![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
সম্প্রতি রাজধানীতে ঘটে যাওয়া নিজেদের মেয়ের হাতে দম্পতির নৃশংসভাবে খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছে। অনলাইন-অফলাইন পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কিংবা ব্লগগুলো নিয়মিত, অনিয়মিত, পেশাদার, অপেশাদার, সাধারণ, বিশেষজ্ঞ লেখকদের প্রতিক্রিয়ায়, বিশ্লেষণে, সমালোচনায়, সহানুভূতিতে ভরে গেছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ দুষেছেন এ ধরণের ঘটনা ঘটবার জন্য সহায়ক আমাদের সমাজের মধ্যে বিদ্যমান পূর্ব শর্তকে, অপরিণত সংস্কৃতিকে। সাধারণেরা দোষ চাপিয়েছেন উচ্ছন্নে যাওয়া মাদকাসক্ত যুব সমাজের উপর। কেউ তিরস্কার করেছেন মা-বাবাদের, যারা সন্তানদের জটিল মানসিক অবস্থা বুঝতে চান না এবং তাদের প্রতি চরম ঔদাসীন্য দেখান; যে কোনও তরিকায় তারা অর্থ-বিত্ত উপার্জন করাকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করেন। খুন হয়ে যাওয়া ঐশী এবং ওহীর মা-বাবা নিঃসন্দেহে নিজেদের ভুলেরই সর্বোচ্চ খেসারত নিজেদের জীবন দিয়ে দিয়েছেন।
সন্দেহ নেই যে, ঘটনার জন্য দায়ী যত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ খুঁজে বের করা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে তাদের প্রত্যেকটিই কোনও না কোনও ভাবে সঠিক। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেগুলোর কোনটাই এককভাবে ঘটনার জন্য দায়ী ছিল না। অথবা সব গুলো একসাথে দায়ী ছিল। কারণ এটা একটা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ধাপ গুলো একটি আরেকটির উপর নির্ভরশীল। শুধু প্রাবল্যের উপর ভিত্তি করেই প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন পরিণতি লাভ করে। ঐশীর ঘটানো হত্যাকাণ্ডটি ছিল প্রক্রিয়াটির একটি চরম পরিণতি।
আমরা যদি খোঁজ নেই তবে জানতে পারব যে রাজধানীতে পিঁপড়ের ঢিবির মত দেখতে ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর ভেতর বাস করতে থাকা পরিবারগুলোর অনেকগুলোতেই, বিশেষ করে মায়েরা নিয়মিত তাদের নেশাগ্রস্ত সন্তানদের দ্বারা মানসিকভাবে, এমনকি শারীরিকভাবেও নির্যাতিত (যারা অর্থ-বিত্ত দ্বারা লালায়িত, সন্তানদের প্রতি উদাসীন তারাও; যারা নন তারাও)। কিন্তু এ ধরণের অবস্থা চরম কোনও পরিণতি লাভ না করলে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানতে পারি। কিংবা জানতে পারলেও তার প্রচার হয় না, স্বাভাবিকভাবেই কারণ, পরিবারের ভেতর স্বামীদের দ্বারা স্ত্রীরা নির্যাতিত হলে তারা আইনের সহায়তা নিতে পারেন, প্রয়োজনে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন; কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক, অপ্রাপ্তবয়স্ক মাদকাসক্ত সন্তানদের দ্বারা নির্যাতিত মা-বাবারা কি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন? বা পারলেও কি সেটা নেন? আইনগত-ভাবে সন্তানের সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে পারেন? ঐশীর ঘটনাটা তাই খুব নিয়মিত কোনও ঘটনা না হওয়া সত্ত্বেও, বেশ আশঙ্কাজনক। কিন্তু মজার বিষয়টি হচ্ছে আমরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিভিন্ন কারণ ও সম্ভাব্য ফলাফল খুঁজে বেরিয়েছি সত্যি (যা প্রশংসনীয়) কিন্তু জানা থাকা সত্বেও, উপরোক্ত প্রক্রিয়াটি যে প্রায় বন্ধ করে দেওয়া যায় সেটা একটি বারের জন্যও কেউ উল্লেখ করিনি।
সত্যি; একটি প্লাগ টেনে খুলে দিতে পারলেই কিন্তু প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সদিচ্ছা থাকা সত্বেও কেন কেউ তা করতে বলছে না? প্রাসঙ্গিক দেখে হয়ত কেউ কেউ নামকোয়াস্তে উল্লেখ করছেন শুধু। কিন্তু স্বতন্ত্র ভাবে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করার সাহস করছেন না কেউ! হ্যাঁ, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধই পারে সেই প্রক্রিয়াতে শক্তি সরবরাহকারী চক্রটির প্রান্তে অবস্থিত প্লাগ খুলে ফেলতে। আমরা সবাই কিন্তু জানি যে শুধু মাদক নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই এধরণের সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক অশান্তি, নির্যাতন, খুনখারাপি অনেকাংশেই লাঘব করা সম্ভব।
মাদক একবার গ্রহণ করলেই কেউ উন্মত্ত, উন্মাদ, অস্বাভাবিক হয়ে যায় না। নেশা-দ্রব্য নিয়মিত গ্রহণের মাধ্যমে অভ্যস্ত হয়েই কেবল ক্রমশ আসক্তির দিকে এগিয়ে যায় একজন মানুষ। সুতরাং যদি মাদক সহজলভ্য না হয়, তবে কিন্তু মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। যদি মাদক সংগ্রহ করা কঠিন করে তোলা যায় তবে হতাশাগ্রস্ত, ব্যর্থ, ক্ষুব্ধ, অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে থাকা তরুণ-তরুণীরা আর যাই হোক, মাদকের সাহায্য নিয়ে অস্বাভাবিক জীবন বেছে নিতে পারবে না; অসুস্থ হয়ে উঠতে পারবে না। একজন ব্যর্থ, হতাশাগ্রস্ত মানুষ সমাজের, নিজের পরিবারের জন্য ক্ষতিকর নাও হতে পারে। এটা মাদক, হতাশা নয়, যেটা কিনা একজন মানুষকে সহিংস করে তোলে। কিন্তু সেটা নিয়ে আমরা কথা বলি না। আমরা কথা বলি অন্যান্য কারণ নিয়ে। যেগুলো শুনতে বেশ জটিল! ধর্ষক, নারী উত্যক্ত-কারিদের রক্ষা করতে রক্ষণশীলেরা যেভাবে নারীদের অযথাযথ পোশাককে দায়ী করে, তাদের স্বাধীনতাকে দায়ী করে, তেমনি মাদক ব্যবসাকে রক্ষা করার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা থেকেই আসলে অনেকে কিশোরকিশোরী, যুবক-যুবতির অবাধ স্বাধীনতা, প্রেমে ব্যর্থতা, বাবামার অবহেলা, অকৃতকার্যতা, হতাশা, ইত্যাদিকে দায়ী করে।
বাবা-মায়েরা হয়ত মাদকাসক্ত ছেলেমেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভুল করেন। কিন্তু তারা তো আর তাদের সন্তানদের মাদক কিনে দেন না! তাছাড়া তারা তো বিশেষজ্ঞও নন! মাদকাসক্ত সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভুল তারা করতেই পারেন! সুতরাং যদি মাদকাসক্ত সন্তান দ্বারা আক্রান্ত হন, এর জন্য তারা দায়ী নন। হয়ত মাদকাসক্ত সন্তানও নয়। দায়ী তারা যারা মাদককে সহজলভ্য করে তুলেছে। একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবির নাম “ট্র্যাফিক” (Click This Link))। ২০০০ সালে হলিউডে মুক্তি পাওয়া ছবিটিতে মাদক ও মাদক ব্যবসাকে ঘিরে থাকা কয়েকটি জীবন ও ঘটনা প্রবাহকে চিত্রায়িত করা হয়। ঘটনা প্রবাহের একটিতে দেখা যায়, ওহিও’র একজন রক্ষণশীল বিচারক, জাতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর পরই শত হুঁশিয়ারি সত্বেও মাদক নিয়ন্ত্রণে বদ্ধপরিকর হয়ে মাঠে নামেন। কিন্তু অচিরেই আবিষ্কার করেন যে এই ব্যবসায়, এই চক্র এতো শক্তিশালী এবং এর পরিধি এত উচ্চপর্যায়ে বিস্তৃত যে একে বন্ধ করাতো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণকারীদের আইনের আওতায় আনা রীতিমত অসম্ভব একটি কাজ। তাদের টাকাতেই বাজেট হয়; তাদের ইশারাতেই দেশ চলে। বরং ছবির এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন যে তার নিজের মেয়েই দীর্ঘকাল ধরে মাদকাসক্ত। ছবির শেষ দিকে ঘরে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে অর্ধ-চেতন অবস্থায় তিনি খুঁজে বের করেন পতিতালয় থেকে, যেখানে সে নিজের দেহ বিক্রি করা শুরু করেছিল শুধুমাত্র মাদক কেনার পয়সা যোগাতে। যদি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের পার্থক্যকে বিবেচনায় এনে তুলনা করা যায়, তবে,আমাদের দেশের, বিশেষ করে রাজধানীর,বর্তমান পরিস্থিতি এবং মা-বাবাদের অসহায়ত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে ছবিটি থেকে।
কিছু নিবেদিতপ্রাণ, নির্ভীক সাংবাদিক তথা ব্লগারদের প্রতি উচ্চাশা ছিল যে এই সুযোগে হয়ত কিছু প্রতিবেদন তারা তুলে আনবেন; কিছু কাজ অন্তত হবে। কিন্তু হায়! তা হয়নি। লেখকদের আমি অভিনন্দিত করি যে তারা একটি চাঞ্চল্যকর বিষয় পেয়ে নিজেদের পাণ্ডিত্যের গভীরতা এবং বিশ্লেষণের দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। তারা করতালির দাবীদার।
http://www.notun-din.com/?p=6675
©somewhere in net ltd.