![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পল্লী কবি জসীমউদ্দিন এর কিছু কবিতা নিয়ে সাজানো হল এই ব্লগ।
১) আসমানী
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়,
সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।
পরণে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালী তার গার বরণের করছে উপহাস।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।
বাঁশীর মত সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।
আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে।
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।
খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে,
কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?
২) নিমন্ত্রণ
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে - নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা - লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া
তোর সনে দেই মিতালী করিয়া
ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।
তুমি যদি যাও - দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম - হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে - সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁঢো - চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।
তুমি যদি যাও - শালুক কুড়ায়ে, খুব - খুব বড় করে,
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;
সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটির যাহাতে খুশী তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া
এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব - কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।
খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,
কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।
ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।
ওরে মুখ - পোড়া ওরে রে বাঁদর।
গালি - ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ঘন কালো বন - মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়
মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!
আজি সে - সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।
তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে
লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।
মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।
৩) নিশিতে যাইও ফুলবনে
নিশিতে যাইও ফুলবনে
রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে।
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
আমি জেগে রব সারা রাতি গো;
কব কথা শিশিরের সনে
রে ভোমরা!
নিশিতে যাইও ফুলবনে।
যদিবা ঘুমায়ে পড়ি-
স্বপনের পথ ধরি গো,
যেও তুমি নীরব চরণে
রে ভোমরা!
(আমার ডাল যেন ভাঙে না,
আমার ফুল যেন ভাঙে না,
ফুলের ঘুম যেন ভাঙে না)।
যেও তুমি নীরব চরণে
রে ভোমরা!
নিশিতে যাইও ফুলবনে।
৪)প্রতিদান
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী, -
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি।
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর ;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।
আমার এ কুল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাঁধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি,
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল-মালঞ্চ ধরি ।
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বার্ণী,
আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
৫)আমার বাড়ি
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা,
গামছা-বাঁধা দই।
আম-কাঁঠালের বনের ধারে
শুয়ো আঁচল পাতি,
গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস
করব সারা রাতি।
চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো
মাখিয়ে দেব সুখে
তারা ফুলের মালা গাঁথি,
জড়িয়ে দেব বুকে।
গাই দোহনের শব্দ শুনি
জেগো সকাল বেলা,
সারাটা দিন তোমায় লয়ে
করব আমি খেলা।
আমার বাড়ি ডালিম গাছে
ডালিম ফুলের হাসি,
কাজলা দীঘির কাজল জলে
কাঁসগুলি যায় ভাসি।
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
এই বরাবর পথ,
মৌরী ফুলের গন্ধ শুঁকে
থামিও তব রথ।
৬) ফুল নেয়া ভাল নয়
ফুল নেয়া ভাল নয় মেয়ে।
ফুল নিলে ফুল দিতে হয়, -
ফুলের মতন প্রাণ দিতে হয়।
যারা ফুল নিয়ে যায়,
যারা ফুল দিয়ে যায়,
তারা ভুল দিয়ে যায়,
তারা কুল নিয়ে যায়।
তুমি ফুল, মেয়ে! বাতাসে ভাঙিয়া পড়
বাতাসের ভরে দলগুলি নড়নড়।
ফুলের ভার যে পাহাড় বহিতে নারে
দখিনা বাতাস নড়ে উঠে বারে বারে।
ফুলের ভারে যে ধরণী দুলিয়া ওঠে,
ভোমর পাখার আঘাতে মাটিতে লোটে।
সেই ফুল তুমি কেমনে বহিবে তারে,
ফুল তো কখনো ফুলেরে বহিতে নারে।
৭)আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে
আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে
প্রাণ বিনোদিয়া;
আমি আর কতকাল রইব আমার
মনেরে বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
কি ছিলাম, কি হইলাম সইরে, কি রূপ হেরিয়া,
আমি নিজেই যাহা বুঝলাম না সই, কি কব বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
চোখে তারে দেখলাম সইরে! পুড়ল তবু হিয়া,
আমার নয়নে লাগিলে আনল নিবাইতাম কাঁদিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
মরিব মরিব সইরে যাইব মরিয়া,
আমার সোনা বন্ধুর রূপ দিও গরলে গুলিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
আগে যদি জানতাম বন্ধু যাইবা ছাড়িয়া,
আমি ছাপাইয়া রাখতাম তোমার পাঁজর চিরিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
৮)গৌরী গিরির মেয়ে
হিমালয় হতে আসিলে নামিয়া তুষার বসন ত্যাজি,
হিমের স্বপন অঙ্গে মাখিয়া সাঁঝের বসনে সাজি।
হে গিরি দুহিতা তোমার নয়নে অলকার মেঘগুলি,
প্রতি সন্ধ্যায় পরাইয়া যেত মায়া-কাজলের তুলি।
তুহিন তুষারে অঙ্গ মাজিতে দুগ্ধধবল কায়,
রবির কিরণ পিছলি পিছলি লুটাত হিমানী বায়!
রাঙা মাটি পথে চলিতে চলিতে পথ যেন মমতায়,
আলতা রেকায় রঙিন হইয়া জড়াইত দুটি পায়।
অলকে তোমার পাহাড়ী পবন ফুলের দেউল লুটি,
গন্ধের বাসা রচনা করিত সারা রাত ছুটি ছুটি।
গহিন গুহার কুহরে কুহরে কলকল্লোলে ঘুরি,
ঝরণা তোমার চরণ বিছাত মণি-মানিকের নুড়ি!
পাষাণের ভাষা শুনিতে যে তুমি ঝরণায় পাতি কান,
শুনিতে শুনিতে কোন অজানায় ভেসে যেত তব প্রাণ!
ঝরণার স্রোতে ভাসিয়া আসিত অলস সোনার ঘুম,
তোমার মায়াবী নয়নে বিছাত দূর স্বপনের চুম।
শিথিল দেহটি এলাইয়া দিয়া ঘন তুষারের গায়,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে ঘুমেরে যে ঘুম পাড়াইতে নিরালায়।
তোমার দেহের বিম্ব আঁকিয়া আপন বুকের পরে,
পরতের পর পরত বিছাত তুষার রজনী ভরে।
তোমার ছাষায় যত সে লুকাত, চাঁদের কুমার তত
তুষার পরত ভেদিয়া সেথায় একেলা উদয় হ।
দূর গগনের সাত-ভাই তারা শিয়রে বিছায়ে ছায়া,
পারুল বোনের নিশীথ শয়নে জ্বালতে আলোর মায়া।
দিন রজনীর মোহনার সোঁতে শুক-তারকার তরী,
চলিতে চলিতে পথ ভুলে যেন ঘাটের বাঁধন স্মরি।
পূর্ব তোরণে দাঁড়ায়ে প্রভাত ছুঁড়িত আবীর ধূলি,
তোমার নয়ন হইতে ফেলিত ঘুমের কাজল তুলি।
কিশোর কুমার, প্রথম হেরিয়া তোমার কিশোরী কায়া,
মেঘে আর মেঘে বরণে বরণে মাখাত রঙের মায়া।
কি কুহকে ভুলে ওগো গিরিসুতা! এসেছ মরতে নামি,
কে তোমার লাগি পূজার দেউল সাজায়েছে দিবা-যামি।
হেথয় প্রখর মরীচি-মালীর জ্বলে হুতাশন জ্বালা,
দহনে তোমার শুকাবে নিমেষে বুকে মন্দার মালা।
মরতের জীব বৈকুন্ঠের নাহি জানে সন্ধান,
ফুলের নেশায় ফুলেরে ছিঁড়িয়া ভেঙে করে শতখান।
রূপের পূজারী রূপেরে লইয়া জ্বালায় ভোগের চিতা,
প্রেমেরে করিয়া সেবাদাসী এরা রচে যে প্রেমের গীতা।
হাত বাড়ালেই হেথা পাওয়া যায়, তৃষ্ণারে বড় করি,
তপ-কৃষ তনু গৈরিকবাসে জাগেনাক বিভাবরী।
হেথা সমতল, জোয়ারের পানি একধার হতে ভাসি,
আরধারে এসে গড়াইয়া পড়ে ছল-কল-ধারে হাসি।
হেথায় কাম সহজ লভ্য, পরিয়া যোগীর বাস,
গহন গুহায় যোগাসনে কেউ করে না কাহারো আশ।
হেথাকার লোক খোলা চিঠি পড়ে, বন-রহস্য আঁকি,
বন্ধুর পথে চলে না তটিনী কারো নাম ডাকি ডাকি।
তুমি ফিরে যাও হে গিরি-দুহিতা, তোমার পাষাণ পুরে,
তোমারে খুঁজিয়া কাঁদিছে ঝরণা কুহরে কুহরে ঘুরে।
তব মহাদেব যুগ যুগ ধরি ভস্ম লেপিয়া গায়,
গহন গুহায় তোমার লাগিয়া রয়েছে তপস্যায়।
অলকার মেয়ে! ফিরে যাও তুমি, তোমার ভবন-দ্বারে,
চিত্রকূটের লেখন বহিয়া ফেরে মেঘ জলধারে।
তোমার লাগিয়া বিরহী যক্ষ গিরি-দরী পথ-কোণে,
পাষাণর গায়ে আপন ব্যথারে মদ্দিছে আনমনে;
শোকে কৃশতনু, বিহবল মন, মৃণাল বাহুরে ছাড়ি,
বার বার করে ভ্রষ্ট হইছে স্বর্ণ-বলয় তারি।
বাণীর কুঞ্জে ময়ূর ময়ূরী ভিড়ায়েছে পাখা তরী,
দর্ভ-কুমারী, নিবারের বনে তৃণ আছে বিস্মরি।
তুমি ফিরে যাও তব আলকায়, গৌরী গিরির শিরে,
চরণে চরণে তুষার ভাঙিও মন্দাকিনীর তীরে।
কন্ঠে পরিও কিংশুকমালা, পাটল-পুষ্প কানে,
নীপ-কেশরের রচিও কবরী নব আষাঢ়ের গানে।
তীর্থ পথিক বহু পথ বাহি শ্রান্ত ক্লান্ত কায়,
কোন এক প্রাতে যেয়ে পৌছিব শিঞ্চল গিরি ছায়।
দিগ জোড়া ঘন কুয়াশার লোল অঞ্চলখানি,
বায়ুরথে বসি কিরণ কুমার ফিরিবে সুদূরে টানি।
আমরা হাজার নব নারী হেথা রহিব প্রতীক্ষায়,
কোন শুভখনে গিরি-কন্যার ছায়া যদি দেখা যায়।
দিবসের পর দিবস কাটিবে, মহাশূন্যের পথে,
বরণের পর বরণ ঢালিবে উতল মেঘের রথে।
কুহকী প্রকৃতি মেঘের গুচ্ছে বাঁধিয়া বাদল ঝড়,
ঘন ঘোর রাতে মহাউল্লাসে নাচিবে মাথার পর।
ভয়-বিহবল দিবস লুকাবে কপিল মেঘের বনে,
খর বিদ্যুৎ অট্ট হাসিবে গগনের প্রাঙ্গণে।
তীর্থ-পথিক তুব ফিরিবে না, কোন শুভদিন ধরি,
বহুদূর পথে দাঁড়াবে আসিয়া গৌরী গিরির পরী।
সোনার অঙ্গে জড়ায়ে জড়ায়ে বিজলীর লতাগুলি,
ফুল ফোটাইবে, হাসি ছড়াইবে অধর দোলায় দুলি।
কেউ বা দেখিবে, কেউ দেখিবে না, অনন্ত মেঘ পরে,
আলোক প্রদীপ ভাসিয়া যাইবে শুধু ক্ষণিকের তরে।
তারপর সেথা ঘন কুয়াশার অনন্ত আঁধিয়ার,
আকাশ-ধরনী, বন-প্রান্তর করে দেবে একাকার।
আমরা মানুষ-ধরার মানুষ এই আমাদের মন,
যদি কোনদিন পরিতে না চাহে কুটীরের বন্ধন;
যদি কোনদিন সুদূর হইতে আলেয়ার আলো-পরী,
বেঘুম শয়ন করে চঞ্চল ডাকি মোর নাম ধরি।
হয়ত সেদিন বাহির হইব, গৃহের তুলসী তলে,
যে প্রদীপ জ্বলে তাহারে সেদিন নিবায়ে যাইব চলে।
অঙ্গে পরিব গৈরিক বাস, গলায় অক্ষহার,
নয়নে পরিব উদাস চাহনী মায়া মেঘ বলাকার।
কাশীশ্বরের চরণ ছুঁইয়া পূতপবিত্র কায়,
জীবনের যত পাপ মুছে যাব প্রয়াগের পথ গায়।
হরিদ্বারের রঙিন ধূলায় ঘুমায়ে শ্রান্ত কায়,
ত্রিগঙ্গা জলে সিনান করিয়া জুড়াইব আপনায়।
কমন্ডলুতে ভরিয়া লইব তীর্থ নদীর বারি,
লছমন ঝোলা পার হয়ে যাব পূজা-গান উচ্চারি।
তাপসীজনের অঙ্গের বায়ে পবিত্র পথ ছায়ে,
বিশ্রাম লভি সমুকের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।
বিশ্রাম লভি সমুখের পানে ছুটে যাব পায়ে পায়ে।
দেউলে দেউলে রাখিব প্রণাম, তীর্থ নদীর জলে
পূজার প্রসূন ভাসাইয়া দিব মোর দেবতারে বলে।
মাস-বৎসর কাটিয়া যাইবে, কেদার বদরী ছাড়ি,
ঘন বন্ধুর পথে চলিয়াছে সন্যাসী সারি সারি,
কঠোর তাপেতে ক্ষীন্ন শরীর শ্রান্তক্লান্ত কায়,
সমুখের পানে ছুটে চলে কোন দুরন্ত তৃষ্ণায়।
সহসা একদা মানস সরের বেড়িয়া কণক তীর,
হোমের আগুন জ্বলিয়া উঠিবে হাজার সন্ন্যাসীর।
শিখায় শিখায় লিখন লিখিয়া পাঠাবে শূন্যপানে,
মন্ত্রে মন্ত্রে ছড়াবে কামনা মহা-ওঙ্কার গানে।
তারি ঝঙ্কারে স্বর্গ হইতে বাহিয়া কণক রথ,
হৈমবতীগো, নামিয়া আসিও ধরি মর্ত্ত্যের পথ।
নীল কুবলয় হসে- ধরিও দাঁড়ায়ে সরসী নীরে,
মরাল মরালী পাখার আড়াল রচিবে তোমার শিরে।
প্রথম উদীতা-ঊষসী-জবার কুসুম মূরতি ধরি,
গলিত হিরণ কিরণে নাহিও, হে গিরি দুহিতা পরি।
অধর ডলিয়া রক্ত মৃণালে মুছিও বলাকা পাখে,
অঙ্গ ঘেরিয়া লাবণ্য যেন লীলাতরঙ্গ আঁকে।
চারিধার হতে ভকত কন্ঠে উঠিবে পূজার গান,
তার সিঁড়ি বেয়ে স্বরগের পথে করো তুমি অভিযান।
তীর্থ-পথিক, ফিরিয়া আসিব আবার মাটির ঘরে,
গিরি গৌরীর বাহিনী আনিব কমন্ডলুতে ভরে।
দেউলে দেউলে গড়িব প্রতিমা, পূজার প্রসূন করে,
জনমে জনমে দেখা যেন পাই প্রণমিব ইহা স্মরে।
৯) রাখাল ছেলে
“রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?”
ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা,
সেথায় আছে ছোট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর রঙে নাওয়া,
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা-
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।”
“রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! আবার কোথা ধাও,
পুব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।”
“ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতো খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,
সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।
চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা,
বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা।’
সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই।
সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই।’
“রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! সারাটা দিন খেলা,
এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।”
কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙল দিয়ে খেলি
নিড়িয়ে দেই ধানের ক্ষেতের সবুজ রঙের চেলী।
রিষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হওয়ার সুখে।
টির বোনের ঘোমটা খুলে চুমু দিয়ে যায় মুখে।
ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশী পউষ-পাগল বুড়ী,
আমরা সেথা চষতে লাঙল মুশীদা-গান জুড়ি।
খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা-লাঙল-চষা,
সারাটা দিন খেলতে জানি, জানিই নেক বসা’।
১০) কবর
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা।
সোনালী ঊষায় সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি,
লাঙ্গল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত,
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোর তামাশা করিত শত।
এমন করিয়া জানিনা কখন জীবনের সাথে মিশে,
ছোট-খাট তার হাসি-ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা,
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালা এক ছড়া নিতে কখনও হতনা দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধ্যাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুর বাড়ির বাটে !
হেস না–হেস না–শোন দাদু সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদী যে তোমার কত খুশি হোত দেখিতিস যদি চেয়ে।
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, ‘এতদিন পরে এলে,
পথপানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখি জলে।’
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝ্ঝুম নিরালায়।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, ‘আয় খোদা, দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়।’
তার পরে এই শুন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি,
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি
গনিয়া গনিয়া ভুল করে গনি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কতসোনা মুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক,
আয় আয় দাদু, গলাগলি ধরে কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে তোর বাপ্জী ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই ? কি করিব দাদু, পরান যে মানে না !
সেই ফাল্গুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কি যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপ্ টি বিছায়ে কহিলাম, বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কি জানিত কেউ ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা–বা-জানেরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে।
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দু হাতে জড়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিন-মান ভরি।
গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে,
ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়ে যেতে গেঁয়ো-পথিকেরা মুছিয়া যাইতো চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
উদাসিনী সেই পল্লীবালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।
তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বীষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, ‘বাছারে যাই,
বড় ব্যথা রল দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, দাদু রে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।’
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গণ্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে,
কি জানি আশিস্ করি গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে।
ক্ষণ পরে মোরে ডাকিয়া কহিল, ‘আমার কবর গায়,
স্বামীর মাথার ‘মাথাল’ খানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।’
সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরানের ব্যথা মরে না কো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়-মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়ে।
জোনাকি মেয়েরা সারা রাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নুপুর কত যেন বেসে ভাল।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,’রহমান খোদা, আয়,
ভেস্ত নাজেল করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়ে।’
এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজীদের ঘরে বনিয়াদী ঘর পেয়ে।
এত আদরের বু-জীরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে।
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, ‘দাদু যেন কাল এসে,
দু দিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর তাহার কসাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে,
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে, ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিত ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরানে বাজিবে মরণ-বীণ!
কি জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়াছি দেখে যাও দাদু ধীরে।
ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেউ ভাল,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,’আয় খোদা দয়াময়!।
আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়।’
হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কি জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা।
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদীর মুখখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন গেনু গজ্নার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে,
কি জেনি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গ্যাছে।
আপন হসেতে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি–
দাদু ধর–ধর–বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে, আরও কাছে আয় দাদু,
কথা ক’সনাক, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুড়ে দেখ্ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে।
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
এমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজীদ হইছে আজান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দুর!
জোড়হাতে দাদু মোনাজাত কর্, ‘আয় খোদা, রহমান,
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ!’
১১) এ লেডী উইথ এ ল্যাম্প
গভীর রাতের কালে,
কুহেলী আঁধার মূর্ছিত প্রায় জড়ায়ে ঘুমের জালে।
হাসপাতালের নিবিয়াছে বাহি; দমকা হাওয়ার ঘায়,
শত মুমূর্ষু রোগীর কাঁদন শিহরিছে বেদনায়।
কে তুমি চলেছ সাবধান পদে বয়স-বৃদ্ধা-নারী!
দুই পাশে তব রুগ্ন-ক্লিন্ন শুয়ে আছে সারি সারি।
কাহার পাখাটি জোরে চলিতেছে, বালিশ সরেছে কার,
বৃষ্টির হাওয়া লেগেকার গায়ে শিয়রে খুলিয়া দ্বার!
ব্যান্ডেজ কার খুলিয়া গিয়াছে, কাহার চাই যে জল,
স্বপন দেখিয়া কেঁদে ওঠে কেবা, আঁখি দুটি ছল ছল।
এ সব খবর লইতে লইতে চলিয়াছ একাকিনী,
দুঃখের কোন সান্ত্বনা তুমি, বেদনায় বিষাদিনী।
গভীর নিশীথে, অনেক ঊর্ধ্বে জ্বলিছে আকাশে তারা,
তোমার এ স্নেহ মমতার কাজ দেখিতে পাবে না তারা;
রাত-জাগা পাখি উড়িছে আকাশে, জানিবে না সন্ধান,
রাত জাগা ফুল ব্যস্ত বড়ই বাতাসে মিশাতে ঘ্রাণ।
তারা কেহ আজ জানিতে পাবে না, তাহাদেরি মত কেহ,
সারা নিশিজাগি বিলাইছে তার মায়েলী বুকের স্নেহ।
এই বিভাবরী বড়ই ক্লান্ত, বড়ই স্তব্ধতম
উতলা বাতাস জড়াইয়া কাঁদে আঁধিয়ার নির্মম।
মৃত্যু চলেছে এলায়িত কেশে ভয়াল বদন ঢাকি,
পরখ করিয়া কারে নিয়ে যাবে, কারে সে যাইবে রাখি।
মহামরণের প্রতীক্ষাতুর রোগীদের মাঝখানে,
মহীয়সী তুমি জননী মুরতি আসিলে কি সন্ধানে;
জীবন মৃত্যু মহা-রহস্য তুমি কি যাইবে খুলি,
ধরণীর কোন গোপন কুহেলী আজিকে লইবে তুলি।
যে বৃদ্ধ কাল সাক্ষ্য হইয়া আছে মানুষের সাথে,
তুমি কি তাহার বৃদ্ধা সাথিনী আসিয়াছ আজ রাতে?
নিখিল নরের আদিম জননী আজিকে তোমার বেশে,
রুগ্ন তাহার সন্তানদেরে দেখিয়া নিতেছ এসে।
নিরালা আমার শয্যার পাশে তোমার আঁচল-ছায়,
স্তব হয়ে আজ জড়ায়ে রহিতে বড় মোর সাধ যায়!
১২) কে যাসরে রঙিলা মাঝি
কে যাসরে রঙিলা মাঝি! সামের আকাশরে দিয়া;
আমার বাজানরে বলিস খবর নাইওরের লাগিয়ারে।
অভাগিনীর বুকের নিশ্বাস পালে নাও ভরিয়া,
ছয়মাসের পন্থ যাইবা একদন্ডে উড়িয়া;
গলুইতে লিখিলাম লেখন সিন্তার সিন্দুর দিয়া,
আমার বাপের দেশে দিয়া আইস গিয়ারে।
পরবাসে পাঠাইল বাজান যারে সঁইপা দিয়া,
সে যে শিশিরের গয়না দিল দূর্বাশীষে নিয়া;
কুয়াশার শাড়ী দিল বাতাসে ভরিয়া
অঙ্গে না পরিতে তাহা গেল যে উড়িয়ারে।
সাগরের ফেনায় পতি বানল বাসর-ঘর,
দুস্কের দাগাতে তাহা দাপায় জনমভর;
অবলা ভাঁরাইল যে সে কাঞ্চা পিতল দিয়া,
এমন ঠকের ঘরে রহি কি করিয়ারে।
পরের ছেলের সঙ্গে বাজান আমায় দিল বিয়া,
জনমের মত গেল বনবাস দিয়া;
একদিনের তরে আইসা না গ্যাল দেখিয়া,
এবার জুড়াইব মনের দুস্কু সায়রে ডুবিয়ারে।
১৩) পল্লী-বর্ষা
আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা
তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া!
হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি!
চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!
কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, -
হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!
দিকে দিগেনে- যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।
গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, -
গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।
কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে,
আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।
লাঠির উপরে, ফুলের উপরে আঁকা হইতেছে ফুল,
কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল।
তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে- আমীর সাধুর নাও,
বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজ গাঁও।
ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হতে ওর হাতে,
নানান রকম রসি বুনানও হইতেছে তার সাথে।
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,
এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে!
যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষীরা, আর ওই রূপ-কথা,
বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্প-লতা।
বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি,
সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি।
বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,
মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।
১৪) ও বাবু সেলাম বারে বার
ও বাবু সেলাম বারে বার,
আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু,
বাড়ি পদ্মা পার।
মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি মোরা
পঙ্কি বেইচা খাই-
মোদের সুখের সীমা নাই,
সাপের মাথার মণি লয়ে মোরা
করি যে কারবার।
এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি মোরা
আরেক ঘাটে খাই,
মোদের বাড়ি ঘর নাই;
সব দুনিয়া বাড়ি মোদের
সকল মানুষ ভাই;
মোরা, সেই ভায়েরে তালাশ করি আজি
ফিরি দ্বারে দ্বারে;
বাবু সেলাম বারে বার।
১৫) কবিতা
তাহারে কহিনু, সুন্দর মেয়ে! তোমারে কবিতা করি,
যদি কিছু লিখি ভুরু বাঁকাইয়া রবে না ত দোষ ধরি।”
সে কহিল মোরে, “কবিতা লিখিয়া তোমার হইবে নাম,
দেশে দেশে তব হবে সুখ্যাতি, আমি কিবা পাইলাম ?”
স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিনু কি দিব জবাব আর,
সুখ্যাতি তরে যে লেখে কবিতা, কবিতা হয় না তার।
হৃদয়ের ফুল আপনি যে ফোটে কথার কলিকা ভরি,
ইচ্ছা করিলে পারিনে ফোটাতে অনেক চেষ্টা করি।
অনেক ব্যথার অনেক সহার, অতল গভীর হতে,
কবিতার ফুল ভাসিয়া যে ওঠে হৃদয় সাগর স্রোতে।
তারে কহিলাম, তোমার মাঝারে এমন কিছু বা আছে,
যাহার ঝলকে আমার হিয়ার অনাহত সুর বাজে।
তুমিই হয়ত পশিয়া আমার গোপন গহন বনে,
হৃদয়-বীণায় বাজাইয়া সুর কথার কুসুম সনে।
আমি করি শুধু লেখকের কাজ, যে দেয় হৃদয়ে নাড়া,
কবিতা ত তার ; আর যেবা শোনে-কারো নয় এরা ছাড়া।
মানব জীবনে সবচেয়ে যত সুন্দরতম কথা,
কবিকার তারই গড়ন গড়িয়া বিলাইছে যথাতথা।
সেকথা শুনিয়া লাভ লোকসান কি জানি হয় না হয়,
কেহ কেহ করে সমরকন্দ তারি তরে বিনিময়।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।
©somewhere in net ltd.