নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নমস্কার পাঠক, সামহোয়্যারের এই ব্লগে ঐশিকা আপনাকে স্বাগত জানায়। জীবনের নানা হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনার ইতিহাসে লেগে থাকে কতই না কাহিনী। সেসব কিছু নিয়েই আমার এই ব্লগ। সত্য-কল্পনার মিশেলে কিছু গল্পের ব্লগ। যদি পাঠকের ভাল লাগে। নিজেকে সার্থক বলে মনে করব।

ঐশিকা বসু

নমস্কার পাঠক, সামহোয়্যার ব্লগে ঐশিকা বসু আপনাকে স্বাগত জানায়। জীবনের নানা হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনার ইতিহাসে লেগে থাকে কতই না কাহিনী। সেসব কিছু নিয়েই আমার এই ব্লগ। সত্য-কল্পনার মিশেলে কিছু গল্পের ব্লগ। যদি পাঠকের ভাল লাগে। নিজেকে সার্থক বলে মনে করব। অনেক গল্পসল্প লিখুন, আর পড়ুন। বাংলা সাহিত্যকে টিকিয়ে রাখতে দেশ-কাল নির্বিচারে সকলেরই সাহায্য প্রয়োজন। তাই আমি এক ভারতীয় হয়েও আপনাদের সঙ্গী হতে হাত মেলালাম। আশা করি আপনাদের প্রত্যুত্তরও হবে ইতিবাচক। ধন্যবাদ।

ঐশিকা বসু › বিস্তারিত পোস্টঃ

অশ্লীল

১০ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:১৫

নৈহাটিতে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল ঘটনাটা। বিশেষত এই অঞ্চলের নাট্যপিপাসু মানুষের মধ্যে। কারণ সেবারের নৈহাটি নাট্যোৎসবের শেষ সংযোজন হিসাবে ছিল একটা নতুন ধরনের নাটক – কৃষ্ণা। ‘দ্রোহ’র প্রযোজনা। আর ‘দ্রোহ’ মানেই যে ছোটুলাল আর সাবিত্রীর অভিনয় দর্শনের সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য অর্জন - তা আর বলার অপেক্ষা কে রাখে? কিন্তু ছোটুলাল আর সাবিত্রী যে নৈহাটির মত মফস্বলে আসবেন তা ধারণাও করতে পারেনি নৈহাটির মানুষজন।
নৈহাটিতে মঞ্চ বলতে প্রধানত একটাই – ঐকতান। যে কোন বড় অনুষ্ঠান – নাটক, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা সবেরই একমেবোদ্বিতীয়ম এই সংঘটন স্থান। তবু নাটক এলে বা ভালো গানের অনুষ্ঠান হলেও এর সমস্ত সিট ভ’রে না। রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সেবার তো ডাহা লোকসান করলো যাত্রিক। অবশ্য যাত্রিক এতে দমেনি। নৈহাটিতে যত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর, ধ্রুপদী নৃত্যানুষ্ঠান, বাংলার সেরা নাট্যকারদের নাটক অনুষ্ঠিত হয়, প্রধানত তার আয়োজক হল এই যাত্রিক। আর যাত্রিকের এই কাজের পেছনে যার অবদান সবথেকে বেশি তিনি হলেন বিজন বসু। যিনি কিনা এই সাধারণ কলমচির বাবা। আসলে বাবা চায়, ভালো মানের শিল্পী ও কলাকুশলীদের এখানে এনে নৈহাটির মানুষজনের তাদের কাজের পরিচয় ঘটাতে। বাবা মনে করে, এভাবে মানুষের রুচির পরিবর্তন আসবে। তাই লোকসানের ঝুঁকি নিয়েও, লোকের গালমন্দ, বাঁকা মন্তব্য সহ্য করেও যাত্রিক তাদের গতিধারা অব্যাহত রেখে যাচ্ছে।
বাবা যখন স্কুলে চাকরি করত, তাঁর সেসময়ের অনেক অনুরাগী ছাত্রছাত্রী আজ যাত্রিক দলে নাম লিখিয়েছে। বাবাকে এইসব কাজে তাঁরা আন্তরিকভাবে সাহায্য করে। যাত্রিকের কাজে থাকতে থাকতে আমারও কিছু পরিচয় হয়েছে এদের সাথে। এদের মধ্যে শুদ্ধদা, প্রদীপদা আর বনিদিই প্রধান। কারণ এরা প্রত্যেকেই স্কুলে চাকরি করে আর আশেপাশেই থাকে। আর বাকীরা দূরে থাকে কর্মসূত্রে। তবে প্রয়োজন হলে তারাও সাহায্য করে। এবার যেমন অভিষেকদা এখানে রয়েছে যে কিনা শিকাগো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। এরা সকলেই সমমনস্ক, যাত্রিকের সাথে নিজেদের একাত্মা করে তুলেছে।
তবে ছোটুলালের মত শিল্পী হয়ত এখানে আসতেন না, যদি না বাবা ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানাতেন। বাংলা ভাষা নিয়ে বাবার গবেষণা আর জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার – এই দুইয়ের কারণে বাবার পরিচিতি বরাবরই ভালো। শিক্ষকতা ছাড়া লেখালিখি, লাইব্রেরী, অধ্যয়ন আর যাত্রিক – এই হল তাঁর প্রাণস্বরূপ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সভা-সমিতিতে তিনি যান, বক্তৃতা দেন। এইরকমভাবে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত একটা সাহিত্যসভায় গিয়ে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন ছোটুলালের সঙ্গে। ছোটুলাল তখনও আজকের ছোটুলাল হননি। সেসময় নাট্যমহলে তিনি বিশেষ সমাদৃত হলেও দেশে-বিদেশে তাঁর খ্যাতি আজকের মত ছড়ায়নি। কিন্তু সেই থেকেই তাঁদের পরিচয়। তারপর বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব আজও তাঁদের অটুট আছে এমনই যে বেশ কিছু আমন্ত্রণ নাকচ করেও তিনি শুধুমাত্র বাবার অনুরোধে নৈহাটিতে আসতে সম্মত হয়েছেন।
কৃষ্ণা আগেও দু-এক জায়গায় অভিনীত হয়েছে। বাবা দেখেওছে সে নাটক। বিতর্কিত, অন্য ধরনের এই নাটকটা আনা উচিত হবে কিনা সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে যাত্রিকের অন্দরমহলে। অনেকে আপত্তি জানিয়েছে, কেউ আবার অভিভূত হয়ে স্বাগতও জানিয়েছে একে। বাবার ইচ্ছা ছিল নৈহাটির মানুষ এবার অন্যরকম নাটক দেখুক, অন্যভাবে চিন্তা করতে শিখুক। তাই সবাই মিলেই ঠিক হল, আনা হোক নাটক কৃষ্ণা। ছোটুলাল আর সাবিত্রীদেবীর অভিনয় দেখুক নৈহাটিবাসী।
ঐকতান প্রেক্ষাগৃহের সামনে বিরাট বড় পোস্টার টাঙানো হল। তাতে লেখা – কৃষ্ণা। পোস্টারের ছবিটার বেশিরভাগটাতেই ব্যবহার করা হয়েছে গাঢ় রঙ অথবা কালো। ছবিতে মূল যেটা ধরা আছে তা হল, সেনার উর্দি পরা কিছু লোক সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে, হাতে বন্দুক। আর তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক তরুণী মহিলা। পিছন ফিরে থাকার ফলে তার মুখটা বোঝা যাচ্ছে না।
বিজ্ঞাপনের শেষের দিকে রয়েছে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করা কলাকুশলী, নাট্যরচয়িতা, আলোকসজ্জাকারী, শব্দ ও আবহ সৃষ্টিকারীদের নামের এক তালিকা। আর তারও নিচে অপেক্ষাকৃত ছোট অক্ষরে লেখা রয়েছে – ‘নাটকটি কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’।

নাটক – কৃষ্ণা

এবার প্রেক্ষাগৃহে লোক কিন্তু মন্দ হয়নি। আমি আমার স্ত্রী জয়শ্রী নিয়ে গেছিলাম। দেখলাম, আমাদের মত অনেকেই তাদের পরিবার নিয়ে এসেছে। ফলে সব আসন পূরণ না হলেও বেশিরভাগই ভ’রে গেছে। ঐকতানের বিগত চার-পাঁচ বছরের ইতিহাসে এতো দর্শকসমাগম কিন্তু বেশ ব্যতিক্রমী। নাটক শুরু হবার ঠিক মিনিটখানেক আগে প্রেক্ষাগৃহের দরজা ঠেলে দশ-বারোজনের একটা দল দ্রুতবেগে এসে ঢুকল এবং সামনের সারির আসনগুলো দখল করে নিলো। দলটার মধ্যমণি যাকে আমি দেখতে পেলাম তিনি হলেন শ্রীযুক্ত তূণীর মণ্ডল। বিস্মিত হলাম। তূণীরবাবু আমাদের এলাকার স্থানীয় পৌরপিতা। নাট্যপিপাসু বলে কখনো ওনাকে জানতাম না। ভাবলাম, হয়ত ছোটুলালের নাম শুনেই উনি দেখতে এসেছেন।
নাটক শুরু হল ঠিক সন্ধে ছ’টায়। দেশের উপান্তে অবস্থিত পাহাড়ে ঘেরা একটা ছোট্ট রাজ্য ননীপুর। ভৌগোলিক অবস্থানগত দূরত্বের কারণেই তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি দেশের বৃহৎ অংশের জনগোষ্ঠীর থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষই ওদের সম্পর্কে চূড়ান্ত উদাসীন। তাদের কোন শিল্প বা অন্য কোন নান্দনিক সৃষ্টি দেশের মূল শিল্প-স্রোতে প্রবেশ করতে পারে না। ননীপুরের বাসিন্দা ছোটুলাল তাই নাটকে তাঁদের ভাষার প্রয়োগ কম করেন। নাটকে মূল ভাষা থাকে নানারকম ইঙ্গিতপূর্ণ শরীরী বিভঙ্গ। এটাই তাদের প্রকাশের অন্যতর মাধ্যম। ভাষা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে চলবার নতুন উপায়।
নাটকটা প্রায় ষোলো সতেরো বছর আগেকার একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। সমস্ত রাজ্যে তখন সন্ত্রাস দমনের কারণে সেনাশাসন জারি হয়েছে। তবে কোন কোন জায়গায় শাসন চালাবার নাম করে সেনারা স্বেচ্ছাচারিতা অবলম্বন করছে এমন খবর একটা দুটো বেরোচ্ছে। যদিও সংবাদপত্র বা টিভি মাধ্যম এ সম্পর্কে বরাবরের মতোই নীরব। কিন্তু শোনা যায়, সেনারা যাকে তাকে সন্দেহ হলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এমনিভাবে প্রচুর ছেলেরা নানা এলাকা থেকে বেপাত্তা। অনেক নারী, গৃহবধূ নাকি ধর্ষণেরও শিকার হচ্ছে। আর অভিযোগ দায়ের করতে গেলে, বিচার চাইতে গেলেও সেই সেনাবাহিনীই ভরসা। কাজেই ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যায়। বিচার হয় না। একদিন ফাইল গুটিয়ে যায় নীরবে। তবে যত খবর আসে তার সমস্তটাই অসমর্থিত সূত্র থেকে। বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে না সেসব কথা।
ননীপুরের এক তরুণী সাংবাদিক কৃষ্ণা। সদ্য তিনি পাশ করেছেন দেশের প্রথম সারির একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি ঠিক করলেন, তাঁর নিজের কাজের পাশাপাশি তিনি নিজের রাজ্য থেকেও খবর সংগ্রহ করবেন। সেখানকার মানুষের দুঃখ-কষ্টকে তুলে ধরবেন দেশের মূল ভূখণ্ডের মানুষের সামনে। সেইমতো তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। রাজ্যের ক’জন মানুষ নিখোঁজ, কিভাবে আছেন সেখানকার মানুষ সেসব নিয়ে বিস্তারিতভাবে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু সন্দেহের নজর এড়ানো গেলো না। সেনাবাহিনীর সতর্কতা বিভাগ তাঁর পিছু নিলো। তারপর হঠাৎ একদিন বেপাত্তা হয়ে গেলেন এই তরুণী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকও।
না, হারিয়ে তিনি যাননি। ওরা তাঁকে বন্দী করেছিলো। তারপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে ‘তথ্য’ আদায় করবার চেষ্টা করলো। কোন দুষ্ট চক্রের সাথে যোগ নেই। পূর্বেকার কোন অপরাধ মামলাও নেই তাঁর নামে। শত অত্যাচার চালিয়েও সন্ত্রাসবাদী কোন সংগঠনের সাথেও তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ পাওয়া গেলো না। ফলে ওদের দীর্ঘ জেরা কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেলো। কিন্তু তা কি হতে দেওয়া যায়? এই ব্যর্থতার সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়লো কৃষ্ণার ওপর। এর ফলস্বরূপ ওরা তাদের কাম চরিতার্থ করতে লাগলো কৃষ্ণার ওপর। বিকৃত লালসার দংশন শেষ করে প্রমাণ লোপাট করবার জন্য গোপনাঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হল তরুণীকে।
কিন্তু এই খবর আর গোপন রাখা যায়নি। দ্রুত চাউর হয়ে যায় তা গোটা রাজ্যে এবং তৎসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ননীপুরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও নেমে আসে প্রতিবাদ। কৃষ্ণার মায়ের বয়সী মহিলারা রাস্তায় নেমে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেন। সেখানে শুধু কৃষ্ণার মা নন, আছেন সেইসব তরুণীর মায়েরা যাঁরা ধর্ষিতা হয়েছেন, লাঞ্ছিতা হয়েছেন সেনাদের হাতে। ছোটুলালের বর্তমান নাটকটা ছিল সেই লাঞ্ছনারই এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
সবই ঠিক চলছিল। কিন্তু সমস্যা হল, নাটকটার শেষের একটি দৃশ্যে যেখানে সাবিত্রী, যিনি কৃষ্ণা মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন, একজন সেনা অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করা ছোটুলালের সামনে তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদের চরমতম ভাষা যোগাবেন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে। যদিও সে দৃশ্য ছিল দর্শকদের থেকে সম্পূর্ণরূপে আড়াল করা। কিন্তু সাধারণ দর্শক তাতেও সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না।
তাই উঠলো প্রতিবাদের ঝড়। শুরুটা অবশ্য ছিল চাপা গুঞ্জন দিয়ে। কিন্তু আমি দেখলাম দু-একটা চিৎকার আসতে শুরু করলো। সেই চিৎকারগুলো মূলত শোনা যেতে লাগলো তূণীরবাবুর আশেপাশে থাকা ছেলেগুলোর কাছ থেকে। তূণীরবাবু নিজেও জোরে জোরে বলছেন, ‘এগুলো কি অসভ্যতা শুরু করেছেন? এখানে সবাই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। এসব দেখানোর মানে কী?’ ওদের চিৎকার শুনে আরো কিছু অতি-উৎসাহী ব্যক্তি ওদের সাথে চিৎকারে শামিল হল। কিন্তু চিৎকার বেশিক্ষণ আর ভদ্রসুলভ রইল না। খুব দ্রুত কিছু কাঁচা গালি সে জায়গা পূরণ করে নিলো। তারপর শুরু হল ছোঁড়াছুঁড়ি। মঞ্চের চেয়ারগুলো যেহেতু মেঝের সাথে আটকানো, তাই সেগুলো ছোঁড়া গেল না। কিন্তু তাই বলে কিছু অভাবও হল না। হাতের ব্যাগ, জামা, জুতো মোজা যে যা পারলো তাই দর্শকাসন থেকে মঞ্চের দিকে ছুঁড়তে আরম্ভ করল। আমি দেখলাম তূণীরবাবু এতে তো কোন বাধা দিতে চাইছেনই না, বরং মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছোটুলাল আর সাবিত্রীর নামে গালাগাল করতে করতে ছেলেগুলোকে যেন প্রকারান্তরে উৎসাহিতই করছেন।
এদিকে ততক্ষণে মঞ্চের পর্দা নেমে গেছে। নাট্যকুশলী ও অন্যান্য শিল্পীদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দর্শকাসনের সকলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তারা এখন সবাই যত দ্রুত সম্ভব প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বেরোবার চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে দেখে আমি জয়শ্রীকে বললাম, ‘কি সাঙ্ঘাতিক অবস্থা! বাবা কী করছে কে জানে?’ আমাকে উদ্বিগ্ন দেখে জয়শ্রী বলল, ‘দেখো, আগে এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরোবার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর তুমি বাবার খোঁজ কর।’ আমি বললাম, ‘সেই ভালো।’ এই বলে জয়শ্রীকে নিয়ে কোনোভাবে ভিড়ের মধ্যে ঠেলেঠুলে হল ছেড়ে বাইরে বেরলাম। বাইরেটায় এসে একটু হাঁফ ছাড়া গেল। দেখলাম, সকলেই বেশ উদ্বিগ্ন অবস্থায় বেরিয়ে আসছে। কারুর কারুর মুখে শুনলাম, ‘সত্যি নাটক তো নয়, একেবারে অসভ্যতামি।’ আরেকজন বলছিল, ‘আমাদের সংস্কৃতির সাথে এগুলো খাপ খায়? তূণীরদা ঠিকই করেছে। যোগ্য জবাব দিয়েছে ওদের।’ আমি ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কারণ আমাকে এবার বাবার খোঁজ করতে হবে। কিন্তু জয়শ্রীকে এখানে রেখে যে গ্রিনরুমের দিকে যাব, সে সাহস হল না। তাই ওকে নিয়েই মঞ্চের পিছন দিকের অন্য একটা প্রবেশ দরজা দিয়ে ঢোকবার চেষ্টা করতে গেলাম। কিন্তু সেদিকের দরজা বন্ধ। আয়োজকদের কেউ কেউ এদিকটায় রয়েছে। ওদের মধ্যে একজন আমাকে চিনতে পেরে বলল, ‘ভেতরে তুমি ঢুকতে পারবে না দাদা। মানা আছে। জেঠুকে তুমি বরং ফোন করে নাও।’ অগত্যা আমি বাবাকে ফোন করলাম। বাবা জানালো, ‘আমরা ঠিক আছি।’ আরও জানতে পারলাম নাটকের দলটাকে খুব দ্রুত কলকাতার গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বাবা আমাকে বলল, ‘এখানে তোরা থাকিস না। বাড়ি ফিরে যা। আমি ঠিক সময়েই চলে যাবো।’ খুব আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও বাবা মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে পারে। এটা আমি জানতাম। তবু যেহেতু আজকের এই গোলমালের পেছনে একজন রাজনৈতিক কর্মীর সক্রিয় মদত আছে, তাই আমি বাবার জন্য চিন্তিত ছিলাম।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমনই যে এই সময়ে আমি বাবার কাছে গেলে বাবার অসুবিধার সৃষ্টি হবে। তাছাড়া এই সংগঠনে বাবাকে সাহায্য করবার মত অনেক ছেলেই আছে। আমি আর জয়শ্রী তাই বাড়ির দিকে এগোনোই স্থির করলাম।
সেদিন বাবা বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। সারা শরীরে তার ক্লান্তি, মন অবসন্ন, বিষাদগ্রস্ত। বাড়ি ঢোকার সময়, তার বয়স যেন আরো দশ বছর বেশি মনে হচ্ছিল। বয়সের ভারে কিছুটা যেন ন্যুব্জ দেখাচ্ছিল তাকে। বাড়িতে ঢুকে বিশেষ কিছু কথা বলল না। জয়শ্রীকে শুধু একবার বলে দিলো, ‘আমার জন্য খাবার বাড়তে হবে না।’ আমি জিগ্যেস করলাম, ‘বাবা, গ্রিনরুমে গিয়ে ওরা আবার হাঙ্গামা করেনি তো?’ বাবা বেশ অস্ফুট স্বরে কিছু বলল, আমার মনে হল, বাবা বলছে, ‘আমার সমস্ত সম্মান মাটিতে মিশে গেল।’ তারপর জয়শ্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ঘরের আলোটা নিভিয়ে দাও তো মা।’ আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেই বুঝলাম বাবা এই সময়ে একটু একা থাকতে চায়। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

পরের দিন শোনা গেল, নাটকে অশ্লীলতা প্রদর্শনের কারণে দ্রোহ’কে এই রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দ্রোহ’র কোন নাটক এই রাজ্যের কোন রঙ্গমঞ্চেই আর অভিনীত হতে পারবে না – এই মর্মে সারা রাজ্যে হুলিয়া জারি হয়েছে। কথাটা সোশাল মিডিয়ায় ভালোমতো ছড়াতে লাগলো। দু-চারজন লোক এর বিরোধিতা করলো বটে, কিন্তু বেশিরভাগেরই এই হুলিয়ার পক্ষে মত দিল। ফলে নাটক আর তার দলের প্রতি মানুষের অসহিষ্ণুতা আর সুতীব্র ঘৃণা - কোনটাই আর গোপন রইল না।
পরেরদিন সকালে অফিসে বেরচ্ছি, রাস্তায় চোখে পড়ল একটা বড়ো মিছিল। সেই মিছিলের পুরোভাগে হাঁটছেন শ্রীযুক্ত তূণীর মণ্ডল যাঁর হাতে রয়েছে দলীয় পতাকা। দেশীয় জাতীয়তাবাদী দলের এই মিছিলের মূল উদ্দেশ্য ছোটুলাল আর দ্রোহ’র বিরুদ্ধে ‘অশ্লীল’ নাটক দেখাবার অভিযোগ নিয়ে জনমত গড়ে তোলা। মিছিল শেষ হল ঐকতান মঞ্চের সামনে। সেখানে তারা হিন্দিতে বক্তৃতা দিতে লাগলো। তাদের বক্তব্য ছিল, গতকাল অনুষ্ঠিত এই নাটকটা দেশমাতৃকার প্রতি সুতীব্র অপমান। ভারতীয় নারীর প্রতি অপমান। আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির প্রতি অপমান। তাই দ্রোহকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত… ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ট্রেন ধরবার তাড়া ছিল, তাই ওদের বক্তব্য আর শোনা হল না।
বাবা সেদিন সারাক্ষণ বাড়িতেই ছিল। কারুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেনি, কথাও বলেনি বিশেষ। বাবাকে এমন আমি আগে দেখিনি। কাজের মধ্যেই থাকতে বেশি ভালোবাসে বাবা। স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে পাড়ার ক্লাবে একটা লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছিলো। আর যাত্রিক নিয়ে কাজের বাইরে এই লাইব্রেরীই বাবার প্রাণ। সুতরাং বাবার পক্ষে সারাদিন বাড়িতে বসে থাকাটা যে কতটা অস্বাভাবিক আর কষ্টকর তা বাবাকে যারা দীর্ঘকাল ধরে চেনে তাদের পক্ষে সহজেই অনুমেয়। আমি বুঝলাম, ছোটুলাল আর সাবিত্রীদের যে অপমানটা কাল করা হল সে কারণে সে নিজেকেও প্রকারান্তরে অপরাধী বলে ভাবছে।
অফিস সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হল প্রায় ন’টা। নৈহাটিতে রাত ন’টা মানে ভর সন্ধে। আমি যে রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরি সেখানে যথেষ্ট ভিড়। সাইকেল চালাতে চালাতে লক্ষ্য করলাম নৈহাটিতে যেন উৎসবের মেজাজ। মাইকের হাত থেকে রাস্তার একটাও বিদ্যুতের খুঁটি রক্ষা পায়নি। সেখানে তারস্বরে বাজছে হিন্দি গান। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দু-চারজনের মুখে শুনতে পেলাম সারারাত ধরে চলবে এই সাংস্কৃতিক উৎসব।
আমার রাস্তাতেই পড়ে ঐকতান মঞ্চ। তার থেকে একটু দূরে ভবেশের চায়ের দোকান। অফিস থেকে ফেরার পথে এ দোকান থেকে আমি মাঝে মধ্যে চা খেয়ে যাই। আজ রাত হয়ে গেছে। তাই খাব না। কিন্তু আজ দেখলাম ওর দোকানে এই রাতেও ভরা জোয়ার। দোকানের সামনে লোকে গিজগিজ করছে। সকলেই চা খাচ্ছে। আর ভবেশ চেঁচাচ্ছে, ‘ওঃ, ওদের ব্যান করেছে, বেশ করেছে শালা। যতসব নোংরা কাজ।’
ঐকতানের সামনে বিরাট বড় একটা স্টেজ বাঁধা। সেখানে বাজছে ডি-জে সঙ্গীত। বাজি ফাটছে জোর দমাদম। আকাশভেদী বাজি, যেন পুজোর বাতাবরণ নিয়ে আসছে। স্টেজটার সামনে প্রচুর মানুষের জমায়েত। কেউ স্থির নেই। সকলে উদ্দাম নাচছে। কেউ প্রকৃতিস্থ নেই। সকলে ঘুরছে, টলছে, এর-ওর গায়ে পড়ছে। উন্মত্ত জনতা নাচতে নাচতে রাস্তার ওপর উঠে এসেছে। বুঝলাম, সাইকেল নিয়ে এ রাস্তা দিয়ে চলতে গেলেও বিশেষ বেগ পেতে হবে। অনেক ঠেলেঠুলে, কায়দা করে, দু-একজনের গায়ে সাইকেলের চাকার দাগ লাগিয়ে একটু এগিয়ে গেলাম, তারপর একটু স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলাম। রাস্তার একপাশে এসে আমি সমগ্র ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে লাগলাম।
স্টেজের ওপর এক মহিলা দেদার নাচছে। নাচের তালে তালে সে তার শরীর থেকে একটা একটা করে বসন খুলে ফেলছে। আর সেই বসন সে ছুঁড়ে দিচ্ছে তাণ্ডবরত দর্শকের দিকে। এমন সময়ে আমার নজরে এলো ঐ উন্মত্ত জনতার মধ্যে স্বয়ং তূণীরবাবুও উপস্থিত আছেন। তিনি লাস্যময়ীর অঙ্গভূষণ সংগ্রহ করছেন, আর তা বৃহত্তর জনগণের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। আমি মনে মনে হাসলাম। মদ্যের সুতীব্র উত্তেজক বাস, বাজির দমচাপা সালফারের গন্ধ আর অসহ্য বেদনাদায়ক শব্দমুদ্গর – আমি ঐ স্থানে আর একমুহূর্ত দাঁড়াতে পারলাম না। সাইকেলটার স্ট্যান্ড তুলে লোকজনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
আমাদের বাড়ি সেখান থেকে প্রায় কিলোমিটার খানেক হবে। মাইকের সুতীব্র শব্দনাদ সেখানকার বাতাসকেও জানান দিচ্ছে। জয়শ্রী আমাকে জিগ্যেস করলো, ‘কোথায় উৎসব হচ্ছে গো?’ আমি ওর কথার জবাবটা তখনই দিলাম না। বাড়িতে ঢুকেই বাবার ঘরে গেলাম। বাবা একটা বই পড়ছিল। মুখ তুলে একবার আমার দিকে চাইল। তারপর আবার সে মুখ নামিয়ে নিলো বইয়ের পাতায়। জিগ্যেস করলো, ‘আজ এতো হৈ চৈ কিসের?’
আমি বললাম, ‘উৎসব হচ্ছে ঐকতান মঞ্চের সামনে। সেখানে স্টেজ পাতা হয়েছে। দেখে এলাম, সেই স্টেজের ওপর নাচছেন স্বয়ং মহাকাল আর তাঁর অঙ্গুলিহেলনে তাঁর সামনে থাকা উন্মত্ত জনতার শরীর থেকে একটা একটা করে কাপড় খসে যাচ্ছে।’
জয়শ্রীর চোখে জিজ্ঞাসা, বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:১৭

রানার ব্লগ বলেছেন: প্রতিবাদ বরাবরই অশ্লিল!!!

১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৫২

ঐশিকা বসু বলেছেন: গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পাঠকের ভালোবাসাই আমার পাথেয়।

২| ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: নগ্ন হয়ে ইসলামিক দেশ গুলোতে প্রতিবাদ করা সম্ভব নয়।

১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৫২

ঐশিকা বসু বলেছেন: গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পাঠকের ভালোবাসাই আমার পাথেয়।

৩| ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:০৬

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: আপনার লেখা ভালো লেগেছে ঐশিকা। সামহোয়্যারইন ব্লগে আপনাকে স্বাগতম। আপনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে লিখছেন জেনে খুবই আনন্দিত। আমাদের অনেক সম্মানিত ব্লগার আছেন যারা ভারতীয়।

ব্লগ সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।

১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৫৩

ঐশিকা বসু বলেছেন: গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পাঠকের ভালোবাসাই আমার পাথেয়। সমস্যা হলে নিশ্চয়ই জানাবো।

৪| ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:০৯

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: খুব ভালো লেগেছে আপনার শ্লীলতার আড়ালে অশ্লীলতাকে ব্যক্ত করা। ঘটনার বর্ণনাটা চমৎকার হয়েছে। মনিপুরে অসম রাইফেলসের একটা ঘটনার সঙ্গে মিল পেলাম। সেদিন মায়েরাও এমন করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। গোটা দেশে তুমুল ঝড় উঠেছিল বিষয়টাকে নিয়ে। আপনি ভাল লেখেন আগেও তার পরিচয় পেয়েছি কিন্তু বড্ড অনিয়মিত। ঐক্যতান অনুষ্ঠান গৃহে ব্যক্তিগতভাবে আমারও যাওয়া আছে।
পোস্টে দ্বিতীয় লাইক।

শুভকামনা জানবেন।

১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৫৬

ঐশিকা বসু বলেছেন: গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। নাটকের ঘটনাটার অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল, তবে ঐকতানে নয়, কলকাতায়। সে নাটকে সাবিত্রী হেইসনামের অভিনয় আর মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী। এই দুটোই আমার লেখার প্রেরণা।

৫| ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:২২

অনল চৌধুরী বলেছেন: হত্যা বা ধর্ষণের র দৃশ্যে যদি সত্যিকারের হত্যা বা ধর্ষণ দেখানো না হলে নগ্নতার দৃশ্যে আসল নগ্নতা দেখানো অশ্লীলতা এবং বিকৃতি। শিল্পের মাধ্রমে যাদের প্রকাশে ক্ষমতা নাই, তারাই এসব বিকৃতির আশ্রয় নেয়।

১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৫৭

ঐশিকা বসু বলেছেন: গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পাঠকের ভালোবাসাই আমার পাথেয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.