![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি এর আগে একবার বলেছিলাম যে আমাদের শিক্ষা সংক্রান্ত ফিলসফিতে একটা বেশ বড় সমস্যা রয়েছে। আমার চোখে সেই ফিলসফির সবচয়ে বড় সমস্যাটা হলো ভালো ছাত্রের সংজ্ঞা তে। শিক্ষক,ছাত্র,অভিভাবকদের মনে তথাকথিত ভালো ছাত্রের একটা ইমেজ ঢুকে গেছে যেটা আর কোনভাবেই সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়েও টেনে বের করা যাচ্ছেনা। এই ভালো ছাত্রের ইমেজের জন্যেই আজ আমাদের দেশে প্রকৃত ভালো ছাত্রের বড় অভাব।
ভাবি জানেন,পাশের বাসার অমুক মিয়া ভয়াবহ ভালো ছাত্র। জানেন ভাবি ও এখন বুয়েটে পড়ে। আমার পিংকু কে পড়াইতে বললাম। ওর তো সময়ই নাই একদম। খুব ডিমান্ড! বুঝেন তাইলে কত ভালো ছাত্র!
আল্লাহ ভাবি তাই! ইশ,কি ভাগ্য অমুকের আম্মার। আর আমার চিংকু তো পড়তেই চায়না। খালি সারাদিন গল্পের বই। এই চিংকু,শুনসিস তোর অমুক ভাইয়ার কথা। যা ওর বাসায় যা। ওর পা ধোয়া পানি খেয়ে আয়,তাহলে যদি ওর মতন একটু হতে পারিস।
চিংকু শোনে। শুনে বিমোহিত হয় অথবা ভয়াবহ রকমের বিরক্ত হয়। সে টের পায় যে সে যতদিন পর্যন্ত অমুক ভাইয়ার মতন কিছু হতে পারবে না ততদিন তাকে দিনান্ত অমুক ভাইয়ের পা ধোয়া পানিই খাওয়ানো হতে থাকবে। কাজেই এই নরকযন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি পেতে হলে যেভাবেই হোক তাকে অমুক ভাইয়ার মতো হতে হবে।
তাই চিংকু আদাজল খেয়ে লাগে। কিন্তু একদিন রাতে এল ক্লাসিকো থাকে, বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচ। চিংকু কে দেখতেই হয়। আর চিংকুর আম্মুও খাপ্পা!
চার মাস পরে তোর পরীক্ষা-আর এখন তুই বসে বসে ফুটবল দেখিস! লজ্জা শরম কিছু নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখ তো কেউ এই রাতে বসে ফুটবল দেখে কিনা।
অতঃপর সত্যিই একদিন চিংকুমাতা চিংকুকে লজ্জা দিতে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাবে। এবং নির্দ্বিধায় দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাবে অমুক ভাইয়ের বাসায়। অমুক ভাইয়ের মুখোমুখি হয়ে একসময় চিংকু আর না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলবে-ভাই,আপনি দিনে কয় ঘন্টা পড়তেন?
অমুক ভাই চশমার ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে গলা গম্ভীর করে বলবেন-বারো ঘন্টা!
চিংকু মূর্চ্ছা যাবে।
এখানেই চিংকুর ভুল। চিংকুর মূর্চ্ছা না গিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো-বারো ঘন্টা পড়ে আপনি কি চুলটা ফেলেছেন?
অমুক ভাই বলবে-এইসব কি বলো! বারো ঘন্টা পড়েছি দেখেই আমি -এখন বুয়েটে পড়ছি।
তখন চিংকুর জিজ্ঞেস করা উচিত- বুয়েটে পড়ে আপনি কি চুলটা ফেলেছেন!
অমুক ভাই বলবে-এইসব কি বলো! বুয়েটে পড়লে মানুষের জীবন ফকফকা। কতো কানেকশন তৈরি হয় জানো? চাকরির ভাইবা বোর্ডে এইসব জায়গার নাম বললে ইন্সট্যান্ট চাকরি। আমাদের সাইফুল ভাই, দুইবছর আগে পাশ করসে। পাশ কইরা মাত্র কোন একটা লিংক ধইরা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকরি। এখন মাসে লাখ টাকা কামায়।
তখন চিংকুর মূর্চ্ছা যাওয়া উচিত ছিলো।
তারপর জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো-ভাই,আপনি ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য বুয়েটে পড়ছেন?
অমুক ভাই তখন একটু বিব্রত হবে। বিব্রত হয়ে বলবে-না মানে,ইয়ে!ফিউচার বলে তো একটা ব্যাপার থাকেই।
চিংকু তখন বলবে-আপনার ফিউচার কি? ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ কইরা ব্যাংকে চাকরি করে মাসে মোটা একটা বেতন পেয়ে তিন বাচ্চার বাপ হবেন আর বউকে জ্বালাতন করবেন?
অমুক ভাইয়ের স্বর তখন একটু অগম্ভীর। তিনি পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলবেন-বউকে জ্বালাতন করবো কেনো? বউই আমাকে জ্বালাতন করবে। বুয়েটের ছেলেপুলেকে মেয়ে দেয়ার জন্য সুন্দরী মেয়েদের বাপ মা রা ওৎ পেতে বসে থাকে। হে হে! সাইফুল ভাইয়ের বউকে দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। সেই একখান...
ভাই,তাইলে আপনি ভালো বউ পাওয়ার জন্যে বুয়েটে পড়েন?
আরে শুধু কি বউ! বুয়েটে যেদিন থেকে ঢুকবা সেদিন থেকে তোমার জীবন ফুরফুরা। ছেলেমেয়ের বাপ মা তোমার ঘরে এসে টাকা দিয়ে যাবে। বলবে-পড়ানোর দরকার নাই বাবা। তুমি আমার ছেলের মাথায় একটা ফুঁ দিয়া দাও।
তাইলে আপনি ভালো টিউশনি পাওয়ার জন্য বুয়েটে পড়েন?
শুধু টিউশনি-তার উপর আছে এডমিশন কোচিং। ওই তিন-চারমাসে তো আকাশে বাতাসে টাকা ভাসে। এখন টিউশনি,টিউশনি থেকে গার্লফ্রেন্ড,গার্লফ্রেন্ড থেকে চাকরি। ব্যস,জীবনে আর কি লাগে?
কিন্তু ভাই-আমার তো ধারণা ছিলো বুয়েটে মানুষ রিসার্চ করতে যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে অনেক কিছু জানার জন্য যায়।
আরে ধুর! কিসের রিসার্চ। ছেলেপুলে টিউশনি করায়ে আর প্রেম কইরে কুল পায়না-রিসার্চ কখন করবে? বুয়েটে রিসার্চ বলতে একটাই-কোন কোম্পানি সিমেন্ট নিয়া আসলে সিভিল থেইকা টেস্ট কইরা বলে দেয় যে সিমেন্ট ভালো কিনা। তখন সেই কোম্পানি প্যাকেটের গায়ে লেইখা দেয়-বুয়েট টেস্টেড। মার্কেটে ভালো খায়।
কি বলেন ভাই! এর চেয়ে তো তাইলে ব্র্যাক বা শাহজালাল অনেক ভালো। ওদের ওখানে অনেক রিসার্চ হয় শুনি। ইন্টারন্যাশলাল কম্পিটিশনে জিতে টিতে আসে। নিজেরা সার্চ ইঞ্জিন টিঞ্জিন বানায়।
আরে ধুর ধুর। ব্র্যাকের নাম আর বুয়েটের নাম এক কাতারে নাও কেমনে। শালার প্রাইভেট! ওর শালারা কিছু পারে নাকি? আর শাহজালাল টাহজালাল যাই করুক না কেনো-বুয়েট কখনো হইতে পারবে না ভায়া। বুয়েট তো বুয়েটই।
আমাদের শিক্ষা সংক্রান্ত ফিলসফির সবচেয়ে বড় সমস্যা এইটাই। বুয়েট তো বুয়েটই-নটরডেম তো নটরডেমই-কলেজিয়েট তো কলেজিয়েটই!
হাজার বছরের জীর্ণ লোকাচার আঁকড়ে ধরার অভ্যাস আমাদের পড়াশুনার মাঝেও লোকাচার আর জাতপাত ঢুকায়ে ফেলার প্রেরণা দিচ্ছে বোধহয়। নাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঝে আমরা বর্ণভেদ ঢুকালাম কেমনে?
বুয়েট-মেডিকেল এখানে ব্রাক্ষণ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষত্রিয়, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কায়স্থ, আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এখানে বৈশ্য-শূদ্র। তা সেই শূদ্রের দল যতই জ্ঞানে বিদ্যায় অসাধারণ হয়ে উঠুক,ব্রাক্ষণের পায়ের কাছেই তাকে বসতে হবে। কারণ ব্রাক্ষণ তো ব্রাক্ষণই।
হয় জন্মগত ভাবে তুমি ব্রাক্ষণ,নাইলে সারাজীবন ব্রাক্ষণের পায়ের তলায়।
হয় তুমি ঘন্টামাপা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বুয়েটিয়ান,নাইলে সারাজীবন বুয়েটিয়ানের পায়ের তলায়।
জন্মপরিচয় আর ভর্তি পরীক্ষা পরিচয়ে অদৃষ্টের প্রভাব সমান না হলেও,সমান্তরাল।
আমি বলছি না বুয়েটে সত্যিই কোন রিসার্চ হয়না আর সব বুয়েটিয়ান অমুক ভাইয়ের মতন। সত্যিকারে বুয়েটে বেশ ভালো ভালো কিছু রিসার্চ হয় আর অনেক অনেক বুয়েটিয়ান আসলেই তাদের রিসার্চ নিয়ে খুব বেশি প্যাশনেট।
কিন্তু এইদিকে যে অমুক ভাইয়াদের পা ধোয়া পানি খেয়ে চিংকু প্রজন্ম গড়ে উঠছে-তারা তাদের বাপ মায়ের সামনে তাদের ইউনিভার্সিটি চয়েজ নিয়ে ট্যাঁ-ফো করারও সুযোগ পাবে কি? আর এই চিংকু প্রজন্ম চিংকুর মতন ভুল সময়ে প্রশ্ন করা থামিয়ে দিয়ে সত্যি সত্যি যদি অমুক ভাইয়া হবার লক্ষ্যে অমুক ভাইয়ার মতন ঘন্টায় বারো ঘন্টা করে পড়া ধরে-তাহলে তারা কোনদিনই ভালো ছাত্র হতে পারবে না। তারা হবে ছাগল ছাত্র-যাদের দিয়ে জাতির কেনো,তার নিজের ফ্যামিলিরও কোন লাভ হবেনা। ঘরে খাসির মাংস রান্না হবে-তারে বলা হইলো আধা কেজি খাসির মাংস কিনা আন। সে কিনা আনবে বাতিল মাংস। তারপর কেউ কিছু বললে বলবে-খবরদার,কিছু বলবা না-আমি কিন্তু বুয়েটিয়ান। পুট কইরা দিমু-ধ্বংস হইয়া যাবি।
এইটা কোনভাবেই ভালো ছাত্র না। এইটা হলো ছাগল ছাত্র।
সত্যিকারের ভালো ছাত্র খাসির মাংস কিনার আগে দারোয়ান কুদ্দুস মামার কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বলবে কারণ সবাই বলে কুদ্দুস মামা খাসি কিনার এক্সপার্ট। কুদ্দুস মামা যখন তাকে পেয়ে পান চাবাতে চাবাতে বয়ান দেবে যে খাসির কোন জায়গার মাংস ভালো-কোন দোকান থেকে কিনতে হয়-সামনে দাঁড়ায়া জবাই করায়া আনতে হয় নাকি-তখন সে মনোযোগ দিয়ে তার শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষাটা নেবে। পানের থেকে রস বের হয়ে কুদ্দুস মামার মুখ ভরে গিয়ে যদি তার কথা বোঝা না যায় তাহলে সে বলবে-মামা,পিকটা ফালায়া নেন।
এরপর সে আরো দশটা প্রশ্ন করবে। প্রশ্ন করে করে কুদ্দুস মামার কাছ থেকে পুরো খাসি কেনার প্রসেসটা নিয়ে সর্বোচ্চটুকু জানবে। এইটা হইলো ক্লাসরুম এনগেজমেন্ট।
জানার পরে কসাইয়ের কাছে গিয়ে মাংস কিনে আনবে।এইটা হইলো মিডটার্ম পরীক্ষা।
এখন তার কেনা সেই মাংস অসাধারণ হতেও পারে,বা তার কোন ভুলও থাকতে পারে। ভুল থাকলে সে খুঁজে বের করবে কোথায় ভুল হলো। বের করে আম্মাকে বলবে-আম্মা টাকা দাও,আজকেও খাসি কিনবো। তারপর এইবার দরকার হলে কুদ্দুস মামাকে সাথে নিয়ে গিয়ে দেখে নিবে কুদ্দুস মামা কেমনে কিনে। এইটা হইলো ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট।
এইবার তৃতীয়বারে সে খাসির মাংস কিনতে যাবে একা। এইটা তার সেমিস্টার ফাইনাল। এইবার সে যে খাসির মাংস কিনে আনবে সেই খাসির মাংসের রেজালা খেয়ে বাসার কেউ আর শান্তিতে নড়তে পারবে না। পরীক্ষায় সে পাশ।
আসলে ভালো ছাত্র হবার প্রথম গুণ হলো ভালো শ্রোতা হওয়া। মনোযোগ দিয়ে চুপ করে কারও কথা শোনা-তারপর বোঝা। বুঝতে কোন জায়গায় সমস্যা থাকলে বারবার প্রশ্ন করে সেই জায়গাটা নিয়ে পরিস্কার হয়ে নেয়া। সেই পরিস্কার হবার জন্য যা করা লাগে-পুরোপুরি তা না হওয়া পর্যন্ত যে লেগে থাকে-সে-ই ভালো ছাত্র। ভালো ছাত্র হবার জন্যে পড়াশুনাও করা লাগে না। যে রিকশাওয়ালা ঢাকায় নতুন-সে উত্তরায় রিকশা চালানোর সময় আমারে প্রশ্ন কইরা অস্থির করে ফেলে। মামা,এইডা কি,মামা ঐডা কি।
আমি বিরক্ত হই-কিন্তু উত্তর দেই। পরে একদিন ওই রিকশাওয়ালার সাথে আমার দেখা। আমি কই যাবো বলিও নাই। মামা আমারে ঠিক ঠিক আমার বাসায় আইনা নামাইসে। মামা একজন অসাধারণ ছাত্র।
এখন কেউ যদি বারো ঘন্টা পরে-সে পরিশ্রমী ছাত্র। কেউ যদি ভালো রেজাল্ট করে সে ওয়েল পারফর্মিং ছাত্র। কেউ যদি পরিপাটি থাকে,বইখাতা গোছায়ে রাখে-সে গোছালো ছাত্র। কেউ যদি ভোরে ঘুম থেকে ওঠে,ডেইলি সময়মত স্কুলে যায়-সে নিয়মিত ছাত্র। যে বুয়েটে চান্স পাইসে-সে বুয়েটে চান্স পাওয়া ছাত্র।
এরা ভালো ছাত্র হতেও পারে নাও পারে। ভালো ছাত্র এদের মতন হতেও পারে-নাও পারে। দুইটার মাঝে কোনই সম্পর্ক নাই।
শিক্ষার উদ্দেশ্য ভালো ছাত্র বানানো। সব মিলায়ে একজন পূর্ণাঙ্গ ভালো মানুষ বানানো। চ্যাম্পিয়ন বানানো,সফল বানানো শিক্ষার উদ্দেশ্য না। নিজের ভিতরের চ্যাম্পিয়নকে নিজের খুঁজে নেবার শক্তি দেয়াই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
শিক্ষা কোন ওষুধ না যে সাধারণ মানুষকে সফল মানুষ বানায়ে দেবে।
শিক্ষা হচ্ছে এমন একটা প্রক্রিয়া-যা সাধারণ মানুষকে ভালো ছাত্র বানায়।এই ভালো ছাত্রগুলো হচ্ছে ওষুধ। যেটা একটা দুর্ভাগা দুঃখভরা জাতিকে একটা অসাধারণ সফল জাতি বানায়ে দিতে পারে।
©somewhere in net ltd.