নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার আগে একজন মা। একজন স্ত্রী এবং নিঃসন্দেহে প্রেমিকা। একজন দন্ত চিকিৎসক। আর হ্যা, একজন বইপোকা! শেষ হয়েও হইলোনা শেষ - একজন লেখক।

অন্তরা রহমান

মানুষ নেশা করতে পানীয় খুঁজে, আমি খুঁজি বই। এই একটাই নেশা আমার। পড়তে পড়তেই লেখার ইচ্ছে জন্মাল। আর তার জন্য হাত মকশো করি এখানে এসে।

অন্তরা রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সায়েন্স ফিকশন গল্পঃ সূর্যপ্রিয়া - ০২

১১ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:১৪

প্রথমাংশের পর থেকে...

সেদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে অনেকক্ষণ কাঁদলাম আমি। শব্দ করার উপায় নেই, কারণ পাশের বিছানাতেই আব্বু-আম্মু ঘুমাচ্ছে। তাদের জানতে দিতে চাইনা যে এখনও মানসিকভাবে কতটা দুর্বল আমি।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনো কাঁদবো না। অবশ্য, একসময় ভেঙ্গে যাবে জেনেই প্রতিজ্ঞা করে মানুষ। পরের দিন সকাল আটটার দিকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। রাতের বেলা ঠিক দশটায় সব বাতি বন্ধ হয়ে যায়। আবার সকাল আটটায় চালু হয়, তাও শুধুমাত্র রান্নাঘর আর বাথরুমের বাতি-দুটো। বেডরুমের বাতি জ্বালানো যায় শুধুমাত্র বিকাল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। সব কিছুই নিয়ম করে দেয়া, আর আমরাও বেঁচে থাকার তাড়নায় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি।

বিশাল বইদুটিকে সাথে করে রান্নাঘরের ছোট টেবিলে বসলাম আমি, পাতা উলটে গেলাম যতক্ষণ পর্যন্ত যোগাযোগ কেন্দ্র ব্যবহারের নিয়মগুলো খুঁজে পাই। ধৈর্য ধরে পড়তে থাকলাম। অবশেষে এক জায়গায় দেখলাম যোগাযোগ কেন্দ্রটা খুলে ফেলা যায় ও সেটা তারবিহীন প্রযুক্তিতেই কাজ করে, তখন উঠে গিয়ে বইয়ে দেখানো পদ্ধতিতে খুলে আনলাম কেন্দ্রটাকে। তারপর আধা ঘণ্টা লাগলো জিনিসটা ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখতে, বলা যায় একরকম বিশেষজ্ঞই হয়ে গেলাম যোগাযোগ কেন্দ্র ব্যবহার সম্পর্কে। ঘড়ি দেখলাম আমি, যদিও এই পাতালে ঘড়ির সময় একরকম মূল্যহীন তাও আমাদের দেহ-ঘড়ির হিসেব ঠিক রাখতে ঘড়ির ব্যবহার খুব জরুরী - অন্তত তেমনটাই বোঝানো হয়েছে আমাদেরকে। সকাল সাড়ে দশটার মতন বাজে, আব্বু-আম্মু এখনও ঘুমায়। শুধু আব্বু-আম্মু না, আমার মনে হয় ভূ-অভ্যন্তরে বাস করা অধিকাংশ মানুষই এখন দুপুরের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাঁটায়। পছন্দের কাজও একসময় বিরক্তিকর ঠেকে যদি দিনের পর দিন সেটাই ঘুরেফিরে করা লাগে। কাজেই ঘুম তার চাইতে ভালো বিকল্প। যোগাযোগ কেন্দ্রটা ব্যবহার করে আগের চাইতে সহজেই ভাস্করের সাথে যোগাযোগ করলাম আমি। ছোট দুটো রুমের মধ্যে ব্যক্তিগত বলে কোন শব্দ থাকতে পারে না, জানি। আব্বু-আম্মু উঠার পর বা তারও পরে হয়তো দেখবে যোগাযোগ কেন্দ্র ব্যবহার করছি আমি, আশা করি তাতে খুব একটা কিছু মনে করবে না তাদের কেউ; এই অবস্থায় মনটাকে ব্যস্ত রাখার জন্য কোন উপায় খুঁজে পেলে আমাকে বাঁধা দেয়ার কথা না তাদের। আমার যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দা সবুজ হয়ে ওঠার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভাস্করের গলা ভেসে আসলো, "সুপ্রভাত। এত তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করবে তুমি ভাবতেও পারি নি, আমি আরও ভাবছিলাম তুমি হয়তো এখনও ঘুমচ্ছ। এগারোটা বাজলে পরে হয়তো তোমার সাথে যোগাযোগ করতাম আমি।"

আমি হাসলাম, "আসলে আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠি না, গতকাল তুমি বলাতে ভাবলাম আজ জলদি উঠে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেই দেখি। তা এত সকাল সকাল উঠে কি করছিলে?"

"তুমি যা করছিলে, তাই। যোগাযোগ কেন্দ্রটাকে নিয়ে বসেছিলাম। দাঁড়াও, ভিডিকনটা চালু করে নেই।"

কিছুটা সময় লাগলো আবারো ভিডিকন চালু হতে। দেখলাম একমুখ হাসি নিয়ে আমার মতই রান্নাঘরের একমাত্র টেবিলে বসে আছে ভাস্কর, "সরি, তোমাকে রুম দেখাতে পারছি না। অবশ্য দেখানোর সুযোগও নেই। তুমি বিরক্ত হয়ে যাবে। এই একই রকম রুমে তোমাকেও থাকতে হয়, আমার বিশ্বাস।"

এবার শব্দ করে হেসে ফেলে তাড়াতাড়ি মুখ চাপা দিলাম আমি, "ঠিকই বলেছ। পিছনদিকের দেয়ালটা দেখে ঠিক তাই মনে হচ্ছে, যেন আমাদের রান্নাঘরটাই।"

"ইশ, সেরকম হলে বেশ ভালোই হতো।"

আবারও হাসলাম আমি, মনে মনে নিজেকে ধমকও দিলাম, অনেক হয়েছে, এবার হাসিটা বন্ধ করো। "তা বলো, কি অবস্থা তোমার?"

"কেমন হওয়ার কথা? আর সবার মতই। কিছুই ভালো লাগে না। বাবা-মার সাথে কথা বলতে বলতে আর ছোট বোনের সাথে ঝগড়া করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছি। সবচাইতে রাগ ওঠে যখন প্রতিদিন একবার করে বাবা বুঝানোর চেষ্টা করেন খুব দ্রুতই সব ঠিক হয়ে যাবে। যেন আমি এখনো সেই ছোট্ট বাচ্চাটা আছি।"

"আমার আব্বু-আম্মু মনে হয় মেনে নিয়েছেন যে কিছুই আর ঠিক হবে না। কিংবা মেনে না নিলেও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চেষ্টা করছেন নিজেদের শক্ত দেখাতে। জানি না সত্যিটা কি।"

বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকলাম দুজনই। মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। অসময়ে আমাদের বড়ো করে দেয়ার জন্য জীবনের প্রতি কেমন একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল আমার। বুঝতে পারলাম শুধু আমার না, ভাস্করেরও; হয়তো আমাদের মতন হাজারো-লাখো কিশোর-কিশোরী এই একই মানসিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

"এমনিতে সারাদিন কি করো তুমি?" নীরবতা ভেঙ্গে ভাস্করই প্রথম প্রশ্ন করল।

"ছবি আঁকি। এই একটাই কাজ আমার। অবশ্য কতদিন আঁকতে পারবো জানি না। আঁকার জন্য যত খাতা এনেছিলাম তার বেশিরভাগই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু পেন্সিল ব্যবহার করে সাদা-কালো ছবি আঁকি আমি। মুছে ফেলি, এরপর আবার আঁকি। এভাবেও অবশ্য একটা পাতা তিনবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। আবার কখনো কখনো কোনও ছবি এতটাই পছন্দ হয়ে যায়, রঙ করে ফেলি আমি। ব্যস, একটা পাতা শেষ," এক নিঃশ্বাসে একগাদা ফিরিস্তি গাইলাম আমি। অবশ্য আঁকাআঁকি নিয়ে আমাকে কেউ কথা বলতে দিলে একসময় পাগল হয়ে যাবে আমার বকবকানি শুনতে শুনতে।

"আমি ক্যাডেট স্কুলে ছিলাম, ফৌজদারহাট। অবস্থা যখন খারাপ হতে থাকলো, স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো, আমিও বাসায় ফিরে আসলাম। তারপর তো জানোই।" ভাস্কর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

"আমি নিউ টেনে ছিলাম, লালমাটিয়া। সামনেই এসএসসি দেয়ার কথা ছিল। সুযোগ আর পেলাম কই," সুযোগ পেয়ে বললাম আমি, বয়সের পার্থক্যটা বুঝেছে কিনা তার কোনও ছাপ দেখা গেলো না ভাস্করের চেহারায়। "ক্যাডেট স্কুলের কথা অনেক শুনেছি। ভালো লাগতো সেখানে তোমার, বাসা থেকে দূরে, এতটা নিয়ম-কানুনের মধ্যে?"

"ভালো না লাগলেও কিছু করার ছিল না, আব্বুর খুব ইচ্ছা ছিল আমি ক্যাডেট স্কুলে পড়ি। এখন অন্তত আমার বোন খুব খুশি, আমার সাথে অনেকটা সময় কাঁটাতে পারছে। আর নিয়ম-কানুন, সেটা তো এখন বুঝতেই পারছো, কতটা কষ্টকর মেনে চলা।" ভাস্করের মুখে কষ্ট করে ফোটানো হাসি দেখলাম আমি চুপচাপ।

বেডরুমের বিছানা থেকে কারো একজনের নেমে আসার শব্দ শুনলাম আমি। "ঠিক আছে, পরে যোগাযোগ করবো তাহলে। কালকে, এরকম সময়েই?"

"হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার সাথেই থাকবে যোগাযোগ কেন্দ্রটা। তুমি যোগাযোগ করো, আমার ভালো লাগবে," 'ভালো' কথাটার উপর যেন জোড় দিল ভাস্কর। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, একদিনও কি ভুল হবে আমার যোগাযোগ করতে। অবশ্য এতকিছু আর না বলে "টা টা" দিয়ে যোগাযোগ কেন্দ্রটা বন্ধ করলাম আমি।

একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম, ভাস্কর আমার মতোই নিঃসঙ্গ।

---

এরপর থেকে এটা আমাদের প্রতিদিনের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সকাল আটটার দিকে উঠে পড়তাম আমরা। আমিই সবসময় যোগাযোগ করতাম কারণ ভাস্কর বুঝতে পেরেছিল এখনই আমার বাবা-মাকে ব্যাপারটা জানাতে চাইছিনা আমি, কেনো তার কোনও উত্তর ছিল না আমার কাছে। অন্যদিকে ভাস্কর আমার চাইতে এক বছর চার মাস ছোটো বয়সে। কিন্তু আমাদের কথায় তা বোঝা যেত না। সেই বন্ধুহীন সময়ে আমরা দুজন দুজনের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলাম, কাজেই বয়সের ব্যাপারটা সেখানে পাত্তা পায়নি। ভাস্করের জীবনের লক্ষ্য শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম আমি। ওর অনেক শখ ছিল একজন কৃষিবিদ হওয়ার। ওদের গ্রামের বাড়িতে, ভাস্করের দাদা ওর নামে এক বিঘারও বেশি জমি লিখে দিয়েছিলেন। ওর খুব ইচ্ছা ছিল সেখানে গিয়ে, আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার। সাধারণ সময়ে, পৃথিবীর উপরে এরকম কোন লক্ষ্যের কথা শুনলে হেসে কুটিকুটি হতাম আমি। কিন্তু, এই পাতালে নিজের একমাত্র বন্ধুর ধীর-শান্ত গলায় বলা জীবনের লক্ষ্য হেসে উড়িয়ে দেয়ার মতন বোকা ছিলাম না আমি। প্রতিদিন আমাদের মধ্যে যা কথা হতো, তা নিজের ছোট্ট পকেট ডায়েরিতে লিখে রাখছিলাম আমি। দুই বছর ধরে অকেজো পড়ে থাকা ডায়েরিটাও যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল।

ঠিক মাস ছয়েক পরের কথা, একদিন সকালে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে বসেছি আমি ভাস্করের সাথে যোগাযোগ করার জন্য, আব্বু আর আম্মুও উঠে আসলো আমার সাথে সাথে। অবাক হলেও ধারণা করলাম আমার যোগাযোগ কেন্দ্র ব্যবহারের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে গিয়েছে দুজনই। জেরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম কিন্তু আব্বু-আম্মু এমন একটা বিষয়ে কথা বলা শুরু করল যাতে আমি আসলেই চমকে গেলাম। আসলে এভাবে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মতন খাঁচায় থাকাটা আর সহ্য হচ্ছিল না আব্বু-আম্মুর। কাজেই দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এভাবে বন্দী থাকার কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু কখনোই পৃথিবী-পৃষ্ঠে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই কাজেই এই পাতালেই নিজেদের জীবনটাকে গুছিয়ে আনতে হবে। তার জন্য এই বাক্সের মতন চারকোনা ঘর থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুজন মিলে। এখন আমার মতামত জানতে চাইলো আব্বু।

"সমস্যা অনেক আছে," আব্বু তার দরবেশের মতন লম্বা দাঁড়ি টানতে টানতে বলল। "সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো, নিয়ম না মেনে ঘর থেকে বের হলে আমাদেরকে ভূগর্ভস্থ আবাসস্থল থেকে বের করে দেয়ার ব্যাপারে কিন্তু আগেই সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু, তারপরও আমার আর তোমার মার মনে হয় আমাদের উচিত অন্তত এই পাড়ার অন্যান্য পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করা ও নিজেদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা। তারপর প্রয়োজনে আমরা একসাথে নিয়ন্ত্রক সদস্যের কাছে বিষয়টার বিস্তারিত জানিয়ে আবেদন করলে সবাইকে তারা বের করে দিবে না আশা করি।"

অবশ্য আব্বুর বলা ভঙ্গীতেই বোঝা যাচ্ছিল নিজের কথার উপর তার নিজেরই ততটা বিশ্বাস নেই। আম্মু অবশ্য সায় জানালেন আব্বুর কথায়, "যেহেতু, এখানে বন্দী হয়েই আছি আমরা, কাজেই খাঁচার আকারটা একটু বাড়ানোর চেষ্টাতে ক্ষতি নেই।"

আম্মুর কথায় মজা পেয়ে হেসে উঠলাম আমি। আম্মু সবসময়ই এমনভাবে কথা বলে। যে কোন পরিস্থিতি নিয়ে অনেকটা দাঁড়িপাল্লায় হিসাব করতে বসে আম্মু। তারপর মেপে দেখে কোনদিকের ওজনটা বেশি আর সেদিকেই ঝুঁকে যায়। আমি অবশ্য মুচকি হেসে একটা সমাধান দিলাম, "তোমরা যদি চাও তাহলে অন্য দশ পরিবারের সাথে আগেই কথা বলে দেখতে পারো। আমার মনে হয় নিয়ন্ত্রক সদস্যের কাছে আবেদন পরে করার চাইতে আগে জানিয়ে রাখাটাই ভালো হবে।"

আমার কথা শুনে দুজনের কেউই চমকালো না দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম, আব্বু আর আম্মু দুইজনই আমার যোগাযোগ কেন্দ্র দিয়ে প্রতিদিন গুজুর-গুজুরের ব্যাপারে জানে। কাজেই এরপর কথা না বাড়িয়ে আমি তাদেরকে ভাস্করের ব্যাপারে খুলে বললাম। যোগাযোগ কেন্দ্র দিয়ে একই সাথে দশটা পরিবারের সম্মিলিত সভা ডাকলাম খুব সহজেই। সবাই সবার সাথে পরিচিত হলো, কথা হলো, আলোচনা হলো। এসবই এক দিনে হয় নি, কয়েকদিন ধরে বিরামহীনভাবে যোগাযোগ কেন্দ্র বেজেই চলল। মাঝখান দিয়ে আমার আর ভাস্করের কথা বলাটাই বন্ধ হওয়ার জোগাড়। প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পর নিয়ন্ত্রক সদস্যের অনুমতি সাপেক্ষে আমরা একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনুমতি চাওয়ার সময় জানা গেল, আমাদের আগে আরও অনেক পাড়াতেই এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আমরাই দেরি করে ফেলেছি। অনুমতি তাই সহজেই পাওয়া গেলো। এক শুক্রবারে সবাই দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা, তাও আবার বিকেলে। এতটা নাটকীয়তার পক্ষে ছিলাম না আমি যদিও, কিন্তু বড়োরা কেন যেন এসব খুব পছন্দ করে। কাজেই, পরের শুক্রবার বিকেলবেলা আব্বু-আম্মু আর আমি মিলে নিয়ন্ত্রক সদস্যের দেয়া দরজার সেন্সর বিকলন-কোড প্রবেশ করালাম। আড়াই বছর ধরে বন্ধ থাকা দরজা নিঃশব্দে খুলে গেলো। মনে হচ্ছিল, কত হাজারো দিন পর ঘরের ঐ বদ্ধ দেয়াল ছেড়ে বাইরে বের হয়েছি আমরা। এখানে অবশ্য করিডরে লাগানো বাতিগুলো একদমই কম আলো দিচ্ছিল। তার উপর বাতিগুলো আবার চলন-নিয়ন্ত্রিত। আমরা বাতিগুলোর নীচে গিয়ে দাঁড়ালে জ্বলে উঠছিল, সরে গেলেই নিভে যাচ্ছিল। একে একে করিডরের দুইপাশে থাকা আরও দুটো ঘরের দরজা খুলে গেলো। নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় শেষে আমরা প্রতি পাড়ার কেন্দ্রে থাকা উন্মুক্ত স্থানের দিকে রওয়ানা দিলাম। আর সবার ততক্ষণে সেখানে চলে আসার কথা। ভাস্করেরও।

-----

অবশেষে আমরা দশ পরিবার একত্রিত হলাম। সবার চোখেমুখেই দীর্ঘ বন্দী জীবন শেষে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ। দশ পরিবারের মধ্যে আটটা পরিবারেই ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে আছে, কিন্তু ভাস্কর ছাড়া আমার কাছাকাছি বয়সের আর কাউকে দেখতে পেলাম না। একটা মেয়ে ছিল অবশ্য, সীমন্তি, ০৯ নাম্বার ঘরের। বয়স দেখে মনে হচ্ছিল ১৩ কি ১৪ বছরের হবে। এই বয়সটা একটা অস্বস্তিকর সময় হয়ে আসে সবার জীবনে। বাচ্চাদের সাথে খেলতে গেলে নিজেকে অনেক বড়ো বলে মনে হয় আর বড়োদের সাথে কথা বলতে গেলে নিজেকে অনেক ছোট, অপাঙতেয় বলে মনে হয়। তারপরও, কাছাকাছি বয়সের মেয়ে বলে এতটুকু তো নিশ্চিত, সীমন্তিই আমার বান্ধবী হতে পারবে এখানে। কিন্তু, ভাস্করই আমার কাছের বন্ধু হয়ে থাকবে। ওর সাথে ছয় মাস ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকবক করা শেষে এখন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। মনে হয় যেন বছরের পর বছর ধরে চিনি আমরা একজন আরেকজনকে। আমাকে দেখেই, এগিয়ে আসতে শুরু করেছে ভাস্কর। মুখে সেই চিরচেনা হাসি, প্রতিদিন সকালে যা যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দায় দেখেই শুধুমাত্র অভ্যস্ত ছিলাম আমি। এভাবে দূর থেকে কথা বলা এক ব্যাপার, আর সামনাসামনি কথা বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। ওকে কাছে আসতে দেখে এসব কথাই মাথায় উঁকি দিচ্ছিল আমার। নিশ্চিত ছিলাম যে, ভাস্করের মনেও একই রকম চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই মুহূর্তে।

ভাস্কর আমার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল, আমরা দুজন এমনভাবে হাত মেলালাম যেন কোনও বিজনেস ডিল শেষ করে উঠেছি মাত্র। এখানে থাকা পরিবারগুলোর কেউ জানে না, ভাস্কর আর আমি ওদের সবার মতন অপরিচিত নই। অবশ্য, আব্বু-আম্মু জানে। কিন্তু ভাস্কর নিজের বাসায় এখনও কিছু জানায় নি, অন্তত যতটুকু আমি জানি। গত ছয়টা মাস ভাস্কর আমার জীবনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। আগেও প্রতিরাতে একটা প্রশ্ন নিজেকে করতাম আমি, এভাবে বেঁচে থেকে কি লাভ? তার উত্তর অধিকাংশ সময়ই ছিলো ধোঁয়াশার মতন। 'বেঁচে আছি, টিকে আছি, সেটাই শেষ কথা।' - এসব বলে নিজেকে প্রবোধ দিতাম সাধারণত। ভাস্করের সাথে কথা বলা শুরু করার পর থেকে, পরেরদিন সকালের যোগাযোগটাও সেই উত্তরের অংশ হয়ে গিয়েছিল। দুইবছর কারো সাথে কথা না বলে, সব কথা জমিয়ে, একা একা কিভাবে বেঁচে ছিলাম সেটা ভাবতেও অবাক লাগে এখন।

ভাস্কর লম্বায় প্রায় আমার সমানই হবে। এমন না যে আমি খাটো, তবে ভাস্করের পরিবারের সবাই যে একটু লম্বা গড়নের তা এখানে এসেই বুঝেছিলাম আমি। পর্দায় সেটা এতদিন অতটা ভালো করে বোঝা যায় নি। সেই সাথে প্রতিদিন, ঘরে থাকা শারীরিক-সক্ষমতা কেন্দ্রে নিয়ম করে সময় কাটায় ভাস্কর তা আগে থেকেই জানা ছিল আমার। আমি অবশ্য এব্যাপারে ভীষণ অলস। আমাদের ছাড়াও আরও যে ছোট-ছোট বাচ্চাগুলো ছিলো তারা এতদিন পরে একটু খোলা জায়গা পেয়ে যেন পাগল হয়ে গিয়েছে। এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে পিচ্চিগুলো, সব মিলিয়ে দশ জন। আমি, ভাস্কর আর সীমন্তি সহ তেরো জন। মানে কোনও কোনও বাসায় একের অধিক বাচ্চা থাকে। ভাস্করেরই তো ছোটো বোন আছে। এতদিন কেন যেন মাথায় আসে নি ব্যাপারটা, কিন্তু ঐ ছোটো ঘরে কিভাবে এতজন একসাথে থাকে সেটা আসলেই ভাবার মতন বিষয়। বড়রা এরই মধ্যে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। পুরুষ আর মহিলারা দুইদিকে গিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। মোটা গলার অট্টহাস্য আর চিকন গলার মিহি হাসি - দুইদিক থেকে দুরকমের শব্দ ভেসে আসছে।

"আমাদের দেখা হয়েই গেলো শেষ পর্যন্ত," ভাস্কর আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ওর ফর্সা মুখটা কেমন যেন গোলাপি রঙ ধারণ করেছে হঠাৎ করে।

"হ্যাঁ, আসলেই। আমরা তো ভেবেছিলাম কখনোই হবে না," আমি মৃদু হেসে বললাম।

"চলো, ঐ বেঞ্চটাতে বসি গিয়ে। ভালো কথা, তোমার হাতে এটা কি? তোমার ড্রইং খাতা নাকি?" ভাস্কর একপাশে থাকা বেঞ্চের দিকে হেঁটে যেতে যেতে প্রশ্ন করল।

"হ্যাঁ। এটা অবশ্য আমার সবচাইতে পুরনো ড্রইং খাতা। এর সব পাতায় শুধু সূর্যের ছবি আঁকা, বলেছিলাম না তোমাকে? ভাবলাম প্রথম দেখায় নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাই তোমাকে দেখাই।"

"ভালো করেছ, ঐ বিচ্ছিরি পর্দায় তোমার ছবির রঙ ঠিকমতন বোঝাই যায় না। দাঁড়াও এক মিনিট, আমিও একটা জিনিস নিয়ে আসি তাহলে," আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে তার বাসার দিকে চলে গেলো ভাস্কর। ফিরে আসলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। আমি ততক্ষণে বেঞ্চের মধ্যে বসেছি, ড্রইং খাতাটা পাশেই রেখেছি যেভাবে ক্লাসের মধ্যে পাশে ব্যাগ রেখে বান্ধবীদের জন্য জায়গা রাখতাম। হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে কোলের ওপর একটা মোটাসোটা খাতা ফেলে, ড্রইং খাতাটা বেঞ্চি থেকে তুলে বসে পড়লো ভাস্কর। ও ধীর-স্থির হওয়ার আগেই আমি বললাম, "এটা কি?"

"আমার খাতা। এটাকে আমি ডায়েরি হিসেবে ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে গল্প লিখি। ভবিষ্যতের ভাবনাগুলো তুলে রাখি। এই তো," এখনও দম ফিরে পায়নি সে, তবে আমার দিকে যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেটা দেখে একটু অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল আমার।

"কি হলো? পর্দার আমি আর এই আমির মধ্যে কি এতই বেশি তফাত নাকি?" হেসে বললাম।

"না, আসলে। এভাবে পাশাপাশি বসে কথা বলার মধ্যে একটা অন্যরকম আপন-আপন ভাব আছে, যেটা ঐভাবে কথা বললে পাওয়া যায় না। তুমি আমার এখন সবচাইতে কাছের বন্ধু। তাও, আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন এই প্রথম কথা বলছি আমরা। অথচ সেখানে কথা বলার মতন বিষয়ও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আমাদের মধ্যে।" অন্যদিকে তাকিয়ে ইতস্ততভাবে বলল ভাস্কর, আবারো ওর ফর্সা গাল যে গোলাপি হয়ে উঠছে লক্ষ্য করলাম আমি।

"তাই বলো, আমি আরও ভাবলাম আব্বু-আম্মুকে দেখে এখন তুমি সেই বিখ্যাত লাইনটা বলবে যা একজীবনে যথেষ্ট বার শোনা হয়ে গেছে আমার," আমি সুযোগটা ছাড়লাম না।

"কোন লাইন? কি কথা?" কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো ভাস্করকে।

"এই যে 'ইশ! তুমি তোমার বাবার গায়ের রংটা পেলে ভালো হতো, ব্যাড লাক!' এই ধরনের কিছু একটা," আমি হাসতে হাসতে বললাম।

"আরে ধুর। কি যে বলো না। তুমি অনেক সুন্দর।" কথাটা বলেই গালের গোলাপি রঙ আরও গাঢ় করে তুলল ভাস্কর, বেশ মজা পাচ্ছিলাম আমি।

"তুমিও। ভালো কথা, আমার ড্রইং খাতাটা তোমাকে দেখানোর জন্যই নিয়ে আসা। খুলে দেখলে আমি কিচ্ছু মনে করবো না," ওকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য বললাম আমি। আসলে আমার কাছে ওর ইতস্তত ভাবটাই অস্বাভাবিক লাগছিল। ছয় মাস ধরে কথা বলার পর যতটা কাছের বন্ধু হওয়া যায়, ততটাই কাছের বলে মনে হতো ভাস্করকে আমার। কাজেই এভাবে মুখোমুখি বসে ওর অস্বস্তিভরা আচরণ আমাকেও সহজ হতে বাঁধা দিচ্ছিল, যদিও আমি চেষ্টা করছিলাম প্রতিদিনকার মতোই কথা বলতে।

অনেকটা সময় নিয়ে একের পর এক পাতা উলটে ছবিগুলো দেখে গেলো ভাস্কর। কোনও ছবি পছন্দ হলে আমাকে জানাতে ভুল করলো না অবশ্য। একটা ছবি, নদীর ঢেউয়ের উপর সূর্যের আলো ঝিকিমিকি করছে, ধরার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা; অনেকক্ষণ ধরে দেখলো সে। কিছুক্ষণ হাত বুলালো ছবিটার উপর যেন এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া সূর্য, সূর্যের আলো আর নদীর ঢেউ আরও একবার ধরে দেখতে চায়। তারপর খাতাটা বন্ধ করে চুপ করে থাকলো। এরকম প্রতিক্রিয়ার আশা করি নি আমি। একটু মন খারাপও হলো। ছবিগুলো আমি এঁকেছিলাম শুধুমাত্র অতীতকে ধরে রাখার চেষ্টায়, সেটা যে অন্যদের জন্য বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হতে পারে, কখনো ভাবিনি।

আমার মনের কথাটাই বলে উঠলো ভাস্কর, "ছবিগুলো মন খারাপ করে দেয়। আবার ছবিগুলো আশাও জাগায়। তবে সত্যি কথা কি, সূর্যপ্রিয়া, আমি অনেক ভেবেছি। আমাদের এই অতীতের চিন্তার ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী জানো তো? অভিযোজন ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে সক্ষম আমরা। এই অবস্থাতেও নিজেদের মানিয়ে নিবো, একসময় থেমে থাকা সভ্যতার চাকা, প্রযুক্তির গাড়ি আবার চলতে শুরু করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস।" অদ্ভুত স্বরে কথা বলে গেলো সে। এই ভঙ্গিটার সাথে আমি পরিচিত। নিজের স্বপ্নের কথা বলার সময় এভাবেই কথা বলে ভাস্কর। "এক কাজ করো, খাতাটা খুলে দেখো, কয়েকদিন আগে একটা জিনিস এঁকেছি। অবশ্য সূর্য, মানুষ, ফুল-লতা-পাতা নয়," আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে। ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আমি। হঠাৎ ফিরে তাকানোতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ওর খাতাটা জলদি খুলে পাতা উলটে যেতে থাকলাম।

শেষ যে পাতায় লেখা আছে তার কয়েক পাতা আগে থামিয়ে দিল আমাকে ভাস্কর, "এখান থেকে পড়। একটু সময় লাগবে, বিরক্তও লাগতে পারে কিন্তু।" আমি একটু ভ্রুকুটি হেনে পড়তে শুরু করলাম।

সূর্যালোক আর পানি ছাড়াও কিভাবে চাষাবাদ করা যেতে পারে সেব্যাপারে পাতার পর পাতা লিখে রেখেছে ভাস্কর, এমনকি মাটির এই নীচে বসে কিভাবে সুরঙ্গ খুড়ে অল্প জায়গাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে চাষ করা যায় এঁকে দেখিয়েছে সেটাও। মনে মনে ওর আঁকার হাতের প্রশংসা করলাম আমি। একটু চেষ্টা করলেই ভালো আঁকিয়ে হতে পারতো ছেলেটা। "এটা কি? ৩৬০ পদ্ধতি?" একটা ছবি দেখিয়ে জানতে চাইলাম আমি।

"এখানে, মাটির নীচে ধরো একটা সুড়ঙ্গ কাটলাম আমরা। এর মধ্যে মেঝে থেকে শুরু করে দেয়াল, এমনকি ছাদেও কিন্তু চাষ করা যায় চাইলে। তারই একটা সম্ভাব্য উপায়ের কথা লিখেছি আমি এখানে। আসলে কৃষিবিদ হওয়ার ব্যাপারটা এমনভাবে মাথায় ঢুকে গিয়েছিল এখনো সেসব চিন্তা মাথা থেকে সরাতে পারছি না আমি," ওর উজ্জ্বল চোখে বিষাদের প্রগাঢ় ছায়া লক্ষ্য করলাম আমি। আমার জীবনে আসলে কখনো কোনও লক্ষ্য ছিল না। চাকরি করতে হবে, টাকা আয় করতে হবে, স্বামী-সন্তান-সংসার এসব নিয়ে কখনোই ভাবতাম না আমি। আমার স্বপ্নগুলো ছিলো একদম ছোটোখাটো। দিনের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময় ক্যানভাসের সামনে বসতে পারাটাই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য, চারুকলায় পড়াটা তার একটা অনুষঙ্গ ছিল মাত্র। কিন্তু, ভাস্করের চিন্তাগুলো খুব সুনির্দিষ্ট। এটা করতে হবে, ওটা হতে হবে - যার কোনোটাই এখন আর করা বা হওয়া সম্ভব না ওর পক্ষে।

"মন খারাপ করে থেকো না, অন্তত যখন আমি এখানে তোমার পাশে বসে আছি তখন তো নয়ই," আমার ড্রইং খাতা ধরে থাকা ওর হাতের উপর আমার একটা হাত রাখলাম আমি। ওকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য হলেও অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছিলো আমার মধ্যে। ভাস্কর আর আমি একজন আরেকজনের ব্যাপারে এখন সবই জানি। নিজেদের সবচাইতে গোপন কথাটাও দুজনকে বলে ফেলা শেষ আমাদের, কারণ আমরা দুজনই ভেবেছিলাম এই জীবনে কখনোই দেখা হবে না আমাদের, আর কোনও বন্ধু থাকবে না আমাদের, আমরা দুজনের বন্ধুত্বই পৃথিবীর শেষ বন্ধুত্ব হয়ে থাকবে। যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দার ওপাশে থাকা ছেলেটাকে দূর থেকে যতটা শক্ত বলে মনে হচ্ছিল, সামনে এসে ততটা লাগছে না। মনে হচ্ছে, আমার মতই রাতের বেলা হঠাৎ করে মন খারাপ হয় ওরও, হয়তো কান্নাও করে। আমার রঙ, ড্রইং খাতা এখনও আমার সাথে আছে। কিন্তু, ভাস্করের স্বপ্ন ওর থেকে অনেক দূরে সরে গেছে এখন যেখানে চাইলেও আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না।

"মন খারাপ হয় ঠিকই, তবে মানিয়ে নিচ্ছি। ভালোই হয়েছে, অন্তত আমার বাবার কথামতো সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হবে না আমাকে। কিংবা এগ্রিতে পড়ার জন্য বাসা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ারও প্রয়োজন পরবে না," বলতে বলতে আমার হাতের নীচে থাকা ওর হাতটাকে উলটে দিলো সে। তারপর আঙ্গুলগুলো দিয়ে আমার আঙ্গুলগুলোকে আঁকড়ে ধরলো। মনে হলো আমার বুকের ভেতরে যেন একরাশ প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। ওর হাতটা এত নরম আর উষ্ণ বলে মনে হচ্ছিল যেন মাত্র চুলো থেকে বের করে আনা পাউরুটি। একটা ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ যেন ঝলকে উঠলো মনের কোথাও। যেন আমার ভেতরে আগুন ধরার অপেক্ষায় বসে আছে একরাশ শুকনো পাতা। কিসব ভাবছিলাম আমি, নিজেরও মনে নেই। এমন না, এর আগে কোন ছেলের হাত ধরিনি আমি। এমনকি চুমু খাওয়ার পর্বও শেষ । কিন্তু, এই অনুভূতি সম্পূর্ণই ভিন্নরকম ছিল। সবসময় নিজের ভাবনায় মগ্ন থাকতাম আমি, নিজের মত করে একা থাকাটাই পছন্দ ছিল আমার। আব্বু-আম্মু, হাতে গোণা কিছু বন্ধু, আমার রঙ, আমার ছবি আঁকা - এই ছিল আমার পৃথিবী। প্রেম-ভালোবাসা আমার কাছে একটা বিমূর্ত অনুভূতি ছাড়া কিছুই ছিল না। হলে হবে, না হলেও সমস্যা নেই - অনেকটা এরকম। ছেলেদের সাথে সহজাত ভঙ্গিতে কথা বলতে পারতাম তাই, ছেলে বন্ধুর অভাব ছিল না। কিন্তু, সব কথা আসলে বলে বোঝানো যায় না। লিখেও না। এই বুড়ো বয়সে এসেও লিখতে গিয়ে কিশোরীর মতন হেসে ফেলছি সেই দিনের কথা ভেবে। কখনো কারো হাতের স্পর্শ এতটা প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করিনি আমি, এটুকু নিশ্চিত।

ওর কথাটা আমাকে একটু হলেও অবাক করছিল। ছয় মাসে একবারও কথা শুনে মনে হয় নি, ওর বাবার সাথে কোনও সমস্যা থাকতে পারে ভাস্করের, "তোমার বাবা-কি তোমাকে এগ্রিতে পড়াতে রাজী ছিলেন না?"

ভাস্কর ওর স্বাভাবিক ধীর-শান্ত গলাতে আমাকে এমন সব কথা বলতে থাকলো যা ওর বাসার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকা অবস্থায় আমাকে বলে নি। হয়তো সব কথা সবসময় বলা যায় না। হয়তো কিছু কথা বলার জন্য ঠিক এমন একটা পরিবেশ দরকার। একটা বেঞ্চ, পাশাপাশি বসে থাকা, একজন আরেকজনের হাত ধরে। এমন একজন শ্রোতা যে আপনাকে বুঝতে চাচ্ছে ও বুঝতে পারবে আর এমন একজন বক্তা যে শ্রোতার কাছে নিজেকে খোলা বইয়ের মতন উন্মুক্ত করে দিতে চাচ্ছে। সবাই নিজেদের মধ্যে বিদায় নেয়া পর্যন্ত আমরা দুজন গল্প করতে থাকলাম। এখন থেকে আর অনুমতি নেয়ার বালাই নেই, প্রতিদিন বিকেলে সবার মধ্যে দেখা হবে সেরকমটাই কথা হলো। এই ছোট্ট একটা পরিবর্তন, দুই বছর পরে একটু ঘর থেকে বের হওয়াই সবাইকে যেন আগের মতন প্রাণোচ্ছল করে তুলেছিল। মাঝে মাঝে এরকম দুয়েকটা পরিবর্তন হলে ভালোই হয়, ভাবলাম আমি। পরবর্তীতে নিজেকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কখনো পরিবর্তনের জন্য আশা করে বসে থাকতে নেই। কারণ পরিবর্তন ভালো হবে না খারাপ তা ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে কেউই জানে না। কেউ না।

---

(চলবে)

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:৩৯

ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:




বোনরে, গল্পের স্লট ছোট করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় কথা গল্পে দেওয়া যাবে না, তাহলে পাঠক গল্প পড়ে আনন্দ পাবেন। শুভ কামনা রইলো।

১১ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:৪৫

অন্তরা রহমান বলেছেন: বর্ণনা ছাড়া গল্প লিখে কি লাভ। আমি যদি গল্পের চরিত্রদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মানসিক পরিস্থিতি, অতীত আর ভবিষ্যত নিয়ে বিস্তারিত না লিখি তাহলে তো একটা বড় অংশই পাঠকের কল্পনার উপর ছেড়ে দেয়া হলো। সেই পাঠক আমার গল্প নিয়ে কল্পনা ঠিকঠাক করতে পারবেন কি?

২| ১১ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:০১

ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:




আধুনিক যুগের জাদুকর হচ্ছেন লেখক। আপনিও একজন লেখক তাহলে আপনি কেনো জাদু পারবেন না? আপনি চাইলেই পারবেন, শুধু সামান্য চেষ্টা করতে হবে।

১১ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:১১

অন্তরা রহমান বলেছেন: আমার মনে হয়, আমাদের দেশের সাহিত্যতে এই বর্ণনার ব্যাপারটা খুব উপেক্ষিত। তাই, ১০০ পাতার বইকেও উপন্যাস বলা হয়। আমার মতে ৩০ পাতায় ছোটগল্প, ৬০-৭০ পাতায় বড়ো গল্প, ১৫০ পাতা পর্যন্ত উপন্যাসিকা আর এর বেশি হলে উপন্যাস। ডায়লগ দিয়ে ঠিক উপন্যাস হয় না, ওটা হুমায়ুন স্যার পারতেন। কিন্তু, ওটাই প্রথা নয়। প্রথা ভেঙ্গে সাহিত্যকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। নতুন নতুন জনরা নিয়ে লেখার সময় এসেছে। আমার তাই বিশ্বাস।

৩| ১১ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:৫৪

মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন: ২ পর্ব মিলিয়ে জীবানুর হাত থেকে বাঁচতে মাটির নিচে চলে যাওয়া ছাড়া সাইন্স ফিকশনের আরো কোনো ছোঁয়া এখনো পেলাম না।

১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৪৩

অন্তরা রহমান বলেছেন: আসলেই, লেখা শেষে ভেবে দেখলাম তেমন শুদ্ধ সাই-ফাই হয়নি গল্পটা। শুধু 'ট্রোপ' ইউজ করা হয়েছে সাই-ফাইয়ের। রোমান্টিক এসপেক্টটা বেশি দেখিয়ে ফেলেছি, তবে আসলে একটা সভ্যতা কিভাবে নতুন করে শুরু হতে পারে সেটাই দেখাতে চেয়েছিলাম। দেখা যাক, শেষ পর্ব দেই।

৪| ১১ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৫

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: ভেবেছিলাম শেষ হবে!! দেখী টুবি কন্টিনিউড ;)
হা হা হা

ঠা'মার ২য় মন্তব্যের সাথে সহমত।

+++

১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৪৫

অন্তরা রহমান বলেছেন: নাহ, আর এক পর্ব বাকি। দশ হাজার শব্দের গল্প ব্লগে একবারে দিলে সবাই এসে উইন্ডোর স্লাইডারের সাইজ দেখে বন্ধ করে ভাগবে। ধন্যবাদ প্লাসের জন্য।

৫| ১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:০৭

নেওয়াজ আলি বলেছেন: চলতে থাকুক সাথে আছি । পড়তে থাকি সময় কাটে

১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:২০

অন্তরা রহমান বলেছেন: অবসরে পড়ার চাইতে সময় কাটানোর আর ভালো কি উপায় হতে পারে। ধন্যবাদ।

৬| ১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:২০

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছেন।
সহজ সুন্দর ভাষা। পোষ্ট পড়ে আরাম পাচ্ছি।
আমার ভাইও পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছে।

সাইন্স ফিকশন চলুক। সাথে আছি।

১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:২১

অন্তরা রহমান বলেছেন: বাহ, তাই নাকি। আমি আসলে এমনিই দিয়েছিলাম। ক্যাডেট কলেজ ব্লগের বাইরে ক্যাডেট নিয়ে তেমন কোনো জ্ঞান নেই। ভালো লাগছে জেনে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

৭| ১২ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:০৪

কবিতা ক্থ্য বলেছেন: Smooth Writing ..
Keep it up.

১২ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:০৮

অন্তরা রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ। চেষ্টা করছি।

৮| ১২ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:১৪

ঢুকিচেপা বলেছেন: গত পর্বের ধারাবাহিকতায় পড়ে ভাল লাগলো।

১৩ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:০৪

অন্তরা রহমান বলেছেন: যাক, জেনে ভালো লাগলো। এরকম মন্তব্যই অনুপ্রেরণা যোগায় লিখতে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.