নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ।\nemail: [email protected]

মো: আবু মুসা আসারি

ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। email: [email protected]

মো: আবু মুসা আসারি › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙালি সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদান: ইতিহাস, পরিচয় ও সাংস্কৃতিক সংহতির পুনর্মূল্যায়ন

১৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৪৫

লেখক: মোঃ আবু মুসা আসারি

বাংলা সংস্কৃতি একটি বহুত্ববাদী, বহুমাত্রিক ও ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত এক সাংস্কৃতিক পরিচয়, যার গঠন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় ও ঐতিহ্যের অবদান রয়েছে। সেই দীর্ঘ সাংস্কৃতিক যাত্রায় মুসলমানরা কেবল অংশগ্রহণকারী নয়, বরং সক্রিয় নির্মাতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অথচ আজও অনেক সময় ধর্মীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপকে সংকুচিত করে দেখা হয়। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে—“বাঙালি সংস্কৃতি কি শুধুই হিন্দু ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার?” না, বাস্তবতা হলো, মুসলমানদের ইতিহাস, ধর্ম, রুচি, বিশ্বাস, উৎসব, শিল্প ও ভাষা—সব মিলিয়েই বাঙালি সংস্কৃতি।

ইসলামের আগমন ও সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ

ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলমানদের উপস্থিতি শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে সুফি সাধক, দরবেশ, আলেম ও ভাষ্যকাররা বাংলায় ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মীয় আদর্শের সমন্বয় ঘটান। সুফিবাদ, যার মূল চেতনা মানবতাবাদ ও সহমর্মিতা, তা বাংলার সহজিয়া ও বৈষ্ণব ভাবধারার সঙ্গে মিলিত হয়ে এক নতুন মরমি ধারার জন্ম দেয়। বাউল, মরমি গান, লালন দর্শন—এসবের পেছনে রয়েছে এক আন্তঃধর্মীয় ভাবগত সংহতি, যা মুসলমানদের সংস্কৃতি ও চিন্তার জগতকে বাংলার মাটির সঙ্গে একীভূত করেছে।

ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় মুসলমানদের ভূমিকা

মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ বাংলা ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ দেখিয়েছে। তাঁরা আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় যুক্ত করলেও ভাষার মৌলিক কাঠামো বজায় রেখেছেন। ১৮-১৯ শতকে মুসলিম কবি ও লেখকরা মুসলিম সমাজের জীবনযাত্রা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নারীর অবস্থান, সমাজের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনা করেন। “ইমামগাজ্জালী”, “রহমতনামা”, “গাজী কালু-চম্পাবতী” ইত্যাদি রচনাগুলো শুধু ধর্মীয় সাহিত্য নয়, বরং জনগণমনস্ক এক ধরনের উপাখ্যানধর্মী সাহিত্য, যা বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় তৈরি হয়েছে। এই সাহিত্য ধর্মীয় বয়ান ও স্থানিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের এক যুগলবন্দি।

স্থাপত্য, পোশাক ও খাদ্যসংস্কৃতিতে প্রভাব

মুসলমানদের আগমনের পর বাংলায় এক নতুন স্থাপত্যধারা গড়ে ওঠে—যা মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। গৌড়, পাণ্ডুয়া, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদসহ অসংখ্য নিদর্শন আজও বাংলার মাটি জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এসব নিদর্শন শুধু ধর্মীয় চিহ্ন নয়, বরং সেগুলো বাঙালির নির্মাণশৈলী, কারিগরি দক্ষতা ও রুচির বহিঃপ্রকাশ।

পোশাক ও খাদ্যাভ্যাসেও মুসলমানদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুসলমানরা যেমন পাঞ্জাবি, টুপি, শেরওয়ানি প্রভৃতিকে বাংলার সমাজে জনপ্রিয় করেছে, তেমনি খাদ্যসংস্কৃতিতে এসেছে বিরিয়ানি, কাবাব, শিরমাল, হালিম, পোলাও-এর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ আইটেম। ঈদ ও কোরবানির মতো উৎসবের খাবারগুলো আজ শুধুই ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, বরং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হয়ে গেছে।

ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব: বাঙালি মুসলমানের বৈচিত্র্য

ঈদ, মহরম, শবে বরাত, মিলাদুন্নবী—এইসব ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলা গানের অনুষ্ঠান, লাঠিখেলা, মেলা, হালখাতা, পিঠাপুলির আয়োজন। গ্রামীণ সমাজে এসব উৎসব মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের মিলনস্থল হয়ে উঠেছে। এই সহাবস্থানই বাংলার সামাজিক সংহতির শক্তি।

ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয়

অনেকেই মনে করেন, ইসলাম মানেই এক কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন, যা লোকসংস্কৃতি বা স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। কিন্তু বাংলার মুসলমানরা দেখিয়ে দিয়েছেন, ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক সংবেদনশীলতা ও সমঝোতা সম্ভব। বাংলা ভাষায় আজান দেওয়া, বাংলা খুতবা, বাংলা কোরআন তরজমা, ইসলামী গানের বাংলা রূপায়ণ—এসবই এই সমন্বয়ের বাস্তব উদাহরণ।

ভাষাসংগ্রামী আনাস আনাম যেমন বলেছিলেন—“সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হচ্ছেন মুসলমান, আমাদের ধর্ম এবং আমাদের ঐতিহ্য—সব মিলিয়েই আমাদের সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিকে যদি আমরা এড়িয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদের মত বড় ভুল হবে না।”

সমাপনী ভাবনা: বহুত্ববাদী সংস্কৃতির স্বীকৃতি

বাঙালি সংস্কৃতিকে একক জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা ইতিহাস, সত্য এবং সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করে বাঙালি সংস্কৃতি অসম্পূর্ণ, একপেশে ও বিকৃত হয়ে পড়ে। তাই আমাদের সংস্কৃতির মূল্যায়ন করতে হলে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক চর্চা, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, জীবনযাপন ও দর্শনের প্রভাবকে সম্মান জানাতে হবে। একমাত্র এই স্বীকৃতিই পারবে আমাদের ভবিষ্যতের জাতিসত্তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ, উদার ও মানবিক পরিচয় দিতে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.