে দিবারাত্রি জুড়ে যে আলোআঁধারির জগত, তাও তাকে অনুপ্রাণিত করেছে কিয়ারসক্যুরো/ আলোছায়ার দ্বন্দ্ব এবং স্থাপত্যনির্ভর ছবি আঁকতে। জানা যায় যে, এতদসঙ্গে তার অভ্যেস ছিল প্রিজমের উপর সূর্যকিরণের প্রতিফলনে উদ্ভূত সাতরঙের ইন্দ্রজাল পর্যবেক্ষণের। তার ভাবীকালের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছবি, যেমন সাতভাই চম্পা, বা আলাদীনের গুহা - ইত্যাদি ছবিতে প্রিজমের রঙের বর্ণচ্ছটা পরিলক্ষিত হয়।
গগন - চিত্রবৈশিষ্ট্যঃ
১। আধা - ঘনকবাদী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ
চিত্রঃ সিটি ইন দা নাইটস ( ১৯২০ - ২৫)
গগনেন্দ্রনাথের মূল খ্যাতির জায়গাটা এই যে - তিনি ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে "আধুনিক" শিল্পকলার চর্চা আরম্ভ করেছিলেন সর্বাগ্রে। এই আধুনিকতা, অবশ্যই ইউরোপীয় কেতার আধুনিকতা।
ঘটনা যারা ঘটায়, তাঁদের ঘটনের দ্যোতনায় জন্ম নেয় অনেক বৌদ্ধিক / শৈল্পিক প্রতিঘাত। ডাচ আর পর্তুগিজরা যেদিন থেকে তাঁদের নৌবহরে চড়ে বিশ্বের মানচিত্র চষে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল, সেদিন থেকেই সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিবিধ ঘটনা তারাই ঘটিয়েছে। ফলে ইউরোপেই তার প্রতিঘাত স্বরূপ জন্ম নিয়েছে বিবিধ বৌদ্ধিক / শৈল্পিক তত্ত্বের। মডার্নিজম, বা আধুনিকতা সেরূপেই পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত মাল। কিন্তু এ বস্তু বাংলার শিল্পকলায় আমদানি করবার জন্যে আমরা গগন ঠাকুর বা একই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী কোন ভারতীয় শিল্পীকে দোষারোপ করতে পারি না। শিল্পীর স্বাধীনতা আছে যা ইচ্ছে তাই দ্বারা অনুপ্রাণিত হবার, এবং নিজের স্বতন্ত্র পথ খুঁজে নেবার।
শিল্প সমালোচক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বলেন -
"নিশ্চিতভাবে বলা চলে ১৯২০ সালের পর গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে আধুনিক ইউরোপীয় শিল্পের প্রভাব আত্মপ্রকাশ করেছিল। শিল্পের অবচ্ছিন্ন (অ্যাবস্ত্রাক্ট) গুণ আবিষ্কার করার নানা প্রচেষ্টার সঙ্গে সম্ভবত গগনেন্দ্রনাথের পরিচত ছিল। জার্মান শিল্পীদের সৃষ্টি কোল্যাজ, মন্দ্রিয়ানের রচনা, ক্যান্ডিনস্কি ইত্যাদি শিল্পীদের রচনাতে যে দ্বিমাত্রিক প্যাটার্নের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় গগনেন্দ্রনাথের কাজের সাদৃশ্য তার সঙ্গে।"
১৯২২ সালে, ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টের মুখপাত্র রুপম পত্রিকায় গগনেন্দ্রনাথের কিছু ছবির প্রতিলিপি ছাপিয়ে সমালোচক স্টেলা ক্রামরিশ - "অ্যান ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট" - শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখে ভারতীয় ঘনকবাদী গগনেন্দ্রনাথকে আলোচনায় নিয়ে আসেন।
চিত্রঃ দা ভায়লিন অ্যান্ড দা প্যালেট, জর্জ ব্রাখ, কিউবিজম (১৯০৯)
চিত্রঃ গুয়ের্নিকা , পাবলো পিকাসো , কিউবিজম (১৯৩৭)
জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, যে কিউবিস্ট রীতি পিকাসো বা ব্রাখ সৃষ্টি করেন, এবং সৃষ্টি করেন তৎপূর্ব ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের রূপনির্মিতির তারল্যে বিরক্ত হয়ে - তার সঙ্গে গগন ঠাকুরের চর্চিত কিউবিজমের তফাৎ বিশাল। একটি নির্দিষ্ট বস্তুকে যত সম্ভব পয়েন্ট অফ ভিউ/ অ্যাঙ্গেল থেকে দেখা সম্ভব, সে সমস্ত পয়েন্ট অফ ভিউ বা অ্যাঙ্গেলসহ বস্তুটিকে যদি একত্রে ক্যানভাসে তুলে আনা যায়, তো সেটা হবে একটি কিউবিস্ট বা ঘনকবাদী চিত্র। কিউবিস্ট চিত্ররীতি বিশেষ গুরুত্ব দেয় রূপায়িত বস্তুর গড়নে, মানে যে বস্তুটি ছবির ফোকাস, তার শরীরে। তার গড়নকে বিশ্লেষণধর্মীতায় একই সঙ্গে নানা দিক থেকে চিত্রপটের নিজস্ব রূপশৃঙ্খলায় তুলে ধরা হচ্ছে পিকাসো বা ব্রাখের চর্চিত কিউবিজমের মূল লক্ষ্য। বলা বাহুল্য, গগন ঠাকুরের আধা ঘনকবাদী চিত্রকলার মূলে রয়েছে তার চে' ভিন্ন কিছু। রয়েছে গড়নের পরিবর্তে আলো এবং তার বিপরীতে ছায়ার গতিপ্রকৃতির বিশ্লেষণ।
চিত্রঃ সাত ভাই চম্পা, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আধা ঘনকবাদী চিত্রকলা, চিত্ররচনার সময় অজ্ঞাত
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গগন ঠাকুরের ঘনকবাদী চিত্রকলাকে ভিন্ন করে দেখান পাশ্চাত্যে ব্যবহৃত ঘনকবাদী চিত্রকলার সঙ্গে। তার মতে -
ক) পশ্চিমা কিউবিজম একটি চিত্রের ন্যারেশন, বা চিত্রের মাধ্যমে গল্প বলাকে প্রাধান্য দেয় না, বরং তাতে ছবিটি দেখার মুহূর্তে সৃষ্ট অনুভূতিই প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু গগনেন্দ্রনাথের কিউবিস্ট ধাঁচের ছবিগুলি ন্যারেশনধর্মী, ছবিতে নির্দিষ্ট একটি পটভূমি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবং তা ছবির দর্শককে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে।
খ) পশ্চিমা কিউবিজম ছবির মুখ্য বস্তুর এসেন্স, বা সারাৎসারকে ছবিতে উন্মোচন করে, গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে মুখ্য বস্তু তার আশেপাশের চিত্রিত বিষয়াদির সাথে জৈবিকভাবে / ন্যাচারালি সম্পৃক্ত, সামগ্রিক যে পরিবেশ ছবির মুখ্য বস্তুটিকে ঘিরে রেখেছে - সেখান থেকে শুরু করে, অর্থাৎ, বাহির হতে ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে আমাদের দৃষ্টিকে টেনে আনেন। বাহির, তার ছবিতে বরাবরই থেকে যায় রেফারেন্ট হিসেবে, কন্ট্রাস্ট তৈরি করবার জন্যে।
গ) পাশ্চাত্যের কিউবিস্টধর্মী ছবি যেখানে মুখ্যত বৌদ্ধিক বা ইন্টেলেকচুয়াল, গগনেন্দ্রনাথের কিউবিস্ট ছবি নান্দনিক। পাশ্চাত্যের কিউবিজম যেখানে ব্যবচ্ছেদধর্মী, বিশ্লেষণধর্মী, গগনেন্দ্রনাথের কিউবিজম সংশ্লেষণধর্মী ও সাংগীতিক।
ঘ) গগনেন্দ্রনাথের ছবির পেছনের যে সক্রিয় কল্পনা, যেটাকে চিত্র সমালোচনার ভাষায় আমরা কোয়ালিটি অফ ইমাজিনেশন বলি, তার শেকড় দেশজ এবং ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারের সূত্রে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত।
২। কিয়ারসক্যুরো বা ছবিতে আলো-ছায়ার খেলাঃ
চিত্রঃ মিটিং অ্যাট স্টেয়ারস ( ১৯২০ - ২৫)
আলো ব্যবহারে গগনেন্দ্রনাথ কিছুটা রক্ষণশীল বলে ধারণা করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে দেখা যায়, তিনি ছবিতে আলোকে কেন্দ্রীভূত করতে পছন্দ করতেন। ছবির ক্যানভাসের পেরিফেরি অঞ্চলে আঁধার রেখে হুট করে মাঝখানে আলো ফেলা তার একটি বিশেষ টেকনিক ছিল। তার আধা ঘনকবাদী ছবিগুলোতে এক বিশেষায়ন সংযুক্ত করে আলো আধারির খেলায়। পশ্চিমা কিউববাদী শৈলীর কোন ছবিতে শুধু আলো - অন্ধকারের মাধ্যমে জ্যামিতিক বিন্যাস দেখানো হয়েছে কিনা , সেটা অনিশ্চিত।
তা ছাড়াও, করা আলো পেয়ে তাঁর ছবির বস্তু বা ফিগর ছবিতে নিজেই ছায়া ফেলল, যা ছিল তাঁর আগে ভারতীয় ছবিতে এক বিরল বস্তু।
পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানি যে, জীবনের একটা দীর্ঘ সময় তিনি ক্যামেরার সঙ্গে, ডার্করুমে আলোছায়ার সন্নিকটে কাটিয়েছেন। এটা ছাড়াও, তাঁর ছবিতে কিয়ারসক্যুরোর এ অনুপ্রেরণার আর এক উৎসস্থল হিসেবে মনে হয় আধুনিক মঞ্চসজ্জা এবং তাতে আলোর প্রয়োগে তাঁর আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর সহ আরও বিভিন্ন মঞ্চনাটকের মঞ্চসজ্জা ও আলোকসজ্জায় তাঁর ভূমিকা থাকতো। মঞ্চসজ্জার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় বিবিধ এক্সপেরিমেন্টাল ডিজাইনের ব্যাপারে তাঁর ছিল অগাধ দক্ষতা।
৩। ফর্ম ও স্পেসের ব্যাপারে নতুন ধারণার আনায়নঃ
চিত্রঃ বেড অফ অ্যারোস / শরসজ্জা (রচনাকাল অজ্ঞাত)
চিত্র সমালোচক অশোক মিত্রের লেখনীতে আমরা পাই -
"যে সব ভারতীয় শিল্পী ফ্রেমের অন্তঃস্থিত ছবির জমি বা স্পেসকে ইয়োরোপীয় নীতিতে বিশ্লেষণ করতে শিখেছিলেন এবং পারতেন গগনেন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে সবচে দক্ষ ও সফল বলা যায়।"
পনেরো শতকের পর থেকে ইউরোপীয় শিল্পীর প্রধান কর্তব্য ছিল ছবিটি, যেটি তিনি আঁকছেন, তা এমন করে আঁকতে হবে যাতে অঙ্কের মত বার করা যায় দর্শক কট দূরে, উপড়ে বা নীচে দাঁড়িয়ে ছবির দৃশ্য দেখছেন, এবং যেখানে দাঁড়িয়ে দেখছেন বাস্তব জীবনেও সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলে শিল্পী সেটাকে যেভাবে দেখছেন , দর্শক সেভাবে দেখতে পারবেন কিনা।
চিত্রঃ রেমব্রান্টের দা নাইটওয়াচ (১৬৪২) , পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার দ্রষ্টব্য
যদিও ইউরোপীয় শিল্পীরা মুখ্যত জ্যামিতির হিসাব ও পারস্পেক্টিভকে চিত্রাঙ্কনের পারফেকশনের মুখ্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করলেন, ভারতীয় শিল্পীরা কখনো এই ধরণের পরিপ্রেক্ষিতের মাপকাঠিতে ছবির সফলতা বিফলতা কখনো মাপেন নি। ফলে আমাদের দরবারি চিত্রকলার যে ছবিই আমরা দেখি না কেন, দর্শক হিসেবে আমরা দাঁড়াই একদম ছবির জমির মধ্যে, এবং ছবির মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর একটা অনায়াস স্বাধীনতাও, বা ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে তাকালে ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের উপস্থিতি আবিষ্কারের সুযোগ আমাদের থাকে। অর্থাৎ ভারতীয় দরবারি চিত্ররীতি মুখ্যত খোলা বা ফ্রেমহীন - ওপেন কম্পোজিশন যা দেখলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে হয় সেটি একটি বৃহত্তর দৃশ্যের টুকরো মাত্র, যার ডাইনে বায়ের ছবিগুলো যেমন তেমন ভাবে কাটা পড়েছে।
চিত্রঃ পারসিক / মুঘল ফ্রেমহীন দরবারি চিত্রকলা (সন অজ্ঞাত)
গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে আমরা লক্ষ্য করি, প্রথমবারের মত ভারতীয় কোন শিল্পী ছবির স্পেসের বিশ্লেষণ ও ব্যবহারে ইউরোপীয় রীতির নিদারুণ অনুবর্তী। ছবির জমিকে তিনি বৈজ্ঞানিকসুলভ ভঙ্গিতে ভাগ করে বিষয়বস্তুর প্যাটার্নটি মেপেনিয়ে কক্ষে কক্ষে ন্যস্ত করতেন, ফলে তার ছবিতে যে জ্যামিতিক সংহতি, বাঁধন, কাঠিন্য এবং ঋজুতা আসতো, তা সাক্ষাৎ ইউরোপিয়ান ক্লোজড কম্পোজিশনের মত। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বলেন -
"নির্দিষ্ট আকারের ইটে গাঁথা দেয়ালে যেমন টেনশনের সৃষ্টি হয়, অনুরূপ টেনশন বা বাঁধুনি গগনেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত চিত্রের প্রাণস্বরূপ।"
৪।ব্যঙ্গচিত্র বা ক্যারিকেচারঃ
চিত্রঃ ক্যারিকেচার - ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট (১৯১৭, নিজে পুরোদস্তর সাহেব, স্ত্রীকে সাহেবি কেতায় পোশাক না পড়াতে পারলেও পায়ে মুজো, আর হিলজুতো গলিয়ে দেয়া হয়েছে )
ভারতীয় চিত্রে তাঁর বিশিষ্ট দান হচ্ছে তাঁর অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্রাবলী, বা ক্যারিকেচারসমূহ। তৎকালীন বঙ্গসমাজের নানা ছুঁৎমার্গ, ব্যারিস্টারদের স্বদেশীয়ানা, ইউরোপিয়ানদের অন্ধ অনুকরণে জীবনযাপনের ব্যাপারে তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে প্রকাশিত শ্লেষ যেমন তীব্র, তীক্ষ্ণ, তেমনি গভীর। সাধারণত যে কার্টুনগুলি আমরা সকালে খবরের কাগজে দেখি, প্রায়শই বিকেলে সেগুলো আর আমাদের মনে থাকে না। কিন্তু চিত্র সমালোচক অশোক মিত্র বলেন - "গগনেন্দ্রনাথের কার্টুন অস্ত্রচিকিৎসকের ছুরির মত; যেমন বদরক্ত বার করে দেয় তেমনি দাগও রেখে যায়।" বাস্তব জীবনে তাঁর কবিত্বময় মন যেখানেই পীড়িত হয়েছে, সেখানেই তাঁর ব্যঙ্গ ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত লোক, বিরুপবজ্র, নবহুল্লোড় নামে তাঁর প্রকাশিত তিনখানা ব্যঙ্গচিত্রের সংকলন বাংলার চিত্রকলার ইতিহাসে এক ভিন্ন ধারার সংযোজন।
ক্যারিকেচার - প্রণাম বিভ্রাট (খেয়াল করে দেখুন, কোলকাতার হিন্দু বাবু টুপি উঁচিয়ে ভগবানকে অভিবাদন জানাচ্ছে)
ক্যারিকেচার - ইউনিভার্সিটি মেশিন (সন অজ্ঞাত)
ক্যারিকেচারঃ ব্রাহ্মণের অবিনাশি পবিত্রতা (১৯১৭)
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ক্যারিকেচার - পোয়েটস ফার্স্ট ভিজিট ফ্রম লন্ডন টু প্যারিস, (১৯২১)
৫। একজন যারপরনাই শহুরে চিত্রকরঃ
চিত্রঃ গগনেন্দ্রনাথের শিরোনাম ও রচনাসনবিহীন একটি জলরঙ্গের কাজ
শহুরে কবি, শহুরে সাহিত্যিকের সাথে মিলিয়ে শহুরে চিত্রকর - এই বিশেষণগুলো কোন শিল্পীকে, বিশেষ করে একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যখন দেশে তুমুল আকারে চলছে, তখন কোন সুবিধা দেয় না, তা বলাই বাহুল্য। গ্রামে ফিরে যেতে হবে, দেশমাতৃকার টানে রচনা করতে হবে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও ছবি। গগনেন্দ্রনাথ ঠিক এমন কোন দায় নিয়ে শিল্প চর্চার পথে আসেন নি, তা তাঁর ছবি দেখেই বোঝা সম্ভব।
ভারতের অধিকাংশ প্রথম শ্রেণীর শিল্পীর কাছে আধুনিক কোলকাতা বা দেশের অন্য বড় কোন নগরের অস্তিত্ব তখন ছিল না, তারা নগর সম্বন্ধে অস্বস্তি বোধ করতেন, যদিও বা কখনো নগরের ছবি তারা আঁকতেন, এমন দৃশ্য সাধারণত আঁকতেন, বোঝা শক্ত হয়ে যেত কোন শহরের কোন পাড়ার ছবি এটা। মফস্বলের সঙ্গে মিল বেশী থাকতো তাঁর, হয়ে উঠত শহর এবং গ্রামের মাঝামাঝি কিছু একটা।
গগনেন্দ্রনাথ অপরদিকে শহরকে ধারণ করতেন মনে প্রাণে, কারণ তাঁর মেজাজ ছিল একান্ত সামাজিক, শহুরে। সন্ধ্যার পর শহরের কোন বাড়ির ছাতে দাঁড়িয়ে যখন আকাশের রেখা আঁকেন, তখন তাঁর ছবি থেকে কোলকাতা শহরের সান্ধ্য আকাশটাকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। যে কোলকাতা তাঁর জীবদ্দশায় ছিল নোংরা, বিশ্রী , অপরিসর অথচ রহস্যময়, অশোক মিত্রের ভাষায়, তবুও যার বুকে নিয়ত সুখ দুঃখ, হাসি অশ্রুর খেলা চলছে, সে কোলকাতাই ছিল গগনেন্দ্রনাথের ছবি আঁকার মূল অনুপ্রেরণা। ছায়াতপের দীপ্ত ব্যবহারে দুর্গা প্রতিমা ভাসানের যে ছবি তিনি আঁকেন, তায় শহুরে রাস্তার ছবি, কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট বলে ভাবতে কুণ্ঠা হয় না।
শহুরে বাড়ির অন্দরমহলে আলো প্রবেশ করার পর যে আলোছায়ার খেলা সৃষ্টি হয়, সামান্য গতির ফলে আলোছায়া পড়ে কীভাবে নানা পরিবর্তনশীল রঙের রহস্যময় জগত তৈরি করে, তা ছিল গগনেন্দ্রনাথের অসীম কৌতূহলের বিষয়। এর থেকেই তাঁর রহস্যময় রোম্যান্টিক বিষয়ক অধিকাংশ কিয়ারসক্যুরো ছবির সৃষ্টি।
সমালোচকের দৃষ্টিতে পরিসমাপ্তিঃ
সমাপ্তি টানতে গিয়ে এই কথাগুলোই পুনরায় স্মরণে রাখা বাঞ্ছনীয় বোধ করি যে - গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন ঠাকুর পরিবারের সন্তান। সম্ভ্রান্ত মার্জিত শৌখিন মন নিয়ে তিনি শিল্পের ক্ষেত্রে নানা ভাবের পরীক্ষা - নিরীক্ষা করেছিলেন , পৃষ্ঠপোষকদের কোন সাহায্য বা সহানুভূতির অপেক্ষা ছাড়াই। তাঁর ছবিতে অনুপস্থিতিও ছিল অনেক কিছুরই, যেহেতু তিনি ঠিক অ্যাকাডেমিক কায়দায় শিক্ষিত শিল্পী নন। বস্তু অপেক্ষা আবহ নির্মিতিতে তাঁর আগ্রহ একদিকে যেমন তাঁর চিত্র রচনাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে , অপরদিকে রূপনির্মিতিতে তাঁর অগাধ দক্ষতার অভাবকেও চিহ্নিত করে। তুলির টানে রেখা ইত্যাদি তাঁর রচিত প্রতিকৃতিতে পাওয়া গেলেও তাঁর রচনায় কোন ক্যালিগ্রাফি বা রেখাঙ্কন ধর্ম ছিল না। নরনারীর জীবন অবলম্বনে রচিত ছবির সংখ্যা অনেক কম, তদুপরি, মানুষের সুখ - দুঃখ, বা দৈহিক সৌন্দর্যের আবেদন গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে কখনোই প্রতিফলিত হয় নি। আকারগত বৈশিষ্ট্য ছাড়া অন্য কোন আবেদন গগনেন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিতে পাওয়া মুশকিল। মুখচোখের সূক্ষ্ম ভাবব্যঞ্জনা অথবা মানসিক অবস্থার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ প্রকটিত করার সামান্যতম প্রচেষ্টাও, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতে, তাঁর প্রতিকৃতিগুলোতে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ মানবিকভাব, নৈতিক বা আধ্যাত্মিক ধারণার রুপায়ন গগনেন্দ্রনাথের রচনায় কোনদিনই স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় নি। সর্বোপরি, কোন কোন চিত্র সমালোচক, যেমন, অশোক মিত্রের মতে, ইউরোপীয় কেতায় ক্যানভাসের স্পেসকে মেপেজুকে চিত্রঅঙ্কনের যে প্রয়াস গগন ঠাকুর ব্যবহার করেছেন, সেটাও ক্ষেত্র বিশেষে আরোপিতই মনে হয়।
তবুও আমাদের নব্যবঙ্গীয় চিত্রশৈলীর সম্বন্ধে, বা বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলে বরাবরই প্রাসঙ্গিকরূপে সামনে আসবেন গগনেন্দ্রনাথ। এবং, খুব সচেতনভাবে আমাদের গগন ঠাকুরের ছবিকে পাঠ করতে হবে অবনীন্দ্রনাথের ওরিয়েন্টাল স্কুল অফ আর্টের থেকে পৃথক করে।
ছবি - ডিসেম্বর ২০১৯ সালে বেঙ্গল আর্ট গ্যালারীতে প্রদর্শিত গগন ঠাকুরের কিছু ক্যারিকেচার পেইন্টিং এর সম্মুখে আমি
তথ্যসুত্রঃ
১। চিত্রকথা - বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় (১৯৮৪), অরুণা প্রকাশনী, কোলকাতা
২। বাংলার চিত্রকলা - অশোক ভট্টাচার্য (১৯৯৪), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কোলকাতা
৩। ভারতীয় চিত্রকলা (দ্বিতীয় খণ্ড) - অশোক মিত্র (১৯৯৬), আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কোলকাতা
৪। রবীন্দ্রনাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্পপ্রসঙ্গ - সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (২০১৯), বেঙ্গল পাবলিকেশনস, ঢাকা
৫। চিত্রসুত্রঃ [link|https://artsandculture.google.com/exhibit/gaganendranath-tagore-painter-and-personality/dwLioPF-eVptIQ|Gaganendranath Tagore: Painter and Personality
বরেন্দ্রভূম থেকে জাহাঙ্গীরনগর - বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস, আগের পর্ব (১০)
২৯ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ৯:২৬
সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব ভাই। আপনি সৌভাগ্যবান মানুষ। আমারও যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
©somewhere in net ltd.
১| ২৮ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৫১
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর পোস্ট।
জোড়াসাঁকো গিয়েছি। নিজের চোখে সব দেখে এসেছি। প্রতিটা অলি গলি হেঁটে বেড়িয়েছি।