![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগামী পহেলা আগস্ট তারিখে আমি বাংলাদেশ ছেড়ে চার বছরের জন্যে আমেরিকা চলে যাচ্ছি উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে।
ইচ্ছে ছিলো পনেরই আগস্ট যবো। সেদিন জাতীয় শোক দিবস। আমি চলে যাচ্ছি সেই দুঃখে সারা দেশ শোক পালন করছে-এরকম একটা ভাব নেয়া যাবে। জাতীয় শোকের মতন একটা ব্যাপারকে ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের কাজে লাগানোর জাতীয় সংস্কৃতি উদযাপন করে দেশত্যাগ করা যাবে। আর এতো সব বুদ্দিজীবোচিত শ্লেষাত্মক রসিকতার ছলে খুব ছোটখাট আদিম আবেগে নিজের মাটি কামড়ে আর কিছুদিন পড়ে থাকা যেতো।
তবে সেটা করা যাচ্ছেনা। আমাকে অগাস্টের শুরুতেই যেতে হচ্ছে। সবকিছু রেখে-চলে যেতে হচ্ছে।
কতোদিনের জন্য যাচ্ছি আমি জানিনা। চার বছরের আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়াশোনা,তারপর গ্রাজুয়েট,তারপর সামর্থ্য থাকলে পোস্টগ্রাজুয়েট। সব মিলিয়ে দশ বছর। আমি হয়তো দশ বছরের জন্যেই যাচ্ছি।
অবশ্য নুহাশ ভাই বলেছেন যে দশ বছর না-আমি দশ মাসও আমেরিকায় টিকতে পারবো না। কারণ আমার যে ভাতের খিদা-আমেরিকায় থেকে সেইটা কুলাবে না।
এটা খুব সত্যি কথা। আমি ভাত না খেয়ে থাকতে পারিনা। আমি জানি আমেরিকাতেও ভাত পাওয়া যায়-কিন্তু এই ভাত সেই ভাত না। ভাত আমার বাসাতেও রান্না হয়। কিন্তু আমি বাসায় ভাত না খেয়ে সুযোগ পেলেই বাইরে ভাত খাই। ছাপড়া ভাতের হোটেলে পাঁচ আঙ্গুল পাতলা ডাল,ভাত আর লালঝোলের মাংসে ডুবিয়ে সুড়ুৎ দিয়ে খাওয়ার শান্তি পৃথিবীতে কোথাও নেই। আর সেই হোটেলের একেকজন মামার সাথে আমার রক্তেরই সম্পর্ক যেন। সকাল রাত যখনই হোক-এসে হাত মিলাবে। বলবে মামা,আসেন খেয়ে যান। তিন দিন আগেও মামা ডেকে বললেন-আসেন একসাথে ইফতার করি। আমি মামাদের সাথে ইফতার করতে বসলাম। সকাল থেকে কিছু খাইনি। রাস্তায় ইফতার করবো ভাবলে আমি সবার সাথে না খেয়ে থাকি।
রাস্তা তখন শুনশান। সবাই খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকা। হাজারো মনের একসূত্রে ইবাদত। সারাদিনের পর প্রথম এক গ্লাস পানি। নিজের শরীরের শান্তি উপভোগ করবো নাকি অন্যের চোখেমুখের শান্তি দেখে মুগ্ধ হবো ভাবতে ভাবতে শরীর অবশ হয়ে আসা ক্লান্তি। রাস্তার শত শত মানুষের সারা শরীরজোড়া নিখাদ তৃপ্তি। ইশরে দয়াল! দেখবোনা আর?
দেখা হবে হয়তো। আমেরিকাতেও নিশ্চিত ইফতার পার্টি হয়। ধনাঢ্য ডলারখোরেরা একসাথে কমিউনিটি হলে বসে খেজুরে কামড় দেয়। পরিবেশনকারীকে ডাকে-এক্সকিউজ মি! হাজার এক্সকিউজ মি-র ভীড়ে কারো নাম জানেনা কেউ।
বৃষ্টি হলেই বাদুরতলায় পানি ওঠে। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি আমি। স্কুলে দেরী করে আসতো রাফিদ। স্যার জিজ্ঞেস করতো-দেরী কেন? স্যার,বাদুরতলায় পানি উঠসে। বৃষ্টি হলে কমবেশি সারা চট্টগ্রামেই পানি ওঠে!
একবার পানির মধ্যে আমি আটকে গেলাম। কোমর সমান পানি। আর সেই কি স্রোত। ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাবে। আমি মোটাসোটা মানুষ-আমার কিছু হলোনা তেমন। রাফিদ দুবলা-তার স্যান্ডেল আরো দুবলা। প্রবল স্রোতে স্যান্ডেল খুলে ভেসে গেলো। আমরা তিন চারজন একসাথে বলে উঠলাম-ধর ধর ধর।
কিভাবে ধরবো? ওইদিকে তো অথৈ সাগর। কোন কূলকিনারা নেই। নিচে কোথাও হয়তো রাস্তা আছে,কিন্তু সেই রাস্তার কোন ম্যানহোলের গর্ত বেয়ে পাতালপুরের রাস্তা-তাইবা জানবে কে? তবু মানব শিকল হলো। মানব শিকল করে আমরা জুতো ধরে আনলাম।
প্রথম একলা রিকশায় চড়েছিলাম টাইগারপাসের মোড় থেকে। শুধু আমাকে নিয়ে রিকশা সিআরবি বেয়ে এগিয়ে চললো। ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে এসেছিলো। মনে হচ্ছিলো এখন পাহাড়ের ঝোপের মধ্যে থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসবে। মনে হচ্ছিলো কেউ সাথে থাকলে বেঁচে যেতাম।
একসময় পাশে একজনকে পেলাম। রোদ না থাকলেও এখন বৃষ্টির হুড তোলা থাকতো। বৃষ্টি থাকলে পর্দা।
বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ আমেরিকা-যেখানে ইচ্ছা সেখানে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। কিন্তু সেই আমেরিকাও কি কখনো বৃষ্টির দিনে পর্দাতোলার রিকশার মাতাল স্বাধীনতা এনে দিতে পারবে?
একসময় আবার হুডের পিছনে লুকিয়ে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইতো। একসময় হুড খুলে দিতে ইচ্ছে করলো। একসময় হুড খুলে দিলাম। একসময় রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করলো। দাঁড়িয়ে পরলাম। টাইটানিকের ডেকে তোলা বহুমূল্য মেকি ভালোবাসা কখনো আমাদের হাত ছড়িয়ে উড়ে যেতে দেখেনি,দেখেছিলো রাস্তার পাশে দুইটা মেয়ে-তারা খিলখিল করে হেসে দিলো। তাদের হাতে খালি চিপসের প্যাকেট।
এদের দুইজন একদিন জামা ধরে টান দিয়ে বললো-ভাইয়া দুইটা টাকা দেন। আমি তাদের বললাম-যদি আমার সাথে স্থির হয়ে পাঁচ মিনিট বসে থাকতে পারিস তাহলে সবাইকে দশ টাকা করে দেবো। এমনি ওরা দুই সেকেন্ডও স্থির থাকতে পারে না। এবার একেবারে ঠায় তিনশো সেকেন্ড স্থির হয়ে বসে রইলো। আমার কাছে তিরিশ টাকা ছিলো। পাঁচজনের মাঝে বঞ্চিত দুইজন একটু বোকা ধরণের। তারা বুঝতে পারেনি যা তারা টাকা পায়নি। তারা হেসেই চলেছে।
আমি কিছুদিন পরে আবার বিশ টাকা নিয়ে তাদের দিলাম। ওরা আমাকে চিনতে পারেনি। তবু কিছু না বলে টাকা নিয়ে নিলো। এখনো তারা হেসেই চলেছে। কোন ভাবান্তর নেই।
বাসে ওঠার সময় আর বাস থেকে নামার সময় আমি সবসময় মোবাইল আর মানিব্যাগ হাতে নিয়ে নিতাম। যাতে নামার সময় ধাক্কাধাক্কিতে কখনো কেউ হাত গলিয়ে সরিয়ে না ফেলে। কেউ সরাতে পারেনি কখনো। আমি নিজেই হারিয়ে ফেলতাম। ছোট থাকতে আমি একবার স্কুলের বেতনের টাকা হারিয়ে ফেললাম। এরপর থেকে মা আর আমার হাতে টাকা দিতে চাইতো না। আমার বেতনের টাকা দিতো রাফিদের হাতে। ছোট হবার কারণে এই ব্যাপারটার অন্তর্নিহীত অপমানটা তখন ধরতে পারিনাই। তখনো পর্যন্ত মান অপমান গজায়ে পারেনাই আমার।
এখন বয়সের সাথে সাথে মান অপমানের দন্ড গজায়ে গেছে সবার। সময়ে অসময়ে সেটা টং করে দাঁড়ায়ে যায়। বন্ধু আর বন্ধুর মধ্যে দেয়াল তুলে দেয়। পাশাপাশি থেকে আর কেউ কাউকে চেনে না। মুখে হাসি গল্প আড্ডার ফুলঝুরি-কিন্তু অন্তরে আকাশের সমান দেয়াল।
গোপনীয়তার দেয়াল-মান-অভিমানের দেয়াল আর বড় হয়ে যাবার দেয়াল।
পার্থিব দেয়ালও উঠে গেছে অনেক। সার্কিট হাউজের পাশের টিনেঘেরা জায়গাটা ছোটবেলার থেকে পোড়ো দেখে এসেছি। টিনের ফুটো দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করতাম। টিনগুলোতে একসময় মরচে ধরে গেলো। একবার চট্টগ্রামে বেড়াতে এসে দেখলাম টিনের বেড়া ভেঙ্গে মস্ত দালান উঠে গেছে। র্যাডিসন ব্লু। সেখানে একবেলা বসতে গেলেও উচ্চশ্রেণীয় ব্যবহার লাগে। সাহেবরা চলে গেলো-আধাখেচড়া সাহেবীপনার ভূতটা নিয়ে গেলো না।
থেপুর বাসায় যেতে গেলে ভাঙ্গাচোরা রাস্তা পার করে যেতে হতো। রাস্তা থেকে ধুলো উড়ে নাকমুখ ভরিয়ে দিতো। মরুভূমি বলে গাল দিতাম।
এখন মরুভূমির গোড়ায় ফ্লাইওভার হয়েছে। রাস্তা বেশ মসৃণ। ধুলো কম ওড়ে। যাবার সময় রাস্তা থেকে ধুলো একত্র করে মুখে মাখতে ইচ্ছা করলো।
পারলাম না। ধুলো জড়ো করতে করতে উড়ে গেলো। হাতের ফাঁকা দিয়ে চলে যায়। ধরতে পারি না। মাথার মাঝে এই অপ্রাপ্তির শুষ্কতাটুকু রয়ে গেলো। স্মৃতির সোনালী ধুলো হাত থেকে ফসকে মাথায় গিয়ে জমা হয়। সেই ধুলোগুলো একজন দেশত্যাগী বিদায়ীর নিশ্বাসে জ্বালা ধরায়।
শহরটা আর শহরটার মতন নেই। মানুষগুলোও আর মানুষগুলোর মতন নেই। আমার চট্টগ্রাম সফর ব্যর্থ। গিয়েছিলাম পুরোনো স্মৃতিগুলো একত্র করে একটু বুকে জ্বালা ধরাবো বলে। বরং সাধের স্মৃতিগুলোই ঝাপসা হয়ে গেলো।
এমনটাই হবার কথা। আমার স্মৃতির জন্য তো আর সময় বসে থাকবে না-উন্নতিও না। তাই সব বদলে যাবে। মানুষগুলোও বদলে যাবে। আমার ক্লাবের জুনিয়রগুলো ক্লাবের সিনিয়র হয়ে যাবে। তাদের ছোটমানুষি সমস্যাগুলো বড়মানুষি সমস্যা হয়ে যাবে। আর সেই সমস্যার অংশ আর আমি থাকবো না। চট্টগ্রামের বন্ধুদের কাছে যেমন বাইরের মানুষ হয়ে গেছি-এদের কাছেও বাইরের মানুষ হয়ে যাবো।
কেউ ফোন করে বলবেনা-ভাই,খুব বিপদে পড়সি। আপনে কই?
কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমি আসতে দেরী করেছি বলে কেউ ফুলে বোম হবে না। হাঁটুর সমান বয়েসী হয়েও কেউ কখনো আবদারের অধিকারে হঠাৎ চিৎকার করে উঠবে না। আমিও কাউকে ঝাড়ি দিয়ে আর মাটিতে মিশিয়ে দেবো না। বেশি চিল্লাচিল্লি করে ফেলে পরে আবার কাঁধে হাত দিয়ে-'বল কি খাবি' বলা হবেনা কখনো। ছেলেপেলেরা বড় হয়ে যাবে। বড়দের দুনিয়ায় এইসব ছোটত্বের যায়গা নেই। তাদের মান অভিমান ভেদ করে বেড়ে উঠবে মান অপমানের দেয়াল। জানি,একদিন এরা সবাইও দূরে দূরে সরে যাবে। এখনই যাচ্ছে।
এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
তবে পারলে আমি সবাইকে আটকে রাখতাম। কাউকে বড় হতে দিতাম না। রাফিদদেরকে আটকে রাখতাম ক্লাস টেনে। রফা,রিফাত,রাবিন,অন্তরদের বয়স বরফ করে দিতাম। নুহাশ ভাইকেও বড় হতে দিতাম না-বিয়ে করে তিন বাচ্চার বাপ হতে দিতাম না।
রৌদ্র ভাইকে ডাক্তার হতে দিতাম না-বলতাম সারাজীবন ধরে প্রফের প্যাড়া খান-পাশ করার দরকার নাই।আকিবকে তার লেইম জোকসের ঝুলি বন্ধ করে শক্তপোক্ত আর্মি অফিসার হয়ে যেতে দিতাম না। অমিকে অসাধারণ অমি থেকে সাধারণ মধ্যবয়েসি হয়ে যেতে দিতাম না।
আমি আমেরিকা না গেলেও পারতাম। কিন্তু আমি আমেরিকা না গেলেও এরকম হবে। এরকম হয়। আটকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।
তার চেয়ে বরং চলে গেলেই ভালো। তখন অন্তত বলতে পারবো-আমি চলে গেছিলাম বলেই এরকম হয়েছে। আমি থাকলেই আটকে দিতাম সব।
জানি হবে না। হয়না কখনো। এরা বড় হতে থাকবে। দূরে সরতে সরতে একসময় একেকজনের একেকটা দ্বীপ বানিয়ে ফেলবে আর আমি একদিনের জন্য এসে সেইসব দ্বীপের মাঝের অথৈ পানিতে হাবুডুবু খাবো।
আর বলবো-ইশ! আমার যদি চলে যেতে না হতো।
“So we beat on, boats against the current, borne back ceaselessly into the past.”
― F. Scott Fitzgerald, The Great Gatsby
©somewhere in net ltd.