নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প - ঘোরপ্যাঁচে আমজাদ হুসেইন

২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৫৭



সকাল, বিকেল, বা সন্ধ্যা - সময়ের ব্যাপারটা এক্ষেত্রে ধর্তব্য নয়, কারণ, এরকম পিলে চমকানো অট্টহাসি আমজাদ মহলে শেষ কবে, কে শুনেছে - কেউ মনে করতে পারে না। তাই সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের শুরুতে যখন পুরো বাড়ি জুড়েই সপ্তাহান্তের ছুটির আগাম আমেজ, এমন এক ঘুমঘুম সকালে বেমাক্কা হাসির কান ফাটানো আওয়াজে বাড়ির বাসিন্দাদের খাট থেকে পড়ে যাওয়ার দশা হয়। চোখ খুলে ধাতস্থ হতে তাঁরা সময় নেয় দু' - এক মিনিট। তারপর যে যার স্লিপিং গাউনের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে ছুটে চলে যে যার রুমের জানালা / বারান্দা বরাবর। আমজাদ মহলের ছোট ছেলে আরশাদ সাহেবের বুক ধুকধুক করতে থাকে, কেননা ঠিক গতকালই তিনি তার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি নির্বাপণ ড্রিলের আয়োজন করেছিলেন। সবার চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে সে এক হুলুস্থুল হুটোপুটি কাণ্ড কারখানা। এমন কিছুই কী হল বাড়িতে?

আরশাদ সাহেব এবং তার স্ত্রী জানালা দিয়ে তাকিয়ে বেমাক্কা আওয়াজের উৎসের ব্যাপারে কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। শব্দটা আসছে বাড়ির সম্মুখে, লন থেকে। লনে কি হচ্ছে তা দেখতে হলে যেতে হবে বাড়ির ডায়নিং রুমের সাথের বারান্দায়। তিনি আর তার স্ত্রী ছুটলেন আবার সেদিকে, সঙ্গেসঙ্গেই।

সেই বারান্দার কাছে গিয়ে তাঁরা আবিষ্কার করলেন, মা ব্যতীত বাড়ির সবাই, আরশাদ সাহেবের বড় ভাই এরশাদ সাহেব, এরশাদ সাহেবের স্ত্রী, তাঁদের কন্যা সিলভিয়া, এবং বাড়ির সব কাজের লোকজন পর্যন্ত জড়ো হয়ে আছে সেখানে। এরশাদ সাহেব ক্রমাগত তার গালে হাত বুলাচ্ছেন। তার দাঁড়ি খানিকটা বড় হয়ে গেছে। চুলকাচ্ছে কী? আসল ঘটনাটা কি?

এরশাদ সাহেবের ঘটনা খানিকটা ভিন্ন। আজ, এই মুহূর্তে, এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার ছোটবেলার করুণ কিছু স্মৃতি তার মনে হানা দিচ্ছে বারবার। যখনই তাঁদের বাবা, আমজাদ মহলের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ হুসেইন খান - তাঁদের শৈশবের কোন কর্মকাণ্ডে রেগে গিয়ে কানে ঝিঁঝিঁ ধরানো চড় বসাতেন, তার আগে তিনি নানারকম অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করতেন নিজের রাগ কমিয়ে আনার। তারই মধ্যে একটা কাজ ছিল ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাসি দেয়া।

ডায়নিং রুমের সাথে যে বারান্দা, তার গ্রিলের ওপাশে, লনে যে দৃশ্যটি দেখা যাচ্ছে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া দরকার। তিনদিকে উঁচু বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা তাঁদের সুদৃশ্য লনের পরিধি ঘিরে বৃত্তাকার পথে ক্রমাগত পাক খেয়ে দৌড়াচ্ছে তাঁদের জার্মান স্পিৎজ প্রজাতির কুকুর রেইকো। আর সেই বৃত্তের কেন্দ্রে, লনের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের বাবা আমজাদ হুসেইন খান। পরনে তার সাদা টিশার্ট, সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা মুজো এবং সাদা কেডস। কোমরে দু' হাত রেখে একবার তিনি কিছু খোঁজার ভঙ্গীতে বেশখানিকটা উবু হচ্ছেন, আবার জাম্প দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে ভেঙ্গে পড়ছেন অট্টহাসিতে। এইসব দেখে - শুনে আমজাদ হুসেইন খানের বড় ছেলে এরশাদ হুসেইন খানের নিজের গালে হাত বুলানো ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না, যদিও চড়চাপড় খাওয়ার বয়স তিনি ফেলে এসেছেন প্রায় দু' দশক আগেই।

একই অস্বস্তিকর অস্পষ্টতার এক বাতাস ডায়নিং রুম জুড়ে প্রবাহিত হতে থাকে ব্রেকফাস্টের সময় জুড়ে, যখন আমজাদ হুসেইন খান সবাইকে স্বাস্থ্যকর ব্রেকফাস্টের উপর একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করেন। আরামপ্রিয়, আমুদে, কোনকালেই শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপনের তোয়াক্কা না করা আমজাদ হুসেইন কেন আজ সকাল সকাল সবাইকে নিয়ম মাফিক জীবন যাপন নিয়ে লেকচার দিচ্ছেন, তা কারই বোধগম্য হয় না।

- ' সকাল সকাল কিছুক্ষণ দ্রুতগতিতে হাঁটা, কিছুক্ষণ স্পষ্ট জগিং, কিছুক্ষণ জোরে জোরে হাসা - এই সার্কেলের কন্টিনিউয়েশন মানুষের বয়স দশ বছর কমিয়ে দেয়।'
টোস্টেড ব্রেডের ওপর আলমণ্ড বাটার মাখাতে মাখাতে বললেন আমজাদ সাহেব।

- 'কিন্তু দাদু, তোমাকে তো আজ সকালের জাম্পিং অ্যান্ড জগিং এর পর আরও দশ বছর বুড়ো লাগছে!'

আমজাদ সাহেবের নাতনী সিলভিয়ার স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্যে তার ঝুলে যাওয়া মুখ দেখে সবাই ক্ষণিকের জন্যে বাকরহিত হয়ে পড়লে, এবার তাঁদের পিলে চমকে দিয়ে হেসে ওঠেন তাঁদের মা, আমজাদ সাহেবের পঞ্চাশ বছরকালের সহধর্মিণী হাসিনা বেগম। আজ ভোরবেলা থেকে তার দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল ধরে পরিচিত এই মানুষটির অপরিচিত আচরণে তারই মজা লাগছিল সবচে বেশী।

- 'তা বাবা, আমাদেরও তো মাথার ওপর একজন মুরুব্বী প্রয়োজন। এতদিন পর, আজ হঠাৎ আপনার বয়স কমানোর কি প্রয়োজন পড়লো?'

আমজাদ সাহেব তার ছোট ছেলে আরশাদের বৌয়ের প্রশ্নে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লেন বটে। দু' দুটো পুত্রের অধিকারী, কিন্তু কন্যাহীন আমজাদ হুসেইন খান তার ছোট ছেলের বৌকে একটু অধিক প্রশ্রয় দেন। বড় ছেলে এরশাদের বৌ একটু বেশী সংসারি, হিসেবী। ছোট ছেলের প্রেমের বিয়ে হলেও, ছোট বৌটাকে তার পছন্দ হয়েছিল।

এমন সময় একটা ডাঁশা মৌমাছি কোথা থেকে যেন উড়ে এসে সবাইকে ত্যক্ত করা শুরু করে। সবাইকে তটস্থ, সন্ত্রস্ত করে সেটা গিয়ে বসে ফালি করে কেটে রাখা পাকা আমের উপর। মার মার আওয়াজ তুলে সবাই যখন মৌমাছি নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে, এমন সময় আমজাদ সাহেব পুনরায় দার্শনিকের মত বলে ওঠেন,

- 'ছেড়ে দাও মৌমাছিটাকে। ফলে যদি ফরমালিন মেশানো না থাকে, ফল যদি খাঁটি হয়, তার উপরে মৌমাছি তো ঝাঁপিয়ে পড়বেই! এতে মৌমাছির কি দোষ, আর ফলেরই বা কি দোষ?'

সবাই আবারো কিছুক্ষণ কথা ভুলে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়, তারপর মনোযোগ দিয়ে নাস্তা করতে থাকে।
বেলা দশটা বাজার আগেই যখন নিজের প্লেইন হোয়াইট পার্টি স্যুট পরে প্রাডোতে চড়ে বসলেন তিনি অফিস বরাবর, তাও স্যুটের পকেটে লাল একটি গোলাপ গুঁজে - কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না সাহস করে। দিনটাই আজ অদ্ভুত।

গাড়ি যখন শান্তিনগরের মোড়ে এসে জ্যামে আটকা পড়লো , রাস্তার পাশে এক ফুলের দোকান দেখে আমজাদ সাহেব গাড়ির দরোজা খুলে পা বাইরে রাখলেন।

- 'স্যার কই যান? আমি নিয়া আসি কিছু লাগলে!'

গাড়ির ড্রাইভারকে দিশেহারা লাগে। একদিন আগেও এই রোডে জ্যামের মাঝে গাড়ি থামিয়ে স্যারের বড় ছেলে সিগারেট কিনতে গেলে ট্রাফিক পুলিশ ফাইন করে দিয়েছিল সিগন্যাল ছেড়ে দেয়ার পরেও তাঁদের গাড়ি ব্রেকে থাকার কারণে।

আমজাদ হুসেইন খান জবাব দেন না। তার রুচি অনুযায়ী ফুল যদি তার গাড়ির ড্রাইভার কিনতে পারতো, তাহলে তার মত পাঁচটা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকও সে হতে পারতো।

আজ আর ড্রাইভারকে ফাইন খাওয়া লাগে না। আমজাদ সাহেব দ্রুতই একতোড়া ফুল কিনে ফিরে আসেন। একটা গাড়িও একইঞ্চি সামনে এগোতে পারে নি। রাস্তায় পাটীগণিতের সরল অঙ্কের মত জটিল জ্যাম লেগেছে।

- 'রশিদ, তোমার পছন্দ কোন ফুল?'

- 'স্যার, ডিপেন্ড করে কার লাইগা কিনতেছি তার উপর। ধরেন আমাগো মান্ডা শ্রমিকলীগের সভাপতির লগে দেখা করবার গেলে রজনীগন্ধ্যা ফুলের স্টিক কিনা লয়া যাই। আবার বৌয়ের লিগা গেলে কখনো একটা গেন্দা ফুলের মালা, বা টকটকা লাল গুলাবের হালি।'

'গুলাবের হালি' , শুনেই আমজাদ হুসেইন ঠোঁট চেপে হাসেন। ফুল কি আণ্ডা, যে হালির হিসাবে কিনবে? তিনি তার কোলের ওপরে রাখা ঈষৎ হলুদ গোলাপের ওপর হাত বোলান। নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নেন। কাঁচা গোলাপের স্নিগ্ধ একটা ঘ্রাণ তার নাসারন্ধ্রে সুড়সুড়ি দিলে তিনি আবার তা নামিয়ে রাখেন কোলের ওপর। রশিদ এখনো কিছু একটা নিয়ে বকবক করছে, তিনি তাতে মনোযোগ না দিয়ে বাইরে তাকান।

লাল গোলাপের বদলে হলুদ গোলাপ। কালো হলে আরও ভালো হত। ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকোতে স্থির নিশ্চিন্ত বেতনের চাকরি ছেড়ে গার্মেন্টসের ব্যাবসা। তাও এমন একটা সময়ে - যখন এই খাতের কোন নিশ্চয়তাই ছিল না। মানুষ জানতো না যে এই সেক্টরটাতে টাকা খাটালে আসলে কি ফল হবে। কিন্তু আমজাদ হুসেইন খান ছেড়ে দেন ব্যাটের সেই নিশ্চিন্ত জীবনের চাকরি। নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে দু'কাঠা জমির ওপর একত'লা টিনশেড বাড়ি করে তাতে শুরু করেন নিজের প্রথম গার্মেন্টসের কাজ। একত'লা টিনশেড গার্মেন্টস দেখতে দেখতে ছ'তলা গার্মেন্টসে পরিণত হল বছর ঘুরতেই। একটা গার্মেন্টসের জায়গায় আরও চারটা নতুন। সব মিলিয়ে পাঁচটা। তারপর ব্যবসা ছড়িয়ে দিয়ে শুরু করলেন সিরামিকস উৎপাদন। এটাও পরিণত হল লাভজনক প্রতিষ্ঠানে। সব শেষ এখন আমজাদ অ্যান্ড কোং চেষ্টা করছে বাজারে তাঁদের নতুন সিমেন্টের ব্র্যান্ড নিয়ে আসতে। লাইসেন্সের কাজ হয়ে গেছে। এখন সাংগঠনিক দিকটা। কারখানা বসানো। শ্রমিক জোগাড় করা। এককথায়, যা কিছুতেই হাত দিয়েছেন আমজাদ হুসেইন খান, তাতে সোনা ফলেছে। কিন্তু তিয়াত্তর বছর বয়সে এসে সমস্যা হয়েছে এই যে, অনেক কাজেই এখন আর আগের মত কায়িক পরিশ্রম করা সম্ভব হয় না।
গাড়ি শম্ভুক গতিতে বেইলি রোডের মোড়ে এসে দাঁড়ালে বিশাল বিলবোর্ডে এক মডেলকে দেখা যায় কাপড়ের ব্র্যান্ড ইনডর্সিং এ। সেক্সি মেয়েটা।

সেক্সি।

আমজাদ হুসেইন খানের মনে পড়ে, এই শব্দটা তার জীবনে সবচে কম ব্যবহৃত একটা শব্দ।

সবসময় গতানুগতিক পথের বিপরীতে হেঁটেছেন আমজাদ। স্থির চাকুরীর নিশ্চিন্ত জীবন ঠেলে ব্যবসায়। স্থির, সুনিশ্চিত লাভের সম্ভাবনা সমৃদ্ধ একটা ব্যবসা ছেড়ে অন্যান্য ব্যবসায়। ঝুঁকি নিয়েছেন। জীবন তাকে দু'হাত ভরে দিয়েছে। ঘুরে দেখেছেন পৃথিবীর ১০০টার ওপরে দেশ। পার্টিতে গিয়েছেন। পার্টি থ্রো করেছেন। ঐ সোনালী রুপালী বিলবোর্ডে ঝুলে থাকা 'সেক্সি' মেয়ের মত মডেলদের সাথে দেখা হয়েছে। তাঁদের ভ্রুকুটি পড়া হয়েছে। তাতে যৌনতা, অর্থ, আর লাভলোকসানের অঙ্ক ছাড়া আর কিছু আমজাদ হুসেইনের ক্ষুরধার ব্যবসায়িক রাডারে ধরা পড়ে নি। বিবাহিত জীবনের পঞ্চাশটি বছর তিনি নির্বিবাদে কাটিয়ে দিয়েছেন তার গ্রামের বাড়ির পাশের গ্রামের মেয়ে হাসিনা বেগমের সাথে, যাকে আমজাদ হুসেইনের মায়ের পছন্দ ছিল বিশেষ করে। হাসিনা বেগম সাংসারিক জীবনে দারুণ চৌকস মেয়ে ছিলেন। গাঁয়ের ঘ্রাণ গাঁয়েই ফেলে এসে, আমজাদ হুসেইনের সাথে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে একধাপ একধাপ করে যে উন্নতি তাঁদের সংসারে হয়েছে, তার সাথে মানিয়ে নিয়েছেন দারুণভাবে।

গাড়ি জ্যাম ছাড়িয়ে হু হু করে ছুটে চলছে রামপুরা ব্রিজের ওপর দিয়ে।

হাতির ঝিলের দিকে তাকিয়ে খানিকটা আনমনা হয়ে যান আমজাদ হুসেইন। ভালোবাসা বলতে যে তীব্র উথাল পাথাল এক অনুভূতি, সংসার জীবনে সেটা কখনোই সেভাবে অনুভব করেন নি তিনি। পান নি, বলে খুঁজতেও যান নি কখনো সংসারের বাইরে গিয়ে। তিনি খোঁজেন নি, একইসঙ্গে তার প্রবল ব্যক্তিত্বের দেয়াল টপকে কেউ সাহসও করে নি তাকে ভালোবাসা জ্ঞাপনের।

স্মার্টফোনের স্ক্রিন আনলক করে তিনি ফেসবুকে গিয়ে তার সদ্য আপলোডকৃত প্রোফাইল পিকচারের ওপর ক্লিক করেন। রিঅ্যাকশন সমূহের ওপর ক্লিক করে দেখেন একশো উনিশটা লাইক, পাঁচজনের ওয়াও রিঅ্যাক্ট।

একটা লাভ সাইন। গতকাল রাতে থেকেই সাইনটা আছে। সরে যায় নি।

আমজাদ সাহেব সাহসী মানুষ। তিনি সাহসের মূল্যায়ন করতে জানেন। সাহসী মানুষদের পছন্দ করেন।

গাড়ি অফিসের বাইরে পার্ক করা মাত্রই সিকিউরিটি গার্ড ছুটে এসে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। লিফটে উঠে লিফটের সাত নম্বর বাটন প্রেস করার বদলে প্রেস করেন পাঁচ নম্বর বাটন। নিজের অফিস রুমের বদলে ম্যানেজমেন্ট সেকশনের ফ্লোরে। লিফটের কাঁচের দেয়ালে প্রতিবিম্বিত হয় আমজাদ সাহেবের ঝকঝকে সাদা স্যুট, বেল্টের স্টেইনলেস ষ্টীল, ক্রোকোডাইল লেদারের জৌলুস, শু এমনই পলিশ করা যে তাতে নিজের চেহারা পর্যন্ত দেখা যায়।

ম্যানেজমেন্ট ফ্লোরে এসে লিফটের দরজা খুলে যাওয়া মাত্রই রিসিপশন ডেস্কে বসা টেলিফোন অপারেটর থেকে নিয়ে অফিসের সবাই, সামনে যাকে যাকে দেখা যায়, একযোগে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই অসময়ে সিলভার সানশাইন গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক তাঁদের ফ্লোরে কি করছেন? কার চাকরি যাবে আজ?


আমজাদ সাহেব রিসিপশন ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ান,
- 'ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি সাদিয়া নুসরাতের ডেস্ক কোথায়?'

রিসিপশনে বসা মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে কোনমতে ফোন করে ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের হেডকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটতে ছুটতে হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট ছুটে আসে।

- 'স্যার, সাদিয়া তো জয়েন করেছে এই মাসেই। ও কি কোন ভুল করেছে? আমি এমনিতেও ওর সিলেকশন নিয়ে হ্যাপি ছিলাম না স্যার। বললে ওকে এখনি স্যাক করি! আপনার এজন্যে কষ্ট করে এখানে না এলেও তো চলতো স্যার। আমাকে রুমে ডাকলেই আমি এক ছুটে চলে আসতাম।'

আমজাদ সাহেব স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলেন,
- 'সাদিয়ার ডেস্ক কোনটা?'

আমজাদ সাহেবের দ্রুতগতির পদ সঞ্চারণের সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যার্থ হলেও কৌতূহল নামক মানবজাতির আদিমতম প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে প্রায় পুরো ম্যানেজমেন্ট সেকশন যখন আমজাদ সাহেবের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, তার পিছুপিছু সাদিয়া নুসরাতের ডেস্কের দিকে ছুটে চলে, আমজাদ সাহেবের ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁদের থামার নির্দেশ দিতে মন সায় দেয় না। ভীরু নন তিনি। সাহসিকতার মূল্যায়ন তিনি আজীবন করে এসেছেন। আজও তার ভিন্ন কিছু করবেন কেন? আর এতে কিছু সাক্ষীগোপাল থেকে গেলেই বা ক্ষতি কি? তিনি কি কাউকে পোঁছেন?

- 'ইউ আর সাদিয়া? সাদিয়া নুসরাত ...'

- 'ইয়েস স্যার! সাদিয়া নুসরাত আলম, স্যার ...'

- "ডিয়ার সাদিয়া, আই লাভ ইউ টু! রাদার, আই লাভ ইউ জিলিয়নস অ্যান্ড জিলিয়নস টাইম মোর! থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর শোয়িং দা কারেজ অফ ওপেনিং আপ!"

সাদিয়ার চোখদুটো রসগোল্লার মত গোলগোল হয়ে যায়।

- "কিন্তু স্যার আমি ..."

- "স্যার আমি - কি? তুমি না গতকাল আমার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারে লাভ সাইন দিলে?"





মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:০৮

কল্পদ্রুম বলেছেন: শুরুর সিরিয়াস কথাবার্তা এভাবে রম্যে মোড় নেবে ভাবিনি। ভালো লেগেছে।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৩৪

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ, কল্পদ্রুম! হুসাইন সাহেবের দুঃখে আরেকখানা কাঁটা পুঁতে দেয়ায় নিন্দাবাদ জ্ঞাপন করছি।

২| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৪৬

রাজীব নুর বলেছেন: পড়ে মজা পেলাম।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৩৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ, রাজীব ভাই!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.