নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এই লোকটি আজকের বাংলাদেশকে একাত্তরের লজ্জা বলে ডেকেছিলো

অনুপম দেবাশীষ রায়

আমি অনুপম

অনুপম দেবাশীষ রায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

যেকারণে প্রশ্ন ফাঁস হলেই ভালো হতো

০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৫:১৭

আজ বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এইচএসসি পরীক্ষার শুভসূচনা ঘটেছে।

আমি নিজে আজকে বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষাটি দিয়েছি এবং দুই ঘন্টা দশ মিনিটে ছয়টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এক একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় পেয়েছি বাইশ মিনিটের মতন।

যে যতই মিনমিন করে বলুক না কেন যে এখন আর পৃষ্ঠা গুনে নম্বর দেয়া হয়না,তবু সব মিলিয়ে একটি প্রশ্ন পাঁচ পৃষ্ঠার চেয়ে কমে লেখা এখনও অবশ্যই অত্যন্ত বিপজ্জনক। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের এক নাগাড়ে এক পৃষ্ঠা লিখতে সময় লাগে পাঁচ মিনিটের মতন। সেই হিসেবে একটি সৃজনশীল প্রশ্নের পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর লিখতে সময় লাগার কথা পঁচিশ মিনিট। সেখানে বাড়ি মেরে যখন এই প্রশ্নটিকে বিশ মিনিটে লিখতে হয়-তখন মেশিনের মতন লিখেই কূল পাওয়া যায়না-চিন্তা বা সৃজন করার তো প্রশ্নই আসে না।

অতএব প্রকৃত অর্থে সৃজনশীলভাবে সৃজনশীলের উত্তর লেখার একমাত্র উপায় হচ্ছে পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে-সারারাত সেই প্রশ্ন নিয়ে ভেবে অতঃপর পরদিন সকালে গিয়ে পরীক্ষাটি দেয়া। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে এই বছরের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার খাতার চেয়ে গতবছরের পরীক্ষার খাতা অনেক বেশি সৃজনশীলতা পূর্ণ। তবে তাতে কারও কিছু এসে যায়না কারণ এই বছরও কেউ খাতাটি পড়ে দেখবেনা,গত বছরও পড়ে দেখেনি।

দ্বিতীয় অর্ধে পরীক্ষা হলো নৈর্বক্তিক প্রশ্নের। এই নৈর্বক্তিক প্রশ্নপত্রের প্রশ্নগুলো দেখে আমার মনে হলো আমাদের এখুনি এই গদ্যপদ্যগুলোর রচয়িতাদের কবর থেকে তুলে এনে এই প্রশ্ন সলভ করতে দেয়া উচিত।

আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি,এখন যদি রবীন্দ্রণাথকে সোনার তরী কবিতার অন্তর্নিহিত ভাব সংক্রান্ত একটা বহুপদী সমাপ্তিসূচক প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয় সে বেচারা এক পর্যায়ে চেতে গিয়ে বলবে- এই ফালতু কবিতা কোন গর্দভে...ও শিট!আমিই তো লিখসিলাম।

আমার আসলেই মনে খুব প্রশ্ন জাগে যে একুশের গল্পের তপু চরিত্রের একপায়ের হাড্ডি কয় ইঞ্চি ছোট ছিলো বা তুলসী গাছের কাহিনীতে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় বউ কার আত্মীয়া ছিলেন সেটি জেনে আমাদের আসলে কোন শিক্ষাটি হচ্ছে? যদি বাংলা পরীক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের মনে সাহিত্যপ্রেম জাগ্রত করা তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এই পরীক্ষা সাহিত্য প্রেম না সাহিত্য হত্যার মনোভাব জাগ্রত করে। পাঠ্য হবার আগ পর্যন্ত কবর আর একটি ফটোগ্রাফ আমার খুব প্রিয় দুইটি কবিতা ছিলো এবং আমি মাঝেমাঝেই নিজ মনে আবৃত্তি করতাম। এখন কবিতা দুইটা দেখলে আমার নিজেরে নিজে কবর দিয়ে নিজের ফটোগ্রাফে নিজে মালা ঝুলায়ে দিতে ইচ্ছা করে।

প্রত্যেকটা কবিতা আর গল্পের পর যদি একটা মূলভাবের মহাজঘন্য ব্যাখ্যা দিয়েই রাখে আর সেইটাই যদি হয় একমাত্র নাম্বার পাওয়ার পন্থা-তাহলে আমি সেখানে সৃজনশীলতা কি করবো? মূলভাবের প্যারাগুলো মুখস্ত করার টিকস এন্ড টিপস মার্কা কিছু সূত্র বানানোর সৃজনশীলতা ছাড়া আমি আর কোন সৃজনশীলতা দেখতে পাইনা।

কাজেই আমাদের প্রশ্নপদ্ধতি যে সৃজনশীল হয়ে খুব একটা লাভ হয়েছে তা আমি বলতে পারিনা। বিষের মধ্যে আচ্ছামতো চিনি মিষিয়ে দিলে সেটি খেতে হয়তো মিষ্টি লাগে-কিন্তু তাতেও মৃত্যুই অবশ্যম্ভাবী।

শুধু বাংলার চিপাকাঞ্চি অবজেক্টিভ নয়, পদার্থবিজ্ঞানের যাবতীয় ধ্রুবকের মান আর লম্বা লম্বা সূত্র আর জৈব রসায়নের কোটিখানেক বিক্রিয়া মুখস্ত করে আসলে আমাদের কি লাভ হয় আমি জানিনা যখন কিনা বাস্তবক্ষেত্রে গুগলে সার্চ দিলেই এর যেকোনটাই পাওয়া যায়।অবশ্য বাস্তবক্ষেত্র নিয়ে কার কিবা এসে যায়? আড়াইশো টাকা দিয়ে প্র্যাকটিকেল খাতা লিখিয়ে আর পরীক্ষার আগের দিন ছোট করে চুল কেটে গেলেই পঁচিশে পঁচিশ পাওয়া যায়! ল্যাবে আর কেবা যায়?

ভাই,বাংলাদেশের অনেক স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতেই যখন বছরের পর বছর কোন রিসার্চ হয়না তখন স্কুল কলেজের পোলাপান থেকে আর আশা করে কি লাভ?

আসলে সমস্যাটি প্রশ্নপদ্ধতির নয়,সমস্যাটি পাঠদান পদ্ধতির নয়,সমস্যা আসলে কোনকিছুরই নয়। সমস্যা হলো আমাদের শিক্ষাসংক্রান্ত ফিলসফিতে।আমরা যদি পোলাপানকে পড়াশুনাই করাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে পুলিশে চাকরি নেবার জন্য-তাহলে তো বড়ই সমস্যা। আসলে জাতিগতভাবে আমাদের কাছে শিক্ষা একটা ক্যারিয়ার গড়ার উপায়,কোনকিছু শেখার কোন উপায়ও না। আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় আমি কোনদিন ব্যাচেলর পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারদের উচ্চতর শিক্ষা বা গবেষনার কাজ করতে দেখিনাই-পাশ করার সাথে সাথে চাকরির ধান্দা করে বিসিএস পরীক্ষার জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের উচ্চতা মুখস্থা করতে দেখেছি।

অথচ এরাই কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়ে। এদের দেখে আরো হাজারখানেক ছেলেমেয়ে একই পথে হাটতে চায়।

আসলে বাংলাদেশের সব মানুষ ইঞ্জিনিয়ার আর ডাক্তার হতে চায় কারণ এই পেশাগুলোতেই সবচেয়ে সহজে নিশ্চিত চাকরি পাওয়া যেতে পারে আর ছাত্রাবস্থায় ভালো টিউশনি আর ভালো প্রেমিকা পাওয়া যেতে পারে। একই কারণে অন্য কোথাও চান্স না পেলে সাধারণত কেউ সাধে জুলজি বা মনোবিজ্ঞান পড়তে চায়না। এরপর পছন্দের সাবজেক্ট না পেয়ে এমন স্যাডের স্যাড খেয়ে যায় যে সুইসাইড এটেম্পট করেই কূল পায়না-রিসার্চ আর ইনোভেট করবে কি? যাদের ইকটু গবেষণা করার চুলকানি তারা দেশে ভাত না পেয়ে বিদেশে গিয়ে গবেষণা করতে চাইলেই তোমরা ব্রেইন ড্রেইন-ব্রেইন ড্রেইন কইরা ফাল পাড়ো। চৌবাচ্চায় ইয়াব্বড় একটা ফুটা থাকলে তো গলগল করে পানি বের হবেই রে বাপ!

তাও এই ভয়াবহ গলগলানি পরিস্থিতি নিয়ে কিছুই এসে যায়না কারণ আমাদের সবার চিন্তাধারাই একরকম। আমাদের সকলের কাছেই শিক্ষার উদ্দেশ্য সুন্দরী বউ লাভ। তাইতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাও এরকম করে সাজানো যাতে কম কষ্টে ভালো বউ পাওয়া যায়। যত যাই বলেন ভাই-আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। জনগণ যা চাইবে,শেষপর্যন্ত তাই তো হবে।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো সবসময় অধিকাংশের মতামত ঠিক নয়। সত্য কথা গণতন্ত্রের ধার ধারেনা আর সত্য কথা হলো বাংলাদেশ আসলেই মৃত চিন্তার দেশ। এই কথাটা যখন বাইরের কেউ বলেছিলো তখন আমিও যথেষ্ট ফাল পেড়েছিলাম কিন্তু এখন গোপনে বলে রাখি-কথাটা সত্যি। একটা সমস্যা থেকে লুকায়ে থাকলে সমস্যাটা উধাও হয়ে যায়না।

সত্য হলো বাংলাদেশের মানুষ আসলেই নতুন কোন চিন্তা চায়না,ইনোভেশন চায়না,এন্টারপ্রেনারশীপ চায়না,লিডারশীপ চায়না-সবাই ভালো বউ চায় আর এইটাই সামাজিক বাস্তবতা।

কাজেই কারো মনে হয়না যে শিক্ষাব্যবস্থায় মূল চেতনাতে গলদ আছে। হ্যা,শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্যা আছে সেটা সবাই বলে কারণ সবকিছুতে ভুল ধরার মাঝে একটা আলাদা আরাম আছে। কিন্তু ভুলগুলো ধরা হয় খুব ভুল জায়গায়। ভুল ধরা হয় যে আমাদের ছেলেমেয়েরা নকল করে নকল ঠেকাও-প্রশ্ন ফাঁস হয়-প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাও কিন্তু কেউ কখনো চিন্তা করেনা যে কেন আমরা নকল করি আর কেনই বা প্রশ্ন ফাঁস করি।

আইন দিয়ে একটা সমস্যার প্রতিকার করা যায়-প্রতিরোধ করা যায়না।প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়ে আমাদের কোনই লাভ হয়নাই।মারাত্মক ধরণের একটা ক্ষতি হয়ে গেছে। যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছিলো তখন সবাই একবারের জন্য শিক্ষাপদ্ধতির গোড়ার গলদগুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো এবং চিপার মাঝে পড়ে কিছু মানুষ মিনমিন করে ওপেন বুক এক্সামের মতন চমৎকার কিছু থিওরিও দেয়ার চেষ্টা করেছে। একবারের জন্য সকলে মিলে গোড়ার গলদগুলোর আশপাশ দিয়ে ঘুরে আসার চেষ্টা করেছে।এই বা কম কি? এই বা খারাপ কি?

যেই প্রশ্ন ফাঁস হওয়া বন্ধ হয়ে গেলো-শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনাও বন্ধ হয়ে গেলো। আমি নিশ্চিত যদি প্রশ্ন ফাঁস হওয়া অব্যহত থাকতো তাহলে একসময় সরকারের বাধ্য হয়েই এমন করে শিক্ষাপদ্ধতিটা সাজাতে হতো যেখানে প্রশ্ন ফাঁস করেও খুব একটা লাভ নাই।ইশ! আহারে!যদি সেরকম হতো।

কিন্তু আমাদের সেই ভাগ্য নেই। আমরা বিপুল বিক্রমে প্রশ্ন ফাঁস আটকে দিয়েছি এবং লুকিয়ে চুরিয়ে একটা গোবরের দলা মার্কা প্রশ্ন ছেলেমেয়েদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি যেটার উত্তর হিসেবে সোনার টুকরো ছেলেমেয়েদেরও জোর করে গোবরের দলাই লিখতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার থেকে আমরা গোবরের দলার মতন অনেক অনেক অনেকগুলো গোবরডেন এ প্লাস পাচ্ছি আর ভবিষ্যত সংসারী নরনারী পাচ্ছি কিন্তু একজনও উদ্যোক্তা পাচ্ছিনা,স্বাপ্নিক পাচ্ছিনা।

এর পরেও আমাদের দেশে এতো এতো চমৎকার আইডিয়া বের হয়,এতো এতো স্বাপ্নিক বের হয় আর এতো এতো উদ্যোক্তা বের হয়। মজার ব্যাপার হল এরা সবাই বের হয় 'কো-কারিকুলার এক্টিভিটিস' থেকে। যখন রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট নামক শিক্ষার সবচেয়ে বড় একটা অংশ একটা দেশের কো-কারিকুলার এক্টিভিটি হয়ে যায় তখনই আমাদের বোঝা উচিত যে সেই দেশের কারিকুলামে কঠিন ধরণের ঘাপলা আছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতন সমস্যাগুলো আমাদের সেই সমস্যাগুলোর দিকে আরেকবার তাকানোর প্রণোদনা দেয়।

আমি বলছিনা এটি অপরাধ নয়। অবশ্যই এইটি অপরাধ।তবে একটি অপরাধ যখন একটা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হয়ে যায় তখন আরেকটা অপরাধের তীব্রতা ছাড়া সেই অপরাধের স্বরূপটা বোঝা যায়না। আমাদের দশটা-পাচটা অফিসমুখী ছাপড়াঘরের শিক্ষা আর সৃজনশীল নামক বাঁশের ঠেকনা দিয়ে গড়ে তোলা শিক্ষাপদ্ধতির দিকে আমাদের যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস তাকাতে বাধ্য করে-তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসই হওয়া দরকার।

A crime against a crime cannot be a crime.



পাদটীকাঃ আমি এই লেখাটি আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক এবং বিদগ্ধ শিক্ষাবিদ ডঃমুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কাছে ইমেইল করে পাঠিয়েছিলাম। তিনি লেখাটি পড়ে আমাকে আচ্ছামতো বকে দিয়েছেন আর আমি এতো নৈরাশ্যবাদী বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন যে,এখনই আমার এ অবস্থা হলে বড় হয়ে আমার কি হবে?

আমি স্যারের মন্তব্য পড়ে খুব দুঃখ পেয়েছি কেননা স্যারের কথা আর লেখার উপর ভিত্তি করেই আমি আমার সমগ্র চরিত্র গড়ে তুলেছি। কাজেই স্যারের বকুনি খেয়ে আমার নিজেকে খুবই ব্যর্থ আর অথর্ব মনে হচ্ছে কারণ আমি আসলেই নিজেকে অনেক আশাবাদী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম।তাই আর কারো কাছে না হোক,অন্তত নিজের কাছে আমার এই আপাত নৈরাশ্যবাদের কারণ ব্যখ্যা করছি।

আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে ফুল স্কলারশীপে রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করবো। আমি হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি ছাড়াও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করতে চেয়েছিলাম,কিন্তু তারা জানিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যথেষ্ট মানসম্মত বলে মনে করেনা এবং আমি এ লেভেল ও লেভেলের পড়াশুনা না করে ওদের ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করতে পারবোনা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাদের এহেন মন্তব্য দেখে আমার স্বভাবতই খুব খারাপ লেগেছে। তবে ওদের চামড়া সাদা বলে ওরা যা বলছে তা মেনে নিতে হবে-এমন চিন্তাধারার অনুসারী আমি নই। ওদের অনেক আগেই আমাদের ভূখন্ডে কণাদ,পাণিনী এসেছিলেন-নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের। তবু আমার পছন্দের বিষয়গুলো পড়ার জন্য আমার শেষপর্যন্ত ওদের দেশেই যেতে হচ্ছে।

কেননা আমাদের দেশে রাজনীতির ছাত্রের কোন মূল্য নেই। আমি ছোটবেলা থেকে 'ভালো ছাত্র' ছিলাম বলে আমার আশেপাশের মানুষ আমার রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে আগ্রহটাকে একটা ব্যারাম হিসেবেই দেখতো আর এই ব্যারামের চিকিৎসা করানোর জন্য আমাকে জোর করে বিজ্ঞান পড়ানো হয়েছে এবং সারাক্ষণ কানের কাছে বুয়েট বুয়েট করে করে বুয়েট সংক্রান্ত একটা কঠিন ডিলিরিয়াম তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি যতবার সকলকে বলতে চেয়েছি যে আমি আসলে রাজনীতিবিদ্যা পড়তে চাই-তারা বলেছে-ইশ! মেধার কি নিদারুণ অপচয়।

আমি যদি এখন দেশের বাইরে পড়তে না গিয়ে আসলেই দেশে থেকে রাজনীতিবিদ্যা পড়তে চাইতাম তাহলে সকলে মিলে আমাকে সান্তনা দিতো,আহা! মন খারাপ করোনা-সবাই কি আর বুয়েট-মেডিকেলে চান্স পায়?

আমি নিশ্চিত যে আমি শত অনুনয় করেও কাউকে বুঝাতে পারতাম না যে আমি নিজের ইচ্ছাতেই রাজনীতিবিদ্যা পড়তে চাই।

কাজেই আমার লুকিয়ে লুকিয়ে কাউকে না জানিয়ে আমেরিকা যাবার জন্য স্যাট পরীক্ষা দিতে হয়েছে এবং চোরের মতন দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এপ্লাই করতে হয়েছে।

বিশ্বাস করুন-আমি একটিবারও বলতে চাইছিনা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট কোন অংশে খারাপ। বরং আমার দৃষ্টিতে বিশ্বের যেকোন ইউনিভার্সিটির চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বেশি ভালো আর আমি সারাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছি এবং যদি সবকিছু ঠিক থাকে একদিন আমি আমার পিএইচডি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কমপ্লিট করার চেষ্টা করবো।

কিন্তু বর্তমানে আমার স্বপ্নটুক বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমার বিদেশ চলে যাবার চোরা পথ অবলম্বন করা ছাড়া কিছুই করার ছিলোনা। আমি জানি আমি যতই বলিনা কেন যে আমি একদিন ফিরে আসবো-আপনারা কেউ সেটা বিশ্বাস করবেননা এবং আমাকে বলবেন যে সবাই এরকম বলে আর আমার পিঠের পিছনে আমাকে আমেরিকার দালাল ডাকবেন। আমি কাউকে বলে বুঝাতে পারবো না যে আমার মতন একজন পাগলা বাংলাদেশীর কাছে এই কথাগুলো কি পরিমাণ বেদনার সৃষ্টি করে-আর আমি আসলে কাউকে বলতেও চাইনা।কারণ,আমি নাহয় একজন চোর হিসেবে চোরাই পথে পিছলে বের হয়ে গেছি। কিন্তু যারা বের হতে পারেনি,তাদের কি হবে?

আমার খুব ভয় হয় যে আমি ডিসেম্বর মাসে আমেরিকায় বসে শুনবো যে আমার প্রিয় বন্ধুরা নিজেদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে না পেরে একেকজন আত্মহত্যা করে বসেছে। এবং আমার আরো ভয় হয় কারণ আমি জানি যে যারা আত্মহত্যা করেনি তারাও আসলে জীবন্ত নেই এবং তারা জিন্দা লাশের মতন জম্বিফাইড হয়ে ঘুরছে। অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে জীবন ব্যর্থ-এই আপ্তবাক্য বারবার শুনতে শুনতে তাদের আসলেই মনে হচ্ছে যে অমুকিয়ান হতে না পারলে বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই।তাদের জীবনে আর কোন আশা নেই,কোন স্বপ্ন নেই।

আমি যদি এখন বলি যে যারা অমুকিয়ান হয়ে গেছে,তারাও অমুকিয়ান হয়ে কোন লাভ করেনি কারণ তারাও দিনশেষে চাকরির জন্য ইতিউতি ঘুরবে আর চমৎকার চমৎকার সব প্রতিষ্ঠানের চমৎকার চমৎকার সব শিক্ষকদের সাহায্য নিয়ে চমৎকার চমৎকার উদ্ভাবনী কাজ করার বা গবেষণা করার সময় কারোই হবে না-তাহলে সবাই আমাকে নৈরাশ্যবাদী বলবে আর বলবে যে আমি দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে দেশের সবকিছুকে খারাপ বলি।

কাজেই আমি এর কোনটাই বলছিনা।

আমি শুধু বলছি যে আমাদের শিক্ষার সংজ্ঞাটুকুকে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। শিক্ষিত ছেলেপুলেদের কাছ থেকে আমরা কি চাই সেটাও ভাববার সময় এসেছে। আমি ছোট মানুষ-কাজেই আমার কথার গুরুত্ব নেই।গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এই বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতন ছিঁচকে বিষয় নিয়ে পড়ে না থেকে বরং শিক্ষাযন্ত্রের একেবারে গোড়ার বোধের দিকে তাকানোর সময় এসেছে।

আসলে না,আমি এতো কঠিন কথার কিছুই বলতে চাচ্ছিলাম না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছিলাম যে আগামী ছয় মাসের মধ্যে যে আমার অনেক অনেকগুলো কাছের বন্ধু বান্ধবী আত্মহত্যা করবে অথবা নিজের স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাসকে গলা টিপে খুন করবে-সেটা ভাবতে গেলে আমার গা শিউরে উঠছে।ব্যস,আমি আর কিছুই বলতে চাইনা।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৯

ইলুসন বলেছেন: চমৎকার একটা লেখা। এত ভালভাবে কেউ এটা ব্যাখ্যা করতে পারত না। আমাদের দেশের শিক্ষা হয়ে গেছে জোর করে তেঁতো ওষুধ গেলানোর মত। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে অনেক পড়াশোনা করেও যখন দেখা যায় বিসিএস নামক একটা ফালতু পরীক্ষার (যার ৫৫% কোটা) ৪৫% সিটের জন্য আমাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তখন তা খুব হৃদয় বিদারক হয়ে দাঁড়ায়। আর বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নে যখন দেখা যায় এতদিন যা পড়াশোনা করেছি তার সাথে কোন মিল নেই এমন কিছু আমাকে জোর করে পড়তে হচ্ছে তখন আর কোন কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে না। যারা বড় বড় শিক্ষাবিদ তারা শিক্ষকদের কোন রকম প্রশিক্ষণ না দিয়েই এক একটা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন, আর সেটা চাপিয়ে দেন ছাত্র-ছাত্রী নামক গিনিপিগদের উপর। আবার তারাই বিভিন্ন টকশো, আর প্রত্রিকার কলামে ঝড় তোলেন। হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ!

০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৮

অনুপম দেবাশীষ রায় বলেছেন: ওইযে ভাই-শিক্ষার ফিলসফিতেই সমস্যা। আমরা শিক্ষা দেই আমলা বানানোর জন্যে-শিক্ষিত বানাওর জন্যে না!

২| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩২

আমি মাছরাঙ্গা বলেছেন: আমি পাঠক...লেখক নই । কিন্তু আপনার লেখা পড়ে মনে হল মন্তব্য না করাটা নিজের সাথে অন্যায় করা হবে ।
ধন্যবাদ আপনাকে .....চমৎকারভাবে একটা গুরুত্বপূর্ন সমস্যা তুলে ধরার জন্য।
আমার কাছে মনে হয় "We are CAREFULLY CARELESS about our education system".

সামুকে বলবনা এই পোষ্ট স্টিকি করার জন্য....কারন এই ধরনের লেখা স্টিকি হয় না । কারন "We are CAREFULLY CARELESS" !!

০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৭

অনুপম দেবাশীষ রায় বলেছেন: যাক! নিজেকে নৈরাশ্যবাদী মনে হচ্ছিলো।আপনার কমেন্ট দেখে ভালো লাগছে।
সামু স্টিকি করবে কিনা সেটা সামুর ব্যাপার,আপনার ভালো লাগা দেখে আমার ভালো লাগলো-এটা আপনার আমার ব্যাপার।

৩| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৩

আরজু পনি বলেছেন:

অফলাইনে পোস্টটি পড়া শেষ করার মনে হলো লগইন করি।

এবং এখন আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি।

আপনি ছেলে বলে তবুও নিজের জন্যে এই যুদ্ধ করতে পারছেন। অনেক মেয়েদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।

পছন্দের বিষয়ে পড়তে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাসা থেকে অনেক বেশিই দূরে) এপ্লাই করারও সুযোগ তারা পায়না নিরাপত্তাজনিত কারণে ।

হয় ঢাবিতে পড়ো নয়তো বাসার কাছের কলেজে পড়ো...

আরো অনেক অভিমানের কথা বলতে ইচ্ছে করছে...বলবো না। নিজের মানুষকে দোষী করে কীই হবে। তারচেয়ে আমার বাচ্চারা যেনো এই কষ্ট না পায় সেদিকে সচেতন থাকতে চাই।

আপনার লেখাটি অনেক বেশিই ভালো লাগলো।
অনেক শুভকামনা জানাই।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫০

অনুপম দেবাশীষ রায় বলেছেন: আমি আর কি বলবো আপু?
নারী অধিকার নিয়ে আমি কথা বললে নামর্দ উপাধি পাবো।
নারী ক্ষমতায়নের কথা বললে সবাই শেখ হাসিনা,খালেদা জিয়া আর শিরিন শারমীনের চুষনি মুখে ঢুকায়ে দিবে।
নারীদের নিয়ে কথা বলার লোকের বড় অভাব

৪| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৬

অনুপম দেবাশীষ রায় বলেছেন: কি আর বলবো আপু! কষ্ট লাগে খুব।
কিন্তু আমাদের কষ্টের কোন দাম নাই।আমরা এখনো ভোটার না তো

৫| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:২৩

সুপ্রকাশ সরকার বলেছেন: আপনার লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লাগল। আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় গবেষনার কোনই মূল্য নাই।

আমি নিজে মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছি। অন্যান্য দেশের মেডিকেলের ছাত্ররা এম,বি,বি,এস পাশের সময়ই নিয়োজিত থাকে তাদের স্যারদের গবেষনার কাজে। এম,বি,বি,এস ডাক্তার হয়েই তাদের কেউ কেউ গবেষক হয়ে উঠে। কিন্তু, দুর্ভাগ্য আমাদের যে আমাদের নামী-দামী স্যারদের সময় কোথায় গবেষনা করার। আর আমাদের কথা তো বাদই দিলাম। :(

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:০৯

অনুপম দেবাশীষ রায় বলেছেন: ওইযে ভাই-আর কোথাও না-শিক্ষার ফিলসফিতেই সমস্যা

৬| ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৬

সুমন কর বলেছেন: চমৎকার বলেছেন। এধরনের গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট সামুতে অাসলেই কম অাসে।

৭| ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৮:৪৩

অব্যক্ত স্লোগান বলেছেন: সত্যি অসাধার ণ এক উপস্থাপনা! এত ভাল যুক্তি এবং সমপরিমানে ভাল সেই যুক্তি র ব্যখ্যা আমি কিছু বলার মত খুঁজে পাচ্ছিনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.