![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনুপম দেবাশীষ রায়ের
প্রথম উপন্যাস
তৎসম
ব্লগ সংস্করণ
প্রকাশকালঃ২০১৩
উৎসর্গ
‘একেলা আকাশ থেকে ছিলো বেশি ভালো
প্রিয়মানুষেতে ভরা ঐ গুহা কালো’
চট্টগ্রামে ফেলে আসা বন্ধুদেরকে...
ভূমিকা
প্রথম উপন্যাস লেখা হলো।জিনিসটা উপন্যস হয়েছে নাকি বড় গল্প হয়েছে সেটা পাঠকের বিবেচনায় ছেড়ে দিলাম।
এটা যেহেতু ব্লগ প্রকাশ কাজেই ভূমিকা বেশি বড় করব না।কারণ তাহলে আমার অনেক মহান বন্ধু কেবল ভুমিকা পড়েই বাকিটা আর পড়বেনা।এই ক্ষেত্রে একটি আফসোসের কথা না লিখেই পারছি না।সেটি হলো,আজ প্রথমবারের মত মেয়ে হয়ে না জন্মাবার জন্য আফসোস হচ্ছে।কারণ মেয়ে হয়ে জন্মালে আজ নিশ্চিত এই ব্লগ রিলিজে যে পরিমাণ বাহবা পেতাম,তাতেই সারাজীবনের লেখালেখির জ্বালানী অর্জন হয়ে যেত।যাহোক,কয়েকটা কথা না বললেই নয়,তাই বলে রাখছি;নইলে গণপিটুনি খাবার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে আমি হুমায়ূন আহমেদ,তার লেখনী হিসেবে তার অনবদ্য দুই চরিত্র হিমু এবং মিসির আলী এবং পুরো উপন্যাসটির লেখক হিসেবে নিজেকে ব্যবহার করেছি।প্রথমত এই ধারণাটা গোলমেলে লাগলেও পরে আস্তে আস্তে পরিস্কার হবে বলে আশা করছি।
হুমায়ুন আহমেদের জীবনের শেষ দিনগুলি নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি এবং এ কাজে হুমায়ুন আহমেদের আত্মজৈবনিক ও তাকে নিয়ে অন্যান্য লেখকদের রচিত প্রায় পাঁচ ছয়টি বই ব্যবহার করেছি।বইগুলির লেখকদের প্রতি এবং অবশ্যই এক এবং অদ্বিতীয় হুমায়ুন আহমেদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।এছাড়াও গল্পের স্বার্থে কয়েকটি কাল্পনিক ঘটনা যোগ করেছি।এগুলোর কোনটি আপত্তিকর বা অগ্রহণযোগ্য হবেনা বলে আশা করছি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে উপন্যাসের চরিত্রের দ্বারা গল্পের খাতিরে যে যে মন্তব্য করানো হয়েছে তার সাথে আমার নিজস্ব মতামতের কোন যোগাযোগ নেই।হূমায়ুন আহমেদ আমার কথাসাহিত্যের গুরু।আমি লেখালেখি করার দুঃসাহস করার প্রথম কারণ তিনিই।কাজেই তিনি আমার নিকট অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
উপন্যাসে আমি হুমায়ুন আহমেদের রচনা হিসেবে হিমু এবং মিসির আলীর চরিত্র দুইটির অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছি।চেষ্টা করেছি হুমায়ুন আহমেদের মৌলিক সৃষ্টি হিমু ও মিসির আলীর চরিত্রকে অবিকৃত রাখার জন্য এবং ঘোষণা করছি যে এ উপন্যাস যদি কোনদিন প্রকাশিত হয়,তবে তার পূর্বে আমি অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই প্রকাশ করবো।আমি কোনভাবেই হিমু বা মিসির আলী রচনায় হুমায়ুন আহমেদের ধারেকাছেও যেতে পারবো না,তবুও এই স্পর্ধা করেছি হুমায়ুন আহমেদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে।এবং এও বলে রাখছি যে শুধুমাত্র হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুকালীন মানসিক অবস্থা বোঝাতেই এই দুইটি চরিত্রকে নিয়ে আস্ত আলাদা গল্প তৈরী করেছি কিন্তু ভবিষ্যতে আর কখনও হিমু বা মিসির আলীকে নিয়ে লেখার অপচেষ্টা করবোনা।
এছাড়াও আমি উপন্যাসে কয়েকজন বন্ধুর নাম ব্যবহার করেছি।উপন্যাসে এদের নামের চরিত্রের কর্মকান্ডের সাথে বাস্তব জীবনের কোন মিল নেই।
উপন্যাসটির আকার অনেক বড় হবার কারণে একবারে পোস্ট করছি না।পর্বে পর্বে পোস্ট করবো।আশা করি শুভান্যুধায়ীরা ধৈর্যসহকারে পড়বেন।
আশা করছি আমার লেখা প্রথম উপন্যাস সবার ভালো লাগবে।কোন পরামর্শ বা উপদেশ থাকলে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন।
ধন্যবাদ।
ও আরেকটি কথা,লেখক হিসেবে আমি খুবই নির্লজ্জ ধরণের।বয়সের দোষ হতে পারে।তাই না বলে পারছি না।তৎসম আমার জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটা।
১
হুমায়ুন আহমেদ সাহেব ভুরু কুঁচকে কালো রঙের একটা কাউচে বসে আছেন।
তার চোখেমুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট।কিন্তু তার নিজের ধারণা হচ্ছে বিরক্তিটা যথেষ্ট স্পষ্ট হচ্ছে না।কাজেই তিনি ভুরু আরো বেশি কুঁচকে বিরক্তভাব স্পষ্ট করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বিরক্তির কারণ বহুবিধ।প্রথম কারণ তার আসন।কালো কাউচটিতে তার শরীর দেবে যাচ্ছে।কাউচটা অতিরিক্তই নরম।শাওনের ভাষায় মেঘের মত নরম।মানুষ আমেরিকা থেকে চকলেট,বিস্কুট,ল্যাপটপ,ক্যামেরা আনে।শাওন সুদূর আমেরিকার থেকে স্বামী,সন্তান ও স্বামীর দীর্ঘ ক্লান্তিকর চিকিৎসার স্মৃতির সাথে সাথে এই মেঘতুল্য কাউচ আমদানী করে এনেছে।হুমায়ুন আহমেদ সাহেবের ধারণা স্বামীর প্রভাবে শাওন মানসিক ভারসাম্যহীনতার দিকে এগুচ্ছে।
শাওনের এই মানসিক ভারসাম্যহীনতার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই কালো মেঘতুল্য কাউচে হুমায়ুন আহমেদ সাহেব নিজের শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছেন না।একবার এইদিকে বেশি দেবে যাচ্ছেন,আরেকবার ঐদিকে দেবে যাচ্ছেন।তিনি মোটামোটি নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে বসার জন্য মেঘ কোনরকম উপযুক্ত স্থান না।
বিরক্তির দ্বিতীয় ও প্রধান কারণ তার সামনে বসে থাকা মানুষটি।তার চোখে ভারী গোল ফ্রেমের চশমা।মাথাভরা চকচকে টাক।টাকের ওপর টিউবলাইটের তীব্র আলো প্রতিফলিত হয়ে হুমায়ূন সাহেবের চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে।
সাধারণত টেকোরা মাথার একদিকে একগোছা চুল অত্যন্ত যত্নসহকারে রেখে দেয় এবং সবসময় সেই একগুচ্ছ চুল দিয়ে নিয়ে বিশাল টাক ঢেকে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।এই ব্যক্তি সে চেষ্টা করেন নাই।চকচকে টাক রেখেছেন।কোথাও একগোছা চুলও নেই।ভোরবেলা যে সময়টাতে সাধারণ মানুষ দাঁড়ি কামান,তিনি সম্ভবত সেই সমটাতে টাকে একপোচ দিয়ে নেন।নাহলে এতো চমৎকার টাক বজায় থাকার কথা নয়।
যেহেতু তিনি দাঁড়ি কামানোর সময়টা তিনি মাথা কামানোর পিছনে ব্যয় করেন,কাজেই তার গালে সম্ভবত কোনদিন ব্লেডের ছোঁয়া লাগেনাই।তাই তার গালে গড়ে উঠেছে কাঁচাপাকা দাড়ির এক সুবৃহৎ জঙ্গল!তাকে দেখতে লাগছে ঠিক টেকো রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের মত,যদিও রবীন্দ্রণাথ ঠাকুর আরো অন্তত একহাত লম্বা।
‘নিশ্চয়ই চেনেননি! হেঁ হেঁ!আপনার মত জনপ্রিয় লেখকদের কি আর আমাদের মত চুনোপুঁটি সাহিত্যপূজকদের এতো খোঁজখবর রাখলে চলে।’স্পষ্ট নদীয়ার টানে কথাটা বলে সুড়ড়ড়ুৎ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন সাহিত্যপূজক টেকো রবীন্দ্রণাথ।
‘প্রভাকর চৌধুরী।যাজ্ঞবল্ক্য নামের একটা সাহিত্যপত্র চালাই।লিটলম্যাগ।সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে!মাসে শ পাচেক কপি বিক্রি হয়।হেঁ হেঁ!’
যাজ্ঞবল্ক্য পত্রিকাটি চেনা গেছে।শাকুর মজিদ কয়েকদিন আগে এটির একটি কপি নিয়ে এসেছিলেন।ঐ সংখ্যাটিতে তার কয়েকটি উপন্যাসের সমালোচনা ছাপা হয়েছিলো।বাংলা সাহিত্যের সিরিয়াল কিলার,বাঙ্গালীর সাহিত্যবিমুখতার কারণ,চটিবইয়ের সমতুল্য উপন্যাস লেখক ইত্যাদি নানা উপাধি পেয়েছিলেন সেখানে।হুমায়ুন আহমেদ সাহেব আমোদিত হলেন।ভরদুপুরে পুত্র নিষাদের ঘোড়া হওয়া বন্ধ করে উঠে আসাটাকে প্রথমবারের মত অর্থপূর্ণ বলে মনে হয়।
প্রভাকর চৌধুরী বলতে থাকেন, ‘এবারের ঈদসংখ্যার কিছু ভালো সাহিত্যিক আর কয়েকজন জনপ্রিয় লেখকের লেখা একসাথে ছাপিয়ে একটা পাঁচমিশালি প্রকাশ করতে চাচ্ছি।তাই একটা লেখার আশায় আসা।’
প্রভাকর চৌধুরীর ঠোঁটে আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে।বাজারীটাকে ভালোমত বাঁশ দেয়া গেছে।এই হাবড়ার লেখা কয়েকলাইন ছাপালেই বিক্রি তিনগুণ হয়ে যায়।বাড়তি টাকাগুলো দিয়ে পাওনাদারদের মিটাতে হবে,পত্রিকাটা বাঁচাতে হবে।নইলে এই বুড়ার কাছে কে আসে!
‘আমার হাতে তো এই মুহুর্তে কোন অপ্রকাশিত লেখা নেই।যদি মাথায় কিছু চলেও আসে,সেগুলোর জন্যেও লোকে অলরেডি বলে রেখেছে।তাছাড়া আমি একটু বাজারে লেখক কিনা,তাই হাতে ভালো সাহিত্য আসতে চায়না।এইসব ছাইপাশ দিয়ে কেনো পত্রিকা ভরাবেন।বরং কোন বসনিয়ান বা রোমানিয়ান কবিতার অনুবাদ ছেপে দিন,ম্যাগাজিনের শোভা বাড়বে।’
প্রভাকর চৌধুরীর জিহ্বাটা চায়ে পুড়ে গেলো।বেশি গরম চা তিনি খেতে পারেন না।তাই চা ঠান্ডা করে খান,অথবা পিরিচে ঢেলে।কিন্তু চামচিকেটার কথা শুনে রাগের মাথায় গরম চা মুখে দিয়ে ফেলেছেন।হাবড়াটা পাল্টাবিদ্রুপ করার চেষ্টা করছে।চটজলদি এই ব্যাটার মুখে ঝামা ঘষে দেয়া দরকার।প্রভাকর চৌধুরী ঝড়ের গতিতে চিন্তা করতে থাকেন।
‘তাই কি যে বলেন!আপনাদের কি আর সাহিত্য রচনা করতে হয় নাকি!ও তো আমাদের মাথাব্যাথা!ধরুন আপনি প্যাডের কাগজে আপনার বাজারের লিস্টি ধরিয়ে দিলেন,আমি সেটা ছেপে দিলাম।তাই লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে কিনবে।আপনার বাজারের লিস্টির কাছে তুর্গেনিভ ফেল।’
চামচিকের মুখ ভোঁতা হয়ে গেছে।তীর লেগেছে মোক্ষম জায়গায়;দু পায়ের ফাঁকে।হেহে!প্রভাকর চৌধুরীর সাথে লাগতে আসা!আরে আরে!ব্যাটা দেখি উঠে চলে যাচ্ছে!লেখাটা কি তাহলে পাওয়া যাবেনা?তাহলে কিভাবে হবে!পাওনাদারদের কি জবাব দেবেন প্রভাকর চৌধুরী!দু পায়ের ফাঁকে তীর লেগেছে,এরকম মুখ করে প্রভাকরে চৌধুরী বসে পাওনাদার এড়ানোর বুদ্ধি আঁটতে থাকেন।
শাওন রুমে ঢুকে দেখলেন হুমায়ুন আহমেদ লেখার টেবিলে বসে আছেন।তার চোখেমুখে দুস্টুমিভরা হাসি।
‘কুসুম,বাজার সদাইয়ের জন্য কি কি লাগবে জেনে এসো তো,একটা লিস্ট বানাবো।’
শাওন বিস্মিত হলো না,তার স্বামী মাঝেমাঝেই এইধরণের পাগলামী করেন।সে এগুলোর সাথে অভ্যস্ত।
শাওন বের হয়ে যাচ্ছিলো,এমন সময় হুমায়ূন ডাকলেন,‘কুসুম’
‘হুঁ’
‘যৌবনে অর্থাভাবে যেরকম সোফাসেট আমি কিনতে পারিনি সেটা তোমাকে দোকানে দেখিয়ে দেবার মানে এই না যে সেটাকে তোমার দেশে বয়ে আনতে হবে।তখন সাধ ছিল,সাধ্য ছিলো না।এখন সাধ্য আছে,সাধ আর নেই।’
শাওন ম্লান হেসে ঘর থেকে বের হয়,রান্নাঘরে গিয়ে খোজ নেয় কি কি লাগবে।তারপর এসে মনোযোগ সহকারে হুমায়ূন আহমেদকে একের পর এক জিনিসের নাম বলে।মানুষটা একমনে ঘাড় গুঁজে লিখেই যায়,একটাবার মুখও তোলে না।এবারে শাওন ইচ্ছে করে বলা বন্ধ করে দেয়।মানুষটা ঘাড়া ঘুরিয়ে বাচ্চাদের মত কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকায়।শাওনের বুকটা ধক করে ওঠে।
প্রভাকর চৌধুরী বিমূঢ় দৃষ্টিতে হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছেন।তার চোয়াল ঝুলে গেছে। গালের ঘাটা টনটন করছে,তবু তিনি মুখবন্ধ করতে পারছেন না।চোয়ালটা যেন আটকে গেছে।তার হাতের কাগজটিতে লেখাঃ
টমেটো(পাকা,টসটসে লাল) ১ কেজি
সয়াবিন তেল ২ লিটার
গুড়া সাবান(হুইল) ২৫০গ্রাম
ইঁদুর মারা বিষ
ডানো গুড়াদুধ
পাবদা মাছ ও বোয়াল মাছ
শিমের বিচি
২
আমি খুব দ্রুত মারা যাবো।
শীতের সকাল,চারদিকে ঘন কুয়াশা।দুইহাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছেনা।সামান্যতম জিনিসকে খুব রহস্যময় লাগে।এইযে রাস্তার উল্টোদিকের সিদ্দিকীয়া হোটেল।প্রতিদিন দেখি।আজকে অন্যরকম লাগছে।কুয়াশার জন্য সিদ্দিকিয়া হোটেলের সাইনবোর্ড এবং তার আশেপাশের মাছ মুরগি গরু ছাগলের ছবি দেখা যাচ্ছে না।আবছা আবছা ভাবে হলদেটে বিল্ডিঙ্গের কয়েকটা জানালা দেখা যাচ্ছে।মনে হচ্ছে জানালা খুলে এখনই কোন শ্বেতপরী মুখ বের করবে।
আমি কবি হলে কুয়াশার নাম দিতাম হীমচাদর।
কিন্তু আমি কবি না।আমি হিমু।হিমুরা কোন কিছুর নাম দেয় না,সবকিছুর নাম দেয়।কোন কিছু দেখে অভিভূত হয় না, সবকিছু দেখে অভিভূত হয়।
কাজেই আমি আমার মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে অভিভূত নই।বরং আমি আনন্দিত!জন্ম এবং মৃত্যু মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি ঘটনা।এই দুটি নিয়েই আড়ম্বর-আয়োজনের সীমা নেই।আত্মীয় স্বজন,চেনা অচেনা সবাইকে জানানোর প্রয়োজন পড়ে এমন ঘটনা।অথচ যার জীবনে এই ঘটনা ঘটে,সে কিছুই জানতে পারেনা।এটাই সম্ভবত জন্ম ও মৃত্যুর সৌন্দর্য।
অতএব আমি মানুষ হিসেবে সৌভাগ্যবান।আমি আমার মৃত্যুর ব্যাপারটা জানতে পেরেছি।কাজেই মৃত্যুর প্রস্তুতি নেবার সুযোগ ও আমি পাবো।অবশ্য,মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা নিজেদের মৃত্যুর প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পান।মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা দন্ডের আগের সময়টায় যে মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যান,সেটাই সম্ভবত সবচেয়ে জটিল আর আকর্ষণীয় মানসিক অবস্থা।খুনখারাবি না করেই মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যাবার সুযোগ পাবো।খারাপ কি!
হেমু ভাই,চা।
সিদ্দিকিয়া হোটেলের সাদেক চায়ের বোতল নিয়ে ঘরে ঢুকেছে।
ভোরবেলা চা দিতে এলে সে সবসময় এই কাজটা করে।অথচ রাতের খাবার নিয়ে এলে এই কাজটা করে না।এটাও একটা রহস্যময় ব্যাপার।হীমচাদর বোধহয় সবসময়ই জাপটে রাখে সবাইকে।কখনও আমরা দেখি,কখনও দেখিনা।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকালাম।কুয়াশা কাটছে।স্পষ্ট হয়ে উঠছে চারিধার।চতুর্দিক থেকে হিমচাদর সরে যাচ্ছে।রহস্যময় মনুষ্যকূল জেগে উঠছে।প্রাকৃতিক কুহেলিকা মানুষের ভেতর প্রবেশ করছে।প্রাকৃতিক কুয়াশা পরিণত হচ্ছে মানবিক কুয়াশায়।হলুদ পাঞ্জাবী পরে আমি বের হলাম রাজপথে,মানবিক কুয়াশায় আবছায়া করে রাখা পথ হাঁটবো বলে।
রাস্তায় নেমেই আমি লিস্ট করা শুরু করলাম।মৃত্যুর আগে কি কি করা যায় সেটার লিস্ট।টেন থিংস টু ডু বিফোর আই ডাই।
প্রথমত,বিদায়পর্ব।
বিদায়পর্বের অংশ হিসেবে আমি মেজোফুপুর বাড়িতে উপস্থিত হলাম।মেজোফুপু আমাকে দেখে এমন চেহারা করলেন যে আমি ধন্দে পড়ে গেলাম,তিনি আনন্দিত হয়েছেন,নাকি রাগান্বিত হয়েছেন,নাকি বিস্মিত হয়েছেন।
আমি মধুর হাসি দিয়ে বললাম,কেমন আছো ফুপু।
খুব ভালো আছি।
খুব যে ভালো আছো সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে।যে সাজগোজ করেছো!পার্লারে গিয়েছিলে নাকি?
আরে ধুর!কি যে বলিস।এই বয়সে আর ওসব মানায় নাকি?আমার চেহারাটা এমনিতেই এরকম।দেখলেই মনে হয় সদ্য পার্লার থেকে এসেছি।
তুমি বলছো,নাকি অন্য কেউ বলেছে?কি সর্বনাশ!ফুপা বলেছে নাকি?
আরে ধুর!ওনার আবার এইসবের জন্য সময় আছে নাকি?পাশের বাসার মেয়েটা বলেছে।মস্ত বিউটিশিয়ান!ওই তো সাজিয়ে দিলো!
সত্যিই খালা,তোমার সৌন্দর্য সম্পূর্ণ ন্যাচারাল!
থ্যাঙ্ক ইউ
এমনভাবে বললে যেন আমি তোমাকে ডাইনী বলেছি।
আরে না না! তুই কখোনো এরকম বলিস না তো!তাই একটু ইয়ে লাগছিলো আরকি!
গন্ধ আসছে কিসের?স্পেশাল কিছু রেঁধেছ?
হুম।বিউটিশিয়ান মেয়েটা আবার নানা দেশের রান্নাও জানে।ও একটা মেক্সিকান রান্না শিখিয়েছে।সেটাই রেধেছি।একটু খেয়ে দেখবি নাকি?
অবশ্যি খাবো।তোমার বাসায় আসবো আর মেক্সিকান খাবার খাবো না,তা কি হয়?জলদি করে প্লেটে করে নিয়ে এসো।কাচামরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে খাই।
আরে বোকা!মেক্সিকান খাবার কি আর কাঁচামরিচ মেখে খেতে হয় নাকি?খেতে হয় বোলে করে।তুই তোর খালুর কাছএ গিয়ে বোস,আমি আনছি।
ফুপাসাহেব কফিটেবিলে দুই পা তুলে দিয়ে টিভি দেখছিলেন।আমি দরজায় টোকা দিলাম।ফুপা সাহেব পা নামালেন,টিভি বন্ধ করলেন,হাতে ন্যশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিন নিলেন,তারপর বললেন,কাম ইন।
আমাকে ঢুকতে দেখে ফুপাসাহেব রীতিমত ভড়কালেন।ভদ্রলোকসুলভ টোকার পর তিনি অতিওভদ্র আমাকে আশা করেননি।তিনি গলা খাকারী দিয়ে কিছুই ভাব হয়নি এমন করে পত্রিকার পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগলেন।আমি ফুপাসাহেবের পাশের সোফায় বসলাম।কফি টেবিলের উপর কফি মগ ছিলো।খালুসাহেবের পায়ের কারণে লক্ষ্য করিনি।কফিমগ ভর্তি কফি।উপরে পুরু ফেনা।ফেনার উপর হৃদয় আকৃতি আঁকা।ফুপা মগ নিলেন কিছুক্ষণ কফির গন্ধ নিলেন,চুমুক দিলেন না।আবার নামিয়ে রাখলেন।সম্ভবত সূক্ষ্ম হৃদয়ঘটিত কারণে তিনি হৃদয়াকৃতি নষ্ট করতে চাচ্ছেন না।
ফুপাসাহেব,কি করছেন? তোমার বাড়িতে সাতসকালে একজন ভ্যাগাবন্ড উপস্থিত হলে তুমি কি করতে?
তার কাছে জেমস বন্ডের ফোন নাবার আছে কিনা জিজ্ঞেস করতাম।
শাট আপ।
ওকে।শাটেড আপ।
ফুপা সাহেব বিস্মিত ও বিভ্রান্ত হলেন।তিনি আশা করেন নি আমি এতো সহজে ঠান্ডা হয়ে যাবো।তিনি পত্রিকা ভাজ করলেন,কফি কাপ হাতে নিলেন,এবং পুনরায় কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে নামিয়ে রাখলেন।
হ্যাপি অ্যানিভার্সারী ফুপা।
ফুপাসাহেব প্রথমবারের মত আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলেন।কি আশ্চর্য ব্যপার!কিছুদিন আগে এরা দুইজন একে অপরকে সহ্যই করতে পারতো না,সারাদিন ঝগড়া!আর এখন,প্রেম উগলে উগলে পড়ছে!
কৈশোরের প্রেম পাগলামীর,তারুণ্যের প্রেম ন্যাকামির,মধ্যবয়সের প্রেম ঝগড়াঝাঁটির আর বার্ধ্যকের প্রেম,আবার পাগলামীর।যার মধ্যবয়স যত দীর্ঘ,তার মধ্যবয়সী প্রেম ধীরে ধীরে তত অসহ্য হয়ে ওঠে।পরম করুণাময় এই দম্পতির উপর শুভদৃষ্টিপাত করেছেন।এরা মধ্যবয়স পার করে বার্ধক্যে পৌঁছে কিশোর কিশোরী হয়ে গেছে।
বাদল দরজার দিকে উল্টো ঘুরে কিছু একটা পড়ছিলো।আমি নিঃশব্দে ঢুকে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম।আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।অথচ মজার বিষয় হলো,সকাল থেকে আমার মৃত্যুচিন্তা ছাড়া কিছুই করা হয়নি,ক্লান্তিও নেই।তাহলে ঘুম কেন পাচ্ছে?
হয়তো,সর্বকর্মসাঙ্গ হবার ভয়াবহ ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার মত ক্লান্তিকর ব্যাপার বুঝি আর কিছু নেই!
৩
লেখকের একান্ত ডায়েরীঃ
উপন্যাসের এতোখানি লেখার পর আমার উপন্যাসটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।আমি হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসেছি।মাঝখানব থেকে বিনা নোটিশে জনৈক হিমুসাহেব এসে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।কালকে সারারাত হিমু পড়ার কুফল।লেখকের লেখায় প্রিয় লেখকের প্রভাব আসতে পারে।প্রিয় লেখকের চরিত্র তো ঢুকে পড়তে পারেনা!
ছিঁড়ে ফেলা যেতে পারে হিমুর চ্যাপ্টারটা।কিন্তু খালুর জন্য মায়া হচ্ছে।আহারে বেচারী কত সাধ করে মেক্সিকান খাবার রান্না করেছে হিমুকে খাওয়াবে বলে!থাক না,থাকুক।
অবশ্য এইটারও একটা ব্যখ্যা দেওয়া যেতে পারে।হুমায়ুন আহমেদ সাহেব সাধারণ জীবনের ভেতরেই প্রতিনিয়ত নিজের মনে হিমু লিখে চলেছেন।এরকমই তো হয়।আমি যখন সাইকেলে করে একা একা ঘুরে বেড়াই তখনও তো নিজের মনে রাস্তার লোকদের নিয়ে গল্প লিখতে থাকি।আমার মনে হয় প্রত্যেক লেখকই এইটা করেন।লেখকেরা কখনোই তাএর চরিত্রের জগৎ থেকে পুরোপুরি আলাদা হতে পারেন না।তারা একই সাথে দুই জগতের বাসিন্দা।
ক্যাচ্চর খ্যাচন ক্যাঁক
এই আওয়াজটা আমার এবং আমাদের বহু পরিচিত।বাপি মার রুমের দরজা খোলার আওয়াজ।আমি আমার হস্তিসম দেহ নিয়ে আধ মিনিটের মাঝে তিন লাফে খাতা বন্ধ করে লাইট অফ করে দিদির পাশে এসে শুয়ে পড়লাম।
বাপি ঘরে ঢুকলো।আমি মরার মত পড়ে আছি।অভিনয় যখন করতাম তখন বিচারকেরা বলতো,আমার অভিনয় খুব বাস্তব মনে হয়।আরে বাবা,বাস্তব জীবনেই যে পরিমান অভিনয় করতে হয়,ততটুকুর শতভাগের একভাগ মঞ্চে তুলে আনতে পারলে এল প্যাচিনো ফেল মেরে যাবে।পৃথিবী একটি রঙ্গমঞ্চ,আমরা সবাই অভিনেতা।
আমার সবচেয়ে অপ্রিয় জায়গা হলো আমার বাসা।আমার বাসায় আমার সবচেয়ে অপ্রিয় সময় হলো সন্ধ্যবেলা।কারণ সন্ধ্যেবেলা বাপি ঘরে থাকে।প্রতিটি পদক্ষেপে একটা করে অভিযোগ এবং তৎসংশ্লিষ্ট গজগজানি।এবং তার আধা সেকেন্ডের মাথায় মার ভ্যালু এডেড গজগজানি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার আধ সেকেন্ডের মাথায় বাপির মাকে মারা ঝামটা।এমনকি মাঝেসাঝে ঝামটার প্রেক্ষিতে বাপির অনুপস্থিতিতে মার ক্রন্দন।যেমনঃ
অভিযোগঃ পায়ে স্যান্ডেল নাই কেন?
গজগজানিঃ ছেলেটারে দেখি কিছুই শিখানো যায় না।
ভ্যালু এডেড গজগজানিঃ কতবার বলিসি পায়ে স্যান্ডেল রাখতি?সারাদিনে এতোবার বলি,একটাবার মাথায় ঢোকে না।আমাকে তো মানুষ বলেই গণ্য করিস না।
ঝামটাঃ ছেলেটারে ক্যাডেটে দিলিই আর এরকম হোতো না।তখন তো আমার ছল আমার ছল করে যাতিই দিলে না।এখন বোঝো।
ঝামটার প্রেক্ষিতে ক্রন্দনঃ বাবা,এতোবার করে বলি,তাও শুনিস নে।আর সেইটা নিয়ে তোর বাপি আমারে কথা শুনোয়।সবকিছু আমার দোষ,আমার দোষ।আমিতো এট্টা মানুষ।আমি আর পারতিসি নে!আমারে এট্টু মুক্তি দে বাবা! এট্টু মুক্তি দে।হয় তুই ঠিক হবি,নালি আমি গলায় দড়ি দেবো।এছাড়া আমার আর কোন পথ খোলা রাখিসনি।
যে জায়গায় প্রতি সন্ধ্যায় দুই বা ততোধিক বার এই রকম মেলোড্রামার ভেতর দিয়ে যেতে হয়,সেই জায়গা ভালো লাগার কোন কারণ নেই।সেটা বাসা হোক,আর যাই হোক।
তবে এতোকিছুর মাঝে আমার সবচেয়ে বড় অবলম্বন আমার দিদি।দিদি সবসময় আমাকে সবকিছুর থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে যতটা সম্ভব।সব কষ্ট থেকে,সব দুঃখ থেকে আমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা জমিয়ে আমার সব শখ আহ্লাদও পূরণের ব্যবস্থা করে।আমি এক লাইন কবিতা লিখলেও সেটা পড়ে বলে,হে ঠাকুর!আমি তো জন্মেও এতো সুন্দর কবিতা পড়িনি।একটু কোথাও পড়ে গিয়ে ছিলে গেলে দৌড় দিয়ে এসে কান্না কান্না চেহারা করে বলে,আহারে ভাইডু,কি হইসে।ইসশশিরে!ব্যথা করতিসে?ফু দিয়ে দিই?ফুঁ ফুঁ ফুঁ।
আসলে দিদি আছে বলেই আমি আছি।নাহলে কবেই...
দিদিই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে,এরকম ভয়াবহ যন্ত্রণাকর মেলোড্রামার থেকে বেঁচে থাকার মন্ত্র।দূরে গিয়া মর!যতক্ষণ ড্রামা চলবে,ততক্ষণ মনে মনে বারবার করে বলতে হবে,দূরে গিয়া মর,দূরে গিয়া মর,দূরে গিয়া মর...শুনে হয়তো খুব খারাপ লাগতে পারে।ছি!নিজের ভাইকে বাবা মাকে অশ্রদ্ধা করতে শিখাচ্ছে।ওহে নীতিবাদির দল!একবার এসে আমার জীবনটা বেঁচে গিয়ে এরপর এই নীতির কথা বোলো।
উপল...ও উপল...উপলরে...উপল...ওঠ ওঠ ওঠ...শিগগইর ওঠ...সকাল হয়ে গেসে তো...এই ছেলে...আরে!এতো ভারি যন্ত্রণা...এবার কিন্তু মার দেলাম!
আমি স্প্রিংয়ের মত লাফ দিয়ে উঠলাম।তারপর বাপি ঘুরে চলে যেতে লাগলেই ঢুলতে ঢুলতে জম্বির মত বাথরুমের দিকে এগিয়ে যাই।যেতে যেতে আধেক ঘুমে বাপির গলা শুনি।
এই সীমা...ওঠো তো...সারারাত জেগে জেগে খুটুর খাটুর করবা,আর ভোর হলি সব মড়ার মত ঘুমোয় পড়ে থাকবে।তোমার যন্ত্রণায়ই তো ছেলেমেয়েগুলো সব এরকম হচ্ছে।আরে বাবা...ওঠো না।
বাথরুমের দরজা খুলে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো একদম।এই বাথরুমে হাইকমোড নাই।আগের বাসায় দুইটা বাথরুমেই হাইকমোড ছিলো।বাসা চেঞ্জ করায় দ্বীকমোডীয় নিদ্রাসুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।কি যন্ত্রনা! কমোডলা বাথরুমে নিশ্চয়ই দোলাদিদি ঢুকে বসে আছে! ধুত্তুরি।কি আর করা?বারান্দা থেকে গামছা নিয়ে আসলাম।বাথরুমের ফ্লোরে গামছা পাতলাম।এহহেরে!ফ্লোরটা একদম ভিজা!ঘুম ঘুম চোখে খেয়ালই করিনি!আরেকটা গামছা কে আনতে যাবে?অগত্যা ভেজা গামছার উপরই শুয়ে পড়লাম।ঘুমের রাজ্যে একবার ঢুকে যেতে পারলে আর চিন্তা কি।ঘুমের রাজ্য কল্পনার রাজ্য।সত্যিকার পৃথিবী যেমনই হোক,আমার কল্পনার পৃথিবী সবসময়ই রঙ্গীন,আনন্দময়।আমার কল্পনার পৃথিবী শুধুই আমার একার।সেটা কেউ আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা কখনও।
বাথরুমের স্যাঁতসেঁতে ফ্লোরে শুয়ে আমি আমার নিজের জগত থেকে আস্তে আস্তে একান্ত নিজের কল্পনার জগতে প্রবেশ করতে থাকি।
৪
আমার সামনে আমার বাবা বসে আছেন। তার গালভর্তি ধবধবে সাদা দাড়ি এবং হাতে এক কাপ কফি। কফির উপর পুরু ফেনা এবং ফেনার ওপর হৃদয়াকৃতি আঁকা হয়েছে।
'কেমন আছিস'
'ভালো নেই খুচরো ঘুমের মাঝে তুমি এসে উপস্থিত হয়েছো। এটা কোন সুখের কথা নয়।'
'আমি আহত হলাম। আমি তোর একমাত্র কাছের মানুষ। আর আমি আসাতে তুই বিরক্ত হচ্ছিস।'
'তুমি তো আমার কাছে আসো নাই। আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে কবিসাহেব আর ফুপাসাহেবের সংকর করা।'
'এই কবিসাহেবটা আবার কে?'
'এই কবিসাহেবটা হলো সেই ঘরে দাড়ি তুমি নিজের গালে লাগিয়ে বসে আহ।'
'এটা কেমন কথা? আরেক জনের দাড়ি আমি গালে লাগিয়ে বসে থাকব কেন? আমি কি অজাতশ্মশ্রু নাকি? নিজের দাড়ি নিজের গজাবো,যখন খুশি তখন গজাবো। আরেক জনের দাড়ি চুরি করব না।'
'বাবা, তুমি দয়া করে বিদেয় হও।'
'আরে ব্যাটা দাঁড়ানা।তাড়ানোর জন্যে এতো ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?তোর সাথে একটু গল্প করি। তোকে একটু সঙ্গ দেই। তুই মৃত্যু নামক ভয়াবহ ঘটনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিস।তোর এখন সঙ্গীর প্রয়োজন আছে। আফটার অল,আমার মৃত্যুর অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমি তোকে ভালো সঙ্গ দিতে পারব।
'বাবা,তোমাকে সোজাসাপটা বলি কেন আমার কাছে তোমার উপস্থিতি অসহ্য মনে হচ্ছে?কারণ তুমি মোটেও স্বেচ্ছায় আসনি, সাধারন মানবিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী আমার নিরেই মৃত্যুকে ভয় লগেছে।একারণেই আমার অবচেতন মন তোমার অবয়ব সৃষ্টি করে আমাকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু আমার সচেতন মন বুঝতে পারছে যে তোমার উপস্থিতি আমার মৃত্যুভীতির সরাসরি দৃষ্টান্ত।কাজেই আমার মাঝে সচেতন অবচেতন সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।এই কারণের তুমি আবির্ভূত হয়েছ ঠিকই,কিন্তু কবিসাহেবের দাড়ি গালে, ফুপাসাহেবের কফিকাপ হাতে আর ফুপুর অনর্গল কথা বলার বিরক্তিকর অভ্যাস সাথে নিয়ে আবির্ভূত হয়েছ’
'তাও খারাপ কি?নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। মরা বাবার চেয়ে স্বপ্নবাবা ভালো।আর তুই মিসির আলীর মত গজগজানি মার্কা যুক্তি কপচে যাচ্ছিস কেন?তুই হলি হিমু,তুই মিসির আলী না।তুই চলবি এন্টি লজিকে।তুই কমপ্লিট ননসেন্সের মাঝে জীবনকে খুজে পাবি।কারণ জীবনটাই কমপ্লিট ননসেন্স!লজিক কপচানো তোর কাজ না।
লজিক তো কপচাচ্ছি না।লজিক ভাবছি।তুমি আমার চিন্তারই একটা অংশ।কাজেই তোমার সাথে লজিক কপচালে সেটা লজিক ভাবা হয়।আমি এন্টিলজিকের মানুষ।কিন্তু আমার ভেতরে একটা ঘোর লজিকাল অংশ আছে।
লজিক না ছাই।যুক্তিবিদ্যা বড়ই বদখত জিনিস!ইন্টারমিডিয়েটে আমাদের সাবজেক্ট ছিলো।টেবিলের উপর বইটা আছে,কিন্তু টেবিল মাটির উপর আছে,কাজেই বইটা টেবিলের উপর আছে।এটা কোন কথা হলো।তাহলে তো আমি বলবো,আমি একটা পাদ মারলাম,আমি একটা মানুষ,তুইও একটা মানুষ,কাজেই তুইও পাদ মারলি।এটা একটা কথা হলো?
বাবা অনর্গল কথা বলতে থাকলো। আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। হঠাৎ করে মনে হলো বাবার গলার স্বর বদলে যাচ্ছে। তার গলার সুর হয়ে যাচ্ছে ফুপুর মতো। তিনি আমাকে কোন একটি মেক্সিকান প্রপারেশন খাবার জন্য ডাকছেন।
আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে বার্ধক্য না এলেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো একজন মানুষের সক্ষমতা কমতে থাকে। একারনেই আমি ঠিকমতো স্বপ্নে বাবর অবয়বও তৈরী তৈরি করতে পারছি না। গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার বাবা কখনও এতো বেশি কথা বলতেন না। বাবা মৃত্যুকে ভয়াবহ কোন ব্যাপারে বলেও বিবেচনা করতে চাননি। তার বিখ্যাত ব্রাউন প্যাকেটে তিনি মৃত্যু সম্বন্ধে উপদেবশবানী লিখে গেছেন।
মৃত্যুভীতি
বাবা হিমালয়,মৃত্যু নইয়া কখনও অধিক চিন্তা করিবে না।
মানব জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ কিছু ঘটনার মাঝে মৃত্যু একটি বলিয়া পরিগনিত হয়। কেননা মৃত্যুর পরে কি হইবে তাহা লইয়া মানুষ অনিশ্চিত।ভীতি মানুষের আদিমতম আবেগ।মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যাহা জানে না তাহাকে ভয় পায়।
আমি সারাজীবনের সাধনার মাধ্যমে তোমাকে মহাপুরুষ রূপে নির্মাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি।একজন মহাপুরুষকে হইতে হইবে ভীতিহীন।কাজেই তোমাকে ভীতিহীন হইতে হইবে।তোমাকে মৃত্যুকে জানিতে হইবে।জীবনের কিছুটা সময় আলাদা করিয়া রাখিবে মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ করিবার জন্য।তাহাদের শেষ মুহুর্তগুলি লক্ষ্য করিবে।দেখিবে শেষ মুহুর্তে তাদের মাঝে আতঙ্ক নয়,প্রচন্ড প্রশান্তি নামিয়া আসে।এই দৃশ্য অবলোকন করিবে।
মৃত্যুর কাছাকাছি যাইতে চেষ্টা ক্রিবে।নির্ভয়চিত্তে নিশ্চিতমৃত্যুর মুখোমুখি হইবে।নির্বিকারে চলন্ত ট্রাকের সামনে দাঁড়াইয়া পড়িবে,প্রকৃতি তোমাকে বাঁচাইয়া রাখিতে চাইলে তুমি ঠিকই বাচিয়া থাকিবে।কিন্তু ভীতিপূর্বক মৃত্যুর মুখোমুখি হইতে তুমি পিছু হটিবে না।
মৃত্যুকে নিজের নিকটত্মীয় বানাইয়া লইবে, তবেই মৃত্যুকে আর ভীতিপ্রদ বলিয়া মনে হইবে না। মৃত্যুরূপ শূন্যতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করিবে। মানজীবনের অন্যান্য সকল ঘটনাবলির ন্যায় ইহাও অত্যন্ত স্বাভাবিক ও তুচ্ছ।মৃত্যুর মাঝে অসাধারণ কিছু নাই।সকলেই মরে।সে যতই মহান,রুচিশীল আর পরোপোকারী হউক আর যতই ইতর,নীচ,ছোটলোক হউক না কেন।কাজেই ইহাকে পৃথকভাবে মর্যাদা দিবে পাইবে না। মৃত্যুরূপ অতিসাধারণ ঘটনাকে অসাধারণ হিমালয়েরা গুরুত্ব দেয়না।"
আমার বাবা তার নিজের উপদেশ নিজে মানতে পারেনি। তার মৃত্যু হয়েছে অবর্তনীয় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে।মহাপুরুষ গড়ে তোলার কারখানার কঠোর এবং স্পেশাল কারিকুলামের ভেতর দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়ার পথে যাতে কোন বাধা সৃষ্টি না হয়,সেইজন্য তিনি ঠান্ডা মাথায় আমার মাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।কিন্তু নিজের মৃত্যুর সময় তিনি আমার মায়ের নাম ধরে বেশ কয়েকবার চিৎকার করেছিলেন।ভীতি সম্ভবত সত্যিসত্যিই মানুষের আদিমতম আবেগ।ভালোবাসাও।কাজেই ভীতির সময় মানুষের সবার আগে ভালোবাসার মানুষটি কথাই মনে পড়ে।
আমি ঘুম থেকে উঠলাম বাদলের হাসিভরা মুখ দেখে। যে মানুষ প্রতিবার ঘুম ভেঙ্গে উঠে কারো হাসিমুখ দেখতে পায়,সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যপার হলো এই যে বৈচিত্র্যের নামে প্রকৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের এই সুখ থেকে বঞ্চিত করে।
'হিমুদা, আম্মু তোমার জন্য রেখে গেছে।
বাদলের টেবিলে ওপর একটা চিকটদর্শন বাটিতে বিকটতর কিছু সবুজ রঙের অর্ধতরল বস্তু দেখা গেলো।আমি বললাম,এটা কি জিনিস?
মেক্সিকান খাবার গুয়াখামোলে।খাবে?
তোর কি মনে হয়,যে খাবারের নামের মাঝে একই সাথে গু এবং খা আছে সেই খাবার আমি খাবো?
বাদল আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।ছেলেটা দিনদিন এতো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে কেন কে জানে!
তবু খেয়ে দেখো,একটা এক্সপিরিয়েন্স হয়ে থাক।
আমি চা চামচের মাথায় লাগিয়ে মুখে দিলাম।সক্রেটিস হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।আমি আজ সক্রেটিস সাহেবের মৃত্যুযন্ত্রনায় আভাস কিছুটা হলেও পেলাম।আমার চেহারা নিশ্চয়ই ব্যাপক বিকটদর্শন হয়েছিল।আর তাই দেখে বাদল আরেকবার ক্লোজআপ মার্কা হাসি দিলো।এই ছেলে সম্ভবত জানে তার হাসি মারাত্মক সুন্দর।কাজেই সে ইচ্ছা করে বারবার হাসে।
'তোর এক্সপিরিয়েন্স তোর পকেটে পুরে রাখ।আমি নেই।কি করছিলি এতোক্ষণ?'
গবেষণা করছিলাম।
কি নিয়ে?'
'সমাজে কী ভাবে বদলানো যায়। দেখো হিমুদা, বাংলাদেশে কিছুদিন পরপরই কিছু না কিছু আন্দোলন হচ্ছে। প্রতি শীতকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যমী ছেলেপুলে কম্বল নিয়ে রাজশাহী দৌড় লাগাচ্ছে। সুযোগ পেলেই পথশিশুদের নাইট স্কুল খুলে বসছে।ওইদিকে মহান দুই দল গণতন্ত্রের ঝান্ডা তুলে দেশকে টেনিসবল বানিয়ে গিল্লি ডান্ডা খেলছে।এসবের থেকে উত্তরণের পথ কি?চেস্টা তো আর কম মানুষ করেনি।কিন্তু কেউ পারলোনা কেন?এইওসব নিয়ে চিন্তা করছিলাম।বুঝতে পারছো?
বোঝার চেষ্টা করছি না। আমি আসলাম তোর সাথে উচ্চস্তরীয় অপার্থিব তুলনামূলক পারলৌকিক ইহলৌকিক আলোচনা করতে,আর তুই নিম্নস্তরীয় অতিপার্থিব গজগজানি শুরু করলি!
'আচ্ছা স্যরি।বল কি বলবে।'
'গুড। এখন গবেষক সাহেব ধর তুই জেনে ফেললি যে কিছুদিন পর তোর মৃত্যু হবে। তুই কি করবি?
'প্রথমে কিছুক্ষন চিৎকার চ্যাঁচামেচি করব। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করব। এরপর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো।
মানে হিন্দি ফিল্মের স্টাইলে মদ,গাঁজা,প্রেম?
আরে ধূর!এইসব তো বুদ্ধিহীন মানুষের কাজ।আমি হলে জীবনের শেষ কয়েকটা দিনে নিজের জীবনটাকে অর্থবহ করে তোলার চেষ্টা করব।'
'মানে তুই বলতে চাচ্ছিস সারা জীবনের অগুনতি দিনে তুই না করতে চেয়ে করতে পারিসনি, তা শেষ কয়েকটা দিনে করে ফেলার চেষ্টা করবি?
হ্যা।এটলিস্ট আফসোস নিয়ে তো আর মরা যায় না!
মানুষ খুব অদ্ভুত একটি প্রাণী রে বাদল! এদের জন্ম হয় সবকিছু করতে পারার ক্ষমতা নিয়ে,কিন্তু এরা মৃত্যুবরণ করে কিছুই করতে না পারার আফসোস নিয়ে।
বাদল হাসল।
দার্শনিকতা ঝেড়ে দিলেও বাদলের উক্তি আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলো। সে সে খালি বুদ্ধিমান ছেলে তা নয়, সে মারাত্মক বুদ্ধিমান ছেলে। সারা জীবনে সে একটাই কাজ অকাট গর্দভের মতো করেছে, সেটা হলো আমাকে গুরু হিসেবে গ্রহন করা। তবুও তার বুদ্ধি এতই তীক্ষ্ণ যে তার কথা গুরুত্ব সহকারে বিবচনার দাবি রাখে। আমার জীবনে কী আছে যা আমি হতে গিয়ে হতে পারিনি। নিঃসন্দেহে মহাপুরুষ।আমি সর্বজনস্বীকৃত ব্যর্থ মহাপুরুষ।
'হিমুদা, তুমি কি মারা যাচ্ছ?
'আমরা সবাই মারা যাচ্ছি বাদল। We are all dying.
'না মানে তুকি কোন ভাবে ধারনা করছ সে তুমি খুব দ্রুত মারা যাবে?
'তোর এই ধারনা কেন হয়েছে? আমি কি গলায় সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঘুরছি নাকি?
প্রিয় ঢাকাবাসী
আমি এক মৃত্যুপথযাত্রী
পরকালবাসী কোন আত্মীয়ের প্রতি কোন বক্তব্য থাকলে
আমাকে বলুন
আমি তাদের কাছে পৌছে দেব,
নজরানা অতি সামান্য!
বাদল হাসল।
না,মানে!তোমারসাথে থেকে থেকে আমারও কিছুটা ইনট্যুশন পাওয়ার হয়েছে। তার থেকে বললাম।
'বাহ!চমৎকার ব্যাপার আমি দেখি লোকগুরু!ইনট্যুশন থেকে হোক আর কমন সেন্স থেকে,তুই তা ভাবছিস তা সত্য।'
বাদল ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবে নিল। যেন আমি কয়েকদিন পরে মারা যাব এবং এটা আমি জেনে ফেলেছি, সেটা কোন ব্যাপারই না, আমার তো এরকম হবেই। আমি তো সাধারন কেউ না, আমি তো মহাপুরুষ!
'হিমুদা, তুমি মারা যাবে,যাও। আমি মানা করব না। কিন্তু আমার একটা আবদার আছে।'
কি?
'শেষ মুহুর্তে সময় আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।'
'তথাস্তু।'
আমি ঘর থেকে দ্রুতপদে বের হয়ে এলাম। ঘরে ঢুকেই লক্ষ্য করেছি বাদল অসম্ভব সুপুরুষ হয়ে উঠেছে।খালি সুন্দর না,ব্যক্তিত্ববান পৌরুষময় সুপুরুষ!
অতিরূপবতীদের অশ্রু যতটা সুন্দর,অতিরূপবানদের অশ্রু ততটাই কুৎসিত।কাজেই অতিরূপবানদের অশ্রু গোপন করার বিধান আছে।আমি আবেগের বিধান সবসময় মেনে চলি।
ঘর থেকে বের হওয়া মাতে ফুপু ধরলো,’কেমন লাগলো?’
'কি'
গুয়াখামোলে
চমৎকার!পুরো শিক্ষামূলক রান্না!আমি আজ শিখলাম যে মেক্সিকানদের হজমশক্তি অত্যন্ত প্রবল।
খালা অত্যন্ত স্থুলবুদ্ধির মহিলা।তবুও তার এতাটা প্রকট একটা অপমান লক্ষ্য না করার কথা না। কিন্তু কোন এক কারনে তিনি এটি টের পেলেন না এবং বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসতে থাকলেন।
'খালা, আমি মারা যাচ্ছি, মারা যাবার আগে শেষবার বিদায় নিতে এসেছি। বিদায় দাও।'
খালার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিনি পুরোপুরিভাবে পাথর হয়ে গেছেন। তিনি যে আমার কথা বিশ্বাস করেছেন এবং প্রবলভাবেই করেছেন, তা বোঝা যাচ্ছে।
তিনি এখন আছেন 'সুনামিপূর্ব' অবস্থায়। বরাবর তিন মিনিটের মাথায় তিনি চিৎকার চেঁচামেচিতে কেটে পড়বেন। আমি লম্ব পা ফেলে তার সামনে থেকে বিদেয় হলাম। সুনারিমর সময় সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকা কোন কাজের কথা নয়। দরজার কাছে আগাতেই দেখা গেলো খালুসাহেব এখনও সামনে হৃদয়সংবলিত কফিকাপ নিয়ে বসে আছেন। আমি তাকে পুরোপুরি হতভম্ব করে দিয়ে তাকে সবিনয়ে কদমবুসি করলাম।
তারপর পরীক্ষার্থীদের মতোন স্বরে বললাম, 'ফুপা সাহেব, আমি মারা যাচ্ছি। দোয়া করবেন,'
আমি দরজার দিকে আগালাম, খালু সাহেব বললেন, হিমু।'
আমি গলাভর্তি বিনয় নিয়ে চলালাম জি খালুজান।
'সব কিছু নিয়ে তামাশা করে যায়। মৃত্যু নিয়ে করা যায়না।'
জ্বী আচ্ছা খালুজান।মনে থাকবে।এখন আসি।
শীত ভাব কেটে গেছে। সূর্য সাহেব এসেছেন। তার সর্বশক্তি ঢেলে দিয়েছেন হিমু নামক এক ব্যর্থ মহাপুরুষের মাথার ওপর। আমার পায়ে পিচের টুকরো লেগে লেগে ছুটে যাচ্ছে।পথ আমাকে আগলে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।কিন্তু পথের কাউকে আগলে রাখার নিয়ম নেই।পথ থাকবে নির্বিকার,সোজাসাপ্টা।সকলের প্রতি তার আবেগ হবে অপরিবর্তনীয় আর অনিশ্চিত।যেদিকে খুশি সেদিকে যাও,পথ বাধা দেবে না।কোন ব্যর্থ মহাপুরুষের জন্য পথ তার জনম জন্মান্তরের রীতিনীতি পরিবর্তন করতে পারেনা।
আমি রাস্তাকে বললাম, 'হে আমার নিকটতম আত্মীয় তোমায় আমি বিদায় জানাবো সবার শেষে।
৫
প্রকাশক আর লেখকের সম্পর্ক যে ব্যবসায়িক হবার কথা,কেউ বোধহয় এই ছেলেটাকে সেই কথা বলার সুযোগ পায়নি।কাজেই ছেলেটা বড়সড় ভুল করে ফেলেছে।ব্যবসায়িক সম্পর্কে আত্মার সম্পর্কে নিয়ে গেছে।
ছেলেটার নাম মাজহারুল ইসলাম।
'হুমায়ুন ভাই,একবার হাসপাতালে যাওয়া দরকার।'
কৌশোরে তার কাছে হাসপাতাল খুব মজার জায়গা ছিলো।ফিনাইলের মাদকতাময় গন্ধ তাকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করতো।অথচ অধিকাংশ মানুষের কাছে এই ফিনিলের গন্ধটাই অসহ্য।যেমন ছোটভাই জাফর ইকবাল।ইকবাল ছোটবেলায় হাসপাতালে ঢুকতেই বমি করে ভাসাতো।
সিঙ্গাপুরের হাসপাতালগুলোতে মাদকতাময় ফিনাইলের গন্ধ থাকে না।ভোঁতা নির্বিকার গন্ধ থাকে।কারণ এইসব হাসপাতালগুলোতে মৃত্যুকে ধোঁকা দেয়ার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পরও রোজ শয়ে শয়ে লাশ হিমঘরে ঢোকে।এই তীব্র সত্য গোপন করার জন্যই সম্ভবত এইসব হাসপাতালে ভোঁতা গন্ধ বজায় রাখা হয়। আমরা এরচেয়ে অনেক বেশি অকপট।আমরা তীব্রতাকে তীব্রতা দিয়েই বরণ করে নিতে জানি।
যস্মিন দেশে যদাচার।কাজেই কোলন ক্যান্সারের তীব্র সংবাদ হুমায়ুন আহমেদ ভোতাভাবেই গ্রহণ করলেন।কিন্তু শাওন খাঁটি বাঙালী বধূ হয়ে গেলো।ডাক্তারকে দিয়ে তিনবার একই কথা বলালো,তারপর খাঁটি বাংলা ভাষায় ডাক্তারকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কেন আধা মহাপুরুষ হুমায়ুনের সাথে কোনভাবেই এমনটা হতে পারেনা।তারপর ডাক ছেড়ে কান্নাকাটি আরম্ভ করলো।তার কান্নার বেগ আটকাতে আশেপাশের মানুষের হিমশিম খাবার অবস্থা।
কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ নড়লেন না।তিনি পাথরের মূর্তির মত বসে বসে ভাবতে লাগলেন,যে পরিমান সিগারেট তিনি এক জীবনে খেয়েছেন,তাতে তার কান্সার হলে হওয়া উচিত ছিলো ঠোঁটে বা ফুসফুসে।সেই ক্যান্সার বৃহদান্ত্রে কী করে পৌছল!
মহাযাত্রার যাত্রী যদি হতে হয়,মহাসমারহে যাত্রা করাই সমীচীন।কাজেই হুমায়ুন আহমেদ খবর পাওয়া মাত্রই দেশে ফিরে আসলেন এবং আয়োজন করে পরিবার পরিজনকে খবর দেবার জোগাড় করলেন।কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ বাদে আর কারো সাথে যোগাযোগ করা গেলো না।
শাওন রীতিমত যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললো।সে গবেষণা করে বিশ্বের শ্রেষ্ট ক্যান্সার চিকিৎসার হাসপাতালের বায়োডাটা বের করে ফেললো।হাসপাতালের নাম স্লোন ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার।
হুমায়ুন বাহিনী নিউইয়র্কে পৌঁছান সেপ্টেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ।তেরো তারিখই পৌছানো যেত।কিন্তু আনলাকি থার্টিনের ভয়ে শাওন একদিন পিছিয়েছে।গভীর দুঃসময়ে মানুষের কুসংস্কারে প্রবল বিশ্বাস জন্মায়।
প্লেন ল্যান্ড করলো বিকাল সড়ে চারটায়।এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আক্ষরিক অর্থেই হুমায়ুন আহমেদের চোয়াল ঝুলে গেলো।তার মত নগণ্য এক লেখককে রিসিভ করার জন্য তিন তিনটি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে।তার মাঝে একটি আবার বাংলাদেশ এম্বেসির।তিনি নিজের পুরো দেহের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।নিজেকে তার লেখক হুমায়ুন না,জরিদার পোশাক পরা বাদশাহ হুমায়ুন মনে হচ্ছিলো।
মানুষ দোটানায় পড়ে।হুমায়ুন আহমেদ ত্রিটানায় পড়লেন। এম্বেসির গাড়িতে না উঠলে এই বিরল সম্মানকে অপমান করা হয়।এইদিকে মুক্তধারার প্রকাশক বিশ্বজিতের গাড়িতে না উঠলে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক অপমানিত হয়।আর পুত্র নুহাশের খালার গাড়িতে না উঠলে জামেলা সুক্ষ্ম,কিন্তু প্রকট!
হুমায়ুন চোখ বন্ধ করে মনে মনে ছড়া কাটতে শুরু করলেন
অপু,আকাশ থেকে নেমে এলো ছোট্ট একটি প্লেন
প্লেনের মধ্যে বসে ছিলো লাল টুকটুকে মেম
মেমকে আমি জিজ্ঞেশ করলাম হোয়াট ইজ ইওর নেম
মেম আমাকে উত্তর দিলো-মাই নেম ইজ সুচিত্রা সেন।
কৈশোর থেকে এই ছড়া তাকে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে।আজও করলো। নিউইয়র্কে পৌছানোর ঠিক পরদিনই পৃথীবির সবচেয়ে ব্যস্ত হাসপাতালে হুমায়ুন আহমেদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেলো।এই সম্ভবকে সম্ভব করার পিছনের নায়কের নাম পূরবী বসু।প্রায় অপরিচিত মহিলা হুমায়ুন আহমেদের জন্য প্রায় জীবনপণ লড়াইয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।কেনো নিয়েছে,কে জানে?দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন এন্ড আর্থ,হোরেশিও,দ্যান আর ড্রেমট অব ইন ইওর ফিলোসফি !
ডাক্তার কাগজপত্র দেখে ঘোষণা করলেন যে হুমায়ুনকে কেমোথেরাপি নামক যন্ত্রণাময় দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে।কুটুস করে সার্জারী করে ফেলে দেওয়া যাবে না।এই ভয়াবহ দুঃসংবাদ শুনে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো মহাখুশি হয়ে গেলো।তারা ছাপলো,অস্ত্রপচারের প্রয়োজন নেই।অপারেশন ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠবেন হুমায়ুন আহমেদ।ভয়ানক মানসিক চাপের মাঝেও এই খবর পড়ে হুমায়ুন আহমেদ প্রাণ খুলে হেসেছিলেন।
হুমায়ুন আহমেদের ডাক্তারের নাম স্টিফেন আর ভীচ।নাম বিকৃত করে ডাকার রীতি এইদেশে আছে কিনা কে জানে?এটা তো আবহমান বাংলার রীতিমতো ঐতিহ্য।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহপাঠীরা হুমায়ুন আহমেদকে ডাকতো 'হুমায়ুন হাফম্যাড।'এই দেশেও সেই রীতি প্রচলিত থাকলে ডক্টর ভীচের ডাকনাম অচিরেই ডক্টর কুকুরী হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রচুর। ডক্টর কুকুরীর মুখ থেকে কুকুরীসুলভ কথাবার্তা বের হলো না।মধুবর্ষণ টাইপের স্বরে ডাক্তারসাহেব কথা বলা শুরু করলেন।অবশ্য মধুবর্ষকের বলা কথাগুলো খুবই গরল ধরণের।যেমন হুমায়ুনের আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা সাত থেকে আট শতাংশ।অনেকগুলো কেমোর আগে অবস্থা উন্নতির অম্ভাবনা আছে কিনা,তাও বলা যাবে না।
এক পর্যায়ে হুমায়ুন আহমেদ রীতিমতো ভীত কন্ঠে ভীচকে জিজ্ঞেস করলেন,ডক্টর,আমি কি মারা যাচ্ছি?
ভিচ নিরুত্তাপ কন্ঠে উত্তর দিলেন,হ্যাঁ।
ধপ করে শব্দ হলো।শাওন মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।হুমায়ুন আহমেদ বিচলিত হলেন,ডক্টর ভীচ বিস্মিত হলেন আর হাসপাতালের লোকজন ব্যতিব্যস্ত হলো। কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই শাওনের জ্ঞান ফিরে এলো আর ভীচ তাকে তাড়াহুড়ো করে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে মৃত্যু আমাদের সকলেরই ভাগ্য,সেই অর্থে তিনি এই কথা বলেছেন।এমনিতে হুমায়ুনের দ্রুত মৃত্যুর তেমন কোন কারণ নেই।
শাওন উচ্চকন্ঠে আঞ্চলিক বাংলায় ভীচকে এই ধরণের দার্শনিক কথা বিশেষ স্থানে পুরে রাখার নির্দেশ দিলেন।ভীচ হতভম্ব হয়ে হুমায়ুনের দিকে তাকাতেই হুমায়ুন দাড়ি কমাসহ তার বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করলেন।শুনেই ভীচ হেসে ফেললেন।পরিস্থিতি হালকা হলো।
হুমায়ুন আহমেদের কাছে ডক্টর ভিচকে খুব পছন্দ হলো।দুজনে দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠলো।হুমায়ুন আহমেদ ভীচকে তার বাদশাহ নামদার বইটি গিফট করলেন। শাওন তখনো ধাতস্থ হতে পারেনি।কিছুক্ষণ পরপর ডুকরে কেঁদে উঠছে।ডাক্তার তার কোমল হাত এই মায়াবতী তরুণীর কাধে রাখলেন।তাতে তরুণীর অশ্রুনদীর গতিরোধ হলোনা।কিন্তু তরুনী কিছুটা ভরসা পেলো।
আজ হুমায়ুন আহমেদের কেমোথেরাপী পূর্ব ট্রিটমেন্ট হবার কথা।আজ আবার বিভিষিকাময় ভোঁতা হাসপাতালে প্রবেশ করতে হবে।তবে মন ভালো রাখার খুব সহজ উপায় আছে,গুটুগুট করে মনের মাঝে হিমুকে নিয়ে গল্প লিখতে থাকা।একয়দিনে এই বুদ্ধি তার খুব কাজে দিয়েছে। 'মাজহার,চলো' পুত্রসম মাজহার এবং সৃষ্টিসম হিমুকে অবলম্বন করে হুমায়ুন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
৬
আমি সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম লেখক সে ক্লাশরুমে বসে উপন্যাস লেখে। যখন এক পিরিয়ডের পরে আরেক পিরিয়ডে স্যার আর আসে না, তখন ভালোছাত্রের হাত দিয়ে ক্রিকেট ফেলে আর ব্যাকবেঞ্চাররা মোবাইলের চারদিকে আসর জমিয়ে নিষিদ্ধ জ্ঞান পোক্ত করে।
এই দুইটার কোনটাতেই আমার বেশি উৎসাহ নেই বলেই 'উপন্যাস।
ফাস্টবয় হবার বহুবিধ যন্ত্রনা আছে। তার মাঝে অন্যতম যন্ত্রনা হলো, মানববর্ম! ফার্স্টবয়ের আশেপাশে সবসময় কিছু পোলাপান ঘোরাঘুরি করবে।তার টিফিন সংরক্ষন, প্রাকটিক্যাল ক্লাস স্মরন ইত্যাদি কাজ তারা নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করে। আর ফাস্টবয়েরাও তাতে আপত্তি করে না বরং উল্টো মাঝে মাঝে সুলতান আকবরের মোত কিছু আজ্ঞাদানও করে থাকে!
এ ধরনের পোলাপানের অফিসিয়াল নাম হলো চ্যাগা। চুইগাম থেকে চ্যাগার উৎপত্তি আমিই সম্ভবত স্কুলের একমাত্র ফার্স্টবয় যে চ্যাগাদের ভরনপোষন থেকে মহাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করে।
তবে মৃত্যু এবং চ্যাগাদের এক ঈশ্বর ছাড়া কেউ দূরে রাখার ক্ষমতা ধারণ করে না। অতএব,জনৈক চ্যাগা আমার পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করল, 'কি করস?' আমি ঝামেলা এড়ানোর অভিপ্রায়ে বললাম, 'হোমওয়ার্ক'
সাথে সাথে সেই চ্যাগাসাহেবের চোয়াল ঝুলে গেল এবং চোখ অক্ষিকোটর থেকে বের হবার উপক্রিম হলো। আমি অভিভূত হলাম।
'ওবাবা' দেখসস্' ক্লাশের মাঝখানে বসেও পড়ালেখা করে। ইতে ফার্স্ট হবে না তো কি আমরা হবো।' ইত্যাদি ইত্যাদি স্তুতিগন।কিছুক্ষনের মাঝেই আশেপাশে আরো কিছু চ্যাগা জুটে যায় এব আমি বিরসমুখে আবিস্কার করি যে স্তুতিগাল গনসংগীতে পরিশত হয়েছে।
এটা বিরক্তিকর গনসঙ্গীতের থেকে আমাকে বাঁচালো থেপু। থেপু তার আসল নাম নয় এটা বলাই বাহুল্য। তার এই নামের একটা সুবৃহৎ শানে নুজুল আছে। সবার মুখে মুখে ঘোরে সেটা। থেপুর একটা অভ্যাস হলো যখন তখন ঘনঘন ছোট ছোট লাফ দেওয়া। সেটা বসে থাকলেও দাঁড়িয়ে থাকলেও তো, ছাত্রসমাজ এই কর্মকান্ডের একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করালো এভাবে, সে ওর পশ্চদ্দেশ একটু বেশিই ফুলে গেছে। সেকারনে এই স্ফীততা নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা থেকেই তার এ প্রয়াস এই পরিমান প্রচেষ্টার কারনে তার পশ্চাদ্দেশ বা ছাত্রসমাজের ভাষায় 'পুন' হয়ে গেছে থ্যাতলা। আর সেই থ্যাতলা পুন থেকেই থ্যাপু, সেখান থেকে থেপু এই নামটা ভয়ানকভাবে হিট করে গেছে। ছাত্ররা তো তার আসল নামটি ভুলতে বসেছে এমনকি শিক্ষকেরাও অনেকে মনে করেন এটাই তার আসল ডাকনাম।
তার এই নামের বিস্তৃতি নিয়ে একটা অতিবিখ্যাত জনশ্রুতি হলো সে তার আপন বাপ মাও আজকাল তাকে থেপু বলে ডাকে। তবে আমি কোন ভাবেই থেপু নামের সার্থকতা খুঁজে পাই না। তার পশ্চাদ্দেশ মোটেও থেতলা না। বরং অত্যন্ত সুডৌল, খালি ওর পশ্চাদ্দেশ না, ওর সবকিছুই সুন্দর।এতো সুন্দর ছেলে সচরাচর দেখা যায় না। মায়াবী চোখ টিকোলো নাক দীর্ঘ অক্ষীপল্লব তাই বলে আবার মেয়েদের মতো না। একটা পৌরুষের হঙ্কার আছে ভিতরে ভিতরে।তাছাড়া সে পড়ালেখাতেও ভালো, ক্লাসে সেকেন্ড হয়। আমার সাথে বির্তকও করে।একমাত্র সমস্যা হচ্ছে ছেলেটা অকাট গাধা টাইপের।মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি খুবই কম।কিন্তু আজকের বাংলাদেশে পারফেক্ট মানব হতে বুদ্ধিসুদ্ধি লাগে না।সুন্দর চেহারা আর সুন্দর রেজাল্ট লাগে।কাজেই থেপু বলতে গেলে মোটামুটি পরফেক্ট মানব।
তবে পারফেক্ট মানব হবার কিছু সাইড ইফেক্ট আছে। সেটা হলো বিপরীত লিঙ্গের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া।
কাজেই থেপুর নারীসঙ্গী (আধুনিক ভাষায় গার্লফ্রেন্ড) নিয়ত পরিবর্তনশীল।নিয়ত পরিবর্তনশীল গার্লফ্রেন্ড নিয়ে থেপুর অমর বাণী আছে।মানুষ মরে গেলে পচে যায়,বেচে থাকলে বদলায়।আমার গার্লফ্রেন্ডরাও মানুষ,তাই তারাও বদলায়।
মহান বাণীপ্রদত্তা থেপু মহান প্রস্তাব দিলো,'আয় পালাই'
মন:পুত হবার মতো একটা প্রস্তাব।ক্লাস হচ্ছে না এবং বাকিগুলোও হবার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। অতএব এখন পালায় যাওয়া টা রীতিমতো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
সুতরাং আমরা ক্লাশ থেকে চলে এলাম বাথুরুমে।
তো! প্ল্যান কি? পিছনের গেট দিয়ে দৌড়? আমি বললাম।
' ধুর খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, বীরদর্পে বের হব সামনের গেট দিয়ে, পেছন দিয়ে পালানোর মাঝে মজা আছে নাকি?
বক্সিং ম্যাডামের হাতে পড়লে?
আমার আর থেপুর চেহারায় ভীতভাব স্পষ্ট হলো! ভীত হবার যথেষ্ট কারন আছে।বক্সিং ম্যাডাম আমাদের সমগ্র স্কুলের ত্রাস। সাধারনত স্যার ম্যাডামের বেত দিয়ে মারেন বা কান ধরে ওঠবোস করার। আর সবেচেয়ে বড় ব্যাপার হলো রোল এক দুই দেখলে ছেড়ে দেন। বিশেষত আমি কো কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস এর কল্যাণে স্কুলবিখ্যাত হয়ে যাওয়াতে স্কুলের প্রতিষ্ঠা ধূলিকনা পর্যন্ত আমাকে চেনে, অতএব আমার কখনও মার খেতে হয় না।
কিন্তু বক্সিং ম্যাডাম নিপাতনে সিদ্ধ, শুধু সিদ্ধ না ভালোভাবে সিদ্ধ।নিপাতনে ভাজি। কেননা তার কোন বাছবিচার নেই।জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তিনি শাস্তি বিতরণ করে থাকেন। এবং সেই শাস্তিও ভয়াবহ!চোয়ালে ঘুষি!
তার এই বিখ্যাত চোয়ালে ঘুসির কল্যানে আমাদের অনেক বড় ভাইকে রাস্তাঘাটে ভাঙা চোয়াল নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। জনশ্রুতি আছে সে তিনি নাকি আগে প্রফেশনাল বক্সার ছিলেন, বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে যাবার কথা ছিলো, কিন্তু ওভার ওয়েটের কারনে বাদ পড়ে যান।
'নো টেনশন, ডু ফুর্তি’ থেপুর একান ও কানব্যাপী একটা হাসি ফুটে উঠল। তার পকেট থেকে বের হলো একটা চার ভাঁজ করা এ ফোরে সাইজের কাগজ, আমি সাথে সাথে এটাকে চিনে ফেললাম। এটা হলো আমাদের স্বাধীনতার চাবিকাঠি। বির্তক প্রতিযোগিতার একটা অ্যাপ্লিকেশন। স্যার তাড়াহুড়োর মাঝে সাইন করে যাবার অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন তারিখ বসিয়ে নিতে। থেপু তারিখ বসায়নি এবং সেটা খুব যত্ন করে গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। আমি থেপুর ফিচলা বুদ্ধি দেখে অবাক হলাম। ছেলেটার মাথাভর্তি ফিচলামি আর পড়ালেখা। এই দুই চিরশত্রু কিভাবে পাশাপাশি শান্তিপূর্নভাবে বসবাস করছে কে জানে?
সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দরখাস্ত দেখাতেহলো না। নির্বিঘ্নে জানলা দিয়ে ব্যাগ পাচার করে এনে দ্রুতপদে পগার পার হলাম।
'পুনরায়' পুনরায় রাস্তায়, আমরা দুইজন সব সময় একসাথে থাকি তো, তাই পোলাপান আমাদের নাম দিয়েছে পুনরায়।থেপুর থেকে পুন আর আমার টাইটেল রায় একত্র করে-পুনরায়। এটা আসলে একটা সুদীর্ঘ চেইন জোকের অন্তর্গত, গত কয়েকদিনে আমাদের স্কুলে চেইন জোক খুব জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন থেপু ও তার পুন নিয়ে চেইট জোকটা এরকম:
১। থেপুর প্রিয় অস্ত্র কী?
উ: হার 'পুন'
২। থেপুর প্রিয় নারিকা কে?
উ: নি 'পুন'
৩। থেপুর গনিতে কোন চিহ্ন বেশি ব্যহার করে?
উ: 'পুন' পৌনিক
৪। থেপুকে টিভিতে দেখালে শোর নাম কি হবে?
উঃ ‘পুনঃ’প্রচার
৫। থেপু আর অনুপমের বিয়ে হলে তাদের বাচ্চার টাইটেল কি হবে?
উ: পুনরায়
আমার আর থেপুর বাচ্চার টাইটেল কিভাবে আমার আর থেপুর টাইটেল হয়ে গেলো। সেটা বলা মুস্কিল।
হঠাৎ করে থেপুর ফোনটা ক্যাঁও ম্যাও করে বেজে উঠল। সে সারাদিন বান্দরের কিচকিচানি মার্কা র্যাপ গান শুনে কি সে মজা পায় কে জানে!ফোনের কথোপকথনের একপ্রাপ্ত যা শোনা গেল তা এরকম।
'হ্যালো জান কেমন আসো? কই তুমি?
'এইতো তোমার কথা চিন্তা করি।'
'স্যারের সাথে কথা বলতে সিলাম তো, তাই কোন ধরতে পারি নাই, স্যরি বেবি।'
'কালকে তো পারবো না সোনা, পরশুদিন তিনটায় শিশুপার্ক।'
'ওকে জান, বাই লাভ ইউ।'
আমি হেসে বললাম, কয় নম্বর?
'তিন'
আমি হা হয়ে গেলাম এটা থেপুর তিন নম্বর গার্লফ্রেন্ড হতেই পারে না। বিশটা তো আমি নিজেই গুনেছি। থেপু সম্ভবত আমার হতভম্ব মুখ দেখে মাইন্ড রিড করল। 'আরেবাপ, তিন মানে সাইমালটেনিয়াস তিন, মানে একইসাথে তিন নম্বর, এমনেত তো তেত্রিশ।
ও আচ্ছা। আমি এবার কিছুটা আশ্বস্ত হলাম, বেচারা থেপুর জন্য মায়া হলো। কতো পরিশ্রম করতে হচ্ছে বেচারাকে। একসাথে তিনটাকে সামলানো কি সোজা ব্যাপার? মাথা লাগে! ওর মেধাগুলো যদি ঐসব কাজে ব্যয় না করে পড়ালেখা, ডিবেট এই গুলোতে লাগাতো, তবে কবেই আমাকে পার করে ফেলতো।
তবে থেপুর অধ্যবসায় মারাত্মক, দিনরাত পড়াশুনা করে! পড়াশুনা, প্রেম আর স্টাইল ছাড়া কিছুই করে না। জীবনে কোনদিন একটাও গল্পের বই বা খবরের কাগজ ছুঁয়ে দেখেছে কিনা কে জানে!হারামজাদার ডিবেটের স্ক্রিপ্ট পর্যন্ত আমাকে বানিয়ে দিতে হয়।
দুই তিনঘন্টা রাস্তায় কাটালাম। এর মাঝে আমার নেকাগজগুলো করতে হলো তার কয়েকটার উদাহরপ দেয়া যেতে পারে-
০১। মার্কেটে গিয়ে মেয়ে দেখা এবং দশের মাঝে নাম্বর দেয়া।
০২। সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ফেসবুক গুতানো।
০৩। ডায়মন্ডের কাটলেট খাওয়া।
০৪। থেপুর এক গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করা।
০৫। পাথর ছুঁড়ে বিলবোর্ডের মডেলের বিশেষ স্থানে লাগানো।
০৬। রাস্তার যত হলুদ রঙের গোপন রোগ সংক্রান্ত সাইনবোর্ড আর লিফলেট আহে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া আর চিকিৎসাকেন্দ্রে ফোন দিয়ে গালিগালজ করা।
০৭। পোষ্টার আর সাইনবোর্ডের বানানর ভুল খুঁজে বের করে ছবি তোলা।
০৮। সকল পড়াতে চাই পোষ্টারকে থকড়াতে চাই বানানো।
০৯। মার্কেটের গলিঘুঁজিতে 'প্যাকম্যান' অর্থাৎ বিশেষ ধরনের লুকোচুরি খেলা।
১০। থেপুকে লক্ষতম বারের মতো সিগারেট সম্পর্কে লেকচার দেয়া এবং বিফল হওয়া।
এই সুবিশাল অ্যাডভেঞ্চার শেষ করে আমরা যখন শাহেদ স্যারের কোচিংয়ে পৌছাঁলাম, তখন দুপুর।ঢুকেই ওমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটা লাইন একটু পরিবর্তিতভাবে আমার মাথায় ঘুরতে শুরু করল:-
দ্বিপ্রহরের আলোয় রাঙ্গা সেদিন ফাগুনমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ
৭
নীল শাড়ি, আসমানি গাড়। হাতে লাল কাঁচের চুড়ি,পিঠময় ছড়িয়ে পড়া চুল। চোখমুখে গোধূলীবেলার কন্যাসুন্দরী আলোর ছটা।কপালে লাল টিপ।
প্রথম প্রথম আমি মাঝেমাঝেই রূপকে কল্পনা করতাম।ও কি পরেছে, ওকে কেমন লাগছে: এইসব।তবে আমার অপ্রকৃতস্থ পিতাপ্রদত্ত মায়ামুক্তি কঠোর বিধানের জন্য পরে সব বাদ দিতে হয়েছে। আজ অনেকদিন পর হঠাৎ আজকে আবার কেন যেন পিতার উপদেশ অমান্য করে ওকে কল্পনা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
আমার পিতার উপদেশাবলির মাঝে স্ববিরোধিতা প্রবল, সেখানে বলা হয়েছে নিজের বিধিবিধান নিজে তৈরী করতে, সমাজের নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করতে।আবার ব্রাউন প্যাকেটে মুড়ে পাতার পর খাতা অর্থহীন উপদেশ দ্বারা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে যাতে না নিতে পারি, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আচ্ছা, আমি করছি তা ঠিক? আঁতেল বুদ্ধিজীবিদের মতো নিজের সাথে তর্ক করছি কেন? কে সারা সারা!যা হবার হবে। আমার বিধিবিধান আমি ঠিক করবো নাকি আমার অপ্রকৃতস্থ পিতার ব্রাউন প্যাকেট তৈরী করবে তা সময়ই বলে দেবে!
কবিসাহেব গালভর্তি দাড়ি নিয়ে বাংলাবাজর প্রকাশক পাড়ার কুঠপাতে বসে গাল চুলকাচ্ছেন। বিস্ময়কর ব্যাপারে হলো, তার হাতে কফির কাপ, তবে কফির কাপের ওপর হৃদয়াকৃতি আঁকা আছে কিনা তা এতো দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না।
'কবিসাহেব!ভালো আছেন?'
'আপনার কাছে টাকা আছে?
আমি বিস্মত হলাম না, কেননা প্রথমমত হিমুদের সহজে বিস্মিত হতে নেই। আর দ্বিতীয়ত, কবিসাহেব প্রায়শই এরকম অকস্মাৎ উদ্ভট কথাবার্তা বলেন।আমার ধারনা সব কবিই বলে এবং আমার ধারনা ইচ্ছে করেই বলে। সবাইকে বুঝিয়ে দেয়া, আমি তোমাদের চেয়ে আলাদা।আমি 'আউলা'।যে সে আউলা না ।'ক্রিয়েটিভ আউলা'।
আমি হাসিমুখে বিশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিলাম এবং ভেবে পেলাম না যে এই বিশ টাকা নোট আমার কাছে কোথেকে এলো।
কবিসাহেব টাকা হাতে নিলেন, বিল মিটালেন এবং মধুর স্বরে বললেন, কবিতা শুনবেন?
আমি মধুরতা স্বরে বললাম, 'না'
'কেন'?
'আগে আমাকে একটা রহস্যভেদ করতে হবে।'
'কি রহস্য' এই যে, কফিকাপের ওপর হৃদয়কৃতি কিভাবে আঁকা হয় সেই রহস্য।'
আমি দোকানে গলাম, হৃদয় অঙ্কনশৈলী দেখলাম এবং মোহিত হয়ে ফিরে এলাম।
'এবার আপনার কবিতা শোনান। কফিশিল্পশৈলী থেকে মোহিত হেয়ছি, আপনার কবিতা শুনে দ্বিতীয়বার মোহিত হব। মোহিতে মোহিতে কাটাকাটি হবে। আমি নরমাল অবস্থায় ফিরে আসব।কবি সাহেব গাঢ় স্বরে আবৃত্তি শুরু করলেন-
পাখার আর নেই তার আগের যৌবন
ঠোঁটে আর নেই তার আগের তীক্ষ্নতা
কমে গ্যাছে অগ্রুর ব্যাথানাশকতা
আজ আর কদর নেই আগের মতোন
বুড়ো হয়ে গ্যাছে সেই জাদুর পাখিটা।
আমি মোহিত এই কবিতাটি আমার পরে শোনা। তবু প্রতিবার একইভাবে মোহিত হই। আমার সাথে কবিসাহেবের সেদিন প্রথম দেখা হয় সেদিনও উনি আমাকে এই কবিতাটিই শুনিয়েছিলেন।
আমি তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবনকালের সবচেয়ে কাছাকাছি দেখতে একজন মানুষ খুঁজছিলাম।মজার ব্যাপার হলো, বাংলাবাজার এলাকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'যৌবনভেক' ধরা অনেক মানুষ পাওয়া যায়।এদের অধিকাংশই কবি।এরা প্রকাশকদের কাছে ছাপানোর জন্য কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপি নিয়ে আসে।
রবিঠাকুরের যৌবনভেক ধরার কারণ সম্ভবত তাদের ধারণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দাঁড়ি এবং চুল রাখলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবিতা লেখা যায়। সমস্যার ব্যাপার হলো, কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাথা থেকে বের হয়েছিলো, দাঁড়ি এবং চুল থেকে নয়।সেখান থেকে বের হলে সম্ভবত এই শ্রেনীর কবিদের সুবিধা হতো।
আমি রবীন্দ্রদর্শন ব্যক্তি পাইনি, তবে পেয়েছি কবিসাহেবকে যার গালে পারফেক্ট রবীন্দ্রযৌবনীয় দাঁড়ি এবং চেহারও কাছাকাছি। কিন্তু মাথাটা পুরোপুরি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, একটু করে চুল নেই, আমি উৎসাহী হলাম। এরকম কম্বিনেশন সাধারনত দেখা যায় না।
ভালো কবিরা ভাত পায় না। কবিসাহেব রুটিও পান না।
তার কোন ঘর সংসার নেই।মেসে থাকেন। কখনও কখনও ভাড়া ঠিকমতো দিতে পারেন না বলে অর্ধচন্দ্র খেয়ে বিদেয় হয়ে পূর্নিমার চাঁদের মতো নতুন মেসে গিয়ে উঠতে হয়। তার দিনের অধিকাংশ সময় কাটে বাংলাবাজারের প্রকাশকদের কাছে ধর্ণা দিয়ে। তিনি বছরের পর বছর প্রকাশকদের পিছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। আপাতত কোন প্রকাশকের একটাও নতুন লেখকের বই ছাপানোর সুযোগ নেই। তারা দুহাতে বিখ্যাত লেখকদের বই ছাপিয়েই কুল পাচ্ছেন না। একটা বইয়ে প্রুফ দেখতে না দেখতেই আরেকটা হাজির হচ্ছে।
কাজেই কবিসাহেব মহাত্মা গান্ধীর নীতি গ্রহন করেছেন। সত্যাগ্রহ।যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশকের বই ছাপাবে না,ততক্ষন পর্যন্ত তিনি ফুটপাত থেকে নড়বেন না। প্রকাশকের তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হচ্ছেন না। বরং মাঝেমধ্যে কলা, বনরুটি দিয়ে যাচ্ছেন।ভাগ্যিস ভারতবর্ষে ইংরেজরা দখল করেছিল, বাংলাবাজারের প্রকাশকেরা না। নইলে মহাত্মাজির সত্যাগ্রহ সত্ত্বেও ভারতবর্ষ আজও পরাধিন থাকার সম্ভাবনা ছিল।
কবিতা শেষের পথে। অতিপরিচিত শেষ লাইনগুলো শোনা যাচ্ছে।
ফিনিক্স পাখির কালো চোখ ভরে জলে
সেই জলে সারে যত ক্ষত দুনিয়ার
শুধু সারে নারে তার হৃদয়ের ক্ষত
হৃদয়ের মাঝ খানে দাবানল জ্বলে।
কুয়াশার মায়াজালে রাত বাধা হলে
শোনা যায় পাখিটার ডাক শোনা যায়
জোছনা যখন নাচে কুহকের কোলে
ছাই হতে চায় পাখি ছাই হতে চায়।
হঠাৎ করে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল!প্রবল মৃত্যুভীতি আমাকে গ্রাস করল। চোখের সামনে লাল এবং কালো পর্দা দেখতে পেলাম। মাথার ভেতর ঝনঝন করছে কবিসাহেবের গমগমে কন্ঠ:
ছাই হতে চায় পাখি ছাই হতে চায়, ছাই হতে চায় পাখি ছাই হতে চায়, ছাই হতে চায় হিমু ছাই হতে চায়, হাই হতে চায় হিমু হাই হতে চায়।
এই কি শেষ!
©somewhere in net ltd.