![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। email: [email protected]
লেখক: মোঃ আবু মুসা আসারি
বাংলাদেশের পাসপোর্টে বহুল আলোচিত ও প্রতীকী নির্দেশনা—“এই পাসপোর্ট ইসরায়েল ব্যতীত বিশ্বের সব দেশে বৈধ”—২০২৫ সালের এপ্রিলে আবারও যুক্ত হলো। ই-পাসপোর্ট চালুর সময় এই বাক্যটি বাদ দেওয়া হলেও চলমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিপরীতে বিশ্বজনমত ও দেশের আবেগের জায়গা থেকে সরকার পুনরায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত শুধু একটি বাক্যপদ নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রের বিবেক, নৈতিকতা এবং পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন।
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর দমন-পীড়নে নিহত হয়েছে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি, যার মধ্যে একটি বিরাট অংশই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা এই আক্রমণকে “যুদ্ধাপরাধ” বলেও অভিহিত করেছে। এমন সময়ে বাংলাদেশের তরফে একটি নীতিগত উচ্চারণ—‘Except Israel’ নির্দেশনার পুনর্বহাল—আন্তর্জাতিক পরিসরে নৈতিক অবস্থানকে নতুনভাবে চিহ্নিত করেছে।
তবে এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র আবেগ বা প্রতীকী পদক্ষেপ নয়; এটি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ নেই, এবং এই রাষ্ট্রটি নাগরিকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রেও নিষিদ্ধ। ফলে, পাসপোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞার ভাষাগত অপসারণ জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। এবার সেই বিভ্রান্তির অবসান হলো।
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেক মুসলিম দেশ যেখানে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে—যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো, সুদান—সেখানে বাংলাদেশ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চোখে এটি কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ইউরোপে রপ্তানি বাজার, বা আন্তর্জাতিক ফোরামে অবস্থান বজায় রাখার ক্ষেত্রে একধরনের জবাবদিহির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী কোনো দেশের প্রতি এমন নিষেধাজ্ঞা প্রযুক্তিগত সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে। মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট বা আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন সফটওয়্যারে ‘Except Israel’ নির্দেশনার জন্য বাড়তি যাচাইয়ের প্রয়োজন হতে পারে। এতে কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীরা অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন, যদিও এটি খুবই সীমিত মাত্রার সমস্যা।
কিন্তু এসব বাস্তবতার মধ্যেও বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—‘নৈতিক কূটনীতি’ এখনো সম্ভব। এটা কেবল এক দেশের অবস্থান নয়, বরং বিশ্বের বহু নিপীড়িত জনগণের কণ্ঠস্বরকে ধারণ করে। যেখানে বিশ্বশক্তিগুলো অনেক সময় অর্থনীতি ও কৌশলগত জোটের নামে ন্যায়ের প্রশ্ন এড়িয়ে চলে, বাংলাদেশ সেখানে এক দৃঢ় বার্তা দিল: আন্তর্জাতিক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো এখনো সম্ভব, এবং এর রাজনৈতিক মূল্য থাকলেও নৈতিক মূল্য অনেক বেশি।
শেষ কথা হলো—‘Except Israel’ নির্দেশনার পুনর্বহাল নিছক প্রশাসনিক সংশোধন নয়। এটি এমন এক সময়ের বিবেকী ভাষ্য, যখন সত্য ও অন্যায়ের পার্থক্য ধূসর হয়ে আসছে। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত নিপীড়নের বিপরীতে, ইতিহাসের পক্ষেই দাঁড়ানো—যেখানে একটি বাক্য হয়ে উঠেছে এক জাতির নৈতিক স্বাক্ষর।
©somewhere in net ltd.