নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যা কিছু ভালো, সত্য ও সুন্দর; তার সাথে।

বরতমআন

সাগর কবির

বরতমআন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নদী বন্দনা

০৮ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:৫৭

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ‘নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে’ (এই পৃথিবীতে আসি)। নদীর জলের গন্ধে ভরে যায় ভিজে স্নিগ্ধ তীর (অন্ধকারে)। শুধু তাই নয়। নদীর জলের গন্ধ কোন এক নবীনাগতার মুখখানা নিয়ে আসে। কবির মনে হয় কোন দিন পৃথিবীতে প্রেমের আহবান এমন গভীর ক’রে পেয়েছি কি: (হৃদয়ে প্রেমের দিন)।
নদীর সাথে প্রিয়ার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে কবিকে তখন প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বলতে শুনি.. পৃথিবীতে ম্রিয়মান গোধূলি নামিলে / নদীর নরম মুখ দেখা যাবে-মুখে তার দেহে তার কতো মৃদু রেখা তোমারি মুখের মতো (ঘাসের ভিতরে যেই) জীবনানন্দ দাশের কাব্যে নদী নারী আর নক্ষত্র এমনভাবে সম্পৃক্ত যে এদের ছাড়া পৃথিবীর রূপ বর্ণনা করাই যেন সম্ভব নয়, রূপসী বাংলার তো নয়ই।
কবি দেখেছিলেন...‘পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ, কান্তারের একপাশে সে নদীর জল / বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে শুয়ে দেখেছে কেবল বিকেলের লাল মেঘ (শব)। কবির ভাবনায়- ‘মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে; / বড়ো বড়ো নগরীর বুক ভরা ব্যথা; / ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প স্বপ্নের / উদ্যমের অমূল্য স্পষ্ট তা / তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল; / সূর্য মানে আলো, এখানেও প্রিয়ার উদ্দেশ্যে কবির উক্তি...এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো (মিতভাষণ) ‘পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর তীরের দেশ বলে মনে হয়’ কবির যখন-‘দুপুর বেলার জনবিরল গভীর বাতাস / দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর / অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়, / জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার; / জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে, (আমাকে তুমি) জীবনানন্দ দাশ দেখেছেন- ‘বিকেলের নরম মুহুর্ত; / নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, / হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া, / একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া / আতার ধূসর ক্ষীড়ে গড়া মূর্তির মতো / নদীর জলে / সমস্ত বিকেল বেলা স্থরে / স্থির।’ নদীর আয়নায়ই পৃথিবীর প্রকৃত রূপ দরশন করেছেন জীবনানন্দ দাশ এবং তা বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখেছেন- ‘নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতো কল রবে / ভেসে নারকোল বনে কেড়ে নেয় / কোরালীর ভ্রুুণ; বিকেল বলেছে এই নদীটিকে, ‘শান্ত হতে হবে-’ / অকূলে সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে / এক মাইল শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে।’ (শিরীষের ডালপালা) কবির সুন্দর দৃষ্টি নদী খুঁজে পেয়েছে, ‘রাইসর্ষের খেত সকালে উজ্জ্বল হলো / দুপুরে বিবর্ণ হয়ে গেল / তারি পাশে নদী।’ / তখন তাঁর সরল জিজ্ঞাসা- ‘নদী, তুমি কোন কথা কও? / অশ্বত্থের ডালপালা তোমার বুকের পরে পড়েছে যে, / জামের ছায়ায় তুমি নীল হলে, / আরো দূরে চলে যাই / এক পাল মাছ রাঙা নদীর বুকের রামধনু / বকের ডানার সারি শাদা পদ্ম-নিস্তব্ধ / পদ্মের দ্বীপ নদীর ভিতরে / মানুষেরা সেই সব দেখে নাই/ (নদী)।
মানুষেরা না দেখলেও জীবনানন্দ দাশ দেখেছিলেন। নদীর একেবারে নিভৃতে বিচরণ করেছেন কবি। শুনেছেন নদীর নিজের সুর, কবির মনে হয়েছে.... নদী। ‘কার যেন ভালোবাসা পুষে রাখে বুকে / সোনালি প্রেমের গল্প সারাদিন পাড়ে / সারাদিন পাখি তাহা শোনে / পাখিরা তাদের গানে এই শব্দ তবু / পৃথিবীর খেতে মাঠে ছড়াতে পারে না, / নদীর নিজের সুর এ যে?। নদীর এই সুর শুনে মুগ্ধ কবি। নদী নিয়ে হৃদয়ে তাঁর কতকথা। সৌন্দর্য সম্ভার বুকে নিয়ে ঐশ্বর্যময়ী নদী।
বাধাহীন তার চলা অনন্তকাল ধরে, নদীর স্বপ্ন নক্ষত্রের তলে। এমন কত কথাই আছে জীবনানন্দ দাশের কাব্যে আছে ধলেশ্বরী, চিলাই, কালিদহ এমন কত নদীর কথা। তিনি লিখেছেন- ‘কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস / নতুন ডাঙ্গার দিকে একদিন, / চাঁদ সদাগরের মধুকর ডিঙা কবে / পড়েছিল কালিদহে ঝড়ের আকাশে, / বাদলের জলে ধলেশ্বরী চড়ায় / গাঙশালিকের ঝাঁক।’ (মনে হয় এক দিন)। নষ্টালজিক কবি আরো লিখেছেন- ‘মধুকুপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির, / কালীদহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়।’ কিংবা বারনী থেকে গঙ্গা সাগরের বুকে-যেখানে বরুণ কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল’ (এই পৃথিবীতে একদিন) নীলনদের গাঢ় রৌদ্রে গোরোচনা রূপ নিয়ে রাইকে স্থান করে নেয়ার কথাও উঠে এসেছে জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টিতে। নষ্টালজি আর নান্দনিকতা এই দুটির সংমিশ্রণে তার কবিতায় নদীর বহুমাত্রিক রূপ। বিচিত্র কাহিনীর চিত্র যা হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়- ‘রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা / পদ্মার রূপ একুশ রত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ় / আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার / আরো ঢের জল, জল আরো, / নদীর ধারে বাসমতী ধানগুলো / ঝরিছে আবারো’ / (তবু তাহা ভুল জানি) এসব কবিতা হৃদয়ে দাগ টেনে দেয়।
নদী প্রেমিক কবি একদিন লিখেছিলেন ‘যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে র’ বো ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে (যখন মৃত্যুর ঘুমে) কিন্তু রূপসী বাংলার কবি আবারও লিখলেন- ‘পৃথিবীর পথ ঘুরে বহু দিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে / ধান সিঁড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাবে বয়ে, / যেইখানে এলোচুলে রাম প্রসাদের সেই শ্যামা / আজো আসে / যেইখানে কল্কা পেড়ে শাড়ি পরে কোন এক / সুন্দরীর শব / চন্দন চিতায় চড়ে-আমের মাথায় শুক ভুলে যায় কথা / যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ সবচেয়ে গাঢ় বিষন্নতা যেখানে শুকায় পদ্ম-বহুদিন বিশালাক্ষী যেখানে নীরব (যতদিন বেঁচে আছি) আর জলসিঁড়ি। জীবনানন্দ দাশের স্বপ্নের নদী ধানসিঁড়ি জলসিঁড়ি। জলসিড়ি নদীর পারে শুয়ে পড়তে চেয়েছেন কবি বাংলার পরিপূর্ণ রূপ দরশনে- ‘একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে / বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে র’ব; / পশমের মতো লাল ফল / ঝরিবে বিজন ঘাসে বাঁকা চাঁদ জেগে রবে / নদীটির জল / বাঙালি মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে / আঘাত করিয়া যাবে-ভয়ে ভয়ে’ (একদিন জলসিঁড়ি) জীবনানন্দ দাশ বনহংস হতে চেয়েছেন আর বনহংসীকে নিয়ে নিরালা নীড় রচনা করতে চেয়েছেন জলসিঁড়ি নদীর ধারে। ‘আমি যদি বনহংস হতাম / বনহংসী হতে যদি তুমি / কোন এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে / ধান খেতের কাছে / ছিপ ছিপে শরের ভিতর / এক নিরালা নীড়ে।’ (আমি যদি হতাম) কবি পাড়াগাঁকে ভালোবেসেছেন। দু পহরের রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে স্বপনের। এই পড়াগাঁর দু’পহরেই কবি আবিষ্কার করেছেন-‘জলসিঁড়িটির পাশে ঘাসে শাখাগুলো নুয়ে আছে বহুদিন ছন্দহীন বুনো চালতার।’
(পাড়াগাঁর দুপহর) কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ধানসিড়িই জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিশেষ ভূমিকা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। অভিমানী কবিকে অবশেষে ধানসিঁড়ি নদীর তীরে শুয়ে পড়তে দেখি- ‘ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম পউষের রাতে-কোনোদিন আর জাগবো না জেনে কোনদিন জাগবো না আমি- কোনদিন জাগবো না আর-’ (অন্ধকার) কিন্তু এখানেই শেষ হয় না। কবি আবারও ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন ধানসিড়িরই তীরে- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই / বাংলায় হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল / শালিকের বেশে। (আবার আসিব ফিরে) ধানসিঁড়ি নানাভাবে কবিতা রচনার উৎস হয়ে উঠেছে তার কাছে। যেমন দেখি- ‘এসব কবিতা আমি যখন লিখেছি / বসে নিজ মনে একা, / চালতার পাতা থেকে টুপ টুপ জ্যোৎস্নায় / ঝরেছে শিশির / কুয়াশায় স্থির হয়েছিল ম্লান ধান সিঁড়িটির / তীর (এ-সব কবিতা আমি) ধানসিঁড়ির প্রতি কবির গভীর দুর্বলতা ব্যক্ত হয়েছে যে কবিতায়- ‘আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে ;/ বলেছিলো, এ নদীর জল / তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল : / স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি। / এই নদী তুমি।’ কবির মন বলল এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি? প্রণয়িনীকে শুধালেন তিনি। ধানসিঁড়ির আরো উপস্থিতি পাওয়া যায়- ‘মেঘের দুপুরে ভাসে-/ সোনালী চিলের বুক হয়ে উন্মন / মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিঁড়ি নদীটির / পাশে, /সেখানে আকাশে কেউ নেই আর / নেই আর পৃথিবীর ঘাম’ (সিন্ধু সারস) স্বপ্নের নদী ধানসিড়ির পাশেই সোনালি চিলের কান্না শুনে কবি লিখলেন- ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল / এই ভিজে মেঘের দুপুরে / তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে / ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে / তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো / তার ম্লান চোখ মনে আসে / পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো / সে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; / (হায় চিল) কবি অন্যত্র লিখেছেন- ‘যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন / পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হলে, / তবুও একটি নদী রেখা যেত শুধু তারপর; / কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে / নদীর রেখার পার লক্ষ্য করে চলে’ (স্বভাব) সেই একটি নারী যে-ই হোক না কেন, একটি নদী ধানসিড়িই বুঝি।
আর ‘শঙ্কমালা কবিতায় কবিকে যে খুঁজে ছিল তাঁর ও স্বীকাররোক্তি- ‘বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি-কুয়াশার পাখনার- ‘সন্ধ্যায় নদীর জলে নামে যে আলোক / জোনাকির দেহ হতে খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে / ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের / অন্ধকারে / ধানসিঁড়ি বেয়ে বেয়ে।’ ধানসিঁড়ি জলসিঁড়ি, শিপ্রা, ধলেশ্বরী যে নদী-ই হোক না কেন জীবনানন্দ দাশের হৃদয়ের নদী, একথা সত্য যে নদী কবির কাব্যে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কবিতাকে প্রাণ দিতে, নান্দনিকতার ছোঁয়া দিতে কবির নদী বন্দনার তুলনা নেই। প্রিয়ার উপমায় নদীই কথা বলে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.