![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম দুটা বন্ধু।হঠাৎ চুখে পড়ল কিছুটা দূরে বিপরীত পাশে একটা মেয়ে আর একজন বয়স্ক লোক কী নিয়ে যেন গভীর আলাপ করছে।আলাপতো করতেই পারে। তাতে এত ভাবনার কী আছে? আমরা আমাদের মতই গল্প করছিলাম।এদিকে ভ্রুক্ষেপই করলাম না।
কিন্তু হঠাৎ দেখি মেয়েটাকে বয়স্ক ভদ্রলোক কিছু হাজার টাকার নোট দিচ্ছে।তাতে আমরা কিছুটা আগ্রহী হয়ে ওঠলাম।ওভাবে দিনে-দুপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ লেনদেন করে ? আড়চুখে না থাকিয়ে আর পারলাম না।
মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না।আমাদের দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তবে বয়স্ক ভদ্র লোককে স্পস্ট দেখতে পাচ্ছি।বয়স ৬০ থেকে ৭০ হবে,পরনে কালো প্যন্ট সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি, হাতে ভাজ করা প্লাস্টিকের একটি ব্যাগ।অনেকটা গ্রামের সহজ সরল মানুষের মত।এমন লোকদের সত্যিই খুব ভালো লাগে।এরা সাধারণত কর্মট শে্রণীর হয়ে থাকে।মনটা থাকে উদার। যে কোন বিষয়কে সহজভাবেই নেয়।
দেখে মনে হল বাবা-মেয়ে হবে।হ্যা বাবা - মেয়ে না হলে কী কেউ কাউকে এভাবে টাকা দেয়।কিন্তু মেয়েটাতো বাবাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে পারতো অথবা কোনো রেস্টুরেন্টে বসে ওসব লেনদেন করতে পারতো।এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন?
বাবা-মেয়ের এমন গভীর ভালবাসা দেখে সত্যিই আনন্দে বুকটা ভরে গেল।বাবা গ্রাম থেকে এসেছেন মেয়েকে দেখতে।মেয়েটা হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে।আর মেয়েও যেন বাবাকে পেয়ে আনন্দে আত্বহারা।হয়ত অনেক দিনের জমানো কথাগুলোর আদান-প্রদান চলছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই আমাদের ভাবনায় ছেদ পড়ল।আমরা যা ভাবছিলাম তা যে এতটা মিথ্যে হবে তা কখনোই ভাবিনী।
মেয়েটা টাকাগুলো হাতে নিয়েই একবার পেছনের দিকে থাকালো।আমাদেরও খুব ইচ্ছে ছিলো মেয়েটার মুখ দেখার।যাক শেষ পর্যন্ত তাহলে মুখটা ফেরালো।
একি ! মুখ দেখেতো পুরাই অবাক ! এ যে আমাদের ভার্সিটির মেয়ে।শুধু যে আমাদের ভার্সিটির তা নয় আমাদের ডিপার্টমেন্টের,আমাদের সেমিস্টারের একটি ক্লাস মিট মেয়ে।প্রতিদিন যার সাথে ক্লাস করি।কখনোই ওর সাথে কথা হয়নী।আমরা আমাদের মত ক্লাস করি ও তার মতই ক্লাস করে।ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছে কিংবা প্রয়োজন কখনোই দেখা দেয়নী।
মেয়েটা আমাদের দেখে তথমথ খেয়ে গেলো।অনেকটা বিব্রতবোধ করল।ওর মুখ দেখে মনে হলো ও ভাবছে সে কোন অন্যায় কাজে আছে।তাকে বিব্রত না করতে আমরা আবার আমাদের মতই গল্প করতে শুরু করলাম।
কিন্তু না ও শুধু বিব্রতবোধ করল না।একটা কাণ্ডও ঘটিয়ে দিল।বাবার হাত থেকে টাকাটা প্রায় ঝাপট মেরে নিয়ে কোনো কথা না বলে হাঁটতে শুরু করল।এমন দ্রুত হাঁটল যে বাবা তাকে ডাক দিতে গিয়েও দিলেন না।একটা হাত বাড়িয়ে হয়ত বলতে চাচ্ছিলেন, এই হঠাৎ কোথায় যাচ্ছ ? আমার কাছ থেকে বিদায় নিলে না? এত কষ্ট করে টাকা ম্যানেজ করে কয়েক'শ মাইল দূর গ্রাম থেকে আসলাম আর তুমি এভাবেই ক্লাস মিটদের দেখে টাকাটা নিয়েই চলে যাচ্ছ? কিন্তু বলতে গিয়েও বললেন না।শুধু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে থাকিয়ে থাকলেন।
ভাবছিলাম হয়ত বাবা-মেয়ের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে।মেয়েটা তার ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরে এসে বাবার কাছে ক্ষমা চাইবে।কিন্তু না।হাঁটছেতো হাঁটছেই একটিবারের জন্যেও পেছনে ফিরে থাকালো না।এক সময় বাসায় গিয়ে ঢুকে পড়ল।আর ভদ্রলোক স্তব্ধ হয়েই তার চলে যাওয়া রাস্তার দিকেই থাকিয়ে রইলেন।
বাবার অপরাধ কী ছিল? কেন মেয়েটা এমন আচরণ করল? তা যখন পাশে থাকা বন্ধুটাকে জিগ্গেস করলাম সে আমায় বুঝিয়েই বলেছিল,বাবার অপরাধ বাবার পরনে ময়লাযুক্ত কাপড়,বাবার অপরাধ তিনি গ্রাম থেকে এসেছেন,বাবার অপরাধ তিনি উচ্চ শিক্ষিত নন,বাবার অপরাধ তার যোগ্যতা ও সামর্থের চেয়ে বেশী চাপাবাজি করতে পারেন না।আর এ জন্যেই মেয়েটি চায় না যে ক্লাসমিটরা দেখুক এ ধরনের একজন গ্রাম্য,অশিক্ষিত, ময়লাযুক্ত লোক তার বাবা !!! তাই সে আমাদের দেখার সাথে সাথেই বাবার থেকে বিদায় না নিয়েই চলে গেছে।
আমরা যে শুধু অবাক হলাম তা না হতবাকও হয়ে গেলাম।বাবা হয়ত ভাবছিলেন কয়েক শ মাইল দূর থেকে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে এই হরতালের মধ্যে অনেক কষ্টে চারঘন্টার মত লাইনে দাঁড়িয়ে বাসের টিকেঠ কিনে পেট্রোল বোমার ভয় মাথায় নিয়ে কেন তার এই আসা? হালের বলদ, মুরগির ডিম আর শীতের মৌসুমের সবগুলো ফসল বিকি্র করে পারিবারিক খরচটা না করে মেয়ের হোস্টেল আর ভার্সিটির খরচটা ম্যানেজ করে কেন নিয়ে আসা? টাকাটা পাওয়ার পরে মেয়ের মন আর হাসির চিত্ত অনুভব করে কেন এত জল্পনা-কল্পনা করা।এত কষ্ট করে আসার পরে যে মেয়েটা আমায় বাসায় নেয়াতো দূরের কথা একটা রেস্টুরেন্টেও বসলো না।রাস্তায় দাঁড়িয়েও একটু বেশী সময় কথা বলল না।ক্লাসমিটরা আমি তার বাবা জানতে পারলে সে লজ্জা পাবে বলে ওদের দেখতে না দেখতেই আমার থেকে বিদায় না নিয়েই হুট করে চলে গেল।
নিয়তির কী নির্মম খেলা।মেয়ের হাসি-খুশি মুখের পরিবর্তে আজ আমায় পেতে হল শুধুই অবজ্ঞা।টাকাটা নিয়েই যেন " ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি " বলেই চলে গেল।আমার দোষ একটাই, আমি অাধুনিক নই।সভ্য সমাজের সাথে ম্যাচিউড না।কাপড়গুলো ময়লাযুক্ত ফুটপাত থেকে কিনা।
কথাগুলো ভাবছিলেন আর চলে যাওয়া রাস্তার দিকে থাকিয়ে মেয়েটির জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।ভাবলেন হয়ত ও আবার ফিরে আসবে।কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন ও আর আসবে না তখন চুখটা মুছে ধীরে ধীরে আবার গ্রামের দিকে ফিরলেন।আমি স্পটতই অনুভব করলাম,আমার ডান চুখ থেকে এক ফুটা অশ্রু হাতে থাকা মোবাইলের স্কিনে পড়ল।
মেয়েটা যদি কোনো জুনিয়র ছোট ভাই হত তাহলে টাস করে গালে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে বুঝিয়ে দিতাম যে শতশত ক্লাস মিটের চেয়েও যে একজন বাবার মূল্য অনেক বেশী।বিপদে সব গুলো বন্ধুই দূরে ঠেলে দিতে পারে কিন্তু বাবা-মা নয়।বাবাকে বাবার মতই সম্মান দিতে হয় সে বাবা হোক না যে কোনো সমাজের, যে কোনো সভ্যতার, যে কোনো সংস্কৃতির।কিন্তু পারলাম না।কারণ মেয়েটা অপিরিচিত একটা ক্লাসমিট।তার সাথে কখনোই কোনো আলাপ হয়নী।
বি.বি.এ অনার্স লেবেলের একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যদি একজন বাবা এ ধরনের আচরণ পান তাহলে নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা যায় ?
©somewhere in net ltd.