![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। email: [email protected]
নববর্ষ: শেকড়ে ফেরার আহ্বান
লেখকঃ মোঃ আবু মুসা আসারি
বছর ঘোরে, সময়ের চক্র ঘুরে আসে আবারও এক নতুন ভোর—নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়। কিন্তু পয়লা বৈশাখ যেন শুধুই ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়; এ এক মননের ঋতু, এক জাতিসত্তার উন্মেষ, শিকড়ের মাটিতে পা রেখে দাঁড়াবার দিন। আমাদের প্রাচীন চেতনায় এদিনটি হয়ে ওঠে আত্মজিজ্ঞাসার আয়না, যেখানে উঁকি দেয় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছায়াপাত।
ইতিহাস: হিসাবের খাতা থেকে হৃদয়ের দিন
বাংলা বর্ষপঞ্জির শুরু হয় মুঘল দরবারে। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামক সনের প্রচলন করেন রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। তখনকার কৃষিনির্ভর সমাজে হিজরি চান্দ্র বর্ষে রাজস্ব সংগ্রহের অসুবিধা থাকায় সৌর পঞ্জিকার সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয় এই নতুন বর্ষপঞ্জি। হিসাব-নিকাশের খাতায় শুদ্ধতার প্রয়োজন থেকেই যে বাংলা সনের জন্ম, তা কালের পরিক্রমায় হয়ে ওঠে হৃদয়ের দিন।
কিন্তু কেবল রাজস্ব আদায় নয়, পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে আনন্দের রঙে রঞ্জিত এক জনউৎসব। হালখাতার লাল রেজিস্টারে যখন ‘শুভ নববর্ষ’ লেখা হতো সোনালি অক্ষরে, তখন তার পেছনে থাকত আশা, চুক্তি, সম্পর্কের নবায়ন।
বৈশাখ মানেই গ্রামবাংলার গন্ধ
বৈশাখ মানেই ঝড়ের আগমনী সুর, অথচ একইসঙ্গে এক প্রশান্ত সকাল। নীল আকাশে তপ্ত রোদ, কাঁঠাল পাতার নড়াচড়া, খেতের ফসলে দুলে ওঠা হাওয়া—সব মিলিয়ে বৈশাখ বয়ে আনে বাঙালির আত্মার উল্লাস। সেই আনন্দে যোগ হয় মেলা, মুখর হয়ে ওঠে হাট-বাজার, ঘরে ঘরে রান্না হয় পান্তা-ইলিশ, বাজে ঢোল আর একতারা।
এই পান্তা-ইলিশ আজ অনেক বিতর্কের জন্ম দেয় বটে, কিন্তু একদিন তো এ ছিল শ্রমজীবী মানুষের প্রতিদিনের আহার—বাঁসী ভাত আর নদীপাড়ের মাছ। এখন তা উঠে এসেছে নাগরিক প্লেটে, দামি হোটেলের মেনুতে। অনেকেই একে ফ্যাশনের অংশ বলে খারিজ করেন, অথচ ভেতরে ভেতরে এটি আমাদের কৃষিসংস্কৃতির গভীর প্রতীক। ইলিশ শুধু মাছ নয়, সে বাঙালির নদীপ্রীতির স্বাদ, সে বর্ষার গন্ধ, সে মাটির সঙ্গে আত্মিক সংযোগ।
আজকের বৈশাখ: আলোর নিচে ছায়া
২০২৫ সালের বৈশাখ এসেছে এক আলো-আঁধারির পটভূমিতে। শহরের উৎসবজুড়ে রঙ, ডিজিটাল আয়োজন, মুখোশ, শোভাযাত্রা—সবই যেন এক শিল্পময়, আনন্দময় আবহ তৈরি করেছে। কিন্তু তার ভেতরেই জন্ম নেয় কিছু অস্বস্তির প্রশ্ন। এবারের একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়—শিল্পকর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখাবয়ব ব্যবহার করে তৈরি একটি মোটিফ নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়, এবং পরবর্তীতে সেটি প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা—তা আমাদের সহনশীলতা, সংস্কৃতির পরিসর ও মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
সংস্কৃতি কি রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে না, নাকি তারও লাগবে অনুমতি? যে বৈশাখ মানুষকে একত্রিত করে, সে বৈশাখে যদি বিভক্তির রেখা টেনে দেওয়া হয়, তবে আমাদের উৎসবের মানে কোথায় থাকে?
উৎসবের আত্মা
পয়লা বৈশাখের প্রকৃত সৌন্দর্য তার সারল্যে, তার অন্তরঙ্গতায়। এটি কোনো ধর্মের নয়, কোনো দলের নয়—এটি বাঙালির, এ জাতির। উৎসবের মধ্যে যদি আমরা অন্তরের পরিচ্ছন্নতা খুঁজি, তবে বৈশাখ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সুন্দর হওয়া মানেই রঙিন হওয়া নয়, শুদ্ধ হওয়া।
আসুন, বৈশাখে আমরা শুধু পাঞ্জাবি পরে ছবি তুলেই না, আত্মজিজ্ঞাসার সামনে দাঁড়াই। নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা হোক সহনশীলতার, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধার, সংস্কৃতিকে অপব্যবহার না করে তাকে বাঁচিয়ে রাখার। উৎসব কেবল চেতনায় নয়, ব্যবহারেও ফুটে ওঠে।
উপসংহার
নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা যেন আবারও ফিরে যাই আমাদের মূলের কাছে। বৈশাখ হোক শুধুই একটি পঞ্জিকার পরিবর্তন নয়, হোক এক মনোজাগতিক বিপ্লব—যেখানে আমরা নিজেদের ভুল স্বীকার করি, সম্পর্ক মেরামত করি, শিকড়ের মাটি ছুঁয়ে পৃথিবীর দিকে হাঁটি।
বৈশাখ আসুক ধূলিমলিন হৃদয় ঝেড়ে ফেলতে।
আসুক নতুনের ডাক নিয়ে, অতীতের আলিঙ্গন পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হয়ে।
শুভ নববর্ষ ১৪৩২।
©somewhere in net ltd.