![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বোকাসোকা মানুষ, কঠিন কথা বুঝিনা। মৌলবাদের গুষ্ঠি কিলাই। লিখতে ভাল্লাগে তাই লিখি। যোগাযোগ: [email protected]
খুব ছোট তখন আমি; বয়স হয়তো চার কি পাঁচ। ডিশের লাইন ছিলো না সেসময়। বিটিভিই ছিলো একমাত্র সম্বল। রাত আটটা’র খবর দেখতো সবাই মনোযোগ দিয়ে। ওদের সাথে আমিও। আমার কাছে খবরের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিলো খবরের শুরুতে যে সুরটা বাজায়- সেটা। জাতীয় স্মৃতিসৌধে তখন অব্দি যাওয়া হয়নি। জাতীয় পতাকার মানেও তখনও বুঝিনা। কিন্তু স্মৃতিসৌধের সামনে লাল সবুজ একটা পতাকা পতপত করে উড়ছে, তার সাথে একটা অজানা সুর বেজে যাচ্ছে- পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন মায়াময়, অপার্থিব। আমি আটটা বাজার একটু আগে থেকেই টিভি খুলে বসে থাকতাম, পাছে ওই সুরটা যেন মিস না হয়ে যায়। আমার পুরো শৈশব, বছরের পর বছর ওই মোহময় সুরটা শুনে গেছি- বহুদিন জানতে পাইনি ওই সুরের মানে।
আমার মা’র গানের গলা খুব মিষ্টি। তিনি কখনও গানের চর্চা করেননি। ঘর গোছাতে গোছাতে, রান্না করতে করতে মাঝেমধ্যেই আনমনে গেয়ে উঠতেন। আমি খুব মন দিয়ে মা’র গলায় গান শুনতাম সবসময়। আমার খুব ভাল্লাগতো। একদিন হঠাৎ মা একটা অজানা গান গাইতে শুরু করলেন। আমি চমকে উঠলাম! গানটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে! মা গাইছেন- “সবক’টা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো, গাইবো, বিজয়েরই গান! ওরা আসবে, চুপি চুপি- যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ!” আমি মা’র কাছে ছুটে গেলাম- “আম্মু, এইটা কোন গান?” আম্মু হেসে বললো, “কেন?” আমি বললাম- “গানটা কোথায় যেন শুনেছি!” আম্মু বললো, “কেন? রাত আটটা’র খবরের আগে তো এই গানটাই বাজায়!” আমি বললাম, “আবার গাও না!” মা আবার গাইতে শুরু করলেন- “সবক’টা জানালা খুলে দাও না...” আমি তখন হয়তো নিছকই ৬-৭ বছরের একটা বালক। বিজয়ের গান কী- বুঝিনা। জানালা খুলে দিলে চুপি চুপি কারা আসবে- জানিনা। তবে গানটার কথায় কিংবা মা’র গলায় এমন কিছু ছিলো, আমার শরীরের প্রতিটা লোমকূপে একটা শিহরণ খেলে গেলো। মা’র কাছ থেকে শুনে শুনে গানটা শিখে নিয়েছিলাম। তারপর নিজে নিজেই গাইতাম, বিটিভি’র সুরের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে। কেন যেন, খুব ভাল্লাগতো।
পরে যখন বুঝতে শিখেছি, গানটার প্রতি ভালোলাগা আরো অনেকগুণে বেড়ে গেছে। ততদিনে আরো অনেক গান শুনেছি, গানের অর্থ বুঝতে শিখেছি। আমি যখন ক্লাস ফোর-এ পড়ি, একবার সুযোগ হয়েছিলো আমাদের পাড়ার একটা সাংস্কৃতিক দলের রিহার্সেলে যাবার। ওরা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তখন এমন এমন সব গান শুনতে পেলাম, যা আগে কখনও শুনিনি। “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে”, “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”, “শোনো একটি মুজিবরের থেকে”, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা”, “পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল”, আরো কত গান! আমার বাবা তখন রোজ যেতেন রিহার্সেলে, আমিও তার সাথে যেতাম প্রতিদিন। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম গানগুলো। কতটুকু বুঝতাম- জানিনা, তবে গানগুলো শুনলে কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতো বুকের ভেতর- সেটা ব্যাখ্যা করার নয়।
ছোটবেলায় খুব পড়তাম শিশু একাডেমীর বই। একটু বড় হতেই বাবা আমার হাতে মুক্তিযুদ্ধের গল্পের বই তুলে দিতে শুরু করেন। বইগুলোর অনেকগুলোরই নাম মনে নেই, লেখকের নাম মনে নেই। মনে আছে সরদার জয়েনউদ্দীনের “আমরা তোমাদের ভুলবো না”। মনে আছে- ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ নামে একটা বইয়ের কথা, লেখকের নাম মনে নেই। এরকম কত অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের বই! কিছু কিছু বই ছিলো ছোট ছোট অক্ষরে লেখা আর কোনো ছবি ছাড়া, নিউজপ্রিন্টের কাগজে ছাপা। সেসব বই বাবা আমাকে পড়ে শোনাতেন। একটা গল্পের কথা মনে আছে। ছোট্ট একটা ছেলে, সে একজন রাজাকারের বাসায় কাজ করে। একবার ভুল করে ওদের গোপন পরিকল্পনার কথা শুনে ফেলেছিলো বলে ওই রাজাকার তাকে গলা টিপে মেরে ফেলে। ওর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিলো। মৃত্যুর আগে সে সেই রক্ত দিয়ে লিখে যায় একটি শব্দ- ‘মা’। গল্পের শেষটা শুনে আমি দৌড়ে বেরিয়ে যাই ঘর থেকে, ছুটে যাই পাশের ঘরে মা’র কোলে। মা বললো, “কী হয়েছে?” আমি মা’কে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করি, কিন্তু কান্নার দমকে দমকে মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। বয়স কত তখন আমার? পাঁচ কি ছয়?
ছাত্রছাত্রীদের ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি শেখানো কঠিন কাজ। অংক শেখানো কঠিন। ইংরেজি-অর্থনীতিও। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের একটা দু’টা কাহিনী বলা, একটা দু’টা ছবি দেখানো কিংবা তাদের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের মানে শেখানো কঠিন কিছু না। যে রক্ত প্রবাহিত হয়েছে একাত্তরে, যে রক্তে সিক্ত মাটিতে দাঁড়িয়েই কেবল কৃষ্ণচূড়ার ফুল তার টকটকে লাল রং পায়- সেই একই রক্ত এদেশের প্রতিটি শিশুর শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত। এদের দেশপ্রেম শেখাতে হয় না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ক্যাসেটটা ছেড়ে দিলে কিংবা “পূর্ব-দিগন্তে সূর্য উঠেছে” গানটা শুনিয়ে দিলেই ওর গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠবে, যেমনটি আমার হয়েছিলো। সে কারণেই বোধহয় একটা সময় এদেশের শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানতে না দেওয়ার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি ছিলো না। যখন ছোটো ছিলাম, প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা নিষেধ ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের গানও তখন প্রকাশ্যে বাজতো না। না, আমি একাত্তরের কথা বলছিনা। আজ থেকে ঠিক বিশ বছর আগের কথা বলছি। আমি আজও ভাবতে পারিনা- একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকদের তাদের স্বাধীনতার গান, তাদের জাতির পিতার কন্ঠস্বর লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে হতো!
একটা মহলের এই হঠকারী চেষ্টা খুব একটা অসফল হয়নি। আমাদের পূর্বপুরুষের রক্তবীজ থেকে জন্ম নেয়া সন্তানদের একটা অংশকে ওরা নপুংসক গাদ্দারে পরিণত করেছে। ওদেরকে শুনতে দেয়া হয়নি ওদের নিজেদের বুকের ভেতরের ধকধক আওয়াজ। ওরা দেখতে পায়নি, যে ওদের শরীরের লাল রক্তেই ওদের পতাকা রাঙানো। তাই ওরা স্টেডিয়ামে যায় গালে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে কিংবা “আফ্রিদি ম্যারি মি” লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তাই ওরা খুনী রাজাকারদের বাঁচাতে দেশে আবারও রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে ইতস্তত করেনা। আমি আওয়ামী লীগ করিনা। দেশকে ভালোবাসতে আওয়ামী লীগ করা লাগেনা। দেশকে ভালোবাসতে শুধু হৃদয়টুকু থাকলেই চলে। দেশকে ভালোবাসতে শুধু মানুষ হলেই চলে। আসুন, আজকে সবাই মানুষ হই।
আমি আজ বারবার রিপিট করে গানটা শুনছি। কিছুতেই মন ভরছে না। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া দিচ্ছে, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি যেন চুপি চুপি কেউ এসে আমার সাথে গান শোনায় যোগ দিচ্ছে, আমার সাথে সাথে গাইছে।
(পুন: এখন বিটিভি'র সংবাদের আগে "এক সাগর রক্তের বিনিময়ে" গানটা বাজে।)
সবক'টা জানালা খুলে দাও না,
আমি গাইবো, গাইবো বিজয়েরই গান!
ওরা আসবে চুপি চুপি-
যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে
দিয়ে গেছে প্রাণ...
চোখ থেকে মুছে ফেলো অশ্রুটুকু
এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই।
চোখ থেকে মুছে ফেলো অশ্রুটুকু
এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই।
হারানো স্মৃতির বেদনাতে একাকার করে মন রাখতে নেই
ওরা আসবে চুপি চুপি-
কেউ যেন ভুল করে গেয়োনাকো মন ভাঙা গান!
সবক'টা জানালা খুলে দাও না...
আজ আমি সারা নিশি থাকবো জেগে-
ঘরের আলো সব আঁধার করে।
আজ আমি সারা নিশি থাকবো জেগে-
ঘরের আলো সব আঁধার করে।
ছড়িয়ে রাখো আতর গোলাপ-
এদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে
ওরা আসবে চুপি চুপি-
কেউ যেন ভুল করে গেয়োনাকো মন ভাঙা গান!
সবক'টা জানালা খুলে দাও না,
আমি গাইবো, গাইবো বিজয়েরই গান
ওরা আসবে চুপি চুপি-
যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।
সবক'টা জানালা খুলে দাও না...!!
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৫৮
আম-আঁটির ভেঁপু বলেছেন: থ্যাংকু হারামজাদা, চরম হইলে লাইক দিলিনা কেন? বাক্যবাগীষ আকামা....
২| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:১৫
মাজহারুল হুসাইন বলেছেন: একটা সময় এদেশের শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানতে না দেওয়ার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি ছিলো না। যখন ছোটো ছিলাম, প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা নিষেধ ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের গানও তখন প্রকাশ্যে বাজতো না। না, আমি একাত্তরের কথা বলছিনা। আজ থেকে ঠিক এক দশক আগের কথা বলছি। আমি আজও ভাবতে পারিনা- একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকদের তাদের স্বাধীনতার গান, তাদের জাতির পিতার কন্ঠস্বর লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে হতো! >>> লেখা ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১২ এ প্রকাশ । কিন্তু লেখা কি আসলেই আজকে লেখা ? আজ থেকে ঠিক এক দশক আগের হলে তো ২০০২ হওয়ার কথা ।
আমি "সবক'টা জানালা খুলে দাও না" গানটা খবরের আগে শুনেছি মনে পড়ে না । তারমানে আপনি আমার চেয়ে অনেক অনেক বড় বয়েসে । তবে আমার "এক সাগর রক্তের বিনিময়ে" গানটা শুনতেই মনে হয় বেশী ভাল লাগে ।
১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:২২
আম-আঁটির ভেঁপু বলেছেন: দুঃখিত। ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। দুই দশক হবে। লেখাটা কালকেই লিখেছি, নিশ্চিত থাকতে পারেন।
৩| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:২৮
বিসল চক্রবর্ত্তী বলেছেন: যে রক্ত প্রবাহিত হয়েছে একাত্তরে, যে রক্তে সিক্ত মাটিতে দাঁড়িয়েই কেবল কৃষ্ণচূড়ার ফুল তার টকটকে লাল রং পায়- সেই একই রক্ত এদেশের প্রতিটি শিশুর শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত। এদের দেশপ্রেম শেখাতে হয় না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ক্যাসেটটা ছেড়ে দিলে কিংবা “পূর্ব-দিগন্তে সূর্য উঠেছে” গানটা শুনিয়ে দিলেই ওর গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠবে, যেমনটি আমার হয়েছিলো। - ভাল লাগা রইল
১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৩৮
আম-আঁটির ভেঁপু বলেছেন: ধন্যবাদ বিসল
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৫৪
বিষাদ সজল বলেছেন: দোস্ত সবকটা জানলা খুলে দিলে তো আলো বাতাস যেমন ঢুকবে মশা মাছি ও ঢুকবে । তবু বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে ক্ষুদ্র সমস্যাটা না হয় সয়েই গেলাম ।
----------------------------------
চরম হইছেরে ।